অর্থনীতির সহজ পাঠঃ বিষয়- বিদেশি বিনিয়োগ

দিনমজুর এর ছবি
লিখেছেন দিনমজুর [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২০/০২/২০০৮ - ১১:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

dinmojur@yahoo.com
*********দিনমজুর**************
এর আগে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম- "বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কিত কয়েকটি চাপাবাজি" শিরোনামে। আশা করি- এবারের লেখাটি বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কে আরও পরিস্কার ধারণা তৈরি করতে সহায়তা করবে।

বিনিয়োগ ও উন্নয়নঃ
সবসময়ই বিদেশি বিনিয়োগ ও উন্নয়নের প্রসঙ্গটি পাশাপশি আসে। আসলেই বিদেশি বিনিয়োগ উন্নয়নের পূর্বশর্ত কি-না বা এটা আদৌ কতখানি উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এটা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও- এ সম্পর্কিত বিতর্ককে সাধারণত পাশ কাটানো হয়- এড়িয়ে গিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকে উন্নয়ন নামক 'সোনার ডিম' পাড়া মুরগী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আসল চিত্রটি বুঝতে গেলে- বিদেশি বিনিয়োগকে বুঝা দরকার, আর সে উদ্দেশ্যেই আজকের এই পোস্ট। এখানে অর্থনীতির সহজ-সরল ভাষায় বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করার চেস্টা করেছি।

বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কিত সত্যঃ
আসল সত্য হচ্ছে- পাশ্চাত্য অর্থনীতিকে তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই মূলধন(ক্যাপিটাল) রপ্তানী করতে হয়- কেননা, এই অর্থনীতি প্রফিটেবিলিটির সমস্যায় ভোগে, এবং এই সমস্যা থেকে উত্তরণের একটি প্রধান উপায় হলো ক্যাপিটাল রপ্তানী করা। নিচের ব্যাখ্যায় বিষয়টি পরিস্কার হতে পারে-
ক) ক্যাপিটাল ও শ্রমের বিরোধঃ]/b]
কোন পণ্যের দাম বা বাজার মূল্য প্রধানত ক্যাপিটাল, মজুরি ও মুনাফা যোগ করে পাওয়া যায়- যদি অন্যান্য আনুসঙ্গিক খরচ(যেমন পরিবহন খরচ) বাদ দেয়া হয়। এমনকি মুক্ত বাজার অর্থনীতিতেও উতপাদনের গ্রাফে একদিকে ক্যাপিটাল ও অন্যদিকে মজুরি দেখানো হয়। যাহোক- বিষয়টি একটি সহজ সমীকরণের মাধ্যমে দেখানোর চেস্টা করিঃ

[b]মূল্য= ক্যাপিটাল + মজুরি + মুনাফা

সমীকরণটিতে কিছু সংখ্যা স্থাপন করে দেখিঃ

১২০(মূল্য)= ৫০(ক্যাপিটাল) + ৫০(মজুরি) + ২০(মুনাফা) ------(১)

এই সমীকরণে মুনাফা ২০, ধরি ২০ ইউরো। কিন্তু মুনাফার হার হচ্ছে- ২০ ভাগ ১০০ (ক্যাপিটাল ৫০ + মজুরি ৫০) অর্থাত ২০%। আমরা সবাই মনে করি- পুঁজিপতিরা সবসময় মুনাফা সর্বোচ্চ করার চেস্টা করে, কিন্তু অর্থনীতির ছাত্র মাত্রই জানে- তাদের কাছে মুনাফার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মুনাফার হারটি - অর্থাত বিনিয়োগের তুলনায় কতখানি মুনাফা এলো।

এখন যদি শ্রমিকরা অনেক বেশি সচেতন হয়, বা তাদের ইউনিয়ন যদি শক্তিশালি হয় এবং তারা যদি মজুরি বাড়াতে সক্ষম হয়, তবে- সমীকরণটি দাঁড়ায়ঃ

১২০(মূল্য)= ৫০(ক্যাপিটাল) + ৬০(মজুরি) + ১০(মুনাফা) ------(২)

এক্ষেত্রে তার মুনাফা নেমে এসেছে- ২০ ইউরো থেকে ১০ ইউরোতে, কিন্তু মুনাফার হার কমে হয়েছে- ২০% থেকে ৯% এ (১০ ভাগ ১১০)।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় - অনেক কারণেই পুঁজিপতিরা উতপাদনে মেশিনারি ব্যবহারের দিকে আগ্রহী হয় (যেমন- উতপাদিত দ্রব্যাদির মান বৃদ্ধি); কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- পুঁজিপতিরা শ্রমশক্তিকে ক্যাপিটাল দিয়ে স্থানান্তর করতে চায় মজুরি কমানোর উদ্দেশ্যেই। একেই বলা হয় উতপাদনের ক্যাপিটাইলেজেশন- শ্রম শক্তির বদলে অধিক ক্যাপিটাল (মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বিভ্রান্তিকরভাবে যেটাকে উপস্থাপিত করা হয় শ্রম-প্রোডাক্টিভিটির বৃদ্ধি হিসাবে)।

উপরের সমীকরণটিতে বা ঘটনায় মুনাফার হার ২০% থেকে ৯% হওয়ায়- মালিক চাইবে মজুরি খরচ কমাতে। এক্ষেত্রে যদি- কিছু শ্রমিক ছাটাই করা হয়- এবং তাদের কাজটি মেশিনারি দিয়ে করা যায়, অর্থাত শ্রম শক্তিকে ক্যাপিটাল দিয়ে বদল করলে- সমীকরণটি দাঁড়ায়ঃ

১২০(মূল্য)= ৭০(ক্যাপিটাল) + ৩০(মজুরি) + ২০(মুনাফা) ------(৩)

এভাবে, মজুরি কমিয়ে ৩০ ইউরো করে, এবং ক্যাপিটাল বাড়িয়ে ৭০ ইউরো করে- পুনরায় আগের মুনাফা ২০ ইউরো পাওয়া গেলো, এবং মুনাফার হারও আগের মতো অর্জিত হলো (২০%)।

কিন্তু সবক্ষেত্রেই একাজটি করা সম্ভব হয় না। মেশিনারি বাবদ হয়তো- ক্যাপিটাল বাড়ানো সম্ভব হয়- কিন্তু মজুরি কমানো বা শ্রমিক ছাটাই করা অনেক দেশেই- বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স প্রভৃতি শিল্পোন্নত দেশসমূহ বা যেখানে শক্তিশালি শ্রমিক ইউনিয়ন আছে সেখানে করা সম্ভব হয় না। ফলে- মেশিনারির দ্বারা ক্যাপিটাল বাড়ানোর পরও শ্রমিক কমাতে না পারলে- বা মজুরি না কমাতে না পারলে যেটি ঘটেঃ

১২০(মূল্য)= ৭০(ক্যাপিটাল) + ৪০(মজুরি) + ১০(মুনাফা) ------(৪)

ফলে- আবার মুনাফার হার গিয়ে ঠেকে ৯% এ।

সরলভাবে বললে- এটিই হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্যাপিটাল ও শ্রমের বিরোধ।
একে মুকাবেলা করার জন্য অন্যতম যে কাজটি পুঁজিবাদীরা করে- সেটি হলো, শ্রমিকদের উপর চাপ তৈরি করা, তাদের ইউনিয়নগুলোকে দুর্বল করে দেয়া ও ভেঙ্গে দেয়া। এটিই করা হয়েছিলো- ১৯৭০ এর দশকে মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বে ইংল্যাণ্ডে, তার পরপরই রোনাল্ড রেগ্যানের যুক্তরাষ্ট্রে, এবং ১৯৯০ এর দশক জুড়ে ইউরোপের অন্যদেশসমূহে। সুতরাং এটি একটি উপায়- এবং রাজনৈতিক উপায়- পুঁজিপতিদের মুনাফার হার ধরে রাখা বা বৃদ্ধির জন্য।

খ) ক্যাপিটালের বিচরণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যঃ
দ্বিতীয় উপায়টি হলো- ক্যাপিটাল অন্য এমন দেশে নিয়ে যাওয়া যেখানে শ্রম-মজুরি খুবই নগন্য বা শ্রমিক ইউনিয়নও খুবই দুর্বল বা প্রায় নেই। ধরি, পুঁজিপতি তার ক্যাপিটাল জার্মানি থেকে চীনে নিয়ে আসলো। এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে কি ধারণা পাই?

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যটি দ্বারা এটাই বুঝা যাবে যে, ঐ পুঁজিপতি বা বিনিয়োগকারি জার্মানির তুলনায় চীনে অনেক কমে একটি পণ্য উতপাদন করতে পারবে। সে মাত্র ৪৫ ইউরো ক্যাপিটাল খরচ করে এবং আর ৫ ইউরো মজুরি (জার্মানির সাথে চীনের মজুরি পার্থক্য বিশাল) দিয়েই উতপাদন করতে পারবে। ফলে সমীকরণটি দাঁড়ায়ঃ

৭০(মূল্য)= ৪৫(ক্যাপিটাল) + ০৫(মজুরি) + ২০(মুনাফা) ------(৫)

এক্ষেত্রে তার মুনাফা হলো আগের মতই ২০ ইউরো, কিন্তু মুনাফার হার লাফিয়ে হলো- ৪০% (২০ ভাগ ৫০)। ফলে, জার্মানিতে বিনিয়োগ করে যে মুনাফা হতো- চীনে সে একই বিনিয়োগে অনেক বেশি মুনাফা করতে পারে। কেননা, চীনের প্রতি ইউরো বিনিয়োগে সে অধিকতর মুনাফার হার পায়।

অধিকন্তু, সে জার্মানির তুলনায় অনেক কম দামে পণ্য উতপাদন করতে পারে। এবং একই মুনাফা রাখলে দেখা যায় জার্মানিতে যেটার মূল্য ১২০ ইউরো, চীনে সেটির দাম ৭০ ইউরো। ফলে, এবার সে তার পণ্য নিয়ে জার্মানিতে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে তাদের সাথে- যারা এখনও উচ্চ মজুরিতে উতপাদন করছে।

মোটামুটি- এটাই হলো বর্তমান মুক্ত বাজার অর্থনীতির তথাকথিত 'বিশ্বায়ন'এর মূল বিষয়। এখন, পণ্যের বাজারই শুধু খোঁজা হয় না- এখন ক্যাপিটালও দুনিয়া জুরে ঘুরে বেড়ায়।

এখানে বুঝতে হবে যে, উপরের উদাহরণে চীন যতখানি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উদগ্রীব- তার চেয়েও জার্মানির বিনিয়োগকারি মরিয়া বিনিয়োগের জন্য অন্য একটি অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে। সেকারণেই- 'বিশ্বায়ন', 'মুক্ত বাজার অর্থনীতি' এসব তত্ত্বের উদগাতা পাশ্চাত্য- যারা প্রোফিটেবিলিটি হ্রাসের ক্রাইসিসে ভুগছে, এবং যাদের টিকে থাকার জন্যই ক্যাপিটাল ভিন্নদেশে রপ্তানি করা আবশ্যক।

এখন ক্যাপিটাল সে দেশেই যেতে চাইবে যেখানে মুনাফার হার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অনেকসময়, কোন দেশে মুনাফার হার বেশি হওয়ার পরেও সেখানে বিনিয়োগ হয় না। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিনিয়োগ কর্তারা উল্লেখ করে- সেটি হলো বিনিয়োগের উপযোগি পরিবেশ। বিনিয়োগকারিরা বিনিয়োগের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়, এটি ব্যহত হয় বিনিয়োগকৃত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি- সে রাষ্ট্রের তথাকথিত দুর্নীতি-গ্রস্ততা- সে রাষ্ট্রের জনগণের পশ্চাতপদতা- রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত পশ্চাতপদতা প্রভৃতি। কিন্তু মুনাফার হার উচ্চ হলে- এসব বাঁধা দূরীকরণে সেই বিনিয়োগকারি রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়।

প্রোফিটেবিলিটি হ্রাসের ক্রাইসিস থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহঃ

প্রোফিটেবিলিটি ক্রাইসিস থেকে বাঁচতে করপোরেশনগুলো অন্যতম পদক্ষেপ হিসাবে যে কাজটি করে সেটা হলো- নিজ দেশে মজুরি কমায়, শ্রমিক ছাটাই করে, এবং তাদেরকে মেশিনারি দিয়ে প্রতিস্থাপন করে। এছাড়াও আর যেসব কাজ করপোরেশনগুলো করে- সেগুলো হচ্ছে- মার্জার ও অধিগ্রহণের মাধ্যমে উতপাদনকে র‌্যাশনালাইজ করা, অ্যাসেট স্ট্রিপিং করা, রিস্ক কমানোর জন্য নতুন ইনস্ট্রুমেন্ট সৃষ্টি করা প্রভৃতি। রাষ্ট্র তাদের হয়ে যেসব কাজ করে সেসব হচ্ছে- শ্রমিক ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করে, পাবলিক সেক্টরসমূহকে প্রাইভেটাইজেশন করে, সমাজের দুর্বল অংশের উপর বোঝা চাপিয়ে দেয় (যেমন, পেনশনকে কমার্শিয়ালাইজ করা যাতে এই ফাণ্ড কর্পোরেশনগুলো তাদের প্রোফিটেবিলিটি বাড়ানোতে ব্যবহার করতে পারে- এটিই বর্তমানে পাশ্চাত্যের দেশসমূহে পেনশন ক্রাইসিসের অন্যতম মূল কারণ), এবং যুদ্ধ-অর্থনীতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে (যুদ্ধে তাতক্ষণিকভাবে বিদ্যমান সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়, এবং সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে করপোরেশনগুলোর উতপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়)।

কিন্তু, উপরিউক্ত পদক্ষেপসমূহের চেয়েও পাশ্চাত্য সরকারসমূহ যেসব পদক্ষেপ নেয়- সেটা হলো তৃতীয় বিশ্বে বোঝাটা চাপিয়ে দেয়া। মোটামুটি তিনটি পদক্ষেপ দেখা যায়ঃ

১। তৃতীয় বিশ্বকে (প্রাচ্যে ও দক্ষিণের দেশসমূহকে) তাদের বাণিজ্যকে উদার বা মুক্ত করতে বাধ্য করে; এটা করা হয় পাশ্চাত্যের করপোরেশনগুলোর জন্য বাজার তৈরি করার উদ্দেশ্যে। (WTO এর প্রধান ভূমিকা)।
২। ক্যাপিটাল-ফ্লো'কে অবাধ করতে তৃতীয় বিশ্বকে বাধ্য করে, এটা করা হয়- করপোরেশনগুলোর বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করার ও একইসাথে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ার উদ্দেশ্যে। (IMF ও World Bank এর প্রধান ভূমিকা; বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক বিষয় দেখে WTO)।
৩। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের পাবলিক সেক্টরগুলোকে (যেমন- পানি, বিদ্যুত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এনার্জি প্রভৃতি এবং সরকারি প্রোকিরমেন্ট) প্রাইভেটাইজ করতে ও মুক্ত করতে বাধ্য করে। (WTO এর পক্ষ থেকে GAT এর প্রধান ভূমিকা)।

এসমস্ত পদক্ষেপ নেয়া হয় - যখন করপোরেশনগুলো নিজ দেশে শ্রমিকদের চাপে প্রোফিটিবেলিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকে এবং এর থেকে উত্তরণ পেতে চায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো- করপোরেশনগুলো কখনোই তৃতীয় বিশ্বে প্রবেশ করতে পারতো না যদি- তাদের রাষ্ট্র এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন না করতো। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়- World Bank, IMF, WTO, GAT প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানসমূহ না থাকলে করপোরেশনগুলো সফল হতো না। সুতরাং এসব সংস্থার কর্মকাণ্ড ও কার্যক্রম সম্পর্কেও আমাদের পরিস্কার ধারণা থাকা দরকার।

অর্থনৈতিক ইস্যুর বিচারে দুর্ণীতি ও শাসন-ক্ষমতাঃ

এটা স্বাভাবিক যে, কোন একটি রাষ্ট্রের দুর্নীতি ও শাসন-ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু- তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শাসন-ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির বিষয়ে পাশ্চাত্যের উদ্বেগের কারণ অন্যত্র। আসলে, দুর্নীতি বিরোধি মূল্যবোধ ও জনগণের গণতন্ত্রের প্রতি আকাঙ্খাকে পাশ্চাত্য ব্যবহার করে- তাদের নিজেদের স্বার্থে। যদি কেউ প্রকৃতই দুর্নীতি খুঁজতে চায়- তবে তাকে বেশিদূর যেতে হবে না- যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপের দিকে তাকালেই দুর্নীতি পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসাবে তাকান ইটালির দিকে- যেখানে প্রকাশ্যে ও অপ্রতিরোধ্যভাবে চুরি-চামারি হয়; তাকান ইউরোপিয়ান আমলাদের মিলনক্ষেত্র EC Commission এর দিকে- যা দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট!
সুতরাং- তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতি দূর করা পাশ্চাত্যের মূল উদ্দেশ্য নয়। গণতান্ত্রয়নও তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়।

উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগের ভূমিকাঃ

উন্নয়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কে চার ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি দুনিয়া জুরে প্রচারিত। প্রথমে সেগুলোর উপর দৃষ্টি দেয়া যাকঃ

ক) মুক্ত বাজার অর্থনীতি দ্বারা প্রচারিত দৃষ্টিভঙ্গিঃ
তথাকথিত উদার অর্থনীতির দেশসমূহের শাসন ব্যবস্থা 'পাঁচটি সত্য' এর নির্ভর করে বিদেশি বিনিয়োগের সন্ধান করেঃ
১। বিদেশি বিনিয়োগ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
২। বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।
৩। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে- উচ্চতর মানের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি এবং বিশ্ব বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জিত হয়।
৪। কেউ তৃতীয় বিশ্বকে বিনিয়োগের জন্য বাধ্য করছে না- তৃতীয় বিশ্বই নিজের প্রয়োজনে এই বিনিয়োগের জন্য আবেদন-নিবেদন করে।
৫। প্রাইভেট সেক্টর হচ্ছে- উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন স্বরূপ।

তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক-সাহিত্যের এবং সরকার নীতির ৯০% এরও বেশি এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরিচালিত।

খ) বিদেশি বিনিয়োগ ভালোও না, খারাপও না- এটা নির্ভর করছে কিভাবে এটাকে কাজে লাগানো হচ্ছেঃ

আরেক ধরণের পরিমার্জিত দৃষ্টিভঙ্গি (যেমন, অক্সফামের ব্রিফিং পেপার) আছে- যেখানে বলা হচ্ছে- "যথাযথভাবে পরিচালিত হলে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি, দক্ষতা, বাজারে প্রবেশ এবং উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে- অবশ্যই বিদেশি বিনিয়োগের ঋণাত্মক প্রভাবের সাথে ধনাত্মক প্রভাবকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং একে হতে হবে ধারাবাহিক বা দরকারে বিদেশি বিনিয়োগে বিশেষ টবিন ট্যাক্সও আরোপ করতে হবে"। অর্থাত- বিদেশি বিনিয়োগ ভালো বা খারাপ কোনটাই নয়- এটা নির্ভর করছে কিভাবে একে পরিচালনা করা হচ্ছে তার উপর। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের কাছেই জনপ্রিয়- বিশেষ করে, পূর্ব এশিয়া ও আর্জেন্টিনায় ১৯৯৭-২০০১ এর ক্রাইসিসের পর থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি রিফর্মড মুক্ত-বাজার অর্থনীতিবিদদের কাছে জনপ্রিয়।

গ) এইড ঋণ-সমস্যা তৈরি করে- আর বিদেশি বিনিয়োগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরো বড় সমস্যা তৈরি করেঃ

এই দৃষ্টিভঙ্গি নব্য-উদার অর্থনীতিবিদদের দ্বারা প্রচারিত উপরের দুই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলছে- বিভিন্ন এইড-দান-খয়রাত- এসব দেশের ঋণ সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলে, কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ আরো বড় ক্ষতি করে একটা দেশের অর্থনীতির- বা অর্থনীতিকেই পঙ্গু করে দেয়-বিনিয়োগ কারির উপর সম্পূর্ণ নিভরশীল করার মাধ্যমে- সে দেশের বৈষম্য বাড়িয়ে- এবং দেশের মানুষকে আন্তর্জাতিক করপোরেশনগুলোর অর্থনৈতিক শোষণের হাতে তুলে দিয়ে।

ঘ) বিদেশি বিনিয়োগের সাথে উন্নয়নের কোন উপায় না, এটি কেবলমাত্র করপোরেশনগুলোর প্রোফিটেবিলিটি ক্রাইসিস থেকে উত্তরণের উপায়ঃ

এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে- শিল্পোন্নত দেশসমূহ সস্তা শ্রম ও বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই তৃতীয় দেশসমূহে বিনিয়োগ করতে যায়। এক্ষেত্রে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো- শিল্পোদ্যক্তাদের প্রোফিটেবিলিটি বৃদ্ধি করা।

মেক্সিকো, পূর্ব এশিয়া ও আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতাঃ

মেক্সিকো, থাইল্যাণ্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং আর্জেন্টিনা, একয়টি দেশকে প্রায়ই IMF, World Bank ও নব্য-উদার অর্থনীতিবিদরা মডেল হিসাবে উপস্থাপন করে। তাদের ভাষ্যমতে- বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে যে কোন দেশের ব্যপক মাত্রায় উন্নয়ন সম্ভব- তারই মডেল বা উদাহরণ এদেশসমূহ। কিন্তু এসব দেশের প্রকৃত অভিজ্ঞতা কি?

১৯৯৫ সালে, মেক্সিকো পেমেন্ট ক্রাইসিসে পড়েছিলো এবং ব্যাংক সমুহে ভীড় বেড়ে গিয়েছিলো- অর্থনীতি নিম্নগামী হয়েছিলো ও মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগি ছিলো। 'সমস্যাগ্রস্ত আমেরিকান' ব্যাংকসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারের নির্ভরশীল হওয়ায় এ সময় যখন যুক্তরাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো- তখন এ সমস্যার শুরু। ১৯৯৫ সাল থেকে মেক্সিকো এর বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাকি ক্ষেত্রসমূহও মুক্ত করে দেয়। এবং বর্তমানে মেক্সিকো চুড়ান্ত রকমের ডিইনডাস্ট্রিয়ালাইজেশন ও কর্মসংস্থানহীনতায় ভুগছে।
এর পর আসে ১৯৯৭/৯৮ এর পূর্ব-এশিয়ার ক্রাইসিস। ১৯৯০ সালের দিকে থাইল্যাণ্ড IMF এর চাপে আংশিকভাবে ক্যাপিটাল ফ্লো অবাধ করে দেয়। এই বিনিয়োগ বা ক্যাপিটাল আসে ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে অত্যন্ত শর্ট টাইম নোটিশে (রাতারাতি নির্দেশ থেকে ছয়মাস ব্যবধানে)- এবং তা প্রাইভেট সেক্টর এন্টারপ্রাইজসমুহকে লোন দেয়া হয়। যখন আগস্ট, ১৯৯৭ এ বাথের সংকট তৈরি হলো- বিনিয়োগকারিরা আতংকিত বোধ করে এবং তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে আরম্ভ করে। সেসময়- ব্যাংকসমূহ প্রাইভেট কোম্পানি থেকে তাদের লোন ফেরত চায়, কিন্তু বলাই বাহুল্য যে, প্রাইভেট কোম্পানিসমূহ তা দিতে অপারগ ছিলো, ফলে- থাইল্যাণ্ড বাথকে বাঁচাতে দেশের প্রায় সমস্ত রিজার্ভ নিঃশেষ করে ফেলে। অন্য অর্থে বলতে গেলে, প্রাইভেট ঋণ পাবলিক ঋণে রূপান্তরিত হয়। শীঘ্রই থাই ক্রাইসিসের হাওয়া লাগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং কোরিয়ায়। দ্য ইকোনমিস্টের রিপোর্টে আমরা দেখি,
"For much of the region, the crisis destroyed wealth on a massive scale and sent absolute poverty shooting up. In the banking system alone, corporate loans equivalent to around half of one year's GDP went bad- a destruction of savings on a scale more usually associated with a full-scale war." (The Economist, February8. 2003)

আর্জেন্টিনাকে দীর্ঘদিন ধরেই IMF/WB মডেল হিসাবে উপস্থাপন করতো। এই আর্জেন্টিনাকে মডেল হিসাবে উপস্থাপন করা হয় - কেননা, এটি এর বাণিজ্যে যেকোন প্রতিবন্ধকতা তুলে নিয়েছে, ক্যাপিটাল ইন-ফ্লো ও আউট-ফ্লো এর জন্য নিজেকে 'ওপেন' করে দিয়েছে, ব্যাংক থেকে মল- সবকিছুই প্রাইভেটাইজ করেছে- সবই করেছে বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার জন্য। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে IMF/WB এর এই "মডেল"টি তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ে। ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণ (১৫৫ বিলিয়ন ডলার) নিয়ে দেশটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক এক অরাজক পরিস্থিতে পড়ে।

এক কথায় তাই বলা যায়- বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় সত্যটি হচ্ছে- এটি উন্নয়ন প্রত্যাশী দেশসমূহের অর্থনিতিকে নির্ভরশীল অর্থনীতিতে পরিণত করে, এবং তথাকথিত 'ডেভলোপিং' দেশসমূহের অর্থনীতিও চুড়ান্ত রকমের নির্ভরশীল- যাকে বলা হয় 'বুদবুদ' অর্থনীতি- কেননা, আজ কোন একটি অর্থনীতিকে আপাত শক্তিশালী মনে হলেও- কতদিন তা একই আবস্থানে থাকবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না!!


মন্তব্য

প্রবাসি এর ছবি

সুবিনত মুস্তাফি ভাই এর স্টাইল
মনে হইতাছে
আফসোস বাংলাদেশ সরকারের কেউ দেখবো না লেখা গুলি যারা দেশের অরথনিতী নিয়ন্ত্রন করেন ।
খুবই তথ্যবহুল লেখা

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

প্রবাসী ভাই,

আমার পজিশন একটু ভিন্ন। যদ্দুর বুঝি, বিশ্বায়ন শুরু হয়ে গেছে। ১৫ বছরের বেশী হইলো। এর বিপরীতে আপনে চাইলে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকতে পারেন। নাইলে এটারে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারেন। Riding the tiger অনেকটা। ভালো মতো সওয়ার হন, বাঘ চড়েন - নাইলে বাঘ আপনেরে খাবে।

আর দরজা জানালা বন্ধ করলেও খুব একটা লাভ হবে না। মনের জানালা, টিভির পর্দা খুলে দিছে সব। এর আগের পোস্টে লেখছিলাম কেমনে ৮ লক্ষ লোক দেশ ছাড়ছে এক বছরে। হপায় তো শুরু। আরো ৮০ লক্ষ লোক চলে যাবে। ওদের কিছু বলে-কয়ে দেশে রাখতে পারবেন না। উন্নয়ন যদি না দেওয়া যায়।

দিনমজুরের কথা একদিকে ঠিক। ফরেন পুঁজি আসবে নিজের লাভ খুঁজতে। আমাদের উঠায় দেওয়া ওদের কম্মো না। সেই দায়িত্ব আমাদের। ৩৫ বছর ধরে পলিসি লেভেলে অনবরত ব্যর্থতাই দেখা যাচ্ছে। অনেকে বলে আরে দেশ তো ৫-৬% হারে বাড়তেছে। আমি বলি সেইটাতে সরকারের অবদান নগণ্য। যা করছে, দেশের ব্যবসায়ীরা, রপ্তানীকারকরা নিজের প্রচেষ্টায় করছে। রাজনীতিবিদরা আর সরকার খালি চান্দা লুটছে। Rentier গোষ্ঠী। সেই রকমই ফরেন পুঁজির কি ব্যবহার হবে, সেইটা থেকে আমরা কি ফায়দা তুলতে পারবো, সেইটা আমাদের দায়িত্ব, সরকারের পলিসিমেকারদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব বিদেশীদের না।

দিনমজুর খুব সুন্দর করে এশিয়ান ক্রাইসিস আর ল্যাটিন আমেরিকান ক্রাইসিস পর্যন্ত এসে থেমে গেছেন। সেইটা প্রায় ৮-৯ বছর আগের কথা। এর পর ওদের পলিসি প্রতিক্রিয়ার কথা বলেন নাই। এইটাও বলেন নাই পূর্ব এশিয়ার বর্তমান রমরমা অবস্থার কথা। বিদেশী বিনিয়োগের অবারিত প্রবাহের কথাও কিছু বলেন নাই। বাব্‌ল বইলা উড়ায় দিছেন। এই বাব্‌লের দিকেই তাইলে আমাদের যুবসমাজ দৌড়ায় - মালেশিয়া আর সিঙ্গাপুরে দেশান্তরী হয়। বাব্‌লটা তাইলে নিজের দেশেই আনি না কেন?

যাক কিছু প্রমাণাদি দেখাতে হবে। অসুবিধা নাই - টাইম পাইলে অন্তত ডজন দুয়েক উন্নয়নশীল দেশের বর্তমান পরিসংখ্যান দেখানো যাবে।

আবারো বলি, ফরেন পুঁজি সর্বরোগের ঔষধ না। কিন্তু সেইটারে বেনিয়া বেনিয়া বইলা উড়ায় দিলেও এক-পেশে আলোচনা হয়। কিন্তু এইসব ideology-র সাথে ঝগড়া কইরা আসলে কোন লাভ নাই। এইটা দুই মাস আগে রাজনীতি নিয়া তর্কের সময়ই বুঝছি। কাউরে শয়তান ভাইবা নিলে সে আজীবনই শয়তান মনে হয়। আমি অতো কট্টর ideological না, আমারে pragmatic কইতে পারেন। একেবারে শাদা কিছু না, একেবারে কালোও কিছু না। মাঝখানে বিরাট একটা রেঞ্জ আছে। পরিমিত মদ খাইলে মজা পাইবেন, আর মদ বেশী গিললে alcoholic হইয়া মারা যাইবেন। কতখানি খাইবেন কেমনে খাইবেন, আপনের ব্যাপার। মদ বিক্রেতারে গাইল দিয়েন না।

শেষ হিসাব একটাই - দেশের মানুষের লাভ। সেইটা যেভাবে আনা যায়।

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

দিগন্ত এর ছবি

বিদেশী বিনিয়োগের উলটো পিঠও আছে, আমার মনে হয় সে নিয়েও কিছুটা লেখা দরকার।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

হিমু এর ছবি

সুলিখিত পোস্ট। আলোচনা আরো সামনে গড়াবে মনে হচ্ছে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অতিথি লেখক এর ছবি

*******দিনমজুর**********
সবাইকে আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।

সুবিনয় মুস্তফি,
আপনার আলোচনার কয়েকটি পয়েন্টে আমার বক্তব্য নিম্নরূপঃ
১। দুই ডজন উন্নয়নের দেশের যে কথা বললেন- আপনি উদাহরণ দিলে সেটিতে ধরে ধরে দেখানো যেতে পারা যাবে- আসলে সেসব দেশে কি কি হয়েছে। একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আজকের নিওলিবারেল ইকোনোমিস্টদের মতবাদ অনুসারে উন্নয়ন বা উন্নতির যে মাপকাঠি গুলো নির্ধারিত- সেগুলো অঢিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেক, উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র তা থেকে পাওয়া সম্ভব না। প্রবৃদ্ধি, গড় ইনকাম- এসবের ফাঁক-ফোকরগুলো আশা করি এখন সবাই কমবেশি জানে, পরে সময় করে হয়তো আরো পরিস্কার যেতে পারে।
২। আপনাকে একে একে ৮০ টিরো বেশি দেশের উদাহরণ দিয়ে দেখানো যেতে পারে- যারা অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল(ঋণ-দান-খয়রাত-সাহায্য-বিনিয়োগ) হতে গিয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতরই হয়েছে।
৩। পূর্ব এশিয়া ও আর্জেন্টিনার বর্তমান অভিজ্ঞতাও খুব ভালো কিছু না। মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড প্রমুখ দেশের শিল্প টিকিয়ে রাখতে সেখানকার শ্রমিকদের মজুরি চাহিদা যখন উচ্চমুখী তখন সেসব দেশ- আমাদের মত কম মজুরির দেশের দিকে নজর দিচ্ছে। আমরা যাচ্ছি, এবং ভাবছি- সেসব দেশ কতই না শিল্পোন্নত!!!! অথচ, মূল বিষয় হচ্ছে- সেসব দেশের কৃষি তো আগেই শিল্পের আগ্রাসনে ডুবেছে, এখন শ্রমিকরাও কাজ হারাচ্ছে- বেকারের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। পুঁজিপতিদের অবশ্য আয় কমছে না এখন, ফলে রিসেন্টলি প্রবৃদ্ধিও বেশি দেখানো সম্ভব হচ্ছে (যদিও সেই প্রবৃদ্ধি এখন আর আগের সেই লেভেল ধরতে পারছে না), এই প্রবৃদ্ধি ধরতে আরেকটি কাজ তাদের করতে হয়েছে- সেটা হলো নিজেদের পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে হয়েছে। সারাবছরই অসংখ্য পর্যটক এদেশসমূহে আসছে- অসংখ্য মার্কেট-মল-শপিং কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে, সেখানে বিদেশী ব্রাণ্ড জিনিসপত্রের সাথে সাথে দেশীয় জিনিসপত্রও কিছু বিক্রি হচ্ছে- কিন্তু এই পর্যটন শিল্পের বিকাশের উদ্দেশ্যে দেশের মা-বোনকেও বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
থাইল্যাণ্ডের ব্যংকক শহরেই অলিতে গলিতে পাবেন- অসংখ্য বার-পাব-ম্যাসেজ সেন্টার- ও পতিতালয়, কিন্তু এতসব কিছুর পরেও সাধারণের জনগণের জীবনযাত্রার মানের কোন উন্নয়ন হয়নি, থাইল্যাণ্ডের ৪০% গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখন দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে!!!
৪। আমি শয়তানকে শয়তান বলার মধ্যে কোন দোষের কিছু দেখি না। বরং তাকে সাদা ও কালোর মাঝামাঝি বলার মধ্য দিয়ে এর দোষকে হালকা করার প্রবনতাকেই বেশি চোখে পড়ে।
আপনাকে ধন্যবাদ।

দিগন্ত,
উল্টো পিঠ থাকতে পারে- এটা কি আপনার বিশ্বাস টাইপের কিছু??
যদি বিশ্বাস না হয়ে যুক্তি মনে করেন- তবে সেই যুক্তির উপস্থাপনপূর্বক আলোচনা- তর্ক- বিতর্কে অংশগ্রহণই কাম্য।

অতিথি লেখক এর ছবি

*****************দিনমজুর**************

আসলে আমি এখনো সচল হতে পারিনি বিধায়- আমার মন্তব্য সাথে সাথে আসে না- অনেক সময় লাগে। এতে অনেক খানি বিরক্তিও তৈরি হয় মাঝে মাঝে, ফলে- আলোচনাটা স্ভাবাভিক গতিতে কনটিনিউ করা অনেক খানি কঠিন হয়ে পড়ে!!

একজন প্রবাসী এর ছবি

দিনমজুর ভাই
দেশী বিনিয়োগ বলেন আর বিদেশি বিনিয়োগ কোনোটাই কাজে আসবেন না যতক্ষন পর্যন্ত না আমরা নিজেরা ঠিক হচ্ছি ।
বাংলাদেশে ১৯৭১ এর আগে কমিউনিস্ট পন্থিরা যেমন দেশ কে স্বাধীন করার জন্য একটা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেছিলো
বাংলাদেশের উন্নয়ননের জন্য এমনই আরেকটা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক দরকার
যারা স্কুল কলেজ থেকে যুবক দের সত্ পথে চলার অভ্যাস করতে সহায়তা করবে তা সেই যুবক যেই প্রফেশনেই যাক না কেনো।
সত্ ভাবে চলা আসলে একটা অভ্যাসের ব্যাপার
(আমাদের এত্ত করাপ্ট দেশে এখনও কিছু সত্ ভালো মানুষ আছেন
সত্ ভাবে চলার রিদম টা ধরিয়ে দিতে পারলেই উন্নয়নের কাজ ৫০% হয়ে যাবে )
তারা নিজেদের চাইতে দেশের ও দেশের লোকদের সার্থ আগে দেখবে
এবং
সকাল সাতটার কাজ সাতটায় করবে ডিসিপ্লিন্ড হবে
এবং চান্দাবাজি মাস্তানি নেশা করাকে ঘৃনা করবে
বেশি না একটা জেনারেশন তুলে দিতে পারলেই দেখবেন বিদেশি বিনিয়োগ আনলেও সেটা দেশের অনুকূলেই যাচ্ছে তা সে যত বড় বাঘা কম্পানি ই হউক না কেনো।

আমি নিজে সচল না
অচল আছি
অচল থাকতেই ভালো লাগতেছে
তবে দিনমজুর ভাই রে সচল করার অনুরোধ জানানোর দুঃসাহস দেখাইতেছি ।
তাইলে উনার লেখা গুলি ট্র্যাক করতে সুবিধা হইত

অতিথি লেখক এর ছবি

****দিনমজুর**********
একজন প্রবাসী,
আপনাকে ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য, যদিও সেটির সাথে আমার কিছু জায়গায় দ্বিমত রয়েছে!!

কেননা- আপনি যে গ্রাউণ্ড ওয়ার্কের কথা বলেছেন- সেটি আমার কাছে মনে হয়- একটি মাত্র উদ্দেশ্যেই করা যায়- তা হলো আমাদের সরকার ব্যবস্থাসমূহের গণবিরুধী সমস্ত নীতি নেয়ার ও সাম্রাজ্যবাদ তোষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা। তাহলেই হয়তো- মানে ব্যাপক মাত্রায় গণ-আন্দোলন থাকলে হয়তো সরকারসমূহ বিদেশী বিনিয়োগ বন্ধ করতে পারে!!

আর, আপনার সাথে দ্বিমতের জায়গা হলো- আপনি মনে করেছেন, দুর্ণীতিমুক্ত হলেই আমাদের দেশে বিদেশী বিনিয়োগকে কাজে লাগাতে পারবো। আমার মতে - দুর্ণীতি মুক্ত হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরই লাভ- ফলে, তাদের গরজও মাঝে মধ্যে দেখা যায়, এ বিষয়ে পোস্টেই আলোচনা করা হয়েছে।

একটা কথা এখানে বলতেই হয় যে, আমার দেশকে দুর্ণীতি গ্রস্ত বলতে আমি রাজি নই, স্বাধীনতার পরবর্তিতে ৩৬ বছর ধরে দুর্ণীতি -লুটপাট করে আমাদের শাসকগোষ্ঠী চ্যাম্পিয়ন হিসাবে নাম কুড়ানোর পরেও এ দেশকে করাপ্টেড বলতে আপত্তি করি একারণে যে- দুর্ণীতির সাথে যুক্ত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা, এবং সাম্রাজ্যবাদী মোড়ল দেশসমূহও অনেক বড় দুর্ণীতিবাজ। আমার দেশের কৃষকেরা দুর্ণীতি করে না, বরং তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করে যে ফসল ফলায়, তার দামই সে তুলতে পারে না- ফলে লসের মুখে পড়ে ও শেষ পর্যন্ত জমিজিরাত সব বেচে দিয়ে সর্বসান্ত হয়; অর্থাত আমাদের চাষীরা এই কঠোর পরিশ্রম করে লসে উতপাদন করে আমাদের মুখের অন্ন তুলে দেয় (আমাদের কৃষি, আমাদের প্রাণ শীর্ষক পোস্ট দ্রষ্টব্য http://www.sachalayatan.com/guest_writer/12622)। শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও তাই। কৃষকরা, শ্রমিকরা সেই কাকডাকা ভোরে কাজে বের হয়ে- সন্ধায়/রাতে বাসায় ফিরে, তারা তো ঠিকই সময়ের কাজ সময়েই করছে!!!

ফলে- সমস্যার মূল অন্যখানে। আপনি যে বিষয়টির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সেটি কোন সমস্যাই নয়!!!
আপনি রাষ্ট্রের সেলারি স্ট্রাকচার পরিবর্তন করবেন না- অথচ, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম হুহু বাড়াবেন, এবং অসংখ্য লোভনীয় দ্রব্যাদির আকর্ষণীয় উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের চাহিদার লেভেলকে গগনে তুলে দিবেন, আর লোকে ঘুষ খাবে না, দুর্ণীতিগ্রস্ত হবে না- এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই।

আপনাকে আবারো অনেক অনেক ধন্যবাদ।

একজন প্রবাসী এর ছবি

দিনমজুর ভাই
বাংলাদেশের স্যালারী স্ট্রাকচার আসলেই খারাপ কোনো দ্বীমত নাই এখানে ।
কিন্তু ৫ লাখ টাকার বিজনেস প্রজেক্টে যদি দুই লাখ টাকা ঘুষ /চান্দা দিতে হয় তাইলে
কে যাবে বিজনেস করতে, বলেন?
আপনার চিন্তাভাবনা টা ভালো তবে এখানে আবেগটা বেশি কাজ করছে যেমন আপনার ধারনা দুর্নীতির সাথে যুক্ত মানুষ হাতে গোনা
কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন দেশে সত্ লোকের সংখ্যা হাতে গোনা ।
আর বাংলাদেশে অতীতে বিদেশি বিনিয়োগের কি হাল হয়েছে সেটাও একটু খোজ নিলে দেখতে পাবেন বিদেশিদের চাইতে আমাদের দেশী ভাইদের লুটপাটই বেশি ।
আর বেতন বাড়ালেই যে সমস্যার সমাধান হয় না তার উজ্জ্বল উদাহারন র‌্যাব ।
এদের বেতন সুযোগ সুবিধা বেশি দিছে কিন্তু তাই বলে কি দুই নাম্বারী করা বন্ধ করছে ?
সুতরাং দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ যাই বলেন না কেনো আগে পরিবেশ তৈরী করতে হবে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

*******দিনমজুর***********
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

দেখুন, আমি কিন্তু মনে করি- আমার আলোচনায় আবেগ থাকলেও আবেগ মূল বিষয় নয়, বরং আমি যা যা বলেছি প্রতিটি যৌক্তিক বলেই মনে করি। আমি যখন বলেছি- দেশের হাতেগোনা লোক দুর্ণীতির সাথে যুক্ত, তখন তথ্য-উপাত্ত নিয়েই বলেছি। আমাদের মোট কর্মসংস্থানের ৫৬% ই আসে কৃষি থেকে। এরা আসলেই মাথার ঘা পায়ে ফেলে দেশের জিডিপিতে অবদান ২১.৭৭% (সত্তরের দশকে এটা পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি ছিল), এই কৃষক প্রতিবছর লসে উতপাদন করতে করতে আজ সর্বসান্ত।
আমাদের দেশের জিডিপির প্রধান অন্য দুটি খাত রেমিটেন্স ও রপ্তানি। রেমিটেন্স এর জন্য বিদেশের মাটিতে কি অবর্ণনীয় কষ্ট ও পরিশ্রমই করে আমাদের শ্রমিকেরা, আর রপ্তানী পণ্য উতপাদনেও আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকেরা, আমাদের ট্যানারি শ্রমিকেরা, আমাদের চিংড়ির শ্রমিকেরা প্রচণ্ড শ্রম দিয়ে মালিকদের বঞ্ছনা-শোষণ-নিপীড়ন সহ্য করে আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখে!! আপনি আমার কৃষি নিয়ে পোস্ট টি মনে হয় পড়েন নি!!! পড়ার আহবান জানাচ্ছি- অনেক কিছুই পরিস্কার হতে পারে!!

আর, জিডিপিতে বিদেশী বিনিয়োগের অবদান মাত্র- ২% বা তারও কম!!!
কেন, এত কম?? একটি পরিসংখ্যান দিলেই পরিস্কার হবে- ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত এদেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ ছিলো ২১৮.৫ কোটি ডলার, আর এর বিপরীতে বিনিয়োগকারিরা ২৭৪.৪ কোটি ডলার নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করেছে!!!!!!

আপনি আমাদের দেশের এক এক করে বিদেশী বিনিয়োগের পরিসংখ্যান দেখেন- সেই পাওয়ার সেক্টর দেখেন- গ্যাস-কয়লা দেখেন, আপনি টেলিকমিউনিকেশন দেখেন- বুঝতে পারবেন- কি পরিমাণ টাকা আমরা প্রতিবছর বিদেশী পাচার করে দিচ্ছি। ঠিক আছে, এর পরে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টর নিয়ে একটি পোস্ট দিচ্ছি, আশা করি পড়বেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।