কিছু মার্কসীয় তত্ত্ব/ জে বি এস হ্যালডেন

দিনমজুর এর ছবি
লিখেছেন দিনমজুর [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/১১/২০০৮ - ১০:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
ভূমিকাঃ ১৯৩৮ সালের দিকে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রখ্যাত জিনবিজ্ঞানী ও বিবর্তনবাদী বায়োলজিস্ট, population genetics এর অন্যতম প্রবক্তা জে বি এস হ্যালডেন (John Burdon Sanderson Haldane, 1892 – 1964) রাজনৈতিক দর্শনের উপর কয়েকটি বক্তৃতা দেন। এগুলো 'ম্যুরহেড বক্তৃতামালা' হিসেবে সর্বাধিক প্রচারিত। এই বক্তৃতার প্রথমটির শিরোনাম ছিল "Some Marxist Principles"। মূলত বৈজ্ঞানিক কর্মী ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এই বক্তৃতাগুলো দেওয়া হলেও এগুলোতে বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা এমনভাবে আলোচনায় এসেছে যাতে করে এগুলো সার্বজনীন গুরুত্ব অর্জন করেছে। হ্যালডেনেরও লক্ষ ছিল ব্যাপক পাঠক সমাজের কাছে বক্তৃতাগুলি বোধগম্য করে তোলায়। ভূমিকা থেকে একটা লম্বা উদ্ধৃতি দেখা যাক-

"-- আমি আমার সময়ের বৈজ্ঞানিক সমস্যাগুলিকে মার্ক্সবাদের আলোকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি ঠিক যেমনটি এঙ্গেলস ও লেনিন করেছিলেন। আমি নিশ্চিত যে আমি অনেক ভুল করেছি কিন্তু একজন মার্ক্সবাদী হিসেবে আমি জানি যে কোন মার্ক্সবাদীরই ভুল করার ভয়ে অতিমাত্রায় ভীত হওয়া সমীচীন নয়। এইরকম একটা প্রচেষ্টা অনিবার্যভাবেই দু'ধরণের সমালোচনার মুখে পড়তে পারে। যদি কেউ সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলীর মাঝে নিজেকে আবদ্ধ রাখে তবে সহজেই সে বলতে পারে যে কোন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেটায় মার্কসবাদ প্রয়োগ করা খুব সহজ এবং জ্ঞানগম্যি থাকলে সাম্প্রতিক কালের যেকোন একটা বৈজ্ঞানিক ঘটনা সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলস থেকে বেশ লাগসই একখানা উদ্ধৃতি দেয়াও আহামরি কিছু নয়। অন্যদিকে ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হয় তবে মূলগতভাবে না হলেও বিস্তারের দিক দিয়ে কিছু ভুলচুক হতে পারে। তবুও আমি মনে করি এই ধরণের আলোচনার দরকার আছে, কেননা এটা বিজ্ঞানীর চিন্তাভাবনাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে, দিতে পারে নতুন কর্মধারা।---- আমি এই বক্তৃতাগুলিকে একটু বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে প্রসারিত করতে চেয়েছি এবং আমি নিশ্চিত যে এটা আমি করেছি অসমভাবে ও অগভীরভাবে। এটার পেছনে আমার এই আশাবাদই আমাকে চালিত করেছে যে, এতে করে আমি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে পারব এবং তারা প্রয়োজনীয় ফাঁকফোকরগুলি মেরামতে আমাকে সাহায্য করবেন। প্রবল বাদানুবাদের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানের যথোপযুক্ত মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় পৌঁছানো সম্ভব। আমি এটা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই যে আমি প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়ার আশা রাখি এবং অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনা আমাকে অনুপ্রাণিত করবে"।
আমরা হ্যালডেনের "Some Marxist Principles" শিরোনামের বক্তৃতাটি অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিচে তার প্রথম কিস্তি দেয়া হলোঃ

প্রথমেই পাঠকের কাছ থেকে দুই দিক থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া জরুরী। প্রথমত আমি দার্শনিক নই কিন্তু আমাকে যখন রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে বলা হয় তখন মার্কস ছাড়া অন্য কারো কথা আমি ভাবতেই পারি না। দ্বিতীয়টা আরো গুরুত্বপূর্ণ- আমি নিজেকে মার্কসবাদ নিয়ে কথা বলার জন্য যথাযোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করি না। বছরখানেক হলো আমি মার্কসবাদ নিয়ে নাড়াচাড়া করছি এবং এখনও মার্কসবাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। অবশ্য যতটা পড়া হয়েছে সেটাও একেবারে মন্দ না। এই বক্তৃতাগুলোর উদ্দেশ্য শুধু আমার শ্রোতৃমন্ডলীর মাঝে জ্ঞানদান নয় বরং আমার নিজের চিন্তাগুলিই আরেকটু ঝালাই করে নেয়া। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে সক্রেটিস নিজেকে একজন ধাত্রী মনে করতেন যার কাজ হলো নতুন চিন্তা ভূমিষ্ঠকরণে সহায়তা করা। আশা করি আমার শ্রোতৃমন্ডলী এবং পাঠকমন্ডলীও আমাকে সেইভাবেই বিবেচনা করবেন।

এখন প্রথমেই প্রশ্ন তোলা ভাল যে কেন মার্কসবাদ এত গুরুত্বপূর্ণ ? আমার মনে হয় এটা ধরে নেয়া অস্বাভাবিক হবে না যে আমার শ্রোতৃমন্ডলী এবং পাঠকমন্ডলীর একটা বেশ বড় অংশের মাঝেই মার্কসবাদ নিয়ে এক ধরনের বিরূপ ধারণা আছে। এটা কেন ? একটা কারণ হ’ল এই দর্শনের রাজনৈতিক তাৎপর্য, যেটাকে কেউই ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারেন না এবং এটা এই মতবাদে বিশ্বাসী লোকজনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এটা বিশ্বাস করি যে একজন গড়পড়তা একাডেমিক দার্শনিকের সাথে সপ্তাহখানেক কাটিয়েও আপনি হয়ত নাও জানতে পারেন ভদ্রলোক একজন আদর্শবাদী নাকি বাস্তববাদী। কিন্তু একজন মার্কসবাদীর সাথে একদিন কাটালেই আপনি বুঝে যাবেন সে কোন মতবাদকে সঠিক বলে মনে করে।

আরো দুইটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ধারা, আমার মতে, বিবেচনার দাবী রাখে। প্রথমটি হলো শাস্ত্রীয় দর্শন যার গুরু সন্ত টমাস অ্যাকুইনাস। এই দর্শন কেবল খ্রিস্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের চর্চার বিষয়বস্তু হয়েই থাকেনি বরং এটাকে মধ্যযুগের প্রতিনিধিত্বশীল ধারা হিসেবেই আমরা চিহ্নিত করতে পারি। এবং এখনও রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলো এই ধারার নিয়ন্ত্রণে। সেজন্য প্রশংসা বা সমালোচনা যাই করি না কেন এই দার্শনিক ধারার বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলো বেশ প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় ধারাটি হলো বিজ্ঞান যাকে দু’য়েক শতাব্দী আগেও প্রাকৃতিক মতবাদ বলে ডাকা হতো। এর কার্যক্ষেত্র সীমিত হলেও কিছু কিছু জায়গায় এর সাফল্য ঈর্ষণীয়। এমনকি এটা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে এটা পুরো দুনিয়ার চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে।

এখন মার্কসবাদ দাবী করে যে এটা রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আলোকে বিশ্লেষণ করে সমাজ রূপান্তরণে আমাদেরকে সক্রিয় করে তোলে। এটা আমাদেরকে বিজ্ঞানকে দেখার এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত হাজির করেছে যেখানে বিজ্ঞানকে আমরা দেখি মানবিক কর্মকান্ড হিসেবে যা কেবল সমসাময়িক সামাজিক ও অর্থনৈতিক শর্তের উপর নির্ভরশীল নয় বরং মানুষের চিন্তাপ্রণালীর দ্বারাও প্রভাবিত হয়। এইখানেই শেষ না, আরো একধাপ এগিয়ে মার্কসবাদ দাবী করে যে এটা কেবল প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টাই নয়, এটা দুনিয়াকে আমূল বদলে দেবার সবল হাতিয়ার। এই ব্যাপারগুলোই আমরা এখন বিচার করে দেখব।

আমি খেয়াল করেছি আমাদের এখানে মার্কসীয় দর্শন নিয়ে এক ধরনের ভুল বোঝাপড়া চালু আছে এবং ঠিক এই জায়গাতেই আমার বক্তৃতাগুলির যাথার্থ্যতা বলে আমি মনে করি। আমাদের মধ্যে বেশ বড়সড় একটা অংশেরই সত্যিকার অর্থে মার্কসের তাত্ত্বিক কাজগুলো সম্বন্ধে কোন ধরনের জানাশোনা নেই, ব্যতিক্রম খুব সম্ভবত উদ্ধৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। অনেক ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি মার্কসবাদকে যখন বস্তুবাদ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় তখন লোকজন বলে ওঠে- “ওহ্ হো বস্তুবাদ, এ তো সেই মতবাদ না, যেটা বলে মানুষ নিছক একটা যন্ত্র অথবা মানুষের মন বলতে আসলে কিছু নেই”

১৯১৭ এর আগে এখানে মার্কসবাদকে বাকুনিন, সরেল এবং অন্যান্য অ্যানার্কিস্টদের দলে ফেলে বাতিলের প্রক্রিয়া চলতো। বিশেষত ইংল্যান্ডে অ্যাকাডেমিক এবং রাজনৈতিক উভয় ঘরানাতেই মার্কসবাদ ছিল অচ্ছুৎদের দলে যেখানে তাবৎ ইউরোপ নিদেনপক্ষে মার্কসবাদকে একটা আলোচনার বিষয়বস্তু মনে করতো। এরা মার্কসবাদকে প্রচার করতো ক্র্যাঙ্ক (crank) দের মতবাদ বলে। অভিধান ঘাঁটলে আপনি দেখবেন crank শব্দটির মানে হলো খেয়ালি, সিদ্ধান্তে অনড় বাতিকগ্রস্ত ব্যক্তি। চোখটা একটু উপরে ওঠালেই দেখতে পাবেন- "A little thing that makes revolutions"! এখন মার্কসবাদকে ঐভাবে দেখার দিন শেষ কারণ আর কিছুই নয়- লেনিন, এবং লেনিন ছিলেন তার সময়ে সবচেয়ে মহান ব্যক্তি। এই স্বীকারোক্তি আসলে কোন কিছুর অপেক্ষা রাখে না ঠিক যেমন আপনি একজন মুসলমান না হয়েও বলতে পারেন যে মোহাম্মদ ছিলেন তার সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। একজন মানুষের দর্শন পুরো দুনিয়াতে কি করে এতটা প্রভাব বিস্তার করলো তা নিশ্চয়ই বিবেচনার দাবী রাখে।

প্লেটোর কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, উনি বলেছিলেন যে আদর্শ রাষ্ট্র কেবলমাত্র এমন রাজার নেতৃত্বেই গঠন সম্ভব যিনি দার্শনিক। লেনিন রাজা না হলেও দার্শনিক ছিলেন যার দেখানো পথ ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এতদূর এসেছে। একটা কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন সুনিশ্চিতভাবেই আদর্শ রাষ্ট্র নয় আর সেটা হলো মার্কসবাদীরা আদর্শ রাষ্ট্র চায় না, তারা চায় সাম্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা। লেনিনের দর্শনকে এখনও সঠিক ও প্রাসঙ্গিক মনে করে সেই অনুযায়ী কাজ করে চলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার বাইরের মার্কসবাদীরা। এর মধ্যে অনেকেই এমনকি কমিউনিষ্ট পার্টিরও সদস্য নয় ! দর্শনশাস্ত্রকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সেটা বুঝতে পারবেন যদি আমি আপনাদের এই খবরটা শোনাই- শুধুমাত্র ১৯৩৬ সালেই সোভিয়েত ইউনিয়নে কান্ট এর রচনাবলী ছাপা হয়েছে এক লক্ষ কপি এবং তার সবগুলোই বিক্রি হয়ে গেছে ! ইংল্যান্ডে দর্শনচর্চার পুনরজ্জীবনের এটা একটা অন্যতম কারণ। ঠিক একারণেই অন্যান্য দর্শনের উপর আস্থাশীল ও অন্য রাজনৈতিক মতানুসারী লোকজনকেও দেখি মার্কসবাদ সম্পর্কে ভাসাভাসা হলেও একধরনের জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করতে। আমার উদ্দেশ্য অবশ্য ভিন্ন কেননা আমি মনে করি মার্কসবাদ সত্য।

প্রথম প্রশ্ন, মার্কসবাদ কি ? লেনিনের পূর্বসুরী প্লেখানভ, একজন রাশিয়ান মার্কসবাদী, তার ‘মার্কসবাদের মৌল সমস্যাবলী’ (Fundamental Problems of Marxism) শুরু করেছিলেন এইভাবে : “মার্কসবাদ হইলো একখান সম্পূর্ণ তত্ত্বীয় প্রণালী।” ভুল, এটা আসলে বলা যেতে পারে অ্যারিস্টটল, টমাস অ্যাকুইনাস, স্পিনোজা, হেগেল এদের দর্শন সম্পর্কে । এমনকি এটা আপনি সক্রেটিসের দর্শন সম্পর্কেও বলতে পারবেন না, মার্কসবাদ সম্পর্কে তো নয়ই। মার্কসবাদ সম্পূর্ণ নয়, নয় কোন বিধিবদ্ধ প্রণালী এবং তত্ত্বীয় দিকটি আসলে আসে প্রথমের পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানে। এটা সম্পূর্ণ নয় কারণ আজো তা বিকশিত হয়ে চলেছে এবং মোদ্দাকথা হলো এটা এবং এর অনুসারীরা কখনই বলে না যে আমরা শেষ দেখে ফেলেছি। মার্কসবাদ সম্পর্কে একজন মার্কসবাদী খুব বেশী হলে বলতে পারে যে মধ্য-ঊনবিংশ শতাব্দীর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ হলো সম্ভাব্য সর্বাধিক সত্য ফসল। এটা কোন প্রণালী নয় বরংচ একে একটা পদ্ধতি বলা যেতে পারে যেমনটা মার্কস তার ‘Eleventh Thesis on Feuerbach’ এ বলেছিলেন:

“এতকাল ধরে দার্শনিকেরা কেবল দুনিয়াকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যাই করে গেছেন, আসল কাজটা হলো একে বদলানো।”
দেকার্তের মত মার্কসও তার দর্শনকে মূলত পদ্ধতিই ভাবতেন এবং অনুশীলনকে তত্ত্বের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন। যদিও এর মানে এটা নয় যে মার্কসবাদে তত্ত্বের গুরুত্ব কম বরং তত্ত্বের ভিতের উপরেই গড়ে ওঠে পদ্ধতির সুদৃঢ় সৌধ। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় মার্কসবাদেও তত্ত্ব গড়ে ওঠে বাস্তব পরিস্তিতি আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে। অন্যান্য ধ্রুপদী দর্শনের সাথে মার্কসবাদের পার্থক্যটা ঠিক এই জায়গাতেই, ধ্রুপদী দর্শন যেখানে বিশুদ্ধ চিন্তার খোঁজে আকাশ-পাতাল মাঝে ছাঁকনি বসায় মার্কসবাদ সেখানে গুরুত্ব দেয় পর্যবেক্ষণের উপর।

এইবার মার্কসবাদের উৎসের দিকে একটু ফিরে তাকানো যেতে পারে। জার্মানীর ট্রিয়ের শহরে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে মার্কস এর জন্ম, বাবা ছিলেন ইহুদী আইন ব্যবসায়ী। মার্কস এর বয়স যখন ছয় তখন তার বাবা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে দীক্ষিত হন। তার সহকর্মী ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এর জন্ম রাইন প্রদেশ এর বার্মেন শহরে ১৮২০ এর দিকে। মার্কসবাদে তার ভ’মিকা অপরিসীম। এঙ্গেলস এর বাবা ছিলেন একজন জার্মান শিল্পোদ্যোক্তা। তারা দুজনেই দর্শন পড়েছিলেন। মার্কস তার ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছিলেন এপিকিউরাস এর দর্শনের উপর অভিসন্দর্ভ লিখে; তারা দুজনেই শুরুর দিকে ছিলেন বামঘেঁষা হেগেলপন্থী এবং পরের দিকে ফয়েরবাখের দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মার্কস এর ইচ্ছে ছিল দার্শনিক হওয়ার এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপটে দর্শনশাস্ত্রের একজন নির্বিষ অধ্যাপক হওয়া তার জন্যে ছিল খুবই সহজ, কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। ঐ সময়টাতে প্রুশিয়ান সরকার ধরে ধরে ফয়েরবাখ, বাউয়ের এর মত দার্শনিকদের, যাদের রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তাভাবনা মৌলিক হলেও মার্কস এর পরবর্তীকালের দর্শনের চেয়ে ছিল অনেক মৃদু ধরনের, নির্বাসনে পাঠাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মার্কস বেছে নিলেন সাংবাদিকতা। তিনি একটা কাগজ খুললেন- রাইনশে জেইটুং (Rheinische Zeitung)। এটা ছিল ১৮৪২ এর দিকে। ১৮৪৩ এর দিকে এটা সরকার বন্ধ করে দিলে তিনি প্যারিস চলে যান। ঐদিকে এঙ্গেলস ১৮৪২ এর দিকে ম্যানচেষ্টারে যান তুলার ব্যবসা করতে যেখানে তার তৎকালীন শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের সুযোগ মেলে। এই পর্যবেক্ষণের ফলাফল হিসেবেই ১৮৪৫ সালে 'The Condition of the Working Class in England' প্রকাশিত হয়।

১৮৪৪ এর দিকে মার্কস-এঙ্গেলস এর সাক্ষাৎ হয় প্যারিসে এবং এরপর তারা আজীবন একে অপরের বন্ধু থেকে যান। প্রুঁধোর সংস্পর্শে তারা দুজনেই সমাজতন্ত্রী হয়ে যান। প্রুশিয়ান সরকারের চাপে মার্কসকে প্যারিসও ছেড়ে যেতে হয়। এইবার তিনি গেলেন ব্রাসেলস এ। এর মধ্যে তাদের চিন্তাভাবনা একে অপরের কাছে পরিষ্কার করে নেন। প্রুঁধো এবং অন্যান্য ফরাসী নেতৃবৃন্দের মতের সাথে বিরোধ ঘটে। ১৮৪৭ এর দিকে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটে ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’তে যেটার খসড়া তৈরী করেছিলেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস।

১৮৪৮ সালে জার্মানীতে যে বিপ্লব হয় তাতে দুজনেই যোগ দেন, মার্কস সাংবাদিক হিসেবে এবং এঙ্গেলস একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে। ১৮৪৯ এর পর থেকে তাদের দুজনেরই ঠাঁই হয় ইংল্যান্ডে। মার্কস লন্ডনে থাকতেন, মারা যান ১৮৮৩ তে। এঙ্গেলস ১৮৭১ সাল পর্যন্ত ছিলেন ম্যানচেষ্টারে, পরে তিনিও লন্ডন চলে আসেন এবং ১৮৯৫ এ মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত লন্ডনেই ছিলেন।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড, যেমন আন্তর্জাতিক শ্রমিক সঙ্ঘ (International Working Men's Association) পরে যেটার নামকরণ করা হয় ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’, ছাড়াও তারা ঐ সময়টাতে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। মার্কসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই হলো ‘পুঁজি’ (Das Kapital), কিন্তু বিজ্ঞানের সাথে মার্কসবাদ এর সংযোগটা দেখাতে গেলে আমাদেরকে আলোচনায় আনতে হবে এঙ্গেলসকে, বিশেষ করে ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত তার ‘Anti-Duhring’ বইটিকে এবং ১৮৮৮ সালে লেখা ছোট্ট পুস্তিকা ‘Ludwig Feuerbach and the Outcome of Classical German Philosophy’ টিকে। আমরা অবশ্য এখন এঙ্গেলস এর বেশ কিছু খসড়া নোট পেয়েছি যা এখনো বই আকারে না বের হলেও মার্কস-এঙ্গেলস সংগ্রহশালায় ‘Dialectics of Nature’ নামে রয়েছে। ‘Anti-Duhring এবং ‘Feuerbach’ দুটোই বেশ বিসংবাদপূর্ণ লেখা এবং অধিকাংশই এ দুটো পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু সাধারণ একজন দর্শনশাস্ত্রের ছাত্রের কাছে এইগুলো সহজ নাও লাগতে পারে। এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে ডুরিং, যার লেখার বেশ কঠোর সমালোচনা করেছেন এঙ্গেলস, ছিলেন একজন সমাজতন্ত্রী ও বস্তুবাদী যার সাথে এঙ্গেলস এর বেশ কিছু জায়গাতেই ঐক্য ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি অনৈক্যের জায়গাগুলো উপেক্ষা করেননি বরং বেশ প্রবলভাবেই সেখানটাতে ডুরিং এর সমালোচনা করেছেন।

এঙেগলস নিজেকে ফয়েরবাখের একজন শিষ্য হিসেবে দাবী করলেও তার সমালোচনা করতে কসুর করেননি। একইভাবে ‘The Holy Family’ তে আমরা এঙ্গেলস ও মার্কসকে দেখি ব্রুনো বাউয়ের এর সমালোচনায় এবং প্রুঁধোর সমালোচনা পাই ‘Poverty of Philosophy’ তে। এই বইগুলোর একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো কেবল সমাজতন্ত্রের প্রকাশ্য শত্রুর বিরুদ্ধেই লিখিত হয়নি বরং এমন অনেকের সমালোচনাই আমরা পাই যাদের সাথে তাদের বেশ ভাল পরিমাণ মতৈক্য ছিল। এই জিনিসটাই গড়পড়তা দর্শনশাস্ত্রের পাঠককে একটু বিপদে ফেলে দেয়।

এই প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক যে কেন এঙ্গেলস তার সমসাময়িক কোঁতে, মিল, স্পেন্সার কিংবা গ্রীন প্রমুখদের সমালোচনা করেননি যেখানে বলতে গেলে প্রায় সব জায়গাতেই তাদের সঙ্গে তার মতানৈক্য ছিল ? উত্তরটা দেয়া যেতে পারে এভাবে- মিল এবং স্পেন্সার এর অনেক রাজনৈতিক তত্ত্বের অপ্রাসঙ্গিকতা খুব সহজেই প্রতিভাত হতো যেখানে তৎকালীন সমাজতন্ত্রীদের অনেকের মাঝেই ফয়েরবাখ ও ডুরিং এর প্রভাব ছিল বেশ গভীর। এঙ্গেলস তাই বেছে নিয়েছিলেন সঠিক তত্ত্বকে, তাদের স্থূল রূপগুলিকে নয় বিপদজনক রূপগুলিকে। সত্যি বলতে কি তিনি সহজ প্রতিপক্ষ না বেছে সবচেয়ে কঠিনদেরকেই মোকাবেলা করেছেন।

লেনিনের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক নিদর্শন হল ‘Materialism and Empirio-Criticism’। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত এই বইতে আমরা তাকে লড়তে দেখি বগদানভ, লুনাচারস্কি এবং অন্যান্য অনেকের সঙ্গেই যারা নিজেদের মার্কসবাদী দাবী করতো। লুনাচারস্কি পরে লেনিনের সহকর্মী হিসেবে সোভিয়েত সরকারে যোগ দেন। প্রথম পাঠে লেনিনের বইটিকে গোড়া মার্কসবাদের নিদর্শন মনে হতে পারে। কিন্তু একটু মনযোগ সহকারে পড়লেই লেনিনের অবস্থানটা পরিষ্কার হয়ে আসে। মূলত বগদানভ নিজেকে মার্কসবাদী দাবী করলেও তিনি মার্কসকে উল্লেখ করছিলেন যেখানটাতে মার্কসের সাথে তার মতের বিরোধ ছিল। পুরো বইটাতেই আমরা লেনিনকে পাই একজন যোদ্ধা হিসেবে যেখানে ত’ণ হতে তার তীরগুলো ছুটে গেছে তাদের দিকে যারাই মার্কসবাদীদের মধ্যে ছিলেন আপোষকামী। মার্কসবাদী আন্দোলনের বাইরের বিরোধী পক্ষ যেমন মাখ, আভেনারিউস এর বিরুদ্ধে তো বটেই এমনকি আন্দোলনের ভিতরে অবস্থানকারী যেমন বগদানভ, লুনাচারস্কিদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট। তার মত ছিল দর্শনে নিরপেক্ষতা আসলে এক ধরনের ভন্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। অন্যদিকে তিনি যেখানেই সততা এবং স্পষ্টতা দেখতেন তার প্রশংসা করতেন, এমনকি সেটা তার দর্শনের ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও। যেমনটা বলা যেতে পারে জেমস ওয়ার্ড এর ক্ষেত্রে। জেমস ওয়ার্ড সম্বন্ধে তার মন্তব্য ছিল –

“এই স্পষ্টবাদী আধ্যাত্মিক ভদ্রলোকের প্রশ্ন বরং যথাযথ এবং অনেক পরিষ্কার”।
এইরকম কার্ল পিয়ারসনকে তিনি উল্লেখ করেছিলেন বস্তুবাদের বিবেকবান এবং সৎ শত্রু বলে। এর মধ্যে অবশ্য লেনিনের আরো বেশ কিছু খসড়া নোট পাওয়া গেছে যেখানে আমরা তাকে বিভিন্ন দার্শনিক সমস্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখি।

এই বক্তৃতামালায় আমরা মূলত মার্কসবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। আমরা বিশেষ করে আলোচনায় আনব এঙ্গেলস এর ‘ফয়েরবাখ’ ও ‘অ্যান্টি-ডুরিং’ এবং লেনিনের উপরিউক্ত বইটিকে। পদার্থবিজ্ঞানে নতুন নতুন আবিষ্কার যেমন তেজস্ক্রিয়তা ও ইলেকট্রনের আবিষ্কারকে লেনিনের স্বাগত জানানোর ঘটনাটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কেননা তখন একটা ধারণা ছিল যে এই আবিষ্কারগুলো হয়ত মার্কসবাদের মৌল নীতিগুলোর পরিপন্থী। যাই হোক মূল উৎস ছিলেন এঙ্গেলস, যদিও এঙ্গেলস বরাবরই বলে আসছিলেন অধিকাংশ মৌলনীতিগুলো তিনি মূলত মার্কস থেকে নিয়েছেন।
এখন একজন ছাত্র যে মার্কসবাদকে অধ্যয়নের বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছে সে প্রথম দিকে একটু হতাশ হয়ে পড়ে যখন সে দেখে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর সে মার্কসবাদে খুঁজে পাচ্ছে না। এটার পিছনে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত বেশ কিছু প্রশ্ন তার সামনে হাজির করা হয় অযৌক্তিকভাবে এবং এগুলোর পিছনের ঐতিহাসিক যুক্তিগুলো বেশ ভাল করেই দেখানো যায়। অন্যান্য প্রশ্নগুলির উত্তর বর্তমান তথ্যগুলির ভিত্তিতে দেয়া সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা মন ও মস্তিষ্কের সম্পর্কের কথা বলতে পারি। এটা বলা যাবে না যে আমরা কখনোই এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারব না, এটা সমাধান অযোগ্য কোন কিছু নয়। আমরা অবশ্যই এটা সঠিকভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারব যখন এই বিষয়ে আমরা পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের কোন একটি পথ খুঁজে নিতে পারব বিশেষত মস্তিষ্ক সম্পর্কে। মার্কসবাদ মূলত সত্তার অস্তিত্বে নয় বরং সত্তার হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি নিয়ে মাথা ঘামায়। মার্কসবাদ দাবী করে যে এটা আমাদেরকে কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলোই নয় বরং আমাদের চারপাশের সকল পরিবর্তন এবং ক্রমোন্নয়নকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে, এবং শুধুমাত্র নিস্ক্রিয় ব্যাখ্যাই নয় সঠিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সেগুলো প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতেও আমাদেরকে সক্রিয় হবার দিক নির্দেশনা দেয়।

অধিকাংশ দার্শনিকই সময় এবং পরিবর্তনকে কম-বেশি ব্যাখ্যা করেছেন এক ধরনের বিভ্রম হিসেবে যদিও হেগেলের পর থেকে তারা বিষয় দু’টিকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। এই পরিবর্তমান মহাবিশ্বে অসীম ও অপরিবর্তনীয় সত্তা সন্ধানের প্রচেষ্টাও নতুন নয়। এই ধারার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন প্লেটো। এটা না বললেই নয় যে শুরুর দিকে খ্রিস্টান ধর্মও তৎকালীন প্রচলিত অনেক অ্যাকাডেমিক দর্শনের তুলনায় বিপ্লবাত্মক ছিল। কিন্তু যখনই এটা প্রতিক্রিয়াশীল পথ ধরে তখন কিছু যাজক, পুরোহিত, ধর্মতাত্ত্বিকের হাতে পড়ে এটা হয়ে পড়ে একদম স্থবির। খ্রিস্টবাদের প্রথম শতাব্দীতে ধর্মতত্ত্বের নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত নব্য-প্লেটোবাদীদের হাতে। এখনও আমরা পাই ডিন ইন্জ এর মত কিছু লোকদের যারা সেই পুরনো কাসুন্দিই গেয়ে চলেছেন। এটা কোন আপতিক ঘটনাও নয় যে এদের রাজনৈতিক মতগুলো বরাবরই খুঁজে চলে প্রতিক্রিয়ার অন্ধ চোরাগলি।

আগেই বলেছি ধ্রুপদী দর্শন যেখানে সত্তার অস্তিত্বের প্রশ্নে মাথা কুটে মরে মার্কসবাদ সেখানে সত্তার হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। মার্কসবাদ ধ্রুপদী দর্শনের এইসব প্রবণতাকে অপরিচ্ছন্ন চিন্তার ফসল মনে করে এবং বস্তুজগতকেই পরীক্ষণের বিষয়বস্তু বলে দাবী করে থাকে। অধিবিদ্যার জায়গা আর কোথাও থেকে থাকলেও মার্কসবাদে নেই। বস্তুজগতের ধর্মাবলীর বাইরে মার্কসবাদ কোন কিছুই বিবৃত করার চেষ্টা করে না।
এই অধ্যায়ের বাকী অংশে আমি মার্কসবাদের কিছু মৌল নীতি, যদিও অর্থনীতির বাইরে, নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করব এবং একেবারে শেষের দিকে আমার আলোচনায় আসবে মার্কসের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার মোটামুটি একটা সারমর্ম। আমি অর্থনীতিবিদ নই, তাই এই ভাণও আমি ধরি না যে আমার আলোচনাটা খুব চোস্ত হবে কিংবা হবে বেশ প্রতিনিধিত্বশীল।
প্রথমত মার্কসবাদে রয়েছে তত্ত্ব ও অনুশীলনের এক মেলবন্ধন, অতি আবশ্যকভাবেই অনুশীলনকে মুখ্য ধরে। মার্কসের ‘Theses on Feuerbach’ এর একটি বাক্য দিয়েই শুরু করা যাক:

“মানুষের চিন্তা নৈর্ব্যক্তিক সত্যে পৌঁছুতে পারে কিনা এটা তত্ত্বের বিচার্য বিষয় নয়, এটা প্রয়োগের প্রশ্ন। প্রয়োগের মধ্য দিয়েই মানুষকে তার চিন্তার সত্যতা, অর্থাৎ তার বাস্তবতা ও ক্ষমতা, এই ‘জাগতিকতা’ প্রমাণ করতে হবে।যে চিন্তার সঙ্গে প্রয়োগের কোন সম্পর্ক নেই তা নিয়ে বিবাদ বিসম্বাদ অনেকটাই স্কলাস্টিকদের বিশুদ্ধ বায়বীয় প্রশ্নের মত যা বাস্তব হতে বহু যোজন দূরে ঘুরপাক খায়।”

অন্যদিকে এঙ্গেলস জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখিয়েছেন, শুরুর দিকে জ্যোতির্বিদ্যার প্রকল্পগুলির মাঝে কোপার্নিকাসের প্রকল্প ছিল একমাত্র প্রকল্প যার সাহায্যে পর্যবেক্ষিত ঘটনাবলী যথেষ্ট পরিমাণে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যেত। নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্ব আসার পরপরই আমরা জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত এইসব ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী, যেমন- নেপচুন গ্রহ আবিষ্কার, হ্যালির ধুমকেতুর পর নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি করতে পেরেছি। এটা কোপার্নিকাসের প্রকল্পকে তত্ত্বের মর্যাদায় উন্নীত করে। এখন, এই আধুনিক বিজ্ঞানের কালে এটাকে খুব সাধাসিধে মনে হলেও নব্বই বছর আগে এভাবে বলাটা এত সহজ ছিল না।

এতক্ষণ পর্যন্ত যা আলোচনা হল তাতে বলা যায় মার্কসবাদে কোন কিছুর মূল্য নির্ভর করে মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে তার প্রাসঙ্গিকতার উপর। এইক্ষেত্রে মার্কসবাদকে প্রয়োগবাদের অনেক কাছাকাছি মনে হলেও বাকী আর সব ক্ষেত্রেই এটার দর্শন প্রয়োগবাদ থেকে একেবারেই ভিন্ন। ভিন্ন এই কারণে যে, মার্কসবাদ বিশেষ করে জোর দেয় দুনিয়ার পরিবর্তনশীলতার উপর এবং সবচেয়ে বড় কথা, মার্কসবাদ মনে করে দুনিয়াটা বাস্তব এবং এখানে পরম সত্যের কাছে যদি পৌঁছানো নাও যায়, তার পিছু ধাওয়া তো করা যেতে পারে।

(চলবে------)


মন্তব্য

অভিজিৎ এর ছবি

লেখাটা ভাল লাগল। জেবি এস হালডেন বিখ্যাত হয়ে আছেন তার বিখ্যাত -'রাসায়নিক উৎপত্তি তত্ত্বের জন্য। যেটাকে অনেকে 'ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব'ও বলে থাকেন। আমি অবশ্য হাল্ডেনের রাজনৈতিক দর্শনের চেয়ে তার বৈজ্ঞানিক অবদানের দিকেই বেশি কৌতুহলি ছিলাম। প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে আমার বইটায় একটা কম্পলিট চ্যাপটার ছিলো ওপারিন-হালডেনের কাজের ওপর। সেটা পড়া যাবে এখান থেকে

হালডেন যখন বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্ক্সবাদ নিয়ে বলেছিলেন - সেই বিগত শতকের শতকের চল্লিশের দশকে মার্ক্সবাদের রমরমা অবস্থা ছিলো। বহু বিজ্ঞানীই তখন মার্ক্সবাদের চর্চা করেছিলেন। হাল্ডেন ছাড়াও ছিলেন জেডি বার্ণাল, মার্ক্সিয় দৃষ্টি থেকে তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাস লিখেছিলেন। একনকি আইনস্টানের অনেক লেখাতেও সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভুতি ছিলো। এমনি একটি লেখা আছে এখানে

এখন অবশ্য মূলধারার গবেষক এবং বিজ্ঞানীদের মধ্যে মার্ক্সবাদী বিজ্ঞানী পশ্চিমে তেমন একটা পাওয়াই যায় না। এইবাস্তবতাটা কি আমাদের কোন ট্রেন্ড তুলে ধরে?



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

দিগন্ত এর ছবি

জে বি এস হ্যালডেন নিজে এতটাই কমিউনিস্ট হাসি ছিলেন যে কোলকাতায় পাকাপাকি ঘাঁটি গেড়ে ভারতীয় নাগরিকত্বও নিয়েছিলেন। দক্ষিণ কোলকাতায় তার বাড়ির কাছে বড় রাস্তার নাম তার নামে রাখা হয়েছে।

বিষয় নিয়ে পরে কমেন্ট লিখব।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

নির্বাক এর ছবি

আশা করছি মার্ক্সবাদ নিয়ে নতুন করে কিছু জানা যাবে।

_________________________________________
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ
আমি আজ চোর বটে!

s-s এর ছবি

মন দিয়ে পড়লাম, ভালো লাগলো। পরে বিস্তারিত বলবার আশা রাখি।

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।