মুক্তিযুদ্ধ প্রসংগে এক ভিনদেশীর সাথে কথোপকথন

এস্কিমো এর ছবি
লিখেছেন এস্কিমো (তারিখ: রবি, ১৫/০৭/২০০৭ - ৯:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুক্তিযুদ্ধদেশ ত্যাগ করার পর প্রথম দিকে দেশের জন্যে মনের গভীরে কত কষ্ট জমে তার সম্পর্কে ভুক্তভোগীরাই ভাল জানেন। আমরা ১০জন বংগসন্তান যখন নেদারল্যান্ডে এসে পৌছি -তখন টের পেলাম পূর্বপরিচয় ছাড়াই আমরা একে অপরের গত কাছের মানুষ। যোগসূত্রটা শুধু আমরা বাংলাদেশী - একই ভাষায় কথা বলি আর একই সংম্কৃতি ধারন করি - লালন করি।

তখন ক্লাসের বা ল্যাবের অবসরে আমাদের একমাত্র কাজই ছিল দেশের সর্বশেষ খবর ভাগাভাগি করা। খবরের একমাত্র সূত্র ছিল ইন্টারনেটে নিউজ ফ্রম বাংলাদেশ। সেখান থেকে খবর প্রিন্ট করে একত্রে বসে পড়া আর পর্যালোচনাই ছিল মূল বিনোদন।

কয়েকজন মেয়ে ছিল আমাদের সাথে যারা ছিল স্বভাবতই দেশের বিষয়ে অনেক বেশী আবেগপ্রবন - তবে দলীয় রাজনীতির বিষয়ে ওদের ছিল সীমাহীন অনীহা। পাকিস্থানী ছাত্রদের সাথে যদি কেহ গল্প করতো বা একটা বেশী মাখামাখি দেখলে ওদের রাগ দেখারমতো পর্যায়ে চলে যেত। এটা নিয়ে মোটামুটি সালিশ করে অবশেসে একটেবিরে বসার ব্যবস্থা করতে হতো।

একদিনে ঘটনা বলি। ঠিক মনে নেই কোন মাস। বাইরে হালকা তুষারপাত হচ্ছে। তুষারপাত দেখলেও কেমন যেন মনটা উতলা হয়ে যেত। একটু আনমনে গ্লাসের বাইরে তুষারপাতের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে কাফেটেরিয়ার দিকে যাচ্ছে। কারন একজন না একজন বাঙালী সেখানে পাবোই। একটি গল্প করে আবার ল্যাবে যাবো।

ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে দেখি এককোনার টেবিলে বসে আছে আমাদের সিনিয়র শম্ভুদা, লাইলী আর রুমি। সাথে আছে দুই সিরিয়ান ছাত্র - যারা শম্ভুদার সাথে একই কোর্সের বরে জানতাম। সেখানে শম্ভুদা হাতপা নেড়ে কি যেন একটা বুঝাচ্ছে - আর একটা সিরিয়ান মাথা নেড়ে অস্বীকার করছে। কাছে গিয়ে দেখি লাইলী আর রুমির মুখ লাল হয়ে আছে।

"বিষয়টা কি?" - জিজ্ঞাসা করতেই লাইলী প্রায় কেঁদে ফেলার মতো করে বাংলায় বললো - “হারামজাদারা কি কয় দেখেন। আমরা নাকি পাকিস্থান ভেঙে মুসলিম উম্মাকে দূর্বল করেছি। মুক্তিযুদ্ধ নাকি ভারতের কাছে মুসলমানদের পরাজয়....”।"

এই কথা শুনে মনোযোগ দিলাম শম্ভুদার কথার দিকে। বেচারা চেষ্টা করেই যাচ্ছে এটা বুঝাতে যে বাঙালী জাতি একটা সেকুলার জাতি - আমরা আদিকাল থেকে একটা আলাদা সংস্কৃতির ধারক যা পাকিস্থানের সাথে মিলেনি - এ ছাড়াও অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো বুঝানো চেষ্টা করছিলেন উনি। কিন্তু সিরিয়ান ব্রাদাররা সেটার দিকে না গিয়ে মুসলিম উম্মা এবং ইসলামিক দেশ বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক করছিলো। তাদের কথা হলো মুসলমানরা এক থাকলে পৃথিবীতে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

অবশেষে শম্ভুদাকে থামিয়ে বললাম - "দাদা, কফি খান, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।"

উনি দীর্ঘক্ষন কথা বলছিলেন এবং উত্তেজনায় কফিতে চুমুক দিতে ভুলে গেছেন।

শম্ভুদা কফিতে চুমুক দেবার সুযোগে আমি সিরিয়ান ভাইদের জিজ্ঞাসা করলাম - “ তোমরা কোথাকার?”

প্রশ্নটা করলাম এভাবে যেন আমি ওদের সম্পর্কে জানতে চাইছি।

উত্তর - “সিরিয়া”।

আমি বললাম - “দেখ, ভুগোল আমার সাবজেক্ট না - তাই ভুগোল তেমন ভাল জানি না। জানার জন্যে কি তোমাদের কিছু প্রশ্ন করবো”।"

আমার কথা শুনে রুমি আস্তে আস্তে বললো - “আপনি কি ওদের সাথে খাতিরের আলাপ করতে শুরু করবেন নাকি, ওদের ধরেন”।"

আমি রুমীকে একটু উপেক্ষা করে আবার ওদের কাছে প্রশ্ন করলাম -“ সিরিয়া কি সৌদি আরবের কাছে না?”

ওরা মোটামুটি জর্ডান, ইরাক, সৌদিআরবের ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ বত্তৃতা শেষ করলে আবার প্রশ্ন করলাম -“ মনে হয় তোমাদের ভাষাও এক এবং সংস্কৃতিও প্রায় একই রকমের, ঠিক না?”

ওরা বেশ অহংকারের সাথে আরবী ভাষা এবং সংস্কৃতির উপর নাতিনীর্ঘ বত্তৃতা শেষ করার পর আমার প্রশ্ন - “তাহলে একই ভাষা, সংস্তৃতি এবং একই ধর্মের মানুষ হয়ে তোমরা আলাদা দেশ করে থাকছো কেন? মুসলিম উম্মাকে শক্তিশালী করার জন্যে সমগ্র আরবে একটা দেশ বানিয়ে ফেলা দরকার, কি বলো?”

এবার ব্রাদাররা ধরতে পেরেছে আমার খেঁজুরে আলাপ আর ভুগোল জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য কি। আমি বললাম - “দেখ বাংলাদেশ সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান এতো কম যে তোমারদের কথা শুনে খুবই কষ্ট লাগলো। তোমরা একই ভাষা, ধর্ম আর সংস্কৃতির মানুষ হয়েও এক থাকতে পারছো না - আর শুধু মাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে হালকা করে দেখার মানসিকতা কিন্তু সিরিয়ান জাতির সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবাবে”।"

আমার কথা শেষ হতেই দু'জন উঠে গেল - বললো পরে কথা হবে এখন ক্লাশ আছে। পরে দীর্ঘদিন এদের আমাদের টেবিলের কাছে আসতে দেখিনি। একদিন তাদের একজন লাঞ্চের সময় আমাদের টেবিলে এসে সেই দিনের ঘটনার জন্যে দু:খ প্রকাশ করে গেল। ও বললো - ইন্টারনেটে বাংলাদেশ এবং ৭১ সম্পর্কে কিছু জানার পর ওর মনে হয়েছে সেদিনে তর্ক করাটা জানা ভুল ছিল।


মন্তব্য

শামীম এর ছবি

জায়গামত ঔষধ পড়েছিলো দেঁতো হাসি

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বেচারি সিরিয়ানের দোষ দিয়ে কী লাভ? অনেক বঙ্গসন্তানকেও এই কথা বলে বলে বোঝানো যাচ্ছে না। কারণ তারা বুঝবে না বলে ঠিক করে বসে আছে। সিরিয়ানটির মতো দুঃখপ্রকাশ তারা কোনোকালে করবে বলে মনে হয় না।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুমন চৌধুরী এর ছবি

সহমত
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ঝরাপাতা এর ছবি

আমার কিছু পাকিস্তানী সহপাঠী আছে। অনেকেই বলে, তোমরা তো আমাদের ভাই, তাই না। আমি বলেছিলাম, তোমাদের ভাই হওয়ার আগে কিছু শর্ত আছে। এই লিংকগুলো (মুক্তিযুদ্ধের উপর) ভালো করে দেখো, তারপর জানতে চেষ্টা করো একাত্তরে প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিলো, প্রকৃত ঘটনা জানার পর যদি অনুতপ্ত হও, তবে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, তখন তোমাকে ভাই বলতে আমি দ্বিধা করবো না। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তোমরা আমার চোখে আমার পূর্বপুরুষের খুনীদের উত্তরসূরী বই কিছু নও।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

এস্কিমো এর ছবি

ঝরা পাতা --

কাজের যায়গার পিসিতে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটা সাইট ফেবারেট করে রেখেছি। যখন কথা শুরু হয় - ভাই ভাই তত্ত্ব বর্ননা শুরু করে তখন একটা খুলে বলি - আগে দেখ পরে কথা হবে।
বিশেষ করে Drik এর ফটোগ্যালারী যথেষ্ঠ ভাল কাজ করে।

লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অপিরিচিত কোনো পাকিস্তানী এসে উর্দূতে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে, এরকম অভিজ্ঞতা দেশের বাইরে যাঁরা থাকেন তাঁদের অবশ্যই হয়েছে। আমি উত্তরে পরিষ্কার বাংলায় কথা বললে তারা প্রথমে থতমত খায়। উর্দূ আমি খুব সামান্য বুঝলেও তা অস্বীকার করে বলি, ওই ভাষা আমি জানি না। তারা তখন প্রাক্তন ভ্রাতৃত্বের দোহাই পেড়ে বিস্মিত হয়ে বলে, উর্দূ জানো না? আমার উত্তর, তুমি বাংলা জানো?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অমি রহমান পিয়াল এর ছবি

জটিল জবাব। এইভাবে হয়
..................................

তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই

এস্কিমো এর ছবি

জুবায়ের ভাই -

এটা একটা মজার বিষয়। অনেকে আছেন স্বাভাবিক ভংগীতেই উর্দুতে কথা বলেন। ফলে সব পাকিরাই মনে করে বাংলাদেশের সবাই উর্দু জানে।

কোন কথা নেই - এসে শুরু করে - "হাল ক্যায়া হ্যা?।

উত্তর দেই ইংরেজীতে - হোয়াট?

পরে বলে - How come you don't know urdu?

উত্তর হলো - Same way, you don't know Bangla"।

অধিকাংশ চুপ মেরে যায় - তবে অনেকে তর্ক শুরু করে। ওদের জন্যে ভিন্ন তরিকা।

লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।