যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে ১. একাত্তরের খেলারাম, খেলে যান খেলে যান (রিপোস্ট)

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি
লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ (তারিখ: শনি, ২৭/১০/২০০৭ - ৮:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই বিষয়টা নিয়ে তিনটা লেখা দেব ভাবছি। প্রথমটা এটি, তবে রিপোস্ট। পরেরটা হবে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দীনের এ বিষয়ে চিন্তা জাগানিয়া লেখা আদি পাপ : ১৯৭১-এর অপরাধের বিচার এবং তৃতীয়টা হবে, আমার নতুন লেখা। শেষেরটিতে যুদ্ধাপরাধের প্রতিকার ও ঘৃণা বিষয়ে চলমান বিতর্কে আমার আলোচনার উপসংহার টানবো।

আমরা ভুলে যাই আমাদের কাঁধে ৩০ লাখ লাশের ভার। আমাদের যে শিশু জন্মেছে এবং যে জন্মাবে, তার প্রাণবায়ুও কিনতু ওই শহীদদের থেকেই ধার করা। আনুমানিক ৪ লাখ নারীর চূড়ান্ত নিপীড়নের প্রতিকারের দায় আমাদের ওপর। এত মৃত্যু এত নির্যাতনের ভার নিয়ে খুব কম দেশকেই যাত্রা শুরু করতে হয়েছে। এবং এত মাহকাব্যিক একটি সংগ্রামের নিদারুণ অপচয়ের নজিরও পৃথিবীতে কম। বেয়াক্কলে ঘীয়ের বোঝে কী? আনে কর্পূর, লাগায় ...-এ।

গত কয়েকশ বছরে বাংলা দিয়েছে যত পেয়েছে অনেক কম। কেবল বাংলা বললে হয় না, পূর্ব বাংলা বললে তবে সহি-শুদ্ধ হয়। দুনিয়ার মধ্যে এমন জাতি নাই, যাদের ওপর অল্পতম সময়ে এরকম সর্বোচ্চতম গণহত্যা হয়েছে। ১৯৭১-এর নয়টি মাস দিনে গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার করে মানুষ হত্যা চলেছে (১৯৮১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা)। কিনতু এর প্রতিদান বাংলার জনগণ পাননি। বাংলার স্বাধীনতা তাদের দুর্দশা ও ক্ষমতাহীনতা থেকে মুক্তি দেয়নি। যে দেশের জন্য তারা যুদ্ধ করেছে জীবন দিয়েছে, সেই দেশ তাদের কবরের জমিনটুকু কিংবা তাদের লাশ পড়ে থাকার নিশানাটৃকু পর্যন্ত দিতে পারে নাই। এমনিতে মানুষ মারলে বিচার হয়, কিনতু মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষ মারলে তার বিচার হয় না। তখনও এবং এখনও।

’৭১-এ আমাদের ওপর দিয়ে যা ঘটে গেছে তা কি কেবলই গণহত্যা? কেবল মৃত্যুই দেখেনি বাংলাদেশ, ধ্বংস দেখেছে, নিকৃষ্টতম ঘৃণা দেখেছে। কী বিষ্ময়, বলা হয়েছিল ঘাতক-দালালদের বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া হবে, কাউকেই মাফ করা হবে না। সাগর পাড়ের দেশ হয়েও বাঙালি সাগরে ভয় পায়। নদী-নালা আর বন্যায় ভাসা তার মজ্জাগত অভ্যাস। সেকারণে শোকের নদীতে ভাসা আর অশ্রুর বন্যায় প্লাবিত হওয়াই বোধহয় আমাদের রীতি। শোকের প্রতিবিধান না করতে পেরে আমরা এখন শোকের কারণটাকেই ভুলতে বসেছি। এতবড় একটা যুদ্ধ জাতি করলো, তারপরও কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বীর রসের কথা নাই! বীর রসে সঞ্জিত গল্প, কবিতা, গান, নাটক বা উপন্যাস কেন এতো হাতে গোণা? কেন আমাদের দেশাত্মবোধক ভাবের বেশিরভাগটাই পুতুপুতু আবেগে জবজবা? দেশটা কি ময়রার ভিয়েন যে সবকিছুই শোকের শিরায় না চোবালে বিকায় না!
অন্যদিকে স্বাধীনতার স্বাদ রসিয়ে রসিয়ে আস্বাদন করতে আমাদের দেশের ভাল-থাকা অংশ কখনোই বিরত হন নাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দিগম্বর করে রেখে তারা একাই স্বাধীনতার সুখ ভোগ করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই, কোনো খামতি নেই। রাষ্ট্র ও সমাজকে দুইয়ে, চুষে, চিবিয়ে ছোবড়া করে করেই তাদের নির্লজ্জ প্রতিষ্ঠা। এ কাজে এরা যেমন দড় এদের রাজনীতিটাও তেমন। দক্ষ বিউটিশিয়ানের মতো এরা স্বাধীনতার দেহ থেকে ৩০ লাখ মানুষের রক্তদাগ মুছে ফেলতে পেরেছে, শারীরীক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হওয়া লাখ-লাখ নারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে চেপে যাওয়া হয়েছে। লুকিয়ে ফেলা হয়েছে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের ধর্ষণের ফসল যুদ্ধশিশুদের অস্তিত্ব। সেইসব মা ও তাদের সন্তাদের পরিণতির কোনো খোঁজ কি আমরা রেখেছি? এমন এক স্বাধীন দেশের জন্য তারা সর্বস্ব দিয়েছে, যে দেশ তাদের স্বীকার করেনি। পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দেশীয় দোসররা লাখ লাখ নারীর জীবনকে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে,আর বীরাঙ্গনা বলে আমরা সেই পোড়া ঘায়ে লবণ দেওয়ার কাজ সেরেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই যে সোনার বাংলার স্বপ্নে সর্বস্ব দিল, তাকি তারা আর ফেরত পেয়েছে?
নির্যাতিত বা শহীদ নারীদের ষ্মরণে স্মৃতিসৌধ তো দূরের কথা একটা ষ্মারক ডাকটিকিট পর্যণ্ত হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, জাতির ধারণা কি কেবলই পুরুষালি, নারীর অস্তিত্ব ও অবদানের স্বীকৃতি সেখানে কোথায়?

এসব এখন কিছু লেখক-গবেষক আর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের বিষয়। আজো রাষ্টীয় এজেন্ডাভুক্ত হয়নি ’৭১-এ সংঘটিত গণহত্যা, জাতিগত নিধন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জরুরত। আমাদের কত কত রাষ্ট্রীয় দিবস, কিনতু ১৯৭১-এর নারকীয় গণহত্যার জন্য একটি ‘গণহত্যা দিবস’ও আজতক ঘোষিত হয়নি। এমনকি এ গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রমাণ করতে গেলে যে ধরনের পদ্ধতিগত তদন্ত দরকার, তাও সমাধা করা হয়নি। হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ হয়েছে, কিন্তু তার চরিত্রটা যে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ তা প্রমাণের উপযুক্ত আইনী ভাষা কি আমাদের আছে? দেশীয় দালালদের বিচারের উপযোগী ১৯৭২-এর দালাল আইনটিও জিয়াউর রহমানের আমলে রদ করা হয়েছে। তারপরও তিনি আমাদের অন্যতম রাজপুরুষ। হা কলিকাল!

সত্য এই যে, আমরা স্বাধীনতা মানি কিনতু যে পথে তা অর্জিত হয়েছে তা মান্য করি না। মানলে অপরাধীদের বিচারের দায় এড়িয়ে স্বাধীনতাকে হালাল ভাবতে অসুবিধা হবার কথা। টিকটিকি যেমন বিপদে পড়লে শত্রুর হাতে লেজ ফেলে দেহ নিয়ে পালায়, তেমনি আমাদের শাসকরা স্বাধীনতার দেহ থেকে গণহত্যাকে কেটে গদি মাথায় করে পালিয়েছে। এ কারণেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ অসমাপ্ত।

আমাদের শাসকদের সকল কিসিমের জাতীয়তাবাদই স্বাধীনতার মহিমা কীর্তন করে, কিন্তু গণদুর্ভোগের বিচারের প্রশ্নকে এড়িয়ে যায়, ভুলিয়ে দেয়। আপস করে ঘাতকের সঙ্গে। একাত্তরের গণহত্যাকারীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ তো শেখ মুজিবই রচনা করেছিলেন, নাকি?আমেরিকা ও সৌদি আরবের চাপে গণহত্যার তদন্ত থেকে দৃষ্টি সরানো কি শেখ তারই কাজ ছিল না? সরকারিভাবে ’৭২ সালের জুলাই মাসে মাত্র ৪০০ জনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। কিনতু কিছুকাল পরেই তা কমিয়ে ১৯৫ জন এবং পরে আবারও কমিয়ে ১১৮ জনে আনা হয়। কিনতু এদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও মামলার নথিপত্র তৈরিতে ভেতর থেকেই একটি চক্র বাধার সৃষ্টি করায় বিষয়টি আর এগোতে পারেনি বলে ভারতীয় কূটনীতিক পি এন হাকসারের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান ইঙ্গিত করেন (যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা : এম হাসান)।

আর তার কণ্যা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে জামাতকে গণতান্ত্রিক দলের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এবং ৯৪-এ আমরা পত্রিকায় দেখা গেল দেখলাম জাহানারা ইমামের লাশের ছবি আর সেই পাতাতেই নিজামী-হাসিনা বৈঠকের ছবি। তার দলের প্রার্থীই তো গোলাম আজমের পদমুবারক চুম্বন করেছিল। আর স্বাধীনতার আরেক নায়ক তাদের পুনর্বাসন করান এবং মন্ত্রী বানিয়ে মসনদের বাহার বাড়ান।

তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষওয়ালাদের মুক্তিযুদ্ধ কিনতু থামে নাই। নিজ জাতির ক্ষমতাবান রাজাকারদের সঙ্গে তারা আপোস করে আর একাত্তরের লড়াই এখনও বিহারিদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যায়। কথায় বলে, মরারে মারো ক্যা? কয়, লড়ে-চড়ে ক্যা? বাঙালি জাতির একাংশের এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিপীড়নের দায় তারা একা নেবে কেন? পিতার অপরাধের দায় কেন এ প্রজন্মের বাংলাদেশী বিহারীরা বহন করবেন? ২৫ মার্চের আগে এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে তাদের ওপরও তো প্রতিহিংসার হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল? সেটাও কি যুদ্ধাপরাধ নয়? একাত্তর তাই কোনো সরল কাহিনী নয়। এ সত্য থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকা কেবল আত্মপ্রতারণাই নয়, সুবিধাবাদিতা। এটাই সত্যের ভেতরকার তিতা শাঁস। চাই কি না চাই, সত্যের আঁটি তিতাই হয় এবং তাতে কখনো কখনো জিভ ঠেকাতে হয়।

দেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘দুই লাখ মা-বোন! এদের আমি কোথায় কী করব?’ ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা’ (বাংলার বাণী, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)। ‘যুদ্ধশিশু’ এবং তাদের মা’দের একটা সুব্যবস্থা করার জন্য নীলিমা ইব্রাহিম অনেক খেটেছিলেন। এদের ভাগ্যে কী হবে, তা জানতে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে বলেন, ‘না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সন্তানদের মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না।’ (ইব্রাহিম, ১৯৯৮ : ১৮)। এটি কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি এক মহানায়কের সংকট নয়, এটা ছিল জাতীয় সংকট। গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তরণ হচ্ছিল,গ্লানি জমছিল। সরকারের তরফ থেকে এসব নির্যাতিত নারীকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তারা ভেবেছেন সেটাই নারী জীবনের একমাত্র গন্তব্য। অল্প ক’জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে আসেন, তবে মোটা যৌতুক চান। যৌতুকের লিষ্টির মধ্যে লাল জাপানি গাড়ি থেকে অপ্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ করা পর্যন্ত ছিল। তাদের যুক্তি: এদের অভিভাবক হিসাবে যৌতুক মেটানোর দায়িত্ব সরকারের। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি ওদের বাবা।’ ইতিহাসের দায় কি এতেই শোধ হয়? এ নিযে কর্মরত ড. ডেভিস মন্তব্য করেন, ‘না, কেউই এটা নিয়ে কথা বলতে চায়নি।... পুরুষেরা এ নিয়ে একদম কথা বলতে রাজি নয়। তাদের চোখে এসব নারী নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো তাদের মরে যাওয়াই ভালো ছিল এবং পুরুষরা সত্যিই তাদের মেরেও ফেলেছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। পশ্চিমা সমাজে এরকমটা এত অপরিচিত! এত অপিরিচিত!’ (সাক্ষাতকার, বিনা ডি কষ্টা, ২০০২)।

পরিবারের পিতা বা বড় ভাই আর ‘জাতির পিতা’ এখানে এক সুরে কথা বলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরুষালি ইতিহাস নারী মুক্তিযোদ্ধাকেও কেবল সতীত্বের তকমা আঁটা চেহারাতেই দেখতে চেয়েছে। নারী যুদ্ধও করবে, পুরুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের বলিও হতে পারবে কিন্তু কোনোভাবেই পুরুষের পরিবারের রাষ্ট্রের)সদস্য হওয়ার অনুপযুক্তা হতে পারবে না,তাকে পুরুষালী শুদ্ধতা রাখতেই হবে।

বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে খায়, তেমনি বড় ইতিহাস ছোট ইতিহাসকে লোপাট করে। বড় ইতিহাস মানে জাতীয় ইতিহাস, সেখানে নায়ক-মহানায়ক আছে, বীর আছে। তারা জাতি গঠনের ইঞ্জিনিয়ার ও স্থপতি। তাদের অনুসারীদের ভাবোচ্ছ্বাসে ইতিহাসের ছোট ছোট কারিগরের ভূমিকা ঢাকা পড়ে যায়। ইতিহাসেও মাতস্যন্যায় আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ সত্য বিরল নয়। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের শ্রেণীগত বিচারের প্রয়োজন পড়ে। মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নিজস্ব রাষ্ট্র চেয়েছে, চেয়েছে বিদেশী শাসক হটিয়ে ক্ষমতার গদিতে নিজেরা বসতে। শেখ মুজিবুর রহমান সাত মার্চের ভাষণে বলেছিলেন,‘বার বার জয়ী হয়েও আমরা গদীতে বসতে পারি নাই'। আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা গদীতে বসতে চেয়েছিল। এটাই স্বাভাবিক। তাদের এই শ্রেণীগত আকাঙ্ক্ষা তখন ইতিহাসের ফেরে জাতীয় আকাঙ্ক্ষাও হয়ে উঠতে পেরেছিল। কিনতু এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাসনা যতটা পাক্কা ছিল, ক্ষমতার চরিত্র বদল ততটা ছিল না। অথচ কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ চেয়েছিল মুক্তি। সেই মুক্তির চেহারা-ছবি তাদের কাছে অস্পষ্ট হলেও, জমি-জীবন ও ভবিষ্যতের ওপর তারা বাঙালি বা অবাঙালি কারো আধিপত্য চায়নি। মুক্তিবাহিনীতে দলে দলে এরাই যোগ দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক হিসাবে আমরা লুঙ্গি-গামছা পড়া কৃষককেই বুঝে থাকি। কিন্তু তাদের লড়াই আর ছয় দফার লড়াই কি এক ছিল? না থাকলেও পাকিস্তানীদের গণহত্যার নিশানায় এরাই বেশি করে পড়েছিল। যে চার লাখ ‘বীরাঙ্গনার’ কথা বলা হয়, তারাও কিনতু গ্রাম শহরের গরিব ঘরেরই নারী। মুক্ত বাংলাদেশ এসব গরিব নারী-পুরুষকে ভুলে গেল। এরা অস্ত্র ও জীবন সমর্পণ করে ফিরে গেল, মেয়েদের অনেকে আত্মহত্যা করলো অনেকে ভীড় জমালো পতিতালয়ে। এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পুরুষরাই তো সেখানে গিয়ে তাদের পয়সার বিনিময়ে ধর্ষণ করে আসতে পারে; তাদের মধ্যে কি মুক্তিযোদ্ধাদেরও কেউ কেউ ছিল না,ছিল না রাজাকরদের কেউ? দেশ গড়া ও রাষ্ট্র পরিচালনার ডাক এদের কাছে যে আসবে না তাতে বিষ্ময় নাই। এমনকি যে সাতজন মুক্তিযোদ্ধকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়া হলো,তাদের মধ্যে কৃষক সন্তানেরা থাকলেও সেই পরিচয়ের জন্য তারা সম্মানিত হননি, হয়েছেন সেনাসদস্য হওয়ার জোরে। নইলে সেনাসদস্যের বাইরের বীরদেরও আমরা দেখতে পেতাম। গণযুদ্ধ'র প্রয়োজনে শ্রেণীতে শ্রেণীতে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, স্বাধীনতার পরপরই তা ভেঙ্গে গেল। রাষ্ট্র একদিকে চলে গেল,সমাজ আরেক দিকে। অন্যদিকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে রুখতে সফল হলেও নিজ জাতির মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হলো। তারই ফল গণহত্যাকারীদের বিচার না হওয়া। স্বাধীন বাংলাদেশেই পরাস্ত হলো তাদের শ্রেণীর লাখ-লাখ মানুষ-হত্যার বিচারের দাবি। এবং স্বাধীনতার শত্রু আমেরিকা ও সৌদি আররে পুনরাভিষেক ঘটলো স্বাধীন বাংলাদেশে। শেখ মুজিব ভুট্টোকে জড়িয়ে ধরে বললেন,'আও মেরে ভাই'।

গত ৩৫ বছরে যারা ক্ষমতাবান হয়েছেন,ব্যক্তিগতভাবে তাদের তো খুব বেশি কিছু হারাতে হয়নি। এদের চেতনার কাঠখড়ে আর আগুন জ্বালানো যাবে না। জ্বলবে না,নানান আরামের রসে সেটা ভিজা।

বড় যুদ্ধের ভেতরে যে ছোট ছোট গোষ্ঠীগত যুদ্ধ চলে তার চরিত্র নিরূপণ এবং তাতে কার কী ভূমিকা তা সনাক্ত করা ছাড়া তাই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কী থেকে কী হয়ে গেল তার কার্যকারণ নিরূপন সম্ভব না। তাই ১৬ ডিসেম্বর একইসঙ্গে জয়-পরাজয়ের দিন। আমরা জয়ী হলাম, কিনতু জনগণের বড় অংশের শরিকানা ছিনতাই হয়ে গেল। বিপ্লব সম্পর্কে বলা হয় যে, তা প্রথমেই তার সন্তানদের খায়। সিরাজ শিকদার, কর্নেল তাহের নিহত হলেন, জাসদের গণবিপ্লবে অনেক তরুণ মুক্তিযোব্দার অকাল মৃত্যু ঘটলো। রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন নিহত হলেন। সবই কিনতু হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার ভেতর থেকে,বাইরের বিদ্রোহ বা আক্রমণে নয়। এটা একটা দিক। অন্য দিকে,লড়াই ও ত্যাগের অগ্রভাগের শ্রেণীটিকে পিছু হঠানো হল। পরবর্তী শাসকেরা চেষ্টা করেছে গরিব জনগোষ্ঠীর শ্রেণীগত পরাজয়ের এই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেয়ার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষপূজক এবং জাতীয়তাবাদী মহাত্মনেরাই এ ব্যাপারে শিরোমণি। বঞ্চিত জনগণকে যদি তাদের পরাজয়ের স্মৃতি ও জ্বালা ভুলিয়ে দেয়া যায়, তবে তারা কখনোই ক্ষমতা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে মাথা তুলবে না। গণহত্যার বিচার না হওয়ার সঙ্গে এই ভুলিয়ে দেয়ার রাজনীতির সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশে ’৭১-এর গণহত্যার বিচারের দাবি যদি কখনো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, যদি সত্যিসত্যি গণশত্রুদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়, তবে রাষ্ট্র ও সমাজের কোটরে বেড়ে ওঠা গোটা বিষবৃক্ষের ঝাড়ই আক্রান্ত হবে। যে রাজনীতির গাফিলতিতে ঘাতকেরা রক্ষা পেয়েছে ও পাচ্ছে, গণরোষের তীরের নিশানা থেকে তারাও রেহাই পাবেন না। অতীতের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে অতীতের সমস্যার নিদান যদি যদি অতীতে না করা হয় তবে তা ফিরে ফিরে আসবেই। ক্ষত যদি না শুকায় তবে তা বারবার ব্যথা জাগাবেই। যতদিন না যার যা প্রাপ্য তা তাকে দেয়া হচ্ছে,ততদিন সেই কর্তব্য আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। এখন তাই একাত্তরের দুটো সম্ভাবনা। এক. একাত্তরের বিজয়কে পরাজয়ে পরিণত করা এবং দুই. অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করে জনগণের মুক্তি ঘটানো।

কিনতু আমরা বীরদের কথা শুনি,জানি। তারা এখন জাতীয় নায়ক। ১৬ ডিসেম্বর,২৬ মার্চে তাদের কথা বা স্মৃতি শোনার জন্য মিডিয়া কান খাড়া করে রাখে আর জাতি শোনে। তারা গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের মতো নন। সমাজে তারা মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। সবচেয়ে বড় কথা তাদের পেছনে বড় বড় দল আছে। কিনতু এভাবে যে মুক্তিযুদ্ধটা একটা বিশেষ শ্রেণীর হাতে চলে গেল, বাদবাকি লোকজনদের ত্যাগ ও রক্তের ছাপ যে মুছে ফেলা হলো, তার বিচার কে করবে? ইতিহাস? ইতিহাসের বিচার অনেক লম্বা। অনেক সময় লাগে তাতে। অতএব নীরবতাই হীরন্ময়!
এখন একাত্তর যেন তামাদি প্রসঙ্গ। কেবল নির্বাচনের হাওয়া এলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা তোলা হয়। মার্চ বা ডিসেম্বরে সংবাদপত্র এবং দৃশ্যমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্দশার সংবাদ বেশ একটা উপভোগ্য বিষয়ে পরিণত হয়। কেননা, যুদ্ধ শেষ, বিজয় লোপাট কান্না হতাশা বকবল অবশিষ্ঠ। এ ব্যপারে ঠিকা নেওয়া লোক আছে, তাদের কারণেই সেটা একটা করুণ রস উপভোগের বিষয় হয়ে ওঠে। এ জন্যই ‘সিরাজউদ্দৌলা’ যাত্রা বা ‘বেদের মেয়ে জ্যোছনার’ করুণ কাহিনী জনপ্রিয় হয়। যে সিনেমা যতবেশি দর্শকের যত ফোঁটা বেশি চোখের জল ফেলাতে পারে সেই সিনেমা তত বাজার পায়। মাঝে মাঝে জাতীয়তাবাদী মেকি ঘৃণার হুম-হাম ধ্বনিও তোলা হয়। কিনতু তার সঙ্গে স্বজন হারানোদের হুতাশনের কোনো সম্পর্ক নাই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-সংগ্রামের করুণ কাহিনীর যে কদর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তার কারণও কি এই করুণ রসের মানসিক অর্থনীতি? মঞ্চে বা ছাপা কাগজে আর টিভির পর্দায় এত যে অশ্রুবর্ষণ, তা কি তবে জনতোষণের নতুন ফন্দি? জনগণের আবেগকে কাজে লাগাবার মোহনীয় আয়োজন? হতে পারে কিনতু।

মধুমিতা ছদ্মনামের এক মেয়ের কথা দিয়ে শেষ করি। সে যশোরের মেয়ে। রাজাকারের তাদের বাড়ীতে আসে। সে পালায় কিনতু, ছোট ভাই ধরা পড়ায় সে ফিরে আসে। তখন তারা তাকে পায়। মধুমিতার জবানীতে :তাদের কাজ হয়ে যাবার পর তারা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে গেল। কিনতু আমি তো আমার ভাইটিকে মরতে দিতে পারি না। তাই অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও নিজেকে কোনো মতে তুলে ভাইকে দরজা ভাঙায় সাহায্য করলাম। তা করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে পুড়ে গেলাম। সেই রাতে লুকিয়ে থাকলাম বাড়ির পেছনের পুকুরটাতে। পরদিন ভোরে যখন পুকুর থেকে উঠলাম,আমার গায়ের মাংস খাবলা খাবলা করে খসে পড়তে লাগল। দু’একটা টুকরা ছাড়া গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম,গাঁয়ের কিছু লোক ভোরের নামাজ পড়ে ফিরছে। আমাকে দেখে তারা মজা পেয়ে হৈহৈ করে উঠল। আমি তাদের বলার চেষ্টা করলাম,‘আমি বেশ্যা নই, ওমুক আমার বাবা, আমাকে সাহায্য করুন।’ কিনতু তারা চলে গেল। সেদিন থেকে আমি জ্যান্ত মরা। আমার শরীরে যন্ত্রণা। আজ আমার কোনো স্থান কোনো মর্যাদা নেই। ভাইয়ের জন্য আমার জীবন,সম্ভ্রম সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছি। অথচ আমি এখন তার চাকরের থেকে বেশি কিছু না। এই-ই বাংলাদেশে মেয়েদের কপাল।’’(সাইকিয়া, ২৮৬, হিস্টরি ওয়ার্কসপ জার্নাল)
কণ্ঠ আরো অনেক বাংলাদেশি মেয়ের মতো। সেই কণ্ঠ নির্যাতিতের কণ্ঠ। যোদ্ধা হওয়া বা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের গর্বের সঙ্গেই জড়িত হয়ে আছে তার সর্বনাশের ইতিহাস। পরিবারের ধর্ম এবং রাজনীতিই তাদের ‘শত্রুশরীরে’পরিণত করেছে। পাকিস্তানি সৈন্য,বাঙালি রাজাকার এবং বিহারিরা দেশ ও জাতির নামে তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ফেলে গেছে পুড়ে মরার জন্য। যখন সে পুকুর থেকে উঠে এলো, তখন তার গায়ের পোড়া মাংসের ঘ্রাণ কি আমাদের নাকে লেগেছিল? কিংবা তার যন্ত্রণা কি আমরা টের পেয়েছিলাম? আমরা তাকে ফেলে এসেছি দূর অতীতে,কখনোই না ফুরানো একাকীত্বের মধ্যে,যেখানে সে কিংবা আরো অসংখ্য বিধবা,পঙ্গু,পরাস্থ যোদ্ধার স্মৃতি,ভয়,উদ্বেগ অথবা আশার কোনো অংশীদার নেই।

কোনো মুক্তির যুদ্ধই তাদের আর মুক্ত করতে পারবে না, কেবল অপরাধীদের শাস্তি ছাড়া। সেইটুকু সান্তনার যোগ্যতা আজো বাংলাদেশের নাই। মুক্তি নিজে যতক্ষণ না মুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ তার অপরকে মুক্ত করার ক্ষমতা নাই।


মন্তব্য

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

দুঃখিত, টের পাওয়ার আগেই বড় হয়ে গেল

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

তারেক এর ছবি

গোটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দিগম্বর করে রেখে তারা একাই স্বাধীনতার সুখ ভোগ করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই, কোনো খামতি নেই। রাষ্ট্র ও সমাজকে দুইয়ে, চুষে, চিবিয়ে ছোবড়া করে করেই তাদের নির্লজ্জ প্রতিষ্ঠা। এরা যেমন এদের রাজনীতিটাও তেমন। দক্ষ বিউটিশিয়ানের মতো এরা স্বাধীনতার দেহ থেকে ৩০ লাখ মানুষের রক্তদাগ মুছে ফেলতে পেরেছে, শারীরীক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হওয়া লাখ-লাখ নারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে চেপে যাওয়া হয়েছে। লুকিয়ে ফেলা হয়েছে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের ধর্ষণের ফসল যুদ্ধশিশুদের অস্তিত্ব। সেইসব মা ও তাদের সন্ত্নদের পরিণতির কোনো খোঁজ কি আমরা রেখেছি?

লেখাটা আমার দু'গালে চড় দিয়ে গেল।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

তারেক এর ছবি

গোটা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দিগম্বর করে রেখে তারা একাই স্বাধীনতার সুখ ভোগ করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই, কোনো খামতি নেই। রাষ্ট্র ও সমাজকে দুইয়ে, চুষে, চিবিয়ে ছোবড়া করে করেই তাদের নির্লজ্জ প্রতিষ্ঠা। এরা যেমন এদের রাজনীতিটাও তেমন। দক্ষ বিউটিশিয়ানের মতো এরা স্বাধীনতার দেহ থেকে ৩০ লাখ মানুষের রক্তদাগ মুছে ফেলতে পেরেছে, শারীরীক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হওয়া লাখ-লাখ নারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে চেপে যাওয়া হয়েছে। লুকিয়ে ফেলা হয়েছে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের ধর্ষণের ফসল যুদ্ধশিশুদের অস্তিত্ব। সেইসব মা ও তাদের সন্ত্নদের পরিণতির কোনো খোঁজ কি আমরা রেখেছি?

লেখাটা আমার দু'গালে চড় দিয়ে গেল।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অমিত এর ছবি

মন্তব্য করতে যেয়ে আটকে গেলাম। কিছুই বলার নেই।

নজমুল আলবাব এর ছবি
প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আমরা ভুলে যাই আমাদের কাঁধে ৩০ লাখ লাশের ভার।

ঠিক। কিছুই বলার নেই।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

চমৎকার লেখা।

অতিথি লেখক এর ছবি

"গত কয়েকশ বছরে বাংলা দিয়েছে যত পেয়েছে অনেক কম। কেবল বাংলা বললে হয় না, পূর্ব বাংলা বললে তবে সহি-শুদ্ধ হয়। দুনিয়ার মধ্যে এমন জাতি নাই, যাদের ওপর অল্পতম সময়ে এরকম সর্বোচ্চতম গণহত্যা হয়েছে। "

সহমত। কিন্তু আপনার ইতিহাস পরিক্রমায় ১৯৪৭ বা দেশভাগের ক্ষতিগ্রস্থদের উল্লেখ নেই কেন? আমরা কি দেশভাগের ইতিহাস ভুলে যাচ্ছি?

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

মোল্লার দৌড়ের সীমাটা ঠিক করে দিলেন? যাহোক, আমার আওতা ছিল ১৯৭১-এর যুদ্ধ ও গণহত্যা। ৪৭-কে যে কারণে আপনি স্বাধীনতা না বলে দেশভাগ বললেন, ঠিক সে সেখানেই ১৯৭১ আর ১৯৪৭-এর প্রভেদ। আর লোকক্ষয়ের বিচারেও '৪৭ ও '৭১ তুলনীয় নয়। কিনতু এটা ঠিক যে, ১৯৪৭ প্রশ্নের মীমাংসা না করে ১৯৭১-এর পূর্ণ বিচার সম্ভব না।

বহুদিন হলো নিকষ কুঠার ফেলে এসে ভুলে
দাঁড়িয়েছি আজ মেঘের কিনারে এসে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

১৯৪৭ এ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই খন্ডিত হয়েছে দেশভাগের মাধ্যমে। সেখানে জনগন পুরোপুরি পরাজিত। ১৯৭১ এ জনগন লড়াই করেছে সরাসরি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পতন বাদে বাকি অর্জনটুকু লুঠ হয়েছে।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

হাসান মোরশেদ এর ছবি

-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ইরতেজা এর ছবি

কি সুন্দর ঝরঝরে সাবলীল লিখা। ভাই আপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম। অনেক কিছু জানলাম। পছন্দের পোস্টে যুক্ত করলাম।

_____________________________
টুইটার

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

আমরা সবই ভুলে যাই।
ইচ্ছে করে ভুলি,ঠেকায় পরে ভুলি,ভুল করে ভুলি।
ভুলতে ভুলতে মূলটাই আজ খুঁজে পাই না আর।
এই ভুলের সমাধিতে তাই ফুল দিয়ে পরিহাস করে যায় ওরা।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

তাই-কি হওয়ার কথা নয়? একাত্তর প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের মেকি বিতর্কের বাইরে এসে একাত্তরের রাজনৈতিক পাঠ যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ তো একাত্তর এক রোমান্টিক ভাবালুতার ব্যাপার। ইহুদিরা কি হলোকস্ট-এর ব্যথা ভূলেছে? জার্মানরা কি নাত্সীবাদের বিচার করে নাই? আমরা আমাদের ভূমিকা ঠিক না করেই, নিজেদের দেশপ্রেমিক রাজনীতির ইমান স্পষ্ট না করে আশা করি যে,জামাতিরা বলবে আমরা মানুষ মেরেছি;আমাদের বিচার করো। তারা কিনতু গণহত্যার দায় অস্বীকার করলেও একাত্তরে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করে না। সেই ভূমিকার রাজনীতি কেন এখনও তরুণদের একটা অংশকে টানে,তার খতিয়ানও তাই দরকার। কেবল অন্ধ ঘৃণার ফোয়ারা ছুটিয়ে লাভ কি?
আমরা ভুলি, কারণ আজকের মধ্যবিত্তের কাছে একাত্তর প্রায় অরাজনৈতিক ঘটনা, সেটা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন। তা-ই তো হবে, কারণ আমাদের একাত্তরের বিশ্লেষণ তাদের থেকেই ধার করা, যার ওর নামে ব্যাবসা করে। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা খারাপ হলে একাত্তর নিয়ে ব্যবসা খারাপ হবে না কেন?

--------------------------------
বহুদিন হলো নিকষ কুঠার ফেলে এসে ভুলে
দাঁড়িয়েছি আজ মেঘের কিনারে এসে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

একাত্তরের রাজনৈতিক পাঠ অবশ্যই দরকার।এই পাঠ ছিল না বলেই জাহানারা ইমামের আন্দোলন ব্যার্থ হয়েছিল।
পরিতাপের বিষয়,আমাদের শিক্ষিতজনেরা,বুদ্ধিজীবিগন এইসব গা করেন না।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

আমাদের জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭১-এর পরপরই রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছেন। স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত তাদের চৈতন্য ও কমিটমেন্ট একটা লক্ষ্য পেয়েছিল। যতই সীমাবদ্ধ হোক, জনগণের জন্য তাদের বলার কিছু ছিল। ১৯৭১-এর পর সেই লক্ষ্য সীমিত হয়ে যায় শাসক-ক্ষমতার পদমর্দনে, আর তাদের অগভীর ও অপরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক বোধ তাদের ঠেলে নিয়ে যায় সাম্রাজ্যিক উন্নয়ন ব্যবসার উচ্ছিষ্টভোগে। এদের থেকে আর কিছু পাওয়ার নাই।
..............................
বহুদিন হলো নিকষ কুঠার ফেলে এসে ভুলে
দাঁড়িয়েছি আজ মেঘের কিনারে এসে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ঠিকাছে



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

s-s এর ছবি

১৯৭১-এর নয়টি মাস দিনে গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার করে মানুষ হত্যা চলেছে (১৯৮১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা)।

এই ঘোষণাটি কোথায় পেতে পারি অনলাইনে? এবং মুক্তিযুদ্ধে মৃতের মোট সংখ্যা? আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংখ্যা?
জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।