একটু চিন্তা... একটু টেনশন...

স্বপ্নাহত এর ছবি
লিখেছেন স্বপ্নাহত (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩১/০১/২০০৮ - ১১:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত কয়েকদিন ধরেই বেশ চিন্তায় আছি। ব্যাপারটা এমন না যে জীবনে কোনদিন কোন কিছু নিয়ে চিন্তায় পড়িনাই।কিন্তু এবারের চিন্তার বিষয় নিয়ে একটু ভালই টেনশনে আছি।চোখের সমস্যাটা খুব বেশি করে চোখে পড়ছে কয়েকদিন হ্ল।সূচনাটা মনে হয় শুরু হয়েছিল যেদিন বাসায় প্রথম পিসি এল।।২০০৩ সালের মে মাসের কথা।আমার তখন এস এস সির ছুটি চলছে। ক্যাডেট কলেজে পড়ি দেখে নতুন কলেজে ভর্তি হবার কথা চিন্তা করে রাতের ঘুম হারাম করতে হয়না।অবশ্য কম্পিউটার বাসায় ঢোকার পরে রাত জাগাটা হালাল করে নিয়েছিলাম।যাইহোক যেটা নিয়ে বলছিলাম।আমারতো তখন ছুটি চলছে।তিন মাসের নামে লেজ ছাড়া বান্দর।সারাদিন কোন কাম কাজ নাই। ফ্রেন্ডগো লগে পই পই করে ঘুরে বেড়াই।আর পাড়ার এক মেসে কয়েক ফ্রেন্ড মিলে নতুন শেখা কলব্রীজ আর টুয়েন্টি নাইন এর আসর জমাই।তাসের নেশা কেমন সেটা পেশাদার তাসাড়ুদের বলে বোঝানোর কিছু নাই।সেই ঝুকি নিচ্ছিওনা।কয়েকদিনের মধ্যে অবস্থা এমন দাড়ালো বাসার চেয়ে মেসেই বেশি সময় পড়ে থাকি।মেসের মালিক ক্যামনে ক্যামনে জানি টের পেয়ে গেল কাহিনী।ফলে ঐ ঘাটিতে আর বেশিদূর শেকড় ফেলা গেলনা।সবাই এরপর নতুন একটা জায়গা খুঁজতে লাগলাম।যেখানে থাকি সেটাতো আর ঢাকা শহর না যে পাশের ফ্ল্যাটের মানুষের সাথে ফার্মগেট দেখা হলে কষ্ট করে মনে করতে হয় আগে কোথায় যেন দেখেছি।টাংগাইলে যেখানে থাকি একেবারে খাস আবাসিক এলাকা।বাসা থেকে এক মাইল দূরে সিগারেটের ধোয়া কেউ ঠোটে দেখলে চোখের পলকে সেটা আগুন সহ বাসায় পৌছে যায়।নতুন জায়গা পাওয়া তাই যতটা সহজ ভাবছেন ততটা ছিলনা।এমন যখন অবস্থা আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল এর কয়েকজন পাশের পাড়ায় রীতিমত একটা মেস রুম ভাড়া নেবার কথা ভাবতে লাগলো। সাধে কি আর কয় শখের তোলা আশি টাকা।

ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত মনে হয় কয়েক লাইন বেশিই গেয়ে ফেলা হল।এতকিছু বলা শুধু একটা কারণেই।তাস খেলার এই কাহিনী আব্বার কান পর্যন্ত পৌছায়নি ঠিকই। কিন্তু চোখের সামনে একজন নতুন ভ্যাগাবন্ড এর উত্থান পর্ব দেখার ইচ্ছেও বোধহয় তার হয়নি।ফলাফল মধ্যবিত্তের একমাত্র অবলম্বন ব্যাঙ্কে জমানো কষ্টার্জিত টাকার সিংহভাগ খরচ করে আমার জন্য একটা পিসি কিনে দেয়া। বেশিরভাগ সময় এম এস ওয়ার্ডে ASDFG টিপে টিপে আর কদাচিৎ dx ball খেলে যদি তাও ছেলের অবসর সময়ের একটা সুগতি হয়।কিন্তু পরে দেখা গেল ব্যাপারটা হল ঠিক উলটো।সারাদিন NFS আর ডিএক্স বল খেলি আর আব্বা রুমে আসলে এম এস ওয়ার্ড খুলে হেভী মনযোগ দিয়ে কী বোর্ড এ ছোট খাট টাইপিং ঝড় তোলার চেষ্টা করি।

বাসায় পিসি আসার প্রথম দিনটার কথা এখনো গতকালকের মতই উজ্জ্বল।
যেদিন সন্ধ্যাবেলায় বাসায় পিসির বাক্সগুলো আমার রুমে ঢুকলো এখনো মনে পড়ে কেমন চকচকে চোখে বাক্সগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম।সেই থেকে শুরু।নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন মনিটর এর সামনে বসে থাকি।নতুন পিসি ব্যাবহারকারী সবারই বোধহয় এরকম হয়।ক্লান্তিহীন ভাবে a quick brown fox jumped over the lazy dog লিখতেও তেমন বিরক্ত লাগেনা।এখন নেট না থাকলে একদিনের জন্যও পিসির সামনে বসা হয়না।অথচ তখন কী মুগ্ধতা নিয়ে সারাক্ষণ আঠার মত লেগে থাকতাম ভাবতে গেলে এখন নিজেই অবাক হই।পুরো ছুটিটা এভাবেই গেল।রুম ভাড়া নেয়ার কথা এই কয়দিনের মধ্যে বেমালুম ভুলে গেলাম।আস্তে আস্তে সে প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল আমার মত কিছু বেরসিক পোলাপানের কারণে।আব্বাও নিশ্চিন্ত মনে বারান্দায় বসে পেপার এর পাতা ওল্টান।যাক,ঘরের ছেলে আজকাল ঘরেই থাকছে বেশির ভাগ সময়।ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।

কলেজে ক্লাস শুরু হয়ে গেলে সেভাবে তো কম্পিউটার ব্যবহার করার কোন অবকাশ নেই।দুই মাস পর পর ছুটিতে এলে শুধু ডাস্ট কভারের ধুলো ঝাড়া দিয়ে আমার পিসি আবার সচল হয়।আর বাকি সময় বেকার হয়ে ঘরের এককোণার শোভা বাড়িয়ে রাখে।দেখতে দেখতে এক সময় কলেজ লাইফও শেষ হয়ে গেল।অবশেষে দীর্ঘ ছয় বছরের সংসার ছাড়লাম।এরপর থেকেই পিসির সাথে নতুন এফেয়ার দিনকে দিন আরো চাঙ্গা হতে লাগলো।

নতুন বউও চোখের সামনে দিয়ে এক সময় পুরনো হয়।আমার কেস হল উলটা। যতদিন যেতে লাগলো চারকোনা বাক্সটার প্রতি ততই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম।আই ইউ টি তে এসে ইন্টারনেট জিনিসটার সাথে মোলাকাত ঘটলো। আর যায় কই।দিন নাই রাত নাই নেটে পড়ে থাকি।প্রথম দিকে চ্যাটিং করতাম না।আসলে চ্যাটিং ব্যাপারটা কি সেটাই ধারণায় ছিল না। এক বন্ধুর কল্যাণে ধারণা হ্ল ।বিনিময়ে ঐ মাসে নেটের বিল আসলো বারোশ টাকা।আই ইউ টি যত পকেট এলাউন্স দেয় তার অর্ধেকই নেটের পেটে যায়।এতগুলা টাকার শোকে বুকে বড় জ্বালা হয়।কিন্তু মনের ক্ষুধার কাছে সেটা তেমন একটা বেইল পায়না।ক্লাস আর ক্লাস টেস্ট দুইটাই মাসুদ রানার মত কানের পাশ দিয়ে শিষ কেটে যেতে লাগলো।সেমিস্টার ফাইনালের ফলাফল এক্সাম হলে বসেই বুঝে গেলাম কি হতে যাচ্ছে।আব্বার মুখটা মনে পড়ে। ভ্যাগাবন্ড হিসেবে আমাকে দেখতে চাননি।ফেইল করা বি এস সি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখাও মনে হয় না সইবে।
মনে মনে কান ধরলাম নেক্সট সেমিস্টার থেকে আর ইন্টারনেট সেন্টার মুখো হবোনা।কান ধরার স্থায়ীত্ব সেমিস্টার শুরু হওয়ার আগ পর্যন্তই।প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গার লিস্টিটা খালি আরেকটু বড় হয়।
নতুন সেমিস্টার এ আবার নতুন উদ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করলাম...
দিন গুলো খারাপ যাইতেসিলনা।ক্লাসটাইম এর বাইরের সময়টুকু ঘুমাই,ক্লাস টাইমের সময়টুকুও ঘুমাই।আর যতক্ষণ জাগি নেটে দৌড়াদৌড়ি করি (বিচরণ বললে একটু কম কম শোনা যায়)।তখন দেখে কে বলবে যে আমার আইলসামির উপরে একটা অনারারি পিএইচডি ডিগ্রী আছে।
এভাবেই চলতে থাকলে এই পর্যায়ে এসে চোখ খুলেই বলা যেত তাহার নেট সংসার সুখে শান্তিতেই চলিতে লাগিল।কিন্তু কিসের কি।নাচা গানা ছাড়া হিন্দি বই আর ঝামেলা ছাড়া আমি- ঠিক মানায় না।লাস্ট ছুটিতে হঠাৎ একসকালে পিসির সামনে বসে ব্যাপারটা প্রথম আবিস্কার করলাম।চোখ কেমন জানি জ্বালা করে।মনে হয় মরিচ বাটা জোর করে চেপে ধরছে কেউ।আর মাথা থাকলে নাকি মাথা ব্যাথা হয়।সো সেটাও হতে লাগলো।প্রথমে ভাবলাম হয়তো বেশি রাত জাগার ফল।আসল কাহিনী বুঝলাম আরেকটু দেরিতে।অবশ্য দেরিতে বোঝাও আমার জন্য তেমন কাহিনী না।কোন জিনিস আগে আগে বুঝলেই বরং বিস্মিত হই।ব্যাপারটা শেষমেষ বুঝলাম... এবং চিন্তা শুরু হল তখন থেকেই...

আজকালকার দিনে চার চোখ নিয়ে ঘোরা কোন ঘটনাই না।আশেপাশে তাকালে বিএ পাস বেকার এর
চেয়ে বরং চারচোখা মানুষ এর সংখ্যাই বেশি ।তারপরও...
চশমা জিনিসটার প্রতি ছোট বেলা থেকেই একটা এলার্জি আছে।নাকের ডগায় সারাক্ষণের জন্য গোল গোল দুটো লেন্স ঝুলে থাকা আর পশ্চাৎদেশ থেকে একটা ল্যাজ ঝুলে থাকা- এই দুই ব্যাপারই আমার কাছে সমান মনে হয়।

এখন যাই দেখি কেমন জানি খুঁতখুঁত করে মন... মায়ের হাতের বালাটার রঙ আগের চেয়ে ক্ষয়ে গেছে নাকি আমিই ঝাপসা দেখছি...
তিন বছরের তুলতুলে ভাগ্নীটা... পেছন থেকে যখন তখন মামা বলে গলা ঝাপটে ধরে...আর দুচোখের পাতায় চুমো ছুইয়ে যায় দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে...এখনতো তাহলে আগে থেকেই চশমা খুলে রাখতে হবে...
ক্লাস ফাইভে থাকতে শখ করে এক বন্ধুর চশমা পড়ে ক্লাসরুমে ঢুকেছিলাম।আমাকে দেখেই মেয়েদের সারি থেকে হাসির হল্লা...হাসিতেই শেষ হলেও হতো...কেউ একজন টিপ্পনি কাটলো...ঈশপের গল্পের বইয়ে আঁকা চশমা পড়া শিয়াল পন্ডিতকেও নাকি আমার চেয়ে সুন্দর দেখা যায়।
ঐদিনই আমার চশমা ফ্যান্টাসির অপঘাতে মৃত্যু।সেই মরা লাশকে টেনেটুনে জ্যান্ত করার কথা ভাবতেই তো চান্দি গরম হইতেসে।

আমি চাই বালা পড়া মায়ের হাতদুটো আমার চোখে আগের মতই সোনা ঝকঝকে থাক...
ভাগ্নীটার চুমু দিতে যেন এক সেকেন্ডও দেরি না করিয়ে দেয় বেয়াদব চশমাটা.... এবং...
"ইউ গট দ্যা লুক" কনটেস্ট এ চশমুদ্দিন শেয়াল পন্ডিতের সাথে আমাকে আর যেন প্রতিযোগিতায় নামতে না হয়...

তাই চিন্তায় আছি... সাথে একটু টেনশনেও আছি...

স্বপ্নাহত


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।