আমাদের কৃষি, আমাদের প্রাণ

দিনমজুর এর ছবি
লিখেছেন দিনমজুর [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/০২/২০০৮ - ৪:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লিখেছেন দিনমজুর

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৬% বাস করে গ্রামাঞ্চলে। আবার গ্রামাঞ্চলের ৯০% মানুষ জীবিকার জন্য সরাসরি কৃষি খাত ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বাধিক কর্মসংস্থানের খাতটি হচ্ছে কৃষি। বিগত ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ি দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৫১.৬৯%-ই হয়েছে কৃষিখাতে এবং মোট দেশজ উতপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান হচ্ছে ২১.৭৭%। সবচেয়ে বড় কথা- দেশের মানুষের অন্ন জোগাতে এই খাতটিই প্রধান ভূমিকা রাখে। তো, বর্তমানে এহেন গুরুত্বপূর্ণ খাতের অবস্থাটি কেমন??

কৃষি খাত অলাভজনক খাত, কৃষকের মাথায় হাতঃ

আমাদের কৃষি, সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে দারুন সংকটে নিমজ্জিত, কিন্তু এই নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা সবচেয়ে কম। সার ও ডিজেল সংকটে কৃষকের আন্দোলনের সময় ব্যতিত এবং সম্প্রতি খাদ্য ঘাটতির সময় ব্যতিত সাধারণত আমরা কৃষি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চাইনি কখনই। অথচ, আমাদের অর্থনীতির প্রাণ এই কৃষি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কৃষকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে- রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে যে উতপাদন করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার উতপাদন খরচ-ই সে তুলতে পারে না। অব্যাহত ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে- ঋণের দায়ে পড়ে, সে শেষ পর্যন্ত তার শেষ অবলম্বন এক টুকরো আবাদী জমি বিক্রি করে সর্বসান্ত হয়ে বেকার হয়ে পড়ে, বাঁচার তাগিদে শহরে পাড়ি জমায়।

নিচের সারণীতে এক পলক চোখ বুলালেই আমরা দেখতে পারবো, কিভাবে ধীরে ধীরে কৃষি একটি অলাভজনক খাতে পরিণত হয়েছে।

সারণী-বিভিন্ন ফসলের প্রাপ্তি/ব্যয় অনুপাত

শস্য/বছর--------১৯৮১/৮২-১৯৮৬/৮৭-১৯৯১/৯২-১৯৯৬/৯৭-২০০১/০২-২০০৫/০৬
আউশ (দেশীয়)--০.৯৬------১.০৪------১.০৯------০.৬৬------০.৭৬------০.৬২
আউশ (উফশী)--১.২৮------১.৩৩------১.৩৬------০.৮২------০.৭৬------০.৮১
আমন (এলটি)---১.৪৯------১.৮৫------১.৪৮------১.০৬------১.০৬------০.৯৬
আমন (এম)-----১.২২------১.৭৯------১.৬৫------১.০৯------১.২৭------০.৯৯
বোরো (এলটি)--১.৪৬------১.১৩------০.৯৮------০.৬৫------০.৮৩------০.৭০
বোরো (এম)-----১.৪৪------১.৬৯------১.৩২------০.৯৮------১.০২------০.৮৯
গম (এম)---------১.৩৩------১.১৪------১.১৬------১.০৯------১.০৪------১.০৭

লাভজনক না হওয়ার কারণগুলোঃ
প্রথমত, ফসল উতপাদন বৃদ্ধির তুলনায় উপকরণ খরচের হার বেড়েছে।
দ্বিতীয়ত, উতপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার হার উপকরণের দাম বাড়ার হারের চেয়ে কম হয়েছে।
তৃতীয়ত, উপকরণ ব্যয় বাড়ার হার অত্যন্ত উচ্চ ও দ্রুত হয়েছে বাজারবিরোধী ততপরতায় (যেমন মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, কালোবাজারি ও মজুদদারি)।
চতুর্থত, কৃষি উদারীকরণের কারণে বাজার এমনভাবে নিয়ন্ত্রণহীন করা হয়েছে যে বাজার থেকে উতপাদকরা কম ও ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ পেয়েছে। যেহেতু বাজারে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেহেতু ব্যবসায়িরা কৃষক তথা উতপাদকের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে পণ্য কিনে নেয়। আর ব্যবসায়িদেরই বাজারে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, যা উতপাদকের নেই।

কৃষিখাতটি এহেন অলাভজনক হওয়ার এই কারণগুলোর আরো গভীরে ঢুকতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। নিচে একে একে সংক্ষেপে সে আলোচনাটি করছিঃ

বিএডিসি'র ভূমিকাঃ সোনালী(!!) অতীতে
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কার্যত এককভাবেই কৃষি উতপাদনের বিভিন্ন উপকরণ যেমন সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচ-যন্ত্রপাতি আমদানি, সংগ্রহ ও বিতরণ-বিপননের কাজগুলো করত। একটা সময়ে ভর্তুকি দিয়ে বিএডিসির মাধ্যমেই এককভাবে সার বিতরণ করা হত। এই ভর্তুকির ব্যবস্থার ফলে ক্ষুদ্র ও গরিব কৃষকদের জন্য কম দামে সার কেনার সুযোগ ছিল। এছাড়াও বিএডিসির তত্ত্বাবধানে সমবায়ভিত্তিক মালিকানা ব্যবস্থায় কৃষকদের পানি-সেচের সুবিধা দেয়া হত। এই ব্যবস্থায় সেচ কার্যক্রমের ব্যয় কম পড়ত বলে দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা সহজেই সুযোগটি নিতে পারত। অন্যদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচের পানি সরবরাহ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের কাজ দেখভাল করত। ব্যবসায়ী-সিণ্ডিকেটের কারণে বাজারে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সেটি এড়াতে বা মোকাবেলায় টিসিবির মাধ্যমে সরকার হস্তক্ষেপ করতে বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারত। এ দেশে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নামের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি খুবই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারত।

কৃষির বিরাষ্ট্রীয়করণ ও উদারীকরণঃ
উপরের চিত্রটি আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেন?
১৯৭১-৭২ অর্থবছরে যেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় কৃষি খাতে সরকারের মূলধনী ব্যয় ছিল ৩১%, সেখানে তা কমতে কমতে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৩%-এরও নিচে নেমে এসেছে। তেমনিভাবে ১৯৯১ সালে যেখানে কৃষি খাতে সরকারের রাজস্ব ব্যয় ছিল ১০%, সেখানে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে তা কমে ১.২%-এ নেমে আসে। এর অর্থ হল, কৃষি খাতে সরকারের ভর্তুকি প্রদান মারাত্মকভাবেই কমেছে। কেন?
কারণ, কৃষির বিরাষ্ট্রীয়করণ ও তথাকথিত উদারীকরণ।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ কৃষি উপকরণ সরবরাহ খাতে উদারীকরণ তথা বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে। এটি করা হয় কৃষিতে বেসরকারিখাতের সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং বহির্বাণিজ্য উদারীকরণ মানে আমদানি পর্যায়ের শুল্ক হ্রাস করার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর চাপে ক্রমান্বয়ে কৃষিখাতে ভর্তুকি হ্রাস ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সেবা সুবিধা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিতে দ্রুততর উদারীকরণ ঘটে।

বিশ্বব্যাংক ১৯৭৯ সালে খাদ্যনীতির ওপর প্রথম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর বছর তিনেক পরে ১৯৮২ সালে 'বাংলাদেশঃ খাদ্যশস্যে স্বয়ম্ভরতা ও ফসলের বৈচিত্র্যকরণ' শীর্ষক দ্বিতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দুটি প্রতিবেদনেই বিশ্বব্যাংক উতপাদন বাড়ানো ও খাদ্যশস্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের ওপর জোর দিয়ে কৃষি উদারীকরণের পরামর্শ দেয়।

'কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি' -স্যাপঃ
এরই মধ্যে অর্থাত আশির দশকের গোড়ার দিকে স্যাপ এর আওতায় বাংলাদেশের কৃষি খাতে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে। এই কর্মসূচির আওতায় বাস্তবায়িত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হচ্ছেঃ

# কৃষিখাতে বিশেষ করে সারে ভর্তুকি হ্রাস/ প্রত্যাহার, সার সরবরাহ- ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ,
# আশির দশকের শেষ নাগাদ বেসরকারিভাবে সেচ যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার,
# ১৯৯৫ সালে বেসরকারি খাতে চালসহ খাদ্যশস্য আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার,
# কৃষি খাতে বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে সার আমদানি, বিক্রয় ও বিতরণ এবং সেচ কার্যক্রম ও বীজ বিতরণের দায়িত্ব ক্রমান্বয়ে সংকোচন,
# আশির দশকেই সরকারিভাবে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন। পল্লী অঞ্চলে রেশন বন্ধ করে খাদ্য নিরাপত্তার নতুন কর্মসূচি কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও ভিজিডি (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) পরিচালনার নীতি গ্রহণ করা হয়।
# ১৯৯২ সালে জাতীয় বীজনীতি প্রবর্তন করে তাতে বীজ উতপাদন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে পাঁচটি শস্য এককভাবে সরকারের হাতেই রেখে দেয়া হয়।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, কৃষি খাতের আয় ও লাভ কমে যাওয়ার বিষয়টি একাধারে জটিল ও বহুমুখী। তবে পুরোটাই বাংলাদেশের সরকারি তথা রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষত গত দেড় দশকে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক কৌশলে ক্রমান্বয়ে কৃষি বিষয়ক সবরকম সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা তুলে নেয়ার কাজ করা হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-যোগানের মিথস্ক্রিয়ায় পণ্য-সামগ্রীর দাম নির্ধারিত হয়, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না, -এসব তত্ত্বকথা বলে বিশ্বব্যাংকের কথিত কাঠামোগত সন্বয় কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন (টিসিবি)সহ প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলায় প্রয়োজনের সময় সরকারের পক্ষে কার্যকরভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সমাধানঃ
সমাধান একটাই। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর কবল থেকে বেরিয়ে স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে তোলা, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় ও বাজেটে কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা প্রধান। ফলে- অতীত সরকারসমূহের ভূমিকা পর্যালোচনা করে, জনগণের উচিত সচেতনা বৃদ্ধি করা- সর্বাত্মক কৃষি আন্দোলনের মাধ্যে সরকারকে বাধ্য করা এবং প্রয়োজনে কৃষি-বিরোধী সরকারসমূহকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে জনগণের প্রকৃত সরকার গঠন করা!!!

দুনিয়াজুড়ে, কৃষকদের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, কৃষকদের মধ্যে দাবিদাওয়া নিয়ে সচেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ আন্দোলন বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-ডব্লিওটিও এর তাঁবেদার সরকারকে উচ্ছেদের আন্দোলনেও গিয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। কেননা, এটাই একমাত্র সমাধান।

সবাইকে ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্রঃ
উন্নয়ন অন্বেষণ এর গবেষণাপত্র এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৬।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

নাস্তিকের ধর্মকথা
-------------------------
গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।