বিরাষ্ট্রীয়করণ, বিদেশী বিনিয়োগ ও আমাদের অর্থনীতি

দিনমজুর এর ছবি
লিখেছেন দিনমজুর [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/১০/২০০৮ - ৯:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক
"অর্থনীতির সহজ পাঠঃ বিষয়- বিদেশি বিনিয়োগ" শীর্ষক পোস্টে বলেছিলাম,
"তথাকথিত উদারনৈতিক অর্থনীতির দেশসমূহের শাসন ব্যবস্থা ‘পাঁচটি সত্য’ এর উপরে নির্ভর করে বিদেশী বিনিয়োগের সন্ধান করেঃ
১। বিদেশী বিনিয়োগ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
২। বিদেশী বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।
৩। বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে উচ্চতর মানের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি এবং বিশ্ব বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জিত হয়।
৪। কেউ তৃতীয় বিশ্বকে বিনিয়োগের জন্য বাধ্য করছে না, তৃতীয় বিশ্বই নিজের প্রয়োজনে এই বিনিয়োগের জন্য আবেদন-নিবেদন করে।
৫। বেসরকারী খাত হচ্ছে উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন স্বরূপ।

তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক-সাহিত্যের এবং সরকার নীতির ৯০% এরও বেশি এই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে পরিচালিত"।

বাংলাদেশও এই দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে নয়। এখানকার সরকারগুলো, বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদেরা, সমস্ত মিডিয়াই বিদেশী বিনিয়োগকে খুব গুরুত্বের চোখে দেখে, বিদেশের টাকা কোন সরকার কতখানি দেশের অর্থনীতিতে লাগাতে পারলো সেটা দিয়েই সেই সরকারের কৃতিত্ব নির্ধারিত হয়। একইভাবে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে একের পর এক বেসরকারীকরণ করাটাও এখানে সরকারের জন্য বিশেষ কৃতিত্বের ও গর্বের। আসলে, বিরাষ্ট্রীয়করণের সাথে বিনিয়োগের একটি যোগসূত্র বিদ্যমান, বিদেশী বিনিয়োগ (একই সাথে দেশী বিনিয়োগ) আকৃষ্ট করতে চাইলে সরকারের জন্য বিরাষ্ট্রীয়করণ অত্যাবশ্যক একটি কাজ। কেননা, বিদেশী বিনিয়োগ যেসব দেশে গেছে, সেসব দেশে বিনিয়োগকারীরা চেয়েছে অবাধ বাণিজ্য, যার পূর্বশর্তই হলো প্রতিযোগিতাহীন একটি পরিবেশ। বিনিয়োগকারীদের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে, সাবসিডি দেয়া প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া সবসময়ই অপছন্দের। তাই তারা চায়, অনেক জোরালো গলায় চায় বিরাষ্ট্রীয়করণ। গত পোস্টে বলেছিলামঃ
পাশ্চাত্যের কর্পোরেশনগুলো যখন প্রোফিটেবিলিটির সংকটে ভোগে, তখন তারা এই সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যায়, পুঁজি নিয়ে বেরিয়ে যায় অন্য দেশে, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে যেখানে শ্রমমূল্য খুবই কম। আর, একাজে পাশ্চাত্য সরকারসমূহকে মোটামুটি তিনটি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়ঃ

১। তৃতীয় বিশ্বকে (প্রাচ্যে ও দক্ষিণের দেশসমূহকে) তাদের বাণিজ্যকে উদার বা মুক্ত করতে বাধ্য করে; এটা করা হয় পাশ্চাত্যের করপোরেশনগুলোর জন্য বাজার তৈরি করার উদ্দেশ্যে। (WTO এর প্রধান ভূমিকা)।
২। পুঁজি প্রবাহকে অবাধ করতে তৃতীয় বিশ্বকে বাধ্য করে, এটা করপোরেশনগুলোর বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করার ও একইসাথে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়। (IMF ও World Bank এর প্রধান ভূমিকা; বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক বিষয় দেখে WTO)।
৩। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের পাবলিক সেক্টরগুলোকে (যেমন- পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এনার্জী প্রভৃতি এবং সরকারী প্রোকিউরমেন্ট) বিরাষ্ট্রীয়করণ ও মুক্ত করতে বাধ্য করে। (WTO এর পক্ষ থেকে GATT এর প্রধান ভূমিকা)”।

এই বাধ্যবাধকতা আমাদের বাংলাদেশেও বিদ্যমান। বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এখানকার সরকারগুলো এক কাঠি উপরে সরেস। রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাল্লা দিয়ে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে, দেয়া হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড এবং ২০০০ সালে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন। প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড ও কমিশনের তৎপরতায় ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৭৪ টি রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে, যার ৫৪ টি সরাসরি টেণ্ডারে বিক্রয় হয়েছে এবং বাকি ২০টি হয়েছে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। এবারে এক নজরে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম দেখা যাকঃ

ক) টেণ্ডারের মাধ্যমে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা এন্টারপ্রাইজসমূহঃ
১। মাদারীপুর টেক্সটাইল মিলস, মাদারীপুর
২। শারমিন টেক্সটাইল মিলস লিঃ, ঢাকা
৩। কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিলস, কিশোরগঞ্জ
৪। জোফাইন ফেব্রিকস লিঃ, ঢাকা
৫। বরিশাল টেক্সটাইল মিলস, বরিশাল
৬। কোহিনুর স্পিনিং মিলস, ঢাকা
৭। বাংলাদেশ সাইকেল ইণ্ডাস্ট্রিজ, ঢাকা
৮। পূর্বাচল জুট ইণ্ডাস্ট্রিজ, যশোর
৯। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ, মুন্সিগঞ্জ
১০। রয়েল টেক্সটাইল, বান্দরবন
১১। আই.কে ইণ্ডাস্ট্রিজ, চট্টগ্রাম
১২। ফিরোজ আটা ডাল মিলস, খুলনা
১৩। জাতীয় বরফ ফ্যাক্টরী, কিশোরগঞ্জ
১৪। বি.জি বাংলা রাইস মিলস, ঠাকুরগাঁও
১৫। ইঞ্জিনীয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, টঙ্গী, গাজীপুর
১৬। ক্যান মেকিং এণ্ড টিন প্রিন্টিং প্ল্যান্ট, চট্টগ্রাম
১৭। জিনাত টেক্সটাইল লিঃ, টঙ্গী, গাজীপুর
১৮। মেঘনা টক্সটাইল মিলস, টঙ্গী, গাজীপুর
১৯। অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস, টঙ্গী, গাজীপুর
২০। মন্নু টেক্সটাইল মিলস, টঙ্গী, গাজীপুর
২১। ফাইন কটন মিলস, টঙ্গী, গাজীপুর
২২। লক্ষীনারায়ন কটন মিলস, নারায়নগঞ্জ
২৩। পাইলন ইণ্ডাস্ট্রিজ লিঃ, চট্টগ্রাম
২৪। কেরিলাইন সিল্ক মিলস, ফৌজদারহাট, চট্টগ্রাম
২৫। ঢাকা কটন মিলস, ঢাকা
২৬। দেশবন্ধু সুগার মিলস, নরসিংদী
২৭। ময়মনসিংহ জুট মিলস লিঃ, ময়মনসিংহ
২৮। নিশাত জুট মিলস লিঃ, টঙ্গী, গাজীপুর
২৯। কর্ণ ফ্লাওয়ার মিলস লিঃ, নারায়নগঞ্জ
৩০। কেবিনেট ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট, দৌলতপুর, খুলনা
৩১। উড ট্রিটিং প্ল্যান্ট, দৌলত পুর, খুলনা
৩২। ম্যানগ্রোভ তানিন প্ল্যান্ট, দৌলতপুর, খুলনা
৩৩। বাংলাদেশ অয়েল মিলস, খুলনা
৩৪। কালিয়াছাপড়া সুগার মিলস লিঃ, কিশোরগঞ্জ
৩৫। ফিশ এক্সপোর্ট, খুলনা
৩৬। বাওয়া জুট মিলস, নারায়নগঞ্জ
৩৭। সার্ভিস ফ্যাসিলিটিস সেন্টার (SFC), সিরাজগঞ্জ
৩৮। নোয়াখালী টেক্সটাইল মিলস, লক্ষীপুর
৩৯। কোহিনুর ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারাস লিঃ, টঙ্গী, গাজীপুর
৪০। নবারুন জুট মিলস, নারায়নগঞ্জ
৪১। সাঙ্গু ভেলী টিম্বার ইণ্ডাস্ট্রিজ, চট্টগ্রাম
৪২। হাফিজ টেক্সটাইল মিলস লিঃ, চট্টগ্রাম
৪৩। ফিশারিজ নেট ফ্যাক্টরী, বিএসসিআইসি আই/এ, অশোকতলা, কুমিল্লা
৪৪। ফিশারিজ নেট ফ্যাক্টরী (মংলা), বিএসসিআইসি আই/এ, অশোকতলা, কুমিল্লা (শুধু মেশিনারি)
৪৫। ফিশারিজ নেট ফ্যাক্টরী, চট্টগ্রাম
৪৬। সিলেট পাল্প এণ্ড পেপার মিলস লিঃ, সুনামগঞ্জ
৪৭। আমিন এজেন্সিজ লিঃ, চট্টগ্রাম
৪৮। কোকিল টেক্সটাইল মিলস লিঃ, ব্রাহ্মনবাড়িয়া
৪৯। ডকিয়ার্ড এণ্ড ইঞ্জিনীয়ারিং ওয়ার্কস, নারায়নগঞ্জ
৫০। দশা এক্সট্রাকশন, চট্রগ্রাম
৫১। বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট, জয়দেবপুর, গাজীপুর
৫২। আশরাফিয়া অয়েল মিলস, খুলনা
৫৩। শতরঞ্জ টেক্সটাইল মিলস, টঙ্গী, গাজীপুর
৫৪। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ, খুলনা

খ) সরকারী শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা এন্টারপ্রাইজ সমূহঃ
১। কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানী, ঢাকা
২। চট্টগ্রাম সিমেন্ট ক্লিংকার কোম্পানী, চট্টগ্রাম
৩। ঈগল বক্স এণ্ড কার্টুন ম্যানুফেকচারিং কোম্পানী, ঢাকা
৪। স্কুইব (বাংলাদেশ) লিঃ, ঢাকা
৫। ঢাকা ভিজিটেবল অয়েল, ঢাকা
৬। বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিঃ, চট্টগ্রাম
৭। সেমেন্স বাংলাদেশ লিঃ, ঢাকা
৮। ভ্যান ওমেরান ট্যাংক টার্মিনাল লিঃ, চট্টগ্রাম
৯। ইন্টারন্যাশনাল অয়েল মিলস লিঃ, চট্টগ্রাম
১০। রেকিট এণ্ড কোলম্যান (বিডি) লিঃ
১১। মেটালেক্স কর্পোরেশন লিঃ
১২। ন্যাশনাল আয়রন এণ্ড স্টীল লিঃ, চট্টগ্রাম
১৩। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ
১৪। ইস্টার্ণ ব্যাংক লিঃ
১৫। ন্যাশনাল ন্যাংক লিঃ
১৬। লিরা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজ, টঙ্গী, গাজীপুর
১৭। বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফেকচারিং লিঃ, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ
১৮। উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরী লিঃ, নারায়নগঞ্জ
১৯। টাইগার ওয়ার (রি-রোলিং) মিলস লিঃ, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ
২০। ইস্টার্ণ ইণ্ডাস্ট্রিজ লিঃ, তেজগাঁ, ঢাকা

মজার ব্যাপার হলো- অব্যাহত লোকসানের জিগির তুলে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা এসব রাষ্ট্রায়াত্ত এন্টারপ্রাইজ সমূহ ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দেয়া হয় নাম মাত্র মূল্যে। পানির দরে এ ৫৪ প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে সরকারী কোষাগারে জমা হয় মাত্র ৭০৭ কোটি টাকা!!! (যুগান্তর- ৯ আগস্ট, ২০০৮)

এবারে আরেকটি তালিকা দেখি, যে তালিকার এন্টারপ্রাইজগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে ঘোষিতঃ
ক) ইস্পাত এবং প্রকৌশলঃ
১। বাংলাদেশ ইস্পাত ইণ্ডাস্ট্রিজ লিঃ, তেজগাঁ, ঢাকা
২। বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট, জয়দেবপুর, গাজীপুর
৩। নারায়নগঞ্জ ডকিয়ার্ড, নারায়নগঞ্জ

খ) এনার্জীঃ POL (পেট্রোলিয়াম, অয়েল এবং লুব্রিক্যান্ট) প্রোডাক্টস এণ্ড ডিস্ট্রিবিউশন
১। পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিঃ
২। যমুনা অয়েল কোম্পানী লিঃ
৩। মেঘনা অয়েল কোম্পানী লিঃ
৪। এল.পি. গ্যাস লিঃ
৫। ইস্টার্ণ লুব্রিক্যান্ট লিঃ
৬। স্ট্যাণ্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানী লিঃ

গ) টেক্সটাইলসঃ
১। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস লিঃ, নারায়নগঞ্জ
২। চিত্তরঞ্জন কটন মিলস লিঃ, গোদনাইল, নারায়নগঞ্জ
৩। চিশতী টেক্সটাইল মিলস লিঃ, দৌলতপুর, কুমিল্লা
৪। কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস, টঙ্গী, গাজীপুর
৫। আহমেদ বাওয়ানি টেক্সটাইল মিলস লিঃ, ডেমরা, ঢাকা
৬। মাগুরা টেক্সটাইল মিলস লিঃ, মাগুরা
৭। দারোয়ানি টেক্সটাইল মিলস লিঃ, দারোয়ানি, নীলফামারী
৮। ওরিয়েন্ট টেক্সটাইল মিলস, মিরেরবাগ, ঢাকা
৯। কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলস লিঃ, কুড়িগ্রাম
১০। রাঙ্গামাটি টেক্সটাইল মিলস লিঃ, রাঙ্গামাটি
১১। সিলেট টেক্সটাইল মিলস লিঃ, ইসলামপুর, সিলেট
১২। ভালিকা উলেন মিলস লিঃ, নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম
১৩। টাঙ্গাইল কটন মিলস, গড়াই, টাঙ্গাইল

ঘ) হ্যাণ্ডলুম
১। হ্যাণ্ডলুম ফ্যাসিলিটিস সেন্টার, রায়পুর, নরসিংদী
২। সার্ভিস ফ্যাসিলিটিস সেন্টার (SFC), টাঙ্গাইল
৩। সার্ভিস ফ্যাসিলিটিস সেন্টার (SFC), বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া
৪। টেক্সটাইল ফ্যাসিলিটিস সেন্টার (TFC), চৌমুহানি, নোয়াখালী

ঙ) সিল্কঃ
১। রাজশাহী রেশম ইণ্ডাস্ট্রি, রাজশাহী
২। ঠাকুরগাঁও রেশম ইণ্ডাস্ট্রি, ঠাকুরগাঁও

চ) অন্যান্য শিল্পঃ
i) রসায়নঃ
১। কর্ণফুলী রেয়ন এণ্ড কেমিক্যালস লিঃ, কাপ্তাই
২। চট্টগ্রাম কেমিকেল কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম
ii) চামড়াঃ
১। ঢাকা লেদার কোম্পানী, নয়াহাট, সাভার, ঢাকা
iii) ব্যাটারীঃ
১। কোহিনুর ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী লিঃ, টঙ্গী, গাজীপুর
iv) মণ্ড, বোর্ড এবং কাগজঃ
১। খুলনা হার্ডবোর্ড মিলস লিঃ, খুলনা
২। নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস লিঃ, পাকশী, পাবনা
৩। সিলেট পাল্প এণ্ড পেপার মিলস লিঃ, সিলেট
৪। খুলনা নিউজপ্রিন্টস মিলস লিঃ, খুলনা

ছ) চিনি এবং খাদ্যঃ
১। আমিন এজেন্সীজ লিঃ, চট্টগ্রাম
২। শেখ মোজতবা এণ্ড কোং
৩। সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিঃ, সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর
৪। রংপুর সুগার মিলস লিঃ, মহিমাগঞ্জ, গাইবান্ধা

জ) উড, টিম্বার এবং বোর্ডঃ
১। চট্টগ্রাম কেবিনেট ম্যানুফেকচারিং ইউনিট, চট্টগ্রাম
২। ঢাকা কেবিনেট ম্যানুফেকচারিং ইউনিট, ঢাকা
৩। খুলনা কেবিনেট ম্যানুফেকচারিং ইউনিট, খুলনা
৪। উড ট্রিটিং ইউনিট, চট্টগ্রাম
৫। উড ট্রিটিং ইউনিট, খুলনা
৬। চট্টগ্রাম বোর্ড মিলস, চট্টগ্রাম
৭। ইস্টার্ণ উড ওয়ার্কস
৮। ফিডকো ফার্ণিচার কমপ্লেক্স
৯। কর্ণফুলী টিম্বার এক্সট্রাকশন ইউনিট
১০। ল্যাম্বার প্রোসেসিং কমপ্লেক্স
১১। পার্টিকেল বোর্ড ভিনীয়ারিং প্ল্যান্ট
১২। প্রোকিউরমেন্ট এণ্ড সেলস অরগানাইজেশন
১৩। সাঙ্গু-মাতামহুরি টিম্বার এক্সট্রাকশন ইউনিট
১৪। সাঙ্গু ভ্যালী টিম্বার ইণ্ডাস্ট্রিজ

জ) সিভিল অ্যাভিয়েশন এবং ট্যুরিজমঃ
১। মোটেল লাবনী, কক্সবাজার
২। হোটেল পশুর, মংলা, বাগেরহাট
৩। পর্যটন মোটেল, রংপুর
৪। পর্যটন মোটেল, সিলেট

ঝ)পাটঃ
১। মনোয়ার জুট মিলস লিঃ, নারায়নগঞ্জ
২। স্টার জুট মিলস, চন্দনীমহল, খুলনা
৩। দৌলতপুর জুট মিলস লিঃ, খালিশপুর, খুলনা
৪। নিশাত জুট মিলস লিঃ, টঙ্গী, খুলনা
৫। হাফিজ টেক্সটাইল মিলস লিঃ, চট্টগ্রাম
৬। নবারুন জুট মিলস লিঃ, নারায়নগঞ্জ
৭। বাওয়া জুট মিলস লিঃ, নারায়নগঞ্জ
৮। ময়মনসিংহ জুট মিলস লিঃ, শম্ভুগঞ্জ, ময়মনসিংহ
৯। ইস্টার্ণ জুট মিলস লিঃ, আত্রা, খুলনা
১০। পিপলস জুট মিলস লিঃ, খুলনা

ঞ) চাবাগানঃ
১। পটিয়া চা বাগান, পটিয়া, চট্টগ্রাম
২। বিমলা নগর চা বাগান

ট) ফিন্যান্স এণ্ড ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিটঃ
১। বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (BSRS)

এছাড়া আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারেও সরকারী অনুমোদন পাওয়া গেছে।

এই যে তালিকা, গত ১৫ বছরে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং আগামীতে বিরাষ্ট্রীয়করণ করার জন্য প্রস্তুত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান- এগুলোই আমাদের এককালীন শিল্প। দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা, দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি নির্ভর এসব প্রতিষ্ঠান একসময় আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল, লাখ লাখ মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়েছে। এই তালিকার সাথে যুক্ত করুন আদমজী জুট মিল, মংলা বন্দর সহ বিরাষ্ট্রীয়করণ না করেই শ্রেফ বন্ধ করে দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম।

অথচ উপরের তালিকাটি জ্বল জ্বল করে শোভা পাচ্ছে বিনিয়োগ বোর্ডের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে (www.boi.gov.bd), যে ওয়েব সাইটটি তৈরী করাই হয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশে। যদিও বিরাষ্ট্রীয়করণ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে দাবীকৃত তালিকা থেকে প্রায় বছরের বেশী সময় ধরে কোন প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়নি এবং এর কারণে উদারনৈতিক অর্থনীতিবেদেরা-বিনিয়োগকারীরা-মিডিয়া মাঝে মধ্যেই হায়হায় করে উঠছেন; কিন্তু বুঝতে হবে যে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে বা প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে। বিরাষ্ট্রীয়করণের সাধারণ নিয়ম অনুসারে দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত লোকসানের মুখে ঠেলে দিয়ে, তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম করেই টেণ্ডারের মাধ্যমে বা শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এগুলোকে বেসরকারীকরণ করা হয়।

তাইতো গত ৯ আগস্ট, ২০০৮ যুগান্তরের রিপোর্টে বিগত অর্থবছরে একটিও এন্টারপ্রাইজ বিরাষ্ট্রীয়করণ না করার জন্য প্রাইভেটাইজেশন কমিশনকে একহাত নেয়া হলো। ১৬,৭৪৯ কোটি টাকা লোকসানের গান শোনালো হলো! এই লোকসানের গানই হলো বিরাষ্ট্রীয়করণ করার উপযোগী পরিবেশ তৈরীর অপর নাম। অথচ সেই রিপোর্টে ঘুনাক্ষরেই আসেনা এই লোকসানের প্রকৃত ইতিহাস, প্রকৃত কারণ। তেমনি আসেনা এর মধ্যেই বন্ধ করে দেয়া, মুখ থুবড়ে পড়া এন্টারপ্রাইজের কথা। ২৬ টি কোম্পানী অচিরেই বিরাষ্ট্রীয়করণ করার সরকারী পরিকল্পনায় উল্টো হতাশাই ব্যক্ত হয়। হতাশা একারণে যে এই ধীর গতিতে বেসরকারীকরণ করলে নাকি অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে যাবে সমস্ত এন্টারপ্রাইজ বিরাষ্ট্রীয়করণ করতে!!

অথচ এসময়কালে খুলনার খালিশপুরে অবস্থিত পিপলস জুট মিল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জুট মিল ও ফোরাত-কর্ণফুলী কার্পেট ফ্যাক্টরি, সিরাজগঞ্জের কওমি জুট মিল সহ অনেকগুলো শিল্প বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, অর্থাভাবে বাকিগুলোও ধুঁকছে। এগুলোর হাজার হাজার শ্রমিকের কান্না শোনার মত কেউ নেই- শোনানোর মত কেউ নেই! কেউ জানে না এই কারখানাগুলো কবে খুলবে!

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তালিকার শিল্পগুলো বাদে আমাদের আর কি অবশিষ্ট থাকে? আমাদের শিল্প গুলো ধংস করে, আমরা কি গড়ে তুলেছি? আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কি তাহলে?

দুই
পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি, কিভাবে বেসরকারীকরণের নামে আমাদের শিল্পগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এটাকে “ধ্বংস” বলাটাই উত্তম, কেননা আজ পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ৬০% এর অধিকই অস্তিত্বহীন এবং বাকি ৪০% রুগ্ন (“বিদ্যমান ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন”- জানে আলম, সহ সভাপতি- বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ফেডারেশন)! সুতরাং, বিরাষ্ট্রীয়করণের ফল তাই এখানে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানার হস্তান্তরই নয়- একটি জ্বলজ্যান্ত প্রতিষ্ঠানের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।

আবারো বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটের (http://www.boi.gov.bd/) কাছে ধর্না দেই। তাদের শোনানো সাফল্য গাঁথা শুনি, তাদের দেখানো সম্ভাবনাময় খাতগুলো দেখি। ওয়েব পেজের শুরুতেই দেখা যায় ইউকে রিসার্চ ফার্ম কর্তৃক বাংলাদেশকে one of ‘hottest’ emerging markets হিসাবে চিহ্নিত করার খবর। আমাদের দেশ- বাংলাদেশ one of ‘hottest’ emerging markets! Investor Chronicle নামের ইউকে বেসড এই রিসার্চ অরগানাইজেশনটির সার্টিফিকেট, সাথে ইউএসএ বেসড বিনিয়োগ ব্যাংক JP Morgan and Goldman Sachs এরও সার্টিফিকেট দেখে বাঙালি আনন্দে আত্মহারা হবে এটাই স্বাভাবিক। Investor Chronicleএর তালিকায় পাকিস্তান, ইউক্রেন, কাজাখাস্তান, মিশর, নাইজেরিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে বাংলাদেশকেও হটেস্ট এমার্জিং মার্কেট হিসাবে “মর্যাদা” দেয়া হয়েছে। আর JP Mor gan তাদের ‘Frontier Five’ group এর মধ্যে নাইজেরিয়া, কাজাখাস্তান, কেনিয়া এবং ভিয়েতনামের পাশে বাংলাদেশকেও রেখেছে। এ গর্বের কথাতো বিনিয়োগ বোর্ড ফলাও করে প্রচার করবেই! কিন্তু তথাকথিত এই one of ‘hottest’ emerging markets এবং ‘Frontier Five’ group সদস্য আমাদের বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থাটি কেমন তা বুঝতে আমাদের কিছু তথ্য উপাত্তের দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার:

*স্থানীয় বনাম বিদেশী বিনিয়োগের অনুপাতঃ
১৯৮১-৯১=> ৮৮% বনাম ১২%
১৯৯১-২০০১=> ৪২.৫% বনাম ৫৭.৫%

আশির দশকের শেষে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বিপুল হারে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয় এবং বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে দেশের শিল্প নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়, বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে "উদারীকরণ" শিল্প নীতির প্রথম ও প্রধান কথা হয়ে দাঁড়ায়। এরই ফলে ৯০ দশক জুড়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে ছুটেও আসে।

*২০০৩-০৪ এ বিদেশী বিনিয়োগের খাত ওয়ারী ভাগঃ
সেবা=৬১.৪৬%
টেক্সটাইল=১৫.৬৮%
কেমিক্যাল=৬.৮৮%
এগ্রো বেসড=৬.৪৯%
খাদ্য=৩.২৯%
লেদার এণ্ড রাবার=২.৮০%
প্রিন্টিং এণ্ড পাবলিকেশন= ১.৬৪%
প্রকৌশল=১.৪৯%

বিদেশী বিনিয়োগের অধিকাংশটাই হয়েছে সেবা খাতে, যার সরাসরি ক্রেতা হচ্ছে রাষ্ট্র (নিশ্চিত ক্রেতা) নতুবা জনগণ। ফলে, হয় জনগণ আগে যে সেবা নাম মাত্র মূল্যে পেত সেটি এখন চড়া মূল্যে কিনছে অথবা সরকার চড়া মূল্যে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সেবা কিনে লোকসান দিয়ে জনগণকে সাবসিডাইজ সেবা দিচ্ছে। আর উল্টোদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আমাদের কাছে 'সেবা' বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছে!

*বছর ওয়ারি বিদেশী বিনিয়োগঃ (মিলিয়ন ইউএসডি)
২০০৩-০৪=>৪৫৮
২০০২-০৩=>৩৬৮
২০০১-০২=>৩০২
*১৯৯৬-২০০৬ পর্যন্ত বিদেশী বিনিয়োগ=> ৪৪৫৭ মিলিয়ন ইউএসডি
*এসময়কালে মুনাফা, আয়, লভ্যাংশ ও ঋণ পরিশোধ বাবদ নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করেছে=> ৩৬২২ মিলিয়ন ইউএসডি
*২০০১-২০০৫ পর্যন্ত বিনিয়োগ=> ২১৮৫ মিলিয়ন ইউএসডি
*এসময়কালে প্রত্যাবাসন=> ২৭৪৪ মিলিয়ন ইউএসডি

কর্পোরেশনগুলো পুঁজি নিয়ে অন্য দেশে যায় প্রধানত মুনাফার উদ্দেশ্যে। নিজদেশে যখন মুনাফা হারের সংকটে পড়ে তখন পুঁজির বাইরে বের হওয়ার আবশ্যকীয়তা তৈরী হয়। আর, তাই শুরুর দিকে তাদের বিনিয়োগটি অর্থের পরিমাণের দিকে যতই আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন, একটা সময়ে এসে তাদের সেই বিনিয়োগের পরিমাণ আর একই থাকে না। সে সময়ে তাদের রিটার্ণের পরিমাণটি হয় অনেক বড় যেটি অর্থনীতিতে নেগেটিভ ইফেক্টই তৈরী করে।

একইভাবে আমাদের দেশেও যেসব কর্পোরেশন বিদেশী বিনিয়োগের ডালি নিয়ে ছুটে আসছে বা এসেছে, বুঝতে হবে তারা এখানে ব্যবসা করতেই এসেছে, মুনাফাই তাদের উদ্দেশ্য। সেকারণে দেখা যায়, ২০০১-২০০৫ এ এসে বিদেশী বিনিয়োগের চেয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রতাবাসনকৃত অর্থের পরিমাণ বেশী।

এবারে আমাদের দেশটিকে one of the hottest markets বা frontier five group এর অন্যতম সদস্য বানানোর উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও বুঝা যাচ্ছে!

তিন
এর আগে বিরাষ্ট্রীয়করণের কয়েকটি তালিকা দেখেছিলাম, এবং জানিয়েছিলাম যে বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রধানতম ধাপ হলো এগুলোকে লোকসানী প্রতিষ্ঠান বানানো এবং লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যাপক প্রচার দেওয়া। একাজটি প্রতিটি সরকারই খুব ভালো ভাবে করেছে। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে যুক্তি আসে সেগুলো হলো - সরকার এই লোকসানী প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রেখে কি করবে? লোকসানী প্রতিষ্ঠান মাত্রই সরকারের বোঝা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসান সরকারকে টানতে হলে সেই সরকার অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারেনা….. ইত্যাদি। একটু দেখলেই বুঝা যাবে, এসব প্রচারণা আসলে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং প্রচণ্ড ভ্রান্ত।

প্রথম কথা হচ্ছে এসমস্ত প্রতিষ্ঠান বাস্তব গ্রহণযোগ্য কারণে লোকসানী হয়েছে, না-কি এসমস্ত প্রতিষ্ঠানকে লোকসানী প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে? লোকসানের পেছনে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে আছে দুর্নীতি, মাথাভারী ও অদক্ষ ম্যানেজমেন্ট, সিস্টেমের আধুনিকায়ন না করা, অদক্ষ কর্মচারী ও শ্রমিক, আমলাতান্ত্রিকতা ইত্যাদি। এসমস্ত কারণকে সত্য ধরে নিলেও প্রশ্ন আসে- এগুলো দূর করা কি যেত না? তারচেয়েও বড় কথা, এগুলোর জন্য প্রকৃত দায়ী কে বা কারা? সবার প্রথমেই আনা হয় দুর্নীতির কথা, কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে এই দুর্নীতির সাথে প্রতিষ্ঠানগুলোর মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, এমনকি সরকারে অবস্থিত লোকজনই জড়িত ছিল নানাসময়ে। সে দুর্নীতির দায় চাপিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকেই বন্ধ করে দেয়া কি যৌক্তিক?

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক, বাপ-মা সবই রাষ্ট্র তথা সরকার। ফলে সেই প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা, প্রতিযোগিতাশীল বাজারের উপযোগী বানানো, অন্যদেশের প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতায় প্রোটেকশান দেয়া এসমস্ত কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হয়। এটি যদি না করা হয়, তবে সেই প্রতিষ্ঠান কি কোনভাবেই দ্রুত বর্ধনশীল প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে পারবে? আমাদের ক্ষেত্রে সরকার কি সেই ভূমিকা নিয়েছে?

সবচেয়ে বড় কথা এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান তো একসময় লাভজনক ছিল! এখনো এসমস্ত সেক্টরে অমিত সম্ভাবনার কথা সরকারই স্বীকার করছে, যদিও তা প্রাইভেট সেক্টরকে আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে। প্রাইভেট সেক্টরকে আকর্ষণ করার লক্ষে বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়েব সাইটে এ ধরণের প্রচারণার মধ্যে এ কথাও ফলাও করে ঘোষণা করা হয় যে, সে সেক্টরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে বা করা হবে!! কিছু উদাহরণ এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ইস্পাত সেক্টরকে সম্ভাবনাময় খাত হিসাবে দেখাতে গিয়ে ইস্পাত খাতে সাম্প্রতিক বুমিং এর কথা, চাহিদা-যোগান সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে ৮৭ তে নেয়া শিল্প উদারীকরণ সিদ্ধান্তের কথাও। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ বিরাষ্ট্রীয়করণের কথাও সাথে সাথে জানান দেয়া হয়। অথচ, একসময় দেশের চাহিদার একটা অংশ এই চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ মেটাতে পারতো, বাকিটা আমদানি করতে হতো। সে সময়ও তো এই রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত কারখানাটির সামনে অমিত সম্ভাবনা ছিল, বরং বিনিয়োগ বোর্ড আজ প্রাইভেট সেক্টরকে আকৃষ্ট করার জন্য যেসমস্ত সম্ভাবনার কথা বলছে, তার সমস্তটাই সেসময়ে চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ এর জন্য অনেক বেশী করে প্রযোজ্য ছিল। ১৯৮৭ এর পর থেকে আজতক বেসরকারী খাতে ৩০০ এর বেশী ইস্পাত ও ইস্পাত সামগ্রী প্রস্তুতকারক ইউনিট, ৯টি সিআর শিট/কয়েল ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, ২৫০ টি মিল সম্বলিত ৬টি ইস্পাত রি-রোলিং ইউনিট গড়ে উঠেছে, সহজলভ্য পানি ও গ্যাস ব্যবহার প্রতিটিকেই লাভজনক অবস্থায় রেখেছে, এমনকি কোন কোনটি রপ্তানীও শুরু করেছে; তখন কি একবারো মনে হয় না, আমাদের চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ এর পক্ষে কি সম্ভব ছিল না ইস্পাত সেক্টরে লিডিং অবস্থানটি নিতে? আজ টাটা এখানকার সস্তা গ্যাস, পানি, ভূমি, শ্রমের গন্ধে ইস্পাতে বিনিয়োগ করতে আসতে চাইলে, সকলের চোখ চকচক করে ওঠে; জনমত উপেক্ষা করে বারেবারে টাটা গ্রুপের সাথে দরকষাকষি হচ্ছে- অথচ সরকারের পক্ষ থেকে যতখানি সুযোগ সুবিধা প্রস্তাব করা হচ্ছে, ততখানি কি চট্টগ্রাম স্টীল মিলস লিঃ পেতে পারতো না? (টাটা আরো সস্তায় সবকিছু পেতে চায়- সে ভিন্ন প্রসঙ্গ!)

একইভাবে পাটখাতের দিকে তাকাই…….
পাট খাত আজ আমাদের দীর্ঘ হতাশার আরেক নাম। “অর্থকরী ফসল”, “সোনালী আঁশ” খ্যাত পাট ছিল আমাদের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল। পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ সালে প্রথম পাটকল আদমজী জুট মিলে উৎপাদন শুরু হয়, ১৯৫৫ এ আরো ৬টি পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ষাটের দশকে ভারতের সাথে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হলে- সরকার রপ্তানী আয়ের উপর ৩৫% বোনাস ভাউচার নামে ভর্তুকি চালু করে। অর্থাৎ ১০০ টাকা রপ্তানী আয় হলে সরকার ৩৫ টাকা ভর্টুকি দিত, ফলে মোট আয় হত ১৩৫ টাকা। এভাবেই ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ এ পাটকলের সংখ্যা হয় ৭৭টি, আদমজী হয়েছিল বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল, এ কারখানা দিয়েই আদমজী পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শীর্ষে উঠেছিল, এর মুনাফা দিয়েই আরো ১৩টি পাটকল গড়ে তুলেছিল। যদিও পাটকলের মালিক সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী, আমাদের পাটের মুনাফার পুরোটাই চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে- সেই বৈষম্য ভিন্ন ইতিহাস। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে অব্যাহত লুটপাটের মধ্য দিয়ে এহেন পাটখাতকে লোকসানী বানানো হয়েছে। এর পরে চলেছে একের পর ধ্বংস যজ্ঞ।

এই ধ্বংসলীলার সাথে বিশ্বব্যাংকের নাম বিশেষভাবে জড়িত। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক্রমেই প্রথম বেসরকারীকরণ শুরু হয় ১৯৮২ সাল থেকে স্বৈর শাসক এরশাদের আমলে। বন্দুকের নলকে সামনে রেখে ঐ বছর ৩০ নভেম্বর এক দিনে ১০ টি পাটকল বেসরকারীকরণ করা হয়, পরের মাসে আরো ১৩ টি- ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৬৯ টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। সরকার এই মিলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দিয়েছিল মাত্র ১৭৫ কোটি টাকায়। আর মালিকেরা ৩৪ কোটি টাকা পরিশোধ করার পর আজ পর্যন্ত বাকি টাকা পরিশোধ করেনি (যুগান্তর ৬ আগস্ট, ২০০৫)।
১৯৯৪ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সাথে “জুট সেক্টর স্ট্রাকচারাল কন্ট্রাক্ট” স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় আদমজীকে ডাউন সাইজ করার কাজ শুরু হয় অর্থাৎ আদমজীর তাঁত সংখ্যা ৩২৫০ থকে কমিয়ে ১৫০০ টি করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বিক্রি, বন্ধ এবং শ্রমিক ছাটাই সহ পাটখাতকে সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় (যদিও শেষ পর্যন্ত দিয়েছে ৫ কোটি ডলার!!), একই সময়ে ভারতকে পাটশিল্প উন্নয়নের জন্য ইউএনডিপি (জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল) দিয়েছে ২৫ কোটি ডলার। অবশেষে ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে বিএনপি-জামাত সরকার চিরতরে আদমজী বন্ধ করে দেয়, ৩০ হাজার শ্রমিক পথে বসে। অথচ, ২৩০ কোটি টাকা খরচ করলেই আদমজী আধুনিকায়ন করা যেত। বিশ্বে যখন পাটজাত পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, যে সময়ে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানী আগের বছরের তুলনায় বাড়ছে- সেসময়েই পাটকলগুলো একের পর এক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব দেখে কি লোকসানের গল্পটিকে ফাঁপানো মনে হয় না??

পাটকলগুলোকে কি আধুনিকায়ন করা হয়েছিল? অর্ধ শতাব্দীর জীর্ণ-নড়বড়ে তাঁত দিয়েই কেন তাকে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে? ৩২৫০ তাঁত চালানোর উপযোগী মিলে মাত্র ১৫০০ টি তাঁত চালানোয় বাধ্য করা হলো কেন? এসবে যদি লোকসান হয়- সেটিকে কি পরিকল্পিত মনে হয় না?
এরকমই ঘটেছে, এবং ঘটছে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বেলায়। এই লোকসানের সমস্তটাই আরোপিত। শাসকগোষ্ঠী চেয়েছে, তাদের প্রভু দাতাগোষ্ঠী চেয়েছে- এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ুক- ধুকে ধুকে চলুক। এবং সেটাই হয়েছে।
আর সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের কথা- আমরা তাদের প্রচারণায় এমনই বিভ্রান্ত যে, এই প্রতিষ্ঠান গুলোর লোকসানে আমরা যতখানি চিন্তিত-উদ্বিগ্ন, এসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ তথা ধ্বংস করার মাধ্যমে যে লোকসান ঘটেছে- ঘটছে, তার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি!!

চার
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে লালন পালন করতে সরকারের অব্যাহত লোকসানের কথা শুনে আমরা হায়হায় করে উঠি, কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানীকে যখন সরকার কোলে পিঠে নিয়ে আদর-সোহাগ করে তখন সেটা নিয়ে কই কারো তো কোন রা নেই! এবারে এ ধরণের কিছু আদর-সোহাগের নমুনা দেখি। এই আদর সোহাগের কেতাবি নাম হলো “ইনসেনটিভ”। বাংলাদেশ সরকারের দেয়া প্রধান “ইনসেনটিভ”সমূহ নিম্নরূপঃ

১। ট্যাক্স মওকুফঃ ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে বিনিয়োগের জন্য ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজকে ৫ বছর এবং খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহীতে বিনিয়োগের জন্য ৭ বছরের ট্যাক্স মওকুফ করা হবে। পাওয়ার সেক্টরে বিনিয়োগকারী এন্টারপ্রাইজের জন্য এই মওকুফ ১৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। ট্যাক্স মওকুফের বিষয়টি একটি এন্টারপ্রাইজের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে শুরু হবে।
এক্সিলারেটেড ডেপ্রিসিয়েশন এলাউয়েন্সঃ যেসমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স মওকুফ সুবিধার আওতায় আসেনি- তাদের জন্য রয়েছে এক্সিলারেটেড ডেপ্রিসিয়েশন এলাউয়েন্স। যদি শিল্প প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো বা প্ল্যান্ট ঢাকা, খুলনা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম শহরে বা এসব শহর থেকে ১০ কিমি দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত হয়- তবে সেই প্রতিষ্ঠান তার মেশিনারি বা প্ল্যান্টের ১০০% পর্যন্ত, এবং দেশের অন্য যেকোন স্থানে অবস্থিত হলে ৮০% পর্যন্ত এক্সিলারেটেড ডেপ্রিসিয়েশন এলাউয়েন্স পাবে।
২। শুল্কঃ ক্যাপিটাল মেশিনারী এবং স্পেয়ার পার্টস আমদানীর ক্ষেত্রে ১০০% রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আমদানী শুল্ক দিতে হবে না।
৩। কর আইনঃ ক) দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ডাবল ট্যাক্সাশন থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে,
খ) আয়কর অধ্যাদেশের উপযুক্ত শিডিউল অনুযায়ী বিশেষ শিল্প প্রতিষ্ঠানের দক্ষ বিশেষজ্ঞ ৩ বছর পর্যন্ত আয়কর মওকুফ পাবে।
৪। রেমিট্যান্সঃ বিনিয়োগকৃত মূলধন, মুনাফা এবং লভ্যাংশের সম্পূর্ণটাই নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের সুবিধা থাকবে।
৫। মালিকানাঃ বিদেশী বিনিয়োগকারী এদেশে সম্পূর্ণ নিজ মালিকানায় অথবা যৌথ মালিকানায় শিল্প গড়ে তুলতে পারবে।
৬। রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ইনসেনটিভসমূহঃ
ক) ক্যাপিটাল মেশিনারি ও স্পেয়ার পার্টস (ক্যাপিটাল মেশিনারির ১০%) আমদানীর ক্ষেত্রে শুল্ক মুক্ত সুবিধা।
খ) সেলস এগ্রিমেন্টের চুড়ান্ত এবং নিশ্চিত পত্রের বিপরীতে ৯০% পর্যন্ত ঋণ সুবিধা।
গ) দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান আলাদা বিশেষ হারে সুযোগ ও সুবিধা লাভ করবে।
ঘ) নিষিদ্ধ ও রেসট্রিক্টেড কাঁচামাল, যা রপ্তানী পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজন, বিনা বাঁধায় আমদানী সুবিধা।
ঙ)সরকারের “থ্রাস্ট সেক্টর” হিসাবে চিহ্নিত রপ্তানী শিল্প প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে।
চ) হস্ত ও কুটীর শিল্প থেকে রপ্তানী আয়ের পুরোটাই আয়কর মওকুফ পাবে। অন্যান্য শিল্প ৫০% আয়কর মওকুফ সুবিধা পাবে।
ছ) রপ্তানী ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সুবিধা আরো বাড়ানো হবে এবং জোরদার করা হবে।……. প্রভৃতি।
৭। অন্যান্য ইনসেনটিভঃ
ক) বিদেশী ঋণের সুদে কর মওকুফ (শর্ত সাপেক্ষে)।
খ) নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য ৬ মাস মেয়াদী মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা সুবিধা।
গ) নিজ দেশে প্রত্যাবাসনযোগ্য অংশের পুনর্বিনিয়োগ নতুন বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচ্য হবে।
ঘ) ৫০০০০০ ডলার বিনিয়োগ করলে বা কোন প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে ১০,০০,০০০ ডলার ট্রান্সফার করলে (অপ্রত্যাবাসনযোগ্য) নাগরিকত্ব প্রদান।
ঙ) ৭৫,০০০ ডলার বিনয়োগ করলে দেশে স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে গণ্য হবে।

অর্থাৎ আমাদের এ দেশে বিনিয়োগকারীদের নানা মেয়াদে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার আইনি বৈধতা দেয়া হয়েছে! আমাদের এখানে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে মুনাফা হবে তার পুরোটাই এদেশ থেকে প্রত্যাবাসন করার ক্ষেত্রে কোন আইনি বাঁধা নেই, এমনকি বিনিয়োগও যদি তুলে নিয়ে যেতে চায়, সেক্ষেত্রে আমদের বলার কোন উপায় আমরা রাখিনি! আমাদের এখানে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের করা মুনাফার পুনর্বিনিয়োগকে বিনিয়োগ হিসাবেই গণ্য করার বিধান রেখেছি, ফলে তারা এখানকার লোকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করলে সেটাকেও আমরা বিদেশী বিনিয়োগ হিসাবে ঘোষণা করবো, অর্থাৎ আমাদের দেশের টাকাই হয়ে যাবে বিদেশী বিনিয়োগ!! এসবতো গেল কিছু নমুনা ইনসেনটিভ। প্রাইভেট কোম্পানীসমূহের প্রাপ্ত ইনসেনটিভের এই তালিকার বাইরেও নানাবিধ সুবিধা- দেশীয় ও বিদেশী প্রাইভেট কোম্পানী পেয়ে এসেছে, এবং সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এই লোকসানের পরিমাণ বিদেশী কোম্পানীর ক্ষেত্রে আরো অধিক। সরকারের সাথে বিদেশী কোম্পানীর প্রতিটি চুক্তিই হয়েছে দেশের স্বার্থ পরিপন্থী। আমাদের সম্পদ আমরা তাদের তুলে দিয়েছি নাম মাত্র মূল্যে। আমাদের সেবা খাতে বিনিয়োগের নামে উচ্চ মূল্যে তাদের কাছ থেকে আমরা সেবা কিনেছি- সে লোকসানের চরম মূল্য সরাসরি জনগণকে দিতে হয়েছে- হচ্ছে। আর, এ লোকসানের কথা আমরা কেউ বলিনা!!!

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেটে খাওয়া লাখ লাখ শ্রমিকের কথা ভুলে যেতে আমাদের সময় লাগে না। কারখানাগুলো লোকসানী বানানোর মধ্য দিয়ে লক আউট, লে অফ করে শেষ পর্যন্ত সেগুলো চিরতরে বন্ধ করলে যে এইসব শ্রমিকদের পেটে লাথি পড়ে সেটা আমাদের মনে থাকে না!

কারখানাগুলো দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে, সেই কারখানা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমাদের কৃষকদেরও জীবন্ত সম্পর্ক আছে, আরো বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের যোগ আছে- সেটাও আমরা সহজে ভুলে যাই। ঐ কারখানাগুলো এভাবে বন্ধ হয়ে গেলে এ মানুষগুলোরও পেটে লাথি পড়ে তা আমাদের মনে থাকে না। আমাদের যাবতীয় উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা লোকসান নিয়ে! রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ১৬,৭৪৯ কোটি টাকা লোকসানের দুশ্চিন্তায় আমাদের দিবারাত্রির ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের প্রভু বিশ্বব্যাংক, সাম্রাজ্যবাদী বিনিয়োগকারী বন্ধুরা অসন্তুষ্ট ও ভয়ানক রুষ্ট হন যে! আমাদের দেশের সম্মানিত শিল্পপতিরাও হায়হায় করে ওঠেন, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন!

কিন্তু, আমাদের হাজার কোটি মূল্যমানের প্রতিষ্ঠানগুলো পানির দরে বিক্রি করার সময় যে লোকসান হয়, পানির দরটুকুও পুরোটা আদায় না করে যে লোকসান হয়, শিল্প গড়ে তোলার নাম করে ৪৮,০০০ কোটি টাকা সরকার থেকে ঋণ নিয়ে পুরোটা হজম করে ফেললে যে লোকসান হয়, গ্যাস সম্পদ অসম বন্টন চুক্তির মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগকারীর হাতে তুলে দিলে যে লোকসান হয়, আমাদের দুদুটো গ্যাসক্ষেত্র পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেললে যে লোকসান হয়, আমাদের দেশে বিনা ট্যাক্সে ব্যবসা করে গেলে যে লোকসান হয়, আমাদের গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ নাম মাত্র সাবসিডাইজড মূল্যে ওদের হাতে তুলে দিলে যে লোকসান হয়- সেই লোকসানের কথা আমরা যেন জানিই না!!

তখন প্রশ্ন আসে, আমাদের এই রাষ্ট্রটি আসলে কার? কাদের?


মন্তব্য

দিনমজুর এর ছবি

প্রবন্ধটি "নাইল্যাকাডা- ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা"য় প্রকাশিত হয়েছে।

শামীম এর ছবি

আম্মা-আ-আ-আ .... এ্যাত লম্বা পোস্ট! তাহলে আজকে পড়বো না ... কাল সময় নিয়ে পড়বো (শুক্রবার বলে কথা)।

আপনার পোস্ট যতই লম্বা হউক আমি সেগুলো মিস করিনা। হাসি
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

দুর্দান্ত এর ছবি

১। দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা, দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি নির্ভর এসব প্রতিষ্ঠান একসময় আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল, লাখ লাখ মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়েছে।

তেল বিপনন সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে "দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি" এ কথাটা কতটুকু খাটে?
তিন চারটা তেল বিপনন সংস্থা থাকার কোন সুফল তো দেশের মানুষ পাচ্ছে না। তেলের মান, দাম, পরিমান এসবই তো সরকার নিয়ন্ত্রন করে। পেট্রল পাম্পগুলো যদি সরকারি হত, তাহলে ভোক্তার হয়রানি কমত, কিন্তু সেগুলো তো আগে থেকেই বিরাষ্ট্রিকৃত হয়ে আছে। তাহলে মাঝখান থেকে বিপনন সংস্থাগুলোকে সরকারি রাখার যুক্তিটা কি?

২। ২। কিন্তু বুঝতে হবে যে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে বা প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে।
এখানে দুটি উদাহরন বিবেচনা করুন। সাভারের ঢাকা লেদার কম্পানীটি আদতে কখনো চালুই হয়নি। হাজারিবাগের ট্যনারদের ও দেশের বড় কসাইখানাকে সাভারে নিতে না পারলে ঐ কারখানা চালু হলেও বেশিদিন চলত না। আর ন্যশনাল সুগার মিল খাটা পত্রে ১৯৮৩ তে চালু হলেও, অফিস আর আসবাব ছাড়া আর কোন যন্ত্রপাতিই এর জন্য কেনা হ্য়নি।

৩। বিরাষ্ট্রীয়করণের সাধারণ নিয়ম অনুসারে দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত লোকসানের মুখে ঠেলে দিয়ে, তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম করেই টেণ্ডারের মাধ্যমে বা শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এগুলোকে বেসরকারীকরণ করা হয়।

আপনি ধরে নিচ্ছেন যে আমাদের সরকার ও কোন ঔপনিবেশিক শক্তি একটি সুদুরপ্রসারি চিন্তাধারা নিয়ে এগোচ্ছে; লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে আগে কৌশলে লোকশানের দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে। একটি এখানে একটি উদাহরন বিবেচনা করুন ; চিটাগাং বোর্ড ও পার্টিকেল মিলটি (CBPVP) ১৯৮১ সালে পোল্যন্ডের আর্থিক সহায়তায় ও সেই দেশে এই মিলের ৮০% উত্ পাদন রপ্তানী করার আশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বার্লিন দেয়ালের পতনের পর পোল্যান্ড তাদের পূর্বজন্মে করা অনেক প্রতিশ্রুতির মত এটিও বেমালুম ভুলে যায়। তার ওপর নারায়ন গন্জ/মানিকগন্জ ভিত্তিক ও ভিন্ন কাঁচামালের বোর্ড ভোক্তআর কাছে বেশী গ্রহনযোগ্য হওয়ায় ১৯৯৫ সালে CBPVP কে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এখানে কাকে দায়ী করবেন আপনি?

দিনমজুর এর ছবি

১।

তেল বিপনন সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে "দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি" এ কথাটা কতটুকু খাটে?

তেল বিপনন সংস্থাগুলো এবং অন্যান্য সেবাখাতগুলোর ক্ষেত্রে "দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি" কথাটা সরাসরি খাটে না, তবে সেবাখাতগুলো পরোক্ষভাবে যেকোন রাষ্ট্রের শিল্পের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আসলে সেবাখাতগুলোর উপর শিল্প, এমনকি জনগণের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালী সরাসরি নির্ভরশীল। শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা দরকার- সেই পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে সড়ক-নৌ-রেল ব্যবস্থা প্রয়োজন, পরিবহনের জ্বালানীর প্রয়োজন, সেই শিল্প চালনার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি, গ্যাস এসবেরও প্রয়োজন হতে পারে; ফলে এসব কিছুর জন্য সেই শিল্প এ সমস্ত সেবার উপর নির্ভরশীল। এখন এই সেবাগুলো যদি রাষ্ট্র নিজের হাতে না রাখে- সেগুলোর যদি বিরাষ্ট্রীয়করণ ঘটে, এবং সেখানে যদি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ বাণিজ্য ঘটে- তবে এসব সেবার উপর নির্ভরশীল শিল্পসমূহ তখন সরকারের বদলে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে- এভাবে মুনাফার উদ্দেশ্যে ইচ্ছামাফিক সেবার দাম নির্ধারণের সুযোগ তৈরী করে দেয়া হলে শিল্পগুলোকে (সেই সাথে জনগণকেও) সেই সেবা কিনতে হবে উচ্চমূল্যে- ফলে শিল্প সমূহের উৎপাদন খরচ যাবে বেড়ে, এভাবেই শিল্পের উপর সেবাখাতসমূহ সরাসরি প্রভাব রাখে।

তিন চারটা তেল বিপনন সংস্থা থাকার কোন সুফল তো দেশের মানুষ পাচ্ছে না। তেলের মান, দাম, পরিমান এসবই তো সরকার নিয়ন্ত্রন করে। পেট্রল পাম্পগুলো যদি সরকারি হত, তাহলে ভোক্তার হয়রানি কমত, কিন্তু সেগুলো তো আগে থেকেই বিরাষ্ট্রিকৃত হয়ে আছে। তাহলে মাঝখান থেকে বিপনন সংস্থাগুলোকে সরকারি রাখার যুক্তিটা কি?

আগের আলোচনায় হয়তো পরিষ্কার হয়েছে কেন তেল/গ্যাস/বিদ্যুৎ কে পুরোপুরি সরকারের হাতে রাখা দরকার। বিপিসি, বাপেক্স, পেট্রোবাংলা এগুলোর মাধ্যমে সরকার সেই নিয়ন্ত্রণটি বজায় রাখে, ফলে এখন পর্যন্ত তেলের (বা গ্যাসের বা বিদ্যুতের) দাম সরকার নির্ধারণ করতে পারে- সে জায়গাটিতে এদেশের কোন শিল্প বা ভোক্তা জনগণ কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশিল নয় (যদিও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভিন্নদিকে যাচ্ছে)। মাঝে আছে বিপনন- এটাও সরকারী নিয়ন্ত্রণে আছে, বিপনন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে তেল-গ্যাস বিক্রয়ের বড় অংশই এখন সরকারের হাতে নেই। আমার মতে, এই তিনধাপের পুরোটাই সরকারের হাতে থাকা দরকার। এখন তৃতীয় ধাপ (ভোক্তার কাছে বিক্রয়) বিরাষ্ট্রীয়করণ হয়েছে- বলে মাঝের ধাপটিও (বিপনন) বিরাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে- এমন যুক্তিকে সঠিক মনে করি না; বরং এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকেই প্রথম ধাপ (তেল আমদানী- দাম, মান-- নির্ধারণ)সহ বিরাষ্ট্রীয়করণের গন্ধ পাই। তার ফলাফল যে ভয়াবহ হবে আশা করি এ ব্যাপারে একমত হবেন। এখন এটুকুও যদি ধরি, প্রথম ধাপ সরকারের হাতে থাকবে এমন নিশ্চয়তা রেখেই ২য় ধাপটি (বিপনন) বেসরকারীকরণ করা হলে কি হবে?
মাঝের এই ধাপ মানে বিপননটি খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। এটি যখন বেসরকারীখাতে যাবে, যারা এখাতে বিনিয়োগ করবেই মুনাফার উদ্দেশ্য- তখন কি আমরা একই দাম ও মান পাবো? একটা উদাহরণ দেই: আমাদের দেশেই খাদ্যদ্রব্যের যে দামের পার্থক্য উৎপাদনকারী ও ভোক্তার মধ্যে- তার একটা বড় কারণ এই বিপনন। আবুল বারাকাতের হিসাব মতে, উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত আসতে ৮/১০ টি হাত বদলায় এবং এতে কমপক্ষে ৪৫% দাম বাড়ে। এখন হয়তো বলবেন, তৃতীয় ধাপের জন্য সরকার কর্তৃক দাম ফিক্সড থাকলে বিপননের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়াবে কি করে? সেক্ষেত্রে দুটো ঘটনা ঘটবে, এক- বিপনন প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বা কমিশন বাবদ সরকারকে আরো কম দামে তেল বেঁচতে হবে, এর মাধ্যমে সরকারের লোকসান বৃদ্ধি পাবে; এবং দুই- সরকারের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হ্রাস পাবে- কেননা তখন সরকার ৩য় ধাপের সাথে সাথে ২য় ধাপের কাছ থেকেও নানামুখী চাপের সম্মুখীন হবে- তার মধ্যে মূল চাপটি হচ্ছে ভোক্তার কাছে বিক্রিত তেলের দাম বৃদ্ধি ও সরকার তথা বিপিসির কাছ থেকে প্রাপ্ত তেলের দাম হ্রাসের চাপ।

আর, তিন/চারটি বিপনন সংস্থার সুফল কি- এর মাধ্যমে যদি বলতে চান- একাধিক বিপনন সংস্থা থাকার যৌক্তিকতা কি- তবে বলবো- পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মনোপলির চেয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকার কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। তবে একটি প্রতিষ্ঠানকেই যদি সরকার সেভাবে সমস্তদিক থেকে সাফিসিয়েন্ট হিসাবে গড়ে তুলতে পারে- তাতে কোন সমস্যাও থাকার কথা নেই। মূল বিষয়টি হচ্ছে- এখাতকে সরকার নিজের হাতে রাখবে না-কি ছেড়ে দিবে, সেটি।

২।

এখানে দুটি উদাহরন বিবেচনা করুন। সাভারের ঢাকা লেদার কম্পানীটি আদতে কখনো চালুই হয়নি। হাজারিবাগের ট্যনারদের ও দেশের বড় কসাইখানাকে সাভারে নিতে না পারলে ঐ কারখানা চালু হলেও বেশিদিন চলত না। আর ন্যশনাল সুগার মিল খাটা পত্রে ১৯৮৩ তে চালু হলেও, অফিস আর আসবাব ছাড়া আর কোন যন্ত্রপাতিই এর জন্য কেনা হয়নি।

হ্যা, আপনার উদাহরণ দুটির ক্ষেত্রে আমার কথা " এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে বা প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে"- খাটে না, বরং বলতে হবে যে, এ প্রতিষ্ঠান দুটোকে জীবিতই করা হয়নি কখনো, অর্থাৎ এ দুটোকে মৃত হিসাবে প্রসব করা হয়েছিল এবং এখন মৃত প্রতিষ্ঠানদুটোকে কবর দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু এতে কি আমার মূল বক্তব্যের কোন হেরফের কি হচ্ছে?

সাভারে লেদার কমপ্লেক্স তৈরীর দাবি অনেকদিনের এবং এর প্রয়োজনীয়তা এখনো অপরিসীম। সেটা শুধু ঢাকার ভিতর থেকে ট্যানারীবাজার অপসারণের মাধ্যমে ঢাকার পরিবেশকে সুস্থ করার তাগিদে নয়, বরং বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের বিশাল সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই- সাভারে লেদার কমপ্লেক্স গড়ার উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল। এখন, আমরা কোন প্রশ্নটি সামনে আনবো- 'এই কমপ্লেক্স চালু হলো না কেন', সেটা? না-কি 'যেহেতু চালু হয়নি- সেহেতু এটা থাকার যৌক্তিক্তা কি' সেটা??? একটু ভাববেন কি?

আর, ন্যাশনাল সুগার মিলের কথা বললেও একই কথা খাটে। আমাদের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল ছিল আখ, এবং আমাদের চিনি শিল্প আদতেই একসময় ছিল বেশ রমরমা। পাটশিল্প ধংসের সাথে সাথেই আক্রমণ আসে এই চিনি শিল্পে, মূলত অবাধ বা মুক্তবাজার বাণিজ্যের নাম করে। ভারতীয় চিনির সাথে যখন এখানকার ব্যক্তি উদ্যোগগুলো মার খাচ্ছিল, তখন একমাত্র সরকারই পারতো চিনি শিল্পকে রক্ষা করতে। সরকারী উদ্যোগে ও পরিচালনায় চিনি শিল্পকে রক্ষায় ভূমিকা নেয়া কি যেত না? সরকার যে সে ব্যাপারে উদাসীন ছিল তারই নজীর মাত্র এই ন্যাশনাল সুগার মিল। অবশ্য রাষ্ট্রের শিল্প ধ্বংসকারী ভূমিকা আরো আগেই পরিষ্কার হয়ে যায়- যখন বিভিন্ন ধাপে শুল্ক গুলো তুলে নেয় ও কমিয়ে দেয়।

মোটের উপর আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, তা হলো আজ যেসব প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করার কথা উঠেছে, তার একটা বড় অংশই মৃত বা মৃতপ্রায় (আপনার উদাহরণের মত কিছু জন্মমৃত)। এবং এগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণের ক্ষেত্রে এই যুক্তিই সর্বাগ্রে আসে, মৃত/মৃতপ্রায়/জীবন্মৃত এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেখে সরকারের কি লাভ?

৩।

চিটাগাং বোর্ড ও পার্টিকেল মিলটি (CBPVP) ১৯৮১ সালে পোল্যন্ডের আর্থিক সহায়তায় ও সেই দেশে এই মিলের ৮০% উত্ পাদন রপ্তানী করার আশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বার্লিন দেয়ালের পতনের পর পোল্যান্ড তাদের পূর্বজন্মে করা অনেক প্রতিশ্রুতির মত এটিও বেমালুম ভুলে যায়। তার ওপর নারায়ন গন্জ/মানিকগন্জ ভিত্তিক ও ভিন্ন কাঁচামালের বোর্ড ভোক্তআর কাছে বেশী গ্রহনযোগ্য হওয়ায় ১৯৯৫ সালে CBPVP কে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এখানে কাকে দায়ী করবেন আপনি?

যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত, এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব যদি হয় সরকারের; তবে আমি এক্ষেত্রটিতে সরকারকেই দায়ী করবো।
আপনি ঐ প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে সরকারের পরিবর্তে ব্যক্তিমালিকানার কথা চিন্তা করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তি উদ্যোক্তা কি করতো? আপনি যদি মালিক হতেন- আপনি কি করতেন? যাদের কাছে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করার কথা ছিল, তারা যদি আমদানী না করে, তবে আপনি কি নতুন বাজার খুজতেন না? দেশের অভ্যন্তরীন বাজারে কি বোর্ড ও পার্টিকেলের চাহিদা নেই? চাহিদার চেয়ে কি সেটির উৎপাদন বেশী ছিল? ভোক্তার চাহিদার শিফটিং এর সাথে সাথে কি সেই প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন শিফট করেছে?
সরকার কি বাস্তবিকপক্ষেই আন্তরিক ছিল CBPVPকে রক্ষার ব্যাপারে?

আপনি ধরে নিচ্ছেন যে আমাদের সরকার ও কোন ঔপনিবেশিক শক্তি একটি সুদুরপ্রসারি চিন্তাধারা নিয়ে এগোচ্ছে; লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে আগে কৌশলে লোকশানের দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে।

হ্যা এ ধরণের পরিকল্পনা দিয়েই শাসকগোষ্ঠী অগ্রসর হয়।

দিনমজুর এর ছবি

১।

তেল বিপনন সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে "দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি" এ কথাটা কতটুকু খাটে?

তেল বিপনন সংস্থাগুলো এবং অন্যান্য সেবাখাতগুলোর ক্ষেত্রে "দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি" কথাটা সরাসরি খাটে না, তবে সেবাখাতগুলো পরোক্ষভাবে যেকোন রাষ্ট্রের শিল্পের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আসলে সেবাখাতগুলোর উপর শিল্প, এমনকি জনগণের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালী সরাসরি নির্ভরশীল। শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা দরকার- সেই পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে সড়ক-নৌ-রেল ব্যবস্থা প্রয়োজন, পরিবহনের জ্বালানীর প্রয়োজন, সেই শিল্প চালনার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি, গ্যাস এসবেরও প্রয়োজন হতে পারে; ফলে এসব কিছুর জন্য সেই শিল্প এ সমস্ত সেবার উপর নির্ভরশীল। এখন এই সেবাগুলো যদি রাষ্ট্র নিজের হাতে না রাখে- সেগুলোর যদি বিরাষ্ট্রীয়করণ ঘটে, এবং সেখানে যদি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ বাণিজ্য ঘটে- তবে এসব সেবার উপর নির্ভরশীল শিল্পসমূহ তখন সরকারের বদলে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে- এভাবে মুনাফার উদ্দেশ্যে ইচ্ছামাফিক সেবার দাম নির্ধারণের সুযোগ তৈরী করে দেয়া হলে শিল্পগুলোকে (সেই সাথে জনগণকেও) সেই সেবা কিনতে হবে উচ্চমূল্যে- ফলে শিল্প সমূহের উৎপাদন খরচ যাবে বেড়ে, এভাবেই শিল্পের উপর সেবাখাতসমূহ সরাসরি প্রভাব রাখে।

তিন চারটা তেল বিপনন সংস্থা থাকার কোন সুফল তো দেশের মানুষ পাচ্ছে না। তেলের মান, দাম, পরিমান এসবই তো সরকার নিয়ন্ত্রন করে। পেট্রল পাম্পগুলো যদি সরকারি হত, তাহলে ভোক্তার হয়রানি কমত, কিন্তু সেগুলো তো আগে থেকেই বিরাষ্ট্রিকৃত হয়ে আছে। তাহলে মাঝখান থেকে বিপনন সংস্থাগুলোকে সরকারি রাখার যুক্তিটা কি?

আগের আলোচনায় হয়তো পরিষ্কার হয়েছে কেন তেল/গ্যাস/বিদ্যুৎ কে পুরোপুরি সরকারের হাতে রাখা দরকার। বিপিসি, বাপেক্স, পেট্রোবাংলা এগুলোর মাধ্যমে সরকার সেই নিয়ন্ত্রণটি বজায় রাখে, ফলে এখন পর্যন্ত তেলের (বা গ্যাসের বা বিদ্যুতের) দাম সরকার নির্ধারণ করতে পারে- সে জায়গাটিতে এদেশের কোন শিল্প বা ভোক্তা জনগণ কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশিল নয় (যদিও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভিন্নদিকে যাচ্ছে)। মাঝে আছে বিপনন- এটাও সরকারী নিয়ন্ত্রণে আছে, বিপনন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে তেল-গ্যাস বিক্রয়ের বড় অংশই এখন সরকারের হাতে নেই। আমার মতে, এই তিনধাপের পুরোটাই সরকারের হাতে থাকা দরকার। এখন তৃতীয় ধাপ (ভোক্তার কাছে বিক্রয়) বিরাষ্ট্রীয়করণ হয়েছে- বলে মাঝের ধাপটিও (বিপনন) বিরাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে- এমন যুক্তিকে সঠিক মনে করি না; বরং এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকেই প্রথম ধাপ (তেল আমদানী- দাম, মান-- নির্ধারণ)সহ বিরাষ্ট্রীয়করণের গন্ধ পাই। তার ফলাফল যে ভয়াবহ হবে আশা করি এ ব্যাপারে একমত হবেন। এখন এটুকুও যদি ধরি, প্রথম ধাপ সরকারের হাতে থাকবে এমন নিশ্চয়তা রেখেই ২য় ধাপটি (বিপনন) বেসরকারীকরণ করা হলে কি হবে?
মাঝের এই ধাপ মানে বিপননটি খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। এটি যখন বেসরকারীখাতে যাবে, যারা এখাতে বিনিয়োগ করবেই মুনাফার উদ্দেশ্য- তখন কি আমরা একই দাম ও মান পাবো? একটা উদাহরণ দেই: আমাদের দেশেই খাদ্যদ্রব্যের যে দামের পার্থক্য উৎপাদনকারী ও ভোক্তার মধ্যে- তার একটা বড় কারণ এই বিপনন। আবুল বারাকাতের হিসাব মতে, উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত আসতে ৮/১০ টি হাত বদলায় এবং এতে কমপক্ষে ৪৫% দাম বাড়ে। এখন হয়তো বলবেন, তৃতীয় ধাপের জন্য সরকার কর্তৃক দাম ফিক্সড থাকলে বিপননের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়াবে কি করে? সেক্ষেত্রে দুটো ঘটনা ঘটবে, এক- বিপনন প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বা কমিশন বাবদ সরকারকে আরো কম দামে তেল বেঁচতে হবে, এর মাধ্যমে সরকারের লোকসান বৃদ্ধি পাবে; এবং দুই- সরকারের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হ্রাস পাবে- কেননা তখন সরকার ৩য় ধাপের সাথে সাথে ২য় ধাপের কাছ থেকেও নানামুখী চাপের সম্মুখীন হবে- তার মধ্যে মূল চাপটি হচ্ছে ভোক্তার কাছে বিক্রিত তেলের দাম বৃদ্ধি ও সরকার তথা বিপিসির কাছ থেকে প্রাপ্ত তেলের দাম হ্রাসের চাপ।

আর, তিন/চারটি বিপনন সংস্থার সুফল কি- এর মাধ্যমে যদি বলতে চান- একাধিক বিপনন সংস্থা থাকার যৌক্তিকতা কি- তবে বলবো- পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মনোপলির চেয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকার কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। তবে একটি প্রতিষ্ঠানকেই যদি সরকার সেভাবে সমস্তদিক থেকে সাফিসিয়েন্ট হিসাবে গড়ে তুলতে পারে- তাতে কোন সমস্যাও থাকার কথা নেই। মূল বিষয়টি হচ্ছে- এখাতকে সরকার নিজের হাতে রাখবে না-কি ছেড়ে দিবে, সেটি।

২।

এখানে দুটি উদাহরন বিবেচনা করুন। সাভারের ঢাকা লেদার কম্পানীটি আদতে কখনো চালুই হয়নি। হাজারিবাগের ট্যনারদের ও দেশের বড় কসাইখানাকে সাভারে নিতে না পারলে ঐ কারখানা চালু হলেও বেশিদিন চলত না। আর ন্যশনাল সুগার মিল খাটা পত্রে ১৯৮৩ তে চালু হলেও, অফিস আর আসবাব ছাড়া আর কোন যন্ত্রপাতিই এর জন্য কেনা হয়নি।

হ্যা, আপনার উদাহরণ দুটির ক্ষেত্রে আমার কথা " এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে বা প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে"- খাটে না, বরং বলতে হবে যে, এ প্রতিষ্ঠান দুটোকে জীবিতই করা হয়নি কখনো, অর্থাৎ এ দুটোকে মৃত হিসাবে প্রসব করা হয়েছিল এবং এখন মৃত প্রতিষ্ঠানদুটোকে কবর দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু এতে কি আমার মূল বক্তব্যের কোন হেরফের কি হচ্ছে?

সাভারে লেদার কমপ্লেক্স তৈরীর দাবি অনেকদিনের এবং এর প্রয়োজনীয়তা এখনো অপরিসীম। সেটা শুধু ঢাকার ভিতর থেকে ট্যানারীবাজার অপসারণের মাধ্যমে ঢাকার পরিবেশকে সুস্থ করার তাগিদে নয়, বরং বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের বিশাল সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই- সাভারে লেদার কমপ্লেক্স গড়ার উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল। এখন, আমরা কোন প্রশ্নটি সামনে আনবো- 'এই কমপ্লেক্স চালু হলো না কেন', সেটা? না-কি 'যেহেতু চালু হয়নি- সেহেতু এটা থাকার যৌক্তিক্তা কি' সেটা??? একটু ভাববেন কি?

আর, ন্যাশনাল সুগার মিলের কথা বললেও একই কথা খাটে। আমাদের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল ছিল আখ, এবং আমাদের চিনি শিল্প আদতেই একসময় ছিল বেশ রমরমা। পাটশিল্প ধংসের সাথে সাথেই আক্রমণ আসে এই চিনি শিল্পে, মূলত অবাধ বা মুক্তবাজার বাণিজ্যের নাম করে। ভারতীয় চিনির সাথে যখন এখানকার ব্যক্তি উদ্যোগগুলো মার খাচ্ছিল, তখন একমাত্র সরকারই পারতো চিনি শিল্পকে রক্ষা করতে। সরকারী উদ্যোগে ও পরিচালনায় চিনি শিল্পকে রক্ষায় ভূমিকা নেয়া কি যেত না? সরকার যে সে ব্যাপারে উদাসীন ছিল তারই নজীর মাত্র এই ন্যাশনাল সুগার মিল। অবশ্য রাষ্ট্রের শিল্প ধ্বংসকারী ভূমিকা আরো আগেই পরিষ্কার হয়ে যায়- যখন বিভিন্ন ধাপে শুল্ক গুলো তুলে নেয় ও কমিয়ে দেয়।

মোটের উপর আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, তা হলো আজ যেসব প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করার কথা উঠেছে, তার একটা বড় অংশই মৃত বা মৃতপ্রায় (আপনার উদাহরণের মত কিছু জন্মমৃত)। এবং এগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণের ক্ষেত্রে এই যুক্তিই সর্বাগ্রে আসে, মৃত/মৃতপ্রায়/জীবন্মৃত এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেখে সরকারের কি লাভ?

৩।

চিটাগাং বোর্ড ও পার্টিকেল মিলটি (CBPVP) ১৯৮১ সালে পোল্যন্ডের আর্থিক সহায়তায় ও সেই দেশে এই মিলের ৮০% উত্ পাদন রপ্তানী করার আশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বার্লিন দেয়ালের পতনের পর পোল্যান্ড তাদের পূর্বজন্মে করা অনেক প্রতিশ্রুতির মত এটিও বেমালুম ভুলে যায়। তার ওপর নারায়ন গন্জ/মানিকগন্জ ভিত্তিক ও ভিন্ন কাঁচামালের বোর্ড ভোক্তআর কাছে বেশী গ্রহনযোগ্য হওয়ায় ১৯৯৫ সালে CBPVP কে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এখানে কাকে দায়ী করবেন আপনি?

যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত, এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব যদি হয় সরকারের; তবে আমি এক্ষেত্রটিতে সরকারকেই দায়ী করবো।
আপনি ঐ প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে সরকারের পরিবর্তে ব্যক্তিমালিকানার কথা চিন্তা করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তি উদ্যোক্তা কি করতো? আপনি যদি মালিক হতেন- আপনি কি করতেন? যাদের কাছে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করার কথা ছিল, তারা যদি আমদানী না করে, তবে আপনি কি নতুন বাজার খুজতেন না? দেশের অভ্যন্তরীন বাজারে কি বোর্ড ও পার্টিকেলের চাহিদা নেই? চাহিদার চেয়ে কি সেটির উৎপাদন বেশী ছিল? ভোক্তার চাহিদার শিফটিং এর সাথে সাথে কি সেই প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন শিফট করেছে?
সরকার কি বাস্তবিকপক্ষেই আন্তরিক ছিল CBPVPকে রক্ষার ব্যাপারে?

আপনি ধরে নিচ্ছেন যে আমাদের সরকার ও কোন ঔপনিবেশিক শক্তি একটি সুদুরপ্রসারি চিন্তাধারা নিয়ে এগোচ্ছে; লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে আগে কৌশলে লোকশানের দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে।

হ্যা এ ধরণের পরিকল্পনা দিয়েই শাসকগোষ্ঠী অগ্রসর হয়।

দিনমজুর এর ছবি

১। দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা, দেশীয় কাঁচামাল ও দেশীয় প্রযুক্তি নির্ভর এসব প্রতিষ্ঠান একসময় আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল, লাখ লাখ মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়েছে।
----------->>>>>>>>>>

মূল লেখাটিতে ইতোমধ্যে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা এবং আগামীতে বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রস্তুত বলে ঘোষণা দেয়া প্রতিষ্ঠানের যে তালিকাকটি দিয়েছি- তার দিকে এক পলক তাকালেই বোধ হয়, পরিষ্কার হওয়ার কথা যে, এই প্রতিষ্ঠান গুলো প্রকৃতই একসময় লাখ লাখ লোকের মুখে অন্ন জুগিয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে, টঙ্গী-গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, ঠাকুরগাঁ, সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি----------- বলতে গেলে পুরো দেশ জুড়েই গড়ে উঠেছিল এসব শিল্প। স্বাধীনতার পরের সময়টাতে প্রায় ১ কোটি বেল পাট উৎপাদিত হতো- যা দুনিয়ার ৭০ শতাংশ (এখন টেনেটুনে- ৪০ লাখ বেল পাট)। সেই পাটের প্রায় পুরোটাই অভ্যন্তরীন বাজারে যেত- যেটার অধিকাংশই পাটশিল্পকে গড়ে তুলেছিল (এখন বড় অংশই যাচ্ছে কাঁচামাল হিসাবে ভারতের বাজারে!)। নারায়নগঞ্জ আর খুলনা-খালিশপুরের পাটশিল্পের বেলটে গেলে বুঝবেন, প্রকৃত চিত্রটা কতখানি কষ্টকর! জায়গাগুলো আজ পরিত্যক্ত, কোন শ্মশানভূমির কথাই স্মরণ করিয়ে দিবে।
এককালের পাট ও পাটশিল্প, তারপরে দেখবেন চিনি শিল্প- আখ চাষও আজ কমে গেছে, চিনি উৎপাদন এখন আমাদের একদম মিনিমাম পর্যায়ে চলে গেছে- অথচ একসময় কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা এসবের চিনিকলগুলো একেকটা এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবনকে গতি দিত, চালনা করতো।
আজ আমরা গড়ে তুলছি শুধু মার্কেট, মার্কেটের পর মার্কেট- বসুন্ধরা মার্কেটের পর তার চার/পাঁচগুন আরেক মার্কেটও গড়ে উঠছে, প্রচুর পণ্য বেচাকেনা হচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি তৈরী করছি? হ্যা এখন গার্মেন্টস শিল্পের কথা অনেকে বলেন। কিন্তু আসলে আমরা এখন কি করছি? শুধু দর্জিগিরির বাইরে আমরা এখন একটা সুই কি তৈরী করতে পারছি? সুতা, এমনকি বোতামও আমরা কিনে নিয়ে এসে দর্জিগিরি করাকে আমরা নাম দিয়েছি গার্মেন্টস শিল্প। অথচ এককালে এখানে আমাদের রেশম শিল্প ছিল, ঠাকুরগাঁ-বগুড়ায় গেলে সেই তুত গাছের মাঠ এখনো হয়তো দেখা যায়- রেশম গুটি বা তুত পোকা সংরক্ষণের কক্ষও চোখে পড়ে, তবে তা তালাবদ্ধ!
আমাদের পানি আর গ্যাস সম্পদকে ব্যবহার করে আমাদের ইস্পাত কারখানা ছিল, আমাদের টেক্সটাইলগুলো, আমাদের সিলক মিলগুলো, আমাদের হ্যাণ্ডলুম গুলো, আমাদের কটন মিলগুলো ------- সবই দেশীয় প্রযুক্তি, দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে- স্থানীয় কৃষি উৎপাদনের ও কাঁচামালের সহজলভ্যতার উপর নির্ভর করে সারাদেশে গড়ে উঠেছিল।

আমি এটাই বলতে চেয়েছি- আমাদের অর্থনীতিকে একসময় দারুন গতি দেয়া এসমস্ত প্রতিষ্ঠানকে মেরে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে। কৃষি নিয়ে আগের দুটো লেখায় দেখিয়েছি- কৃষিকে কিভাবে মেরে ফেলার যোগাড়যন্ত্র করা হয়েছে। ফলে, একটা দেশের কৃষি আর শিল্প হলো তার অর্থনীতির ভিত্তি। সেটাই নেই। সেটা গড়ে তোলার বদলে আমরা শুধু বিদেশী বিনিয়োগের আশায় হা করে থাকি আর বিদেশী প্রভুদের কথায় বিদেশী বিনিয়োগের লোভে নিজেদের কৃষি-শিল্পকে ধংস করে ফেলি---------- এই হলো আমাদের অবস্থা, এভাবেই আমরা চলছি-------------

শামীম এর ছবি

পড়ার পর তো মাথায় আগুন ধরে গেছে ... ... ...
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

শামীম এর ছবি

আমার আরেকটি প্রতিক্রিয়া এখানে
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

শামীম এর ছবি

যুদ্ধ কী দরকার!

একটা সময় যখন কোথাও হত ভাতের কষ্ট,
তেড়ে গিয়ে অন্য দেশে করতো জীবন নষ্ট।
লুট করতো গরু বাছুর, ধন-সম্পদ যত,
মারতো মানুষ, পুড়তো বাড়ী, অনেক হতাহত।

লুট করেও অনেকের হয়না অভাব শেষ,
ধরে নিয়ে যেত, দিতো দাসের বেশ।
আমেরিকার কথাই ধরো, ওবামার ঐ দাদা,
আফ্রিকাতে বাড়ি তাঁদের, দাস ছিল একদা।

ভারতের পাশে আছে, দেখো সোনার দেশ,
ইংরেজরা ছুটে এল, করলো সবই শেষ।
নিজের দেশে নাই সম্পদ, নাই তো থাকার জায়গা,
কী করা তাই, করায় হেথায় নীল চাষ আর মংগা।

করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, সম্পদ যা ছিলো,
সবই তখন জাহাজ চেপে, ঐদেশেতে গেলো।
এদেশেরই রক্ত চুষে, চকচকে হয় দেশ,
ধন-সম্পদ সবই গেল, মরে সবাই শেষ।

এখন দেখ আবার তাঁদের, অভাব তাড়া করে,
নিজ দেশেতে নাই সম্পদ, রক্ত চক্ষু ঘোরে।
মারবে নাকি লোক আবারো? করবে কি লুটপাট?
অভাব তাঁদের একার নাকি! অন্যেরা কি বাদ?

খুনাখুনি, নীলচাষী, দাসের দিন শেষ,
তাতে কি, সমস্যা নাই, চলো বাংলাদেশ।
মোবাইল ফোনের ব্যবসা, লাভ কত জানো!
বছর শেষে শত কোটি ডলার গুনে আনো!

আরো আছে কত শত, ঠকানোর উপায়,
পেপারে দাও বিজ্ঞাপন, কে আছে ঠেকায়!
ঘুষ দিলে সবই ভুলে দিবে কাপড় তুলে,
যতই মারো, প্রতিবাদ করবে নাতো ভুলে।

তাইতো বলি, অবস্থাটা বদলেনি একটুও,
একই ভাবে যাচ্ছে সবই, একটু ভাবিও।
লোক মেরে আর লাভ কি বল! কয় টাকা আর পাবে!
তার চে ভাল এইভাবেই, সবই তাঁদের হবে।

সম্পদ চাও? এই যুগে ভাই দরকার নাই যুদ্ধ,
ব্যবসা কর ইচ্ছামত, লোকগুলো সব বুদ্ধু।
মারামারি, কাটাকাটির দিনতো কবে শেষ,
সবাই এসে শোষন করে সোনার বাংলাদেশ।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।