এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ||পর্ব ৩|| এলএনজি চুক্তির প্রাথমিক ধারণা

ফারুক হাসান এর ছবি
লিখেছেন ফারুক হাসান (তারিখ: শুক্র, ২২/০৭/২০১১ - ৭:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এলএনজি বাণিজ্য প্রধানত চুক্তিনির্ভর। এলএনজি চুক্তিগুলোকে মূলত Sales and Purchase Agreement (SPA) বলা হয়। এই চুক্তির একপক্ষ হচ্ছেন এলএনজির জোগানদাতা, বিক্রেতা বা রপ্তানিকারক। দ্বিতীয়পক্ষ হচ্ছেন ক্রেতা বা আমদানিকারক। এখানে একটা কথা বলে নেয়া ভালো যে, এই পক্ষগুলি হতে পারে কোনো রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান, কিংবা কোনো কোম্পানি। বাংলাদেশ সরকার এলএনজি আমদানি করার অভিপ্রায়ে যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি করেছে তার অপরপক্ষও একটি রাষ্ট্র, কাতার।

[justify]SPAতে এলএনজি ক্রয়-বিক্রয়ের সকল শর্তাবলী, ধারা (clause) এবং ক্রেতা ও বিক্রেতার সকল কমিটমেন্ট লিপিবদ্ধ করা হয়। ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যেকার এই চুক্তির কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সুনির্দিষ্ট সময়সীমা (Fixed duration), দীর্ঘমেয়াদ (সাধারণত ১৫ – ২৫ বছর), শর্তের অনমনীয়তা, ইত্যাদি। এছাড়াও, প্রায় সব চুক্তিতে একটি ধারা থাকে যাকে বলা হয় TOP (Take or Pay)। অর্থাৎ, যে মেয়াদের জন্য এলএনজি চুক্তিটি করা হবে সেই পুরোটা সময় জুড়ে ক্রেতা বাধ্য থাকবে চুক্তিতে উল্লেখকৃত এলএনজির দাম পরিশোধ করতে। ক্রেতার প্রান্তে এলএনজির সেই চাহিদা না থাকলেও সে বাধ্য থাকবে সেটা গ্রহন করতে। আর গ্রহন না করলেও তার দাম পরিশোধ করতে হবে। চুক্তির আরেকটি বৈশিষ্ট্য যেটিও ক্রেতার বিপক্ষে যেতে পারে সেটি হচ্ছে Ex-shippment। এর মানে হচ্ছে, বিক্রেতা কেবলমাত্র চুক্তিতে উল্লেখিত স্থানে এলএনজির কার্গোকে পৌছে দিবে এবং ক্রেতার কোনো অধিকার থাকবে না সেই কার্গোতে থাকা এলএনজি অন্য কোথায়ো নিয়ে যাবার কিংবা বিক্রি করার।

এই পর্বের আলোচনা মূলত সীমাবদ্ধ থাকবে SPA চুক্তিগুলোর প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্যের উপর।

(১) চুক্তির দীর্ঘমেয়াদ, দীর্ঘসুত্রিতা এবং অনমনীয়তা

আমরা যদি এলএনজির পুরোটা যোগান-শৃংখল (Supply Chain) সামনে নিয়ে বসি, তাহলে দেখবো যে খনি থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসকে এলএনজির মাধ্যমে একদম ব্যবহারকারীর আঙিনায় পৌছে দিতে বেশ কয়েকটি প্রযুক্তিগত ধাপ পেরুতে হয়। সেগুলি হচ্ছে- প্রথমে প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন, তারপর উত্তোলিত গ্যাসকে তরলীকরণ (এলএনজি বানানো), এরপর সেই এলএনজিকে জাহাজে করে ক্রেতার বন্দরে পৌছানো, এলএনজি সংরক্ষণ, এবং সবশেষে পুণঃগ্যাসিকরণ। এই সবগুলি ধাপই প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যন্ত, অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এলএনজি করে গ্যাসকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যেতে যে এককালীন বিনিয়োগের প্রয়োজন সেটা কয়েক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই খাতে একবার বিনিয়োগ করে ফেললে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এলএনজি বিক্রি করতে পারলেই কেবল বিনিয়োগের পুরোটা ফেরত পাওয়া সম্ভব। তাই বিনিয়োগকারীর প্রয়োজন এমন এক ক্রেতা(গোষ্ঠী) যে বা যারা তার কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি কিনবেন। সম্প্রতি কাতারের অন্যতম এলএনজি প্রস্তুতকারক কোম্পানি কাতারগ্যাস বছরে পাঁচ মিলিয়ন টন এলএনজি বিক্রির একটি চুক্তি করেছে আর্জেন্টিনার সাথে যার মেয়াদ ২০ বছর। বেশিরভাগ দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তির মেয়াদ ১৫ – ২৫ বছর বা তারো বেশি হয়।

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পক্ষে বলা হয় যে এতে এলএনজি যোগান শৃংখলের সমস্ত ঝুঁকিকে কেবল এক পক্ষের উপর না চাপিয়ে ক্রেতা এবং বিক্রেতা – দুই পক্ষের মধ্যে ভাগ করে নেয়া হয়, ফলে যে কোনো এক পক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে ক্রেতাপক্ষ অনিশ্চিত বাজারজনিত ঝুঁকির (market risk) কিছুটা নিজের কাধে তুলে নিয়ে বিক্রেতার বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অন্যদিকে, গ্যাস উৎপাদনের যে অনিশ্চয়তা (production risk) সেটার দায় বিক্রেতা নিজের কাধে তুলে নিয়ে ক্রেতার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলি (যেমন বিশ্ব ব্যাংক) যে কোনো মূল্যে তার পুঁজির নিশ্চয়তা চায়, যার ফলে তারা সবসময় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পক্ষে চাপ দিতে থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, “This is the main source of the bank’s recovery of their loan, so its essential that the sales and purchasing agreement (SPA) be as watertight as possible”. সমস্যা হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ফলে মনোপলি বা একচেটিয়া বাজারের উদ্ভব ঘটে যার কারণে ক্রেতার লাভের চেয়ে উলটো ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। একবার চুক্তি করে ফেললে ক্রেতার হাত-পা অনেকটা বাধা পড়ে যায়, কারণ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিগুলি খুব অনমনীয় (rigid) হয়। দীর্ঘমেয়াদে চুক্তি করতে পারলে বিক্রেতার লাভ হচ্ছে সে দীর্ঘমেয়াদে ক্রেতাকে নিজের মুঠোয় পুড়ে ফেলতে পারে। এতে ভবিষ্যতে এলএনজির দাম কমলেও সে ঠিকই আগের মত মুনাফা করে যেতে পারে। অন্যদিকে, বাজারে এলএনজির দাম চুক্তিতে উল্লেখিত দামের চেয়ে কম থাকলেও ক্রেতাপক্ষ এলএনজির দাম তার সুবিধামত কমাতে বলতে পারে না, যদি চুক্তিতে সুস্পষ্টভাবে সেরকম কোনো নির্দেশনা না থাকে। যদিও চুক্তিগুলিতে এলএনজির দাম কখন কত হবে সেটা নির্ধারণের জন্য ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতিতে কিছু ফর্মুলা (pricing formulae) ঠিক করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী ব্যাংক বা মহাজনদের সব সময় চেষ্টা থাকে যাতে চুক্তির পুরোটা সময়ে সেই ফর্মুলাতে কোনো পরিবর্তন না আসে। উপরন্তু, বাজারে স্বল্পমেয়াদের এলএনজি (spot market) পরিমাণে সাম্প্রতিককালে বাড়তে থাকলেও, যারা চুক্তি করে ফেলেছেন তাদের পক্ষে চুক্তিকে অগ্রাহ্য করে স্পট মার্কেট থেকে কিংবা সাময়িকভাবে এলএনজি কেনা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন,“…it is this… risk that has been the focus of so much recent attention, as the potential for a spot market in LNG emerges”. এই সব কারণে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভবিষ্যত লাভ-ক্ষতির খতিয়ান সবদিক খুব ভালো মত খতিয়ে দেখেই কেবল চুক্তি সম্পাদন করা উচিত।

এলএনজি আমদানিচুক্তিগুলি যে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয় তাই নয়। একটি চুক্তি সম্পাদনের পর ক্রেতাকে অনেক সময় এলএনজি পেতে অপেক্ষাও করতে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদের জন্য। যেমন, যদিও আর্জেন্টিনার সাথে কাতারের চুক্তিটি হলো ২০১১ সালে, কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০১৪ সাল থেকে। অর্থাৎ, চুক্তি থাকা সত্ত্বেও আর্জেন্টিনাকে আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে কাতার থেকে এলএনজি হিসেবে গ্যাসের সাপ্লাই পেতে। এলএনজি আমদানির এই দীর্ঘসুত্রিতার পেছনেও থাকে মূলত বিক্রেতা অথবা বিনিয়োগকারীর লাভের বিষয়টি। গ্যারান্টেড বাজার বা ক্রেতা না থাকলে কেইবা এত বিলিয়ন ডলার খরচ করতে চাইবে বলুন? তাই এলএনজি বিক্রেতা তার প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ সম্পর্কে নিশ্চিত হবার সাথে সাথেই কিন্তু সেই গ্যাস থেকে এলএনজি উৎপাদন শুরু করে না। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানো কিন্তু সহজেই বিনিয়োগ করে বসে না। তারা প্রথম যে কাজগুলি করে তা হচ্ছে এলএনজির বাজার খোঁজা, ক্রেতার সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সম্পাদন করা এবং তাদের বিনিয়োগের রিটার্ন নিশ্চিত করা। বেশিরভাগ সময়েই, চুক্তি হয়ে যাবার পর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একটা গ্যাপ পিরিয়ড থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ কাতারের সাথে কেবলমাত্র সমঝোতা চুক্তিই করেছে, মূল চুক্তিটি এখনো করা হয় নি। তাই যারা মনে করছেন যে এলএনজি আমদানি চুক্তি আমাদের বিদ্যুৎ সংকটের হাত থেকে সাথে সাথে মুক্তি দেবে, তাদের সে ধারণা ঠিক নাও হতে পারে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মূল বেনিফিশিয়ারি হচ্ছে মূলত বিনিয়োগকারী এবং এলএনজি বিক্রেতা। কাতারের প্রান্তে সে একই সাথে বিক্রেতা এবং বিনিয়োগকারী। অন্যদিকে যদিও বঙ্গোপসাগরের গভীরে বাংলাদেশকেই বিনিয়োগ করে এলএনজি আমদানির জন্য রিসিভিং টার্মিনাল এবং পুণঃগ্যাসীকরণ প্লান্ট বসাতে হবে, তবে বিনিয়োগের সেই টাকাটা আসছে বিশ্বব্যাংক থেকে। সুতরাং বাংলাদেশের অবস্থানকে নির্দেশ করা যায় কেবল ক্রেতা হিসেবেই। দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তির যে ইতিহাস তাতে এরকম ক্রেতার লাভ হচ্ছে কেবল অতিরিক্ত টাকা গুণে জ্বালানি এবং শক্তির নিরাপত্তা প্রাপ্তি, আর কিছু নয়।

(২) TOP (Take or Pay) ধারা

নাম থেকেই স্পষ্ট, এটি বিক্রেতার নিজস্ব লাভের জন্য ক্রেতার উপর চাপিয়ে দেয়া একটি ধারা। সংক্ষেপে এই ধারার মূল কথা হচ্ছে যে প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, ক্রেতা চুক্তিতে উল্লিখিত পরিমাণ এলএনজি (contracted volume of LNG) বিক্রেতার কাছ থেকে নিতে বাধ্য থাকবে। না নিতে চাইলে কিংবা নেবার সামর্থ্য না থাকলে, সেক্ষেত্রেও ক্রেতা বাধ্য থাকবে এলএনজির মূল্য পরিশোধ করতে। অন্য ভাষায়, ক্রেতার প্রযুক্তিগত কিংবা চাহিদাগত সামর্থ্য থাকুক না থাকুক, অর্থনৈতিক সামর্থ্য সব সময় থাকতে হবে যাতে সে চুক্তিকৃত এলএনজির দাম সময়মত পরিশোধ করতে পারে। TOPর সাথে যদি যুক্ত হয় Ex-shippment ধারাটি তাহলে তো কথাই নেই। সেক্ষেত্রে ক্রেতা সরবরাহকৃত এলএনজিকে অন্য কোনো বন্দরে পাঠানো কিংবা অন্য কোনো পক্ষের কাছে বিক্রিও করতে পারবে না। অর্থাৎ, ঢেকি গিলতে হবে।

একটি সাধারণ TOP ধারাতে যা লেখা থাকে তা অনেকটা এরকম, “If the total quantity of LNG taken by the buyer is less than the Annual Contract Quantity for the contract year, the buyer shall pay the seller for the quantity deficiency at the average price for each month in that contract year”. আবারো, এটি সহজেই অনুমেয় যে চুক্তিতে এই ধারাটি যোগ করা হয় প্রধানত বিনিয়োগকারীর অর্থের সদাপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য। এই ধারাটি এলএনজির বাজারে বিক্রেতা ও বিনিয়োগকারীর মনোপলিকে আরো শক্তিশালী করে, যার ফলে সাধারণ পাইপলাইন গ্যাসের চাইতে এলএনজির মূল্য অনেক বেশি হলেও ক্রেতা সেটা কিনতে বাধ্য হয়। উপরন্তু, যেহেতু চুক্তি করা হয় বহু বছরের জন্য, TOP ধারাটি অদূরদর্শী ক্রেতার জন্য গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাড়ায়।

বর্তমানে বাংলাদেশের গ্যাসের ঘাটতি ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কাতার থেকে বাংলাদেশে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানির কথা চলছে, দৈনিক গড় হিসেবে সেটার পরিমাণ দাড়ায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মতন। যখন গ্যাসের চাহিদা ঠিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, তখন এই পরিমাণ এলএনজি আমদানির সাথে চাহিদার মান সমান সমান হবে। কিন্তু গ্যাসের চাহিদা যখন ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট (অফপীক সিজন) থাকবে, তখন আমাদের আমদানিকৃত গ্যাসের “অতিরিক্ত” পরিমাণ হবে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এখন এই “অতিরিক্ত” গ্যাস গ্রহন করা আমাদের জন্য একটা বিরাট সমস্যা। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পাওয়ার প্লান্ট বাংলাদেশে অপ্রতুল। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে অবকাঠামোও একটা সমস্যা। দ্বিতীয়ত, “অতিরিক্ত” এলএনজিকে সংরক্ষণও বেশিদিন সম্ভব নয়। কারণ তাকে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন মাইনাস ১৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সার্বক্ষণিক রেফ্রিজারেশন প্রদান, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

একটা ছোট্ট হিসেব করা যাক। প্রতি মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পোড়ালে আমরা পাই আনুমানিক ১,১০০ মিলিয়ন বিটিইউ শক্তি। এখন, যদি এলএনজি পুড়িয়ে প্রতি এক মিলিয়ন বিটিইউ শক্তি পেতে খরচ ধরা হয় মোট ১৪ ডলার (এটি আনুমানিক খরচ, কিন্তু এলএনজির বাস্তব খরচ এর কাছাকাছিই), তাহলে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের এলএনজির দাম পড়বে ৩.৮৫ মিলিয়ন ডলার (১,১০০ গুনিতক ২৫০ গুণিতক ১৪)। তার মানে অফপীক সিজনে আমাদের TOP ধারার খড়গের নিচে পড়ে গচ্চা দিতে হবে দৈনিক ৩.৮৫ মিলিয়ন ডলার। বছরে যদি ৬ মাস অফপীক সিজন থাকে তাহলে আমরা প্রতি বছর গচ্চা দিবো প্রায় ৬৯৩ মিলিয়ন ডলার। ডলার প্রতি ৭৫ টাকা ধরলে সেটা হয় বছরে প্রায় ৫২০০ কোটি টাকা।

আবার যদি উল্টোটা ঘটে, মানে যদি আমাদের গ্যাসের চাহিদা আরো বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রেও আমরা পরবর্তীতে খুব বেশি এলএনজি আমদানি করতে পারবো না। এর কারণ, রপ্তানিকারকের সীমাবদ্ধতা ও কমিটমেন্ট। এর সাথে যোগ হবে দেশের এলএনজি রিসিভিং টারমিনালের সম্প্রসারণজনিত বাধা। সম্প্রসারণ করতে চাইলেই সেটা সম্ভব না। বিশেষ করে, গভীর সমুদ্রে।

তাই, পরিশেষে, যে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, এলএনজি জ্বালানির একটি নবাগত উৎস মাত্র। এই প্রযুক্তি ব্যয়বহুল, এলএনজির দাম সাধারণ গ্যাসের চাইতে কয়েকগুণ পর্যন্ত বেশি। তার উপর, দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎচাহিদার আকষ্মিক পরিবর্তন এলএনজির মাধ্যমে অচিড়েই করে ফেলা সম্ভব নয়। আজকে চুক্তি করলেও সেই এলএনজি ২০১৩র আগে পাওয়া যাবে কিনা সেই সন্দেহ থেকেই যায়। তার উপর, একটি দেশের জ্বালানির চাহিদা সাধারণত পরিবর্তনশীল, আমাদের দেশেও গ্যাসের চাহিদা খুব কম সময়েই স্থির থাকে, প্রতিবছরই সেটা উর্ধ্বমুখী। সরকারী হিসেব মতেই আমাদের গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ১০% হারে। আবার, বছরের কিছু সময় গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকে, কিছু সময় থাকে তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এলএনজি আমদানি চুক্তিগুলি সবসময় গ্যাসের বাহ্যিক সরবরাহকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে বেধে ফেলে। যার কারণে, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস আমদানির যে সুফল সেটা এলএনজি আমদানির মাধ্যমে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই, বাংলাদেশকে জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে খুব সাবধানে, ভেবে চিনতে এগুতে হবে। বিশেষ করে এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে হতে হবে সাবধানী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং চুক্তি করতে হবে নিজের লাভ-ক্ষতির বিস্তারিত বিশ্লেষণের পরেই। যদি এলএনজি আমদানি চুক্তি আমরা করতেই চাই, তাহলে সেটি হতে হবে বাংলাদেশের সকল স্বার্থকে বজায় রেখেই, ন্যায্য দামে এবং ন্যায্য শর্তে।

পাদটীকা

  • ১. http://www.qatargas.com/news.aspx?id=266646
  • ২. O. U. Chidinma, International Project financing: What Effect Does the Emerging Spot Market for LNG have on the Financing of Gas Projects?
  • ৩. P.Roberts, Bankable Gas sales Agreements in the Project Financing of Offshore Gas Production Projects, 16 J.E.R.L., P. 201 (May 1998)
  • ৪. R. Burrett and D. Hultman, A Financier’s View of the LNG Market, 065/IJ/LNG Supplement (1 Aug.
    2003).
  • ৫. R. Namikawa. Take-or-Pay under Japanese Energy Policy. Energy Policy, 31 (2003), 1327 - 1337.

মন্তব্য

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ। চলুক
আমাদের এলএনজি রিসিভিং প্ল্যান্ট প্রজেক্টের ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে হবে মনে হচ্ছে।

ফারুক হাসান এর ছবি

রিসিভিং টারমিনালের উপর আপনার পোস্টের অপেক্ষায় রইলাম। প্লিজ লিখবেন।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।