জুবায়ের ভাই প্রজন্মের কাছে প্রত্যুত্তরে

সবজান্তা এর ছবি
লিখেছেন সবজান্তা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৩/২০০৮ - ১১:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই লেখাটা লেখছি এক ধরণের দায়িত্ববোধ থেকে। তরুণ প্রজন্মের হতাশা বিষয়ক পোস্টের সূত্রপাত আমার লেখা থেকেই। এরপর রাবাবের আরো একটি হতাশামন্ডিত পোস্টের পর শ্রদ্ধেয় সচল জুবায়ের ভাই, লিখেছেন রাবাব-প্রজন্মের কাছে।জানি না, রাবাব কিভাবে উত্তর দিবে, কিন্তু রাবাবেরই সমবয়েসী হয়ে আমি আমার উত্তরটা দিতে পারি। উত্তরটা মন্ত্যবের ঘরেই দিতাম, কিন্তু বিশালাকৃতির কারণে নতুন লেখার ঘরেই সরে আসা।
রাবাব কিংবা আমার জন্ম আশির দশকের মাঝের দিকে। আমার স্মৃতিশক্তি তত প্রখর নয়, তবু ছোটবেলার একটা স্মৃতি খুব স্পষ্ট মনে আছে, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা।পার্শ্ববর্তী দেশের একদল উন্মত্ত জঙ্গীবাদী হিন্দুর কার্যকলাপের খেসারত দিল বহু মাইল দূরে থাকা একদল মানুষ। হয়ত দুর্ভাগ্যই যে, জন্মসূত্রে আমি দেশের সংখ্যালঘু ধর্মালম্বীদের একজন। খুব ছোটবেলাতেই বুঝতে পারতাম বাবা, কাকা এদের মুখগুলিতে কত চিন্তার ছাপ। কত আত্মীয় স্বজন তাদের বাড়িঘর খালি ফেলে শুধু মাত্র প্রাণের মায়ায়, তাদের স্ত্রী, কন্যার সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে, আমাদের বাসায় এসে উঠেছিলেন। কতই বা বয়েস আমার ? কিন্তু সে বয়েসেও বুঝেছিলাম, সংখ্যালঘু হওয়া এ দেশে শুধু মাত্র বিব্রতকরই না, বিপদজ্জনকও বটে। দুঃখের কথা, সেই বয়েসেও নিচে যেসব বন্ধুদের সাথে খেলতাম, তাদের মুখেই শুনেছিলাম মালাউন গালিটা। ওরাও তো আমার বয়েসীই, ওরা নিশ্চয়ই এমন শব্দ ওদের বাসা থেকেই শিখেছে। হ্যা, এর দায় দায়িত্ব আমাদের পূর্বসুরি তথা আপনাদেরই নিতে হবে জুবায়ের ভাই। আপনারা ধরে রাখতে পারেননি ৭২ এর সেই সংবিধানকে। যে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসকে ধরে রেখে, একদল মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে, মাত্র ২ দশকের ব্যবধানেই, তারা দু ভাগ হয়ে গিয়েছে।

আমার মনে আছে ক্লাস সিক্সে এক সরকারী স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার ঘটণা। প্রশ্ন বেশ সহজ ছিলো, আমি মোটামুটি আগেই সব উত্তর দেওয়া শেষ করে, রিভিশন দিচ্ছি। হঠাৎ করেই সে স্কুলের এক শিক্ষক এসে, আমার সামনের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার রোলই কি এত ? তুমি অমুক সাহেবের ছেলে ? তারপরই সেই শিক্ষক যখন দেখলেন ছাত্রের অবস্থা গুরুচরণ, আর হাতে সময়ও বেশি নেই, উনি চট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার পরীক্ষা কি শেষ ?” আমার হ্যা সূচক উত্তর পেয়ে শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস না করেই, আমার খাতা সামনের সীটে চালান করে দিলেন এবং টানা ৫-৭ মিনিট আমি খাতা ছাড়া বসেছিলাম।
হ্যা, সেই শিক্ষকও আপনাদের প্রজন্মকেই প্রতিনিধিত্ব করেন। চিন্তা করুন , একটা ক্লাস ফাইভ বাচ্চার মনে কি অদ্ভুত প্রভাব পড়েছিল সে ঘটণার ! মনের উপর অমোচনীয় কালির দাগের দায়ও কিন্তু আমাদের পূর্বসুরিরাই পায়। এর পর সময় গিয়েছে, নানা রঙ এর দুর্নীতি, শঠতা আর ক্লেদাক্ত চেহারা দেখেছি, আর ক্রমাগত বয়েসের চেয়েও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।আজ যেই ক্লান্তি রাবাব কিংবা আমি কিংবা আমার প্রজন্মের অনেকের উপরই ভর করেছে, তা আমাদের পূর্বসুরিদেরই অবদান। আর সে সবই আপনি আপনার লেখাতে স্বীকার করেছেন।
আপনাদেরই নীরবতা আর অন্তর্কলহে উর্দিধারীরা বারবার ক্ষমতার চারপাশে ঘুরঘুর করেছে, তাদের বিষাক্ত, লালাঝরা, লকলকে জিহবা নিয়ে। আপনাদের উদাসীনতা আর আত্মবিস্মৃতি সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববেহায়াকে ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলার, একদল রাজাকার জারজ শুয়োরের বাচ্চাকে পতাকাবাহী গাড়িতে চড়বার।এ সবই আপনাদের দায়।

কিন্তু জুবায়ের ভাই, এর বাইরেও তো হিসাব আছে, তাই না ?

আপনি জানেন, খুব ছোটবেলা থেকেই বছরের কোনদিনটা আমার সবচেয়ে প্রিয় ?
২১শে ফেব্রুয়ারি। খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে আমি আর আমার বোন গুটি গুটি পায়ে যেতাম শহীদ মিনার, সেখান থেকে বইমেলা আর ফেরার পথে চারুকলা। এটা এমন একটা দিন, যেদিন সত্যিকার অর্থেই আমি গর্ববোধ করি একজন বাঙ্গালি হিসেবে। এখনো আমার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে, যখন প্রভাতফেরিতে সবাই নগ্নপদে হেটে যায়, আর ভেসে আসে, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো... ... ” ।এটা কিন্তু আমাদেরকে আমাদের পূর্বপুরুষরাই দিয়েছেন।
আর সবচেয়ে বড় আপনাদের যে অবদান, আপনারা আমাদেরকে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছেন। সেদিন আপনারা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ না করলে আজ হয় সচলায়তনের বদলে কোন বাতচিৎ ডট কমে লেখতে হত আমাকে, উর্দু হরফে। প্রতিটা বাঙ্গালীর এই যে গর্বের জায়গা তা কিন্তু আপনাদেরই দেওয়া জুবায়ের ভাই। এই ভূখন্ডের প্রতিটা ধুলিকণা, আর আমাদের মনের প্রতিটা অক্ষরের পেছনে আপনাদের অবদান। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটা আপনাদেরই দেওয়া।
এই অসাধারণ ইতিহাস আমাদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য, নির্দ্বিধায় আমাদের পূর্ব প্রজন্মের সব দোষকে আমরা ভুলে যেতে পারি।
আর এই বেলা জানিয়ে রাখি, আপনাদের এই প্রজন্মকে আমার ঈর্ষা হয়। আপনার অন্তত একজন নেতাকে পেয়েছিলেন, যার ডাকে সবাই জীবন দিয়ে হলেও দেশকে বাঁচিয়েছেন। আফসোস, একসারি হংসের মধ্যে তেমন বক যথা আমরা একটিও পেলাম না। এ দুঃখ হয়ত স্ব্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের সবারই কিছুটা আছে।

জুবায়ের ভাই, তাই ক্ষমা চেয়ে আমাদেরকে ছোট করবেন না। আপনারা আপনাদের কাজ করে দিয়েছেন। প্রতিটা প্রজন্মেরই ভুল ত্রুটি থাকে, সে সব নিয়েই ইতিহাস এগিয়ে চলে। আপনারা আপনাদের কাজ করে দিয়েছেন। এরপর সামনের যেটুকু পথ সেটা আমাদেরকেই চলতে হবে, নিজেদের দায়িত্বে, সব অভিমানকে ভুলে যেয়ে, সব কষ্টকে মেনে নিয়ে। চাওয়া শুধু একটাই, এই দীর্ঘ রাস্তায় আপনারা আমাদের আলো হাতে পথ দেখাবেন, যাতে আমরা হারিয়ে না যাই।


মন্তব্য

নন্দিনী এর ছবি

স্বাধীনতাউত্তর সংবিধান এ ফিরে যেতে আমাদের নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে হবে- তবেই আমাদের কিছটা পাপ ক্ষয় হলেও হতে পারে!

নন্দিনী

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অনেকগুলি জরুরি প্রসঙ্গ তুলেছেন। সবগুলি নিয়েই একেকটা আলাদা পোস্ট দেওয়া যায়। মাথায় রাখছি। সময় সুযোগ ঘটলে লিখবো। কিছু কিছু অবশ্য আমার "আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন" সিরিজে এসেছে এবং আসবে।

আমার সামান্য লেখার প্রতিক্রিয়ায় আপনার চমৎকার লেখাটি পাওয়া গেলো। অরূপের মতো বলতে ইচ্ছে করে, এতো কম লেখেন কেন?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।