গল্প : পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য

ফকির ইলিয়াস এর ছবি
লিখেছেন ফকির ইলিয়াস (তারিখ: শনি, ০৬/০২/২০১০ - ৯:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য
ফকির ইলিয়াস
-----------------------------------------------------
দু'টো ট্রেন এসে পাশাপাশি দাঁড়ায়। যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করে ট্রেন বদল করে। যে যার গন্তব্য বেছে নেয়। আমি অপলক তাকিয়ে বসে থাকি। বাইরের দৃশ্যগুলো আমাকে এখন খুব একটা টানে না। কখনো মনে হয় মুখ গুঁজে থাকি। আমার সামনের সিটে এসে যে লোকটি বসেছেন, তাকে আমি চিনি। আবার তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে যাই। হ্যাঁ, তিনি এই নগরে একটি টিভি চ্যানেল চালান। একটি বিশাল মুদি দোকানের মালিকও তিনি। এখানে এগুলোকে বলে ‘ক্যাশ এণ্ড ক্যারী’ কিংবা ‘সুপার মার্কেট’। এর সাথে কখনো কখনো ‘হালাল’ শব্দটিও যুক্ত হয়। সবই বিপণনের ধান্দা। মুনাফা অর্জনের নীতিমালা !
লোকটি আমাকে চিনতে পারেনি। এই ভেবে স্বস্থি লাভ করি কর্ণারের ফুড ভেন্ডরের কাছ থেকে কিনে নেয়া কফিটিতে চুমুক দিতে দিতে দৈনিক কাগজে চোখ রাখি। আমি এই লোকটি পরিচালিত টিভি চ্যানেলে একটি নাতীদীর্ঘ সাক্ষাৎকার বেশ আগেই দিয়েছি। এবং সেটি নাকি কয়েক বারই অন দ্য এয়ার-এ গেছে। তারপরও লোকটি কেনো আমাকে চিনতে পারলো না- ভেবে কিছুটা দ্বিধা বেড়ে যায় আমার। তবে কী সে তার নিজের টিভি চ্যানেলটি নিজেই দেখে না! এমনও তো হতে পারে, চ্যানেলটাকে বাণিজ্য ভেবে সবটাই লোকটি ছেড়ে দিয়েছে এর কর্মকর্তাদের উপর।

লোকটি আমাকে না চিনে ভালোই করেছে। না হয় হয়তো আমার দেয়া সাক্ষাৎকারটি বিষয়েই আরো অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হতো আমাকে। আত্মগোপন করে থাকার প্রবণতা আমার মাঝে খুবই প্রবল। এই বিদ্যাটি রপ্ত করতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে প্রায়ই ধন্য মনে করি। সে আনন্দে আমি মাঝে মাঝে হাসি, মাঝে মাঝে কাঁদিও।
একবারের একটি ঘটনা আপনাদেরকে বলি। বিমানে চড়ে দীর্ঘ বারোঘণ্টার ফ্লাইট পাড়ি দিচ্ছি। একটা কোম্পানীর স্পনসরে আমিও ছিলাম সেবার প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। বিমানে বোর্ডিং পর্ব শেষ হবার পর দেখলাম প্রথম শ্রেণীর প্রায় সবকটি আসনই জুড়ে বসেছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় সাংসদরা। তারা একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিয়ে দেশে ফিরছেন। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদেরকে বিশেষ সম্মান দেয়া হয়- সেটা আমার জানা ছিল যদিও, এই সম্মানকে যে কেউ হীনমতলবে কাজে লাগাতে পারে, তা আমার ভাবনায় ছিল না।
আমার ডানপাশের আসনগুলোতেই আয়েশ করে বসেছিলেন দু’জন সাংসদ। বিমানটি যখন মধ্যরাতের পরশ পেলো তখনই শুরু হয়ে গেল মাননীয় সাংসদদের পানপর্ব। পান আমিও করি। ‘জ্যাক ডানিয়েল’ ব্র্যান্ডের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা থাকে সব সময়ই। আমার ঠিক ডানপাশেই বসেছিলেন সাংসদ শাহ বাকীউজজামান। তিনি পীর বংশের সন্তান। এলাকায় তার পরিবারের বেশ খান্দানী নামডাক আছে। সেটা কাজে লাগিয়েই তিনি বার কয়েকের এম.পি।
বিমানে বসে পান তিনি করেই চলেছেন।
একসময় দেখলাম বেশ খেই হারিয়ে ফেলছেন সাংসদরা। একজন সুন্দরী বিমানবালাকে যাত্রার শুরু থেকেই আমার বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছিল। অবশ্য ভালো লাগার একটা কারণও ছিল সংগোপনে। আমার প্রথম প্রেমিকা সুনেত্রা’র চেহারার সাথে বেশ মিল খুঁজে পেয়েছিলাম সেই তন্বী বিমানবালার। আমি স্মৃতি তপস্যায় বেশ পারদর্শী। তাই সে তপস্যা চালাতে চালাতে যখন তুরস্কের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি তখনই দেখলাম সাংসদ শাহ বাকীউজজামান আমার সেই ‘সুনেত্রা’কে ঝাপটে ধরতে চাইছেন!
মুহূর্তে আমার চেহারাও পাল্টে গিয়েছিল সে সময়। আমি যে নগরে থাকি, সে নগরেরই একজন কৃতি সাংবাদিক বন্ধু এই সাংসদ শাহ বাকীউজজামানের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তার কাগজের জন্য। সে আড্ডায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু এক সাথে বিমানে চড়ে দেখলাম, সাংসদদের কেউই আমাকে চিনতে পারলেন না!
সে দিন ও বেশ স্বস্থি এসেছিল আামর মনে। যেচে পরিয়ে দেবার লোক কোনোকালেই আমি ছিলাম না। এখনো নই। কেউ আমাকে না জানতে, না চিনতে চাইলে আমি পরিচিত হতে যাবো কেন?
সাংসদ শাহ বাকীউজ্জামান যখন অশোভন ভঙ্গিতে সেই বিমানবালার উপর চড়াও হতে চাইছেন, তখনই আমি বাঁধা দিলাম। তিনি ভারী রাগ করলেন আমার প্রতিও।
- চেনেন না আমি কে?
- হ্যাঁ, চিনি। আপনি আমার মতো একজন যাত্রী। আমি জবাব দিই। মদ্যপ সাংসদ আমাকে তার সর্বশক্তি দিয়ে গালিগালাজ শুরু করেন। আমি কোনো জবাব না দিয়ে বসে পড়ি। কোনো হিংস্র বন্যতাকে আমি কখনোই প্রশ্রয় দিই না। সেবারও প্রয়োজন মনে করিনি।
বিমানের ক্রুদের মধ্যস্থায় সেবার রক্ষা পান বিমানবালা। তারপরও সাংসদ আমাকে গালিগালাজ থামাননি। শেষ পর্যন্ত বলেন, বিমান মাটি ছুঁলে সে মাটিতেই তিনি আমাকে পুতে ফেলবেন।
মাটিতে কেউ পুঁতে ফেললে আমার জীবনটা আসলে রক্ষাই পেতো। কারণ মৃত্যু সবসময়ই আমার কাছে একটি অনাবিল অবসরের নাম। সে অবসরতো সকল জীবনই চায়।
মৃত্যুর কথাই যখন এলো তখন আপনাদেরকে আরেকটি ঘটনার চিত্রপট একটু ব্যাখ্যা করি।
আমি একবার বেশ কিছু দিনের জন্য বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলাম। সবাই খোঁজাখোঁজি শুরু করলো। পত্রপত্রিকায় কয়েকটা বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়ে গেল ইতোমধ্যে। ‘সন্ধান চাই’। বিজ্ঞাপনটি দেখার পর ময়মনসিংহগামী এক ট্রেনের কামরায় এক ভদ্রবেশী যাত্রী আমার দিকে বেশ ক’বার তাকালেন। তখন ছিল শীতকাল। আমি সবসময়ই একটি নীল মাফলার গলায় জড়িয়ে রাখতাম। সেই মাফলার দিয়ে মুখের অর্ধেক ও ঢেকে দিলাম। যাত্রীটি কিছুটা হতাশ হয়েই আমার দিকে তাকানো ছেড়ে দিলেন।
সেবার আসলেই আমার মৃত্যু হয়েছে কিনা, কিংবা আমি বেঁচে আছি কিনা- তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল আমার পরিবারের বাকী সদস্যদের মাঝে। ছোটমামা তার অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছিলেন, ও আর বেঁচে নেই। কারণ সুনেত্রা’র প্রেমে ছ্যাক খাবার পর সে আর বেঁচে থাকতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনোভাবে আত্মহত্যা করেছে।
সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন বড়মামা। তিনি বলেছিলেন, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করার মতো সাহসী সে নয়। অতএব বেঁচে আছে, এবং ফিরবেই।
হ্যাঁ, আমি ফিরে এসেছিলাম ঠিকই। কিন্তু অনেকটাই নিঃস্ব। সর্বহারার মতোই। কারণ শক্তি ও সাহস দিয়ে নিজেকে, নিজের প্রেমকে, নিজের সত্তাকে রক্ষা করতে না পারা মানুষটি তো সর্বহারার দলেই। এ সমাজে সব থাকার পরও সর্বহারার মানুষের সংখ্যা কম কোথায়?
আমার জীবনের বিশতম বসন্তের একটি বিকেলেই প্রথম ভাব জন্মেছিল ‘সুনেত্রা’র সাথে। সুনেত্রা’র বাবা ছিলেন একজন গায়েন। লোকজ কবি আর মরমী গীতিকারদের গান খুঁজে বের করে গেয়ে বেড়াতেন তিনি। আমি নিজেও ছিলাম তার গানের একজন মুগ্ধ শ্রোতা। স্থানীয় বেতার কেন্দ্রে যে সব নতুন শিল্পীরা পল্লীগীতি গাইতেন- তাদের একটা তালিকা করে রাখতাম আমি। সে তালিকায় নাম লিখতে গিয়ে প্রথম দিন থেকেই আমি সুনেত্রা’র বাবার গানের ভক্ত শ্রোতা হয়ে যাই। পরে আবিষ্কার করি তিনি আমাদের অঞ্চলেরই এক কৃতি শিল্পী।
সেই সুনেত্রা’র বাবা, অর্থাৎ আমার প্রিয় একজন গায়েন যখন গুরুতর অসুস্থ জানতে পারলাম- তখন আমি তাকে দেখতে তার বাড়িতে যাই। তিনি সেবার সেরে উঠেন ঠিকই। কিন্তু বকেয়া ধার-কর্জের হিসেব আর তার পিছু ছাড়েনি।
সর্বস্বান্ত হয়ে সুনেত্রা’র বাবা একদিন আমাকে বলেন, তিনি তার প্রিয় বেহালাটা কারো কাছে বন্ধক রেখে কিছু টাকা কর্জ চান। আমি বলি, এই বাদ্যটাই তো আপনার শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। এটা ছাড়া গান গাইবেন কি করে?
- টাকাগুলান যোগাড় করতে পারলেই বেহালাটা ছাড়ায়া আনুম বাবা।
তিনি উত্তর দেন।
- কিন্তু গান না গাইতে পারলে আপনি আয় করবেন কিভাবে?
- ‘হ, ঠিকই তো কইছেন বাবা।’ তিনি বলেন।
আমার কাছে জমানো কিছু টাকা ছিল। আর আমার ‘স্টেট ব্যাংক’ বলে ভরসা ছিলেন আমার ছোট মামা। এই দুই উৎস মিলিয়ে আমি টাকাগুলো রাতারাতি যোগাড় করে ফেলি। পরদিনই তুলে দিই সুনেত্রা’র বাবার হাতে। এবং এটাও বলি এই টাকা তাকে ফেরৎ দিতে হবে না।
কর্জমুক্ত হয়ে তিনি বেশ স্বচ্ছল জীবনেই ফিরে গিয়েছিলেন। সুনেত্রা’র কলেজ আর তার মা-বাবার ছোট সংসারের খরচপাতি চলে যাচ্ছিল বেশ আরামেই। কিন্তু বিধি বাম হলে সেই সুখ কী আর সয়!
এলাকায় মৌলবাদী ফতোয়াবাজদের কারণে সাধারন মানুষ অতিষ্ঠ ছিলেন বেশ আগে থেকেই। কিন্তু ধর্মান্ধ এসব মৌলবাদীরা একজন নিরীহ গায়েনের উপর এমনভাবে চড়াও হতে পারে- তা কারো কল্পনায় ছিল না। সোমবারী বাজারের একটি চা দোকানে বসে স্থানীয় লোকজনদের অনুরোধে গান গাইছিলেন সুনেত্রা’র বাবা। দিন দুপুরেই মৌলবাদীরা তার উপর চড়াও হয়।
তাকে বেদমভাবে প্রহার করে। তার হাতের প্রিয় বেহালাটি কেড়ে নিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয় শোকলা নদীতে। মারাত্মক আহত অবস্থায় সুনেত্রা’র বাবাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন স্থানীয় একজন চিকিৎসক।
পরে এলাকার মানুষ তাকে পৌঁছে দেন তার বাড়িতে। আমি যখন মধ্যরাতে খবর পাই, তখন পাঁজর ভাঙতে শুরু করে আমার। ভোরে বের হয়ে প্রথমেই যাই আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে। সকাল তখন এগারোটা। চেয়ারম্যান তখনও ঘুমিয়ে। তাকে জাগিয়ে তোলায় তিনি কিছুটা বিরক্ত হন। আমি তাকে জানাই, সুনেত্রা’র বাবার প্রতি এই নির্মম আক্রমনের কথা।
চেয়ারম্যান সহমর্মিতা জানান। কিন্তু দেখলাম তার চোখে মুখে কোনো আতংক নেই।
আমি বললাম, ‘চেয়ারম্যান চাচা এর একটি বিহীত আপনি করুন।’ তিনি হেসে দিলেন। ‘আমি কী করুম বাবা’!
চেয়ারম্যান বলতেই থাকলেন, 'এরা খুবই শক্তিশালী। শুনেছি ধর্মের শাসন কায়েমের নামে তারা রাষ্ট্রের আইনকে ‘তাগুদি’ আইন বলেই চিহ্নিত করে। তাদের কাছে নাকি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রও আছে! চেয়ারম্যান থামেন।
আমি বলতে শুরু করি। ‘তাইলে কী এই দেশে আর কেউ বাউল গানও গাইতে পারবো না, চেয়ারম্যান চাচা?’
‘এখনতো তাই মনে হইতেছে, বাবা।’- চেয়ারম্যান বলেন।
তীব্র হতাশা নিয়ে আমি চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ফিরি। আমার কানে বার বার ভাসতে থাকে তার আওয়াজ- ‘তাদের কাছে নাকি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রও আছে।’
অস্ত্রের সাথে আমার প্রথম পরিচয় সেই একাত্তর সালে। মেঝোভাই স্বাধীন বাংলাদেশে যেদিন প্রথম ফিরে আসেন তখন ছিল খুব ভোরবেলা। ফজরের আজানে মুখরিত হয়েছে বাংলার জনপদ। আমার মা তখন শয্যাশায়ী। নামাজ পড়ে বিছানায় শুয়ে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। একঝাঁক বুলেটের আওয়াজে কম্পিত হয়ে উঠে আমাদের এলাকা। দ্রুত খবর রটে যায় এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা ,এলাকায় ফিরে এসেছেন। অনেকটা দৌড়ে এসেই ‘মা ‘মা বলে চিৎকার করতে থাকেন মেঝো ভাই। মায়ের বেডরুমে ঢুকেই তার শিয়রে জমা রেখে দেন হাতের স্ট্যানগানটা।
অস্ত্র, আমি সেই প্রথম দেখি। মায়ের শিয়রে। মেঝোভাই যখন মাকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন, আমার চোখ তখন সেই কালো স্ট্যানগানটির দিকে। ছোট ছোট ছিদ্রের ভারি অস্ত্রটা যেন যেন চোখ উল্টে তাকাচ্ছে আমার দিকেও!
মহান মুক্তিযুদ্ধে বড়ভাই শহীদ হয়েছেন। সেই শোকে দু’দিন পর হার্টফেল করে মারা গেছেন আমার বাবা। মায়ের অবস্থা সে সময় থেকেই সংকটাপন্ন।
না, সেদিন সেই অস্ত্রটি আমি হাতিয়ে দেখতে পারিনি। কারণ একটা ধমক দিয়ে মেঝোভাই কয়েক মিনিট পরই তা সরিয়ে রেখেছিলেন দূরে কোথাও। কিন্তু কৈশোরে সেই প্রথম দেখা অস্ত্রের প্রতি যে দূর্বলতা আমার জন্মেছিল, তা এখনো আছে। আমি অস্ত্র নিয়ে এখনো কিছু মিথে বিশ্বাস করি। যেমন, অস্ত্র,-একটি জাতির স্বাধীনতা এনে দিতে পারে। অস্ত্র,- হানাদার বাহিনীকে হত্যা করতে পারে। অস্ত্র,- আমার বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারে। অস্ত্র,- যে কোনো জালেমের বুকে বিদ্ধ হতে পারে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ফিরে গ্রামের পাশের ছোট্ট নদীটির তীরে বসে থাকি। পাভেল এসে আমার তন্দ্রা ভাঙায়। সে আমার শিশুকালের বন্ধু। অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষীও। পাভেলকে ঘটনাগুলো খুলে বলি। সে আমাকে জানায়, সুনেত্রার বাবার উপর আক্রমণের ঘটনাটি সেও শুনেছে।
ইতোমধ্যে আমরা সুনেত্রার বাবাকে দেখে এসেছি। তাঁর অবস্থা মোটেও ভালো নয়। মারা যাবেন যে কোনো সময়- এটা নিশ্চিত জেনে ডাক্তার হাসপাতাল থেকে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। এখন তিনি কোনো কথাই বলতে পারছেন না। ফ্যাল ফ্যালিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। কাঁদছে সুনেত্রা। কাঁদছেন তাঁর মা।
‘বাবা, আমাদের কী হবে? এখন তো ওরা আমাদেরকেও মেরে ফেলবে।’ সুনেত্রা’র মায়ের কণ্ঠে তীব্র আতংক। আমি আর পাভেল কোনো উত্তর দিতে পারিনা। তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। বাজারের আড্ডায় এসে দেখা পাই প্রাক্তন সতীর্থদের। হ্যাঁ এরা সবাই এখন প্রাক্তন। বলা যায় ব্যর্থ প্রাক্তন। একটি শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে যে ক’জন তরুণ আমরা একদিন সমবেত হতে পেরেছিলাম এই গ্রামে- এরা তাদেরই ক’জন। শাকিল, নওরোজ, রাকেশ, প্রণব, ভিক্টর সবাই আমার মুখের দিকে তাকায়।
সুনেত্রার বাবার নির্মমভাবে আক্রান্ত হবার কথাটি আমি আবারো তাদেরকে বলি। পাভেল বলে, আমরা এখন কী করতে পারি, সেটা বলো।
শাকিল কঠোর ভাষায় হুংকার ছাড়ে।
'তাহলে তো আমরা আবার সেই পুরনো কালো লেদার জ্যাকেটগুলো গায়ে চড়াতে হয়।'
আমি তার মুখের দিকে তাকাই।
রাকেশ বলে, তবে কী কোনো অনিবার্য পরাজয়ের দিকেই এগুচ্ছি আমরা? এগুচ্ছে এই দেশ?
কী জবাব দেবো ভেবে পাই না। মনে পড়ে যায় আমাদের বিষন্নতার সেই দিনগুলোর কথা। ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘জাতীয়তাবাদ’, চার মুল স্তম্ভের বাংলাদেশে গণমানুষের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র দিয়ে মানুষের স্বপ্ন জয়ের সংগ্রামের কথা। আজ আমি যাদেরকে ‘প্রাক্তন সতীর্থ’ বলছি- তারা সবাই ছিলাম সেই প্রতীক্ষায় বিভোর।

অনেক ঝড় বয়ে গেল। সামরিক বুটের আওয়াজ খান খান করে দিলো বংলার মাটি। বত্রিশ নম্বরে নিথর পড়ে রইলো জাতির জনকের শবদেহ।
তারপর........
তারপর কী হলো- সে কথা আর বলতে চাই না। বলে লাভই বা কী!
‘গ্লাসনস্তো’ আর ‘পেরেস্ত্রেইকা’ নামক শঠতার রাজনৈতিক বীজ বপনের পর ভেঙে খান খান হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। পুঁজিবাদের নগ্ন বিজয়ের পর স্থবির এবং একপেশে হয়ে পড়লো বিশ্বরাজনীতি। এসব কথাগুলো আমি ভাবতে ভাবতে যখন মুহুর্তে ডুবে গিয়েছিলাম অন্য ভুবনে, তখনই ভিক্টরের কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। ভিক্টর গোমেজ, খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী আমার এই বিশ্বস্থ বন্ধুটির হাত তখন আমার পিঠে।
‘যার যা কিছু আছেÑ তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই অমর বাণীটির প্রতিধ্বনি তোলে ভিক্টর।
প্রণব তাকে সমর্থন করে। বলে, আমরা আমাদের সেই পুরনো লেদার জ্যাকেটগুলো গায়ে জড়াতে চাই।
কালো লেদার জ্যাকেটগুলোর ভেতরে তারা কী বহন করে তা আমি খুব ভালো করেই জানি। তারা কী করবে কিংবা করতে চাইবে তাও আমার অজানা নয়। কিন্তু আমি তাদেরকে কোনো অনুমতিই দিতে পারি না। আমার গলা আড়ষ্ঠ হয়ে উঠে।
যারা সশস্ত্র কায়দায় এদেশে জঙ্গী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদেরকে মোকাবেলার অন্য কী কী পথ খোলা আছে,তা ভেবে দেখার জন্য বলতে সায় দেয় আমার মন। কিন্তু তাও পারিনি আমি।
আমরা বাজারের উত্তরের মাঠে বসে যখন এসব দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছি তখনই পাভেল ফিরে এসে খবর দেয় সুনেত্রা’র পিতা ক’ঘন্টা আগে প্রয়াত হয়েছেন। এবং এটাও জানায় মৃত্যুর পূর্বে সুনেত্রার মা’কে বলে গেছেন, তিনি যেন তার একমাত্র ভ্রাতুস্পুত্র সুশীলের সাথে সুনেত্রা’র বিয়ের ব্যবস্থাটি করেন।

দু’টি সংবাদই আমাকে বেদনাহত করে তীব্রভাবে। সেই প্রথম বুঝি, সুনেত্রাকে আমি ভালো বেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু কেন ভালোবেসেছিলাম তাকে? প্রশ্নটি আমাকে আবারো আঁকড়ে ধরে। সতীর্থ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি বাড়ি ফিরি।
সুনেত্রা’র বাবার শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলাম আমি। তাঁর আত্মাকে আমি শুধু একথাই বলেছি, একটি স্বাধীন দেশে গান গাওয়ার স্বধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন নি তিনি। আর এর দায় বহন- আমি, আমরা করেই যাবো আজীবন।
তরুণ অধ্যাপক সুশীলের সাথে সুনেত্রা’র বিয়ে হবে, সে কথা আগেই আমাকে জানিয়েছিলেন সুনেত্রা’র মা। আমি তাতে বাঁধা দিতে পারিনি। বাঁধা দেবার কোনো অধিকারও আমার ছিল না। আমি কে? কেন বাঁধা দিতে যাবো। বরং কায়মন বাক্যে শুভ কামনা করেছিলাম সুনেত্রা-সুশীলের জন্য।
সুশীল মেলবর্ণ ইউনিভার্সিটির বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবার ছ’মাসের মধ্যেই সুনেত্রা কে সেখানে নিয়ে যায়। পাভেল, শাকিল, প্রণব, ভিক্টরসহ প্রায় সকলেই একে একে দেশ ত্যাগ করে। আমি ক্রমশ: আরো বিমূঢ় হয়ে পড়ি। যে আমি আমার প্রেমকে রক্ষা করতে পারিনি, যে আমি-আমার অগ্রজের রক্তে ভেজা মাতৃভূমিকে হায়েনাদের দখলে বাঁধা দিতে পারিনি, সেই আমার কি এদেশে থাকার অধিকার আছে? থাকার প্রয়োজন আছে?

এমন একটি প্রশ্ন দিনে দিনে মারাত্মকভাবে বিদ্ধ করতে থাকে আমাকে। একসময় সিদ্ধান্ত নিই- এদেশ ছেড়ে আমি চলে যাবোই। যে সমাজ, যে সভ্যতা আমাকে এই ভূমিতে বাড়িয়ে তুলেছে তার তলানি ছুঁয়ে দেখি, রাষ্ট্ররক্ষকরা প্রতারণার জাল ফেলছে যত্রতত্র।

শিকাগো থেকে শাকিল ফোন করে জানায়, যে তাত্ত্বিক আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের অ, আ, ক, খ শিখীয়ে ছিলেন, তিনি এখন শিকাগোর ইলনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে লেকচার দিয়ে বেড়ান।
সেই শুশ্রুমণ্ডিত তাত্ত্বিকের একটি বিচ্ছিন্ন প্রেতাত্মা আমাকে যেন ধাওয়া করা শুরু করে। এই দেশে ছেড়ে পালাবার জন্য আমি প্রায় মরিয়া হয়ে উঠি।
নিউইয়র্কে, এখন আমি যে শহরে থাকি এর নাম হিকসভিল। ছোট্ট একটি শহর। এখানে তেমন কোনো স্বদেশী চোখে পড়ে না। না পড়াটাই আমার জন্য মঙ্গলজনক। কারণ আগেই বলেছি, আমি আত্মগোপন করে থাকতে ভালোবাসি। আমি এই সিদ্ধান্তে খুব সুদৃঢ়ভাবেই উপনীত হয়েছি যে, মানুষ মাত্রেই নিজেকে লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে থাকাটাই মানুষের গোপন স্বভাব। তা অন্যের কাছে হোক। কিংবা নিজের কাছেই হোক।
আমার আত্মগল্পটি আমি এখানেই শেষ করবো। আমি জানি, এ গল্পটি পড়ে আপনারা ও একে একে নিজেদের গোপন না বলা গল্পটিকে সাজিয়ে নিয়েছেন নিজের বলয়ে। নিজের বৃত্তে। আমি এটাও জানি, আপনারা কেউ না কেউ লিখে যাবেন আগামীর একটি গল্প। আর তা হবে আমার এই গল্পটির প্রথমাংশ কিংবা শেষাংশ। হ্যাঁ, গল্পটা শেষ হয়েও শেষ হবে না পরবর্তী কোনো এক সংখ্যায়।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।