আমার আত্মহনন বিষয়ক জটিলতা

ইমরুল কায়েস এর ছবি
লিখেছেন ইমরুল কায়েস (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৪/২০০৮ - ১:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তৃতীয়বার আত্মহনন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমার হতাশা আরো প্রগাঢ় হওয়া শুরু করল।

আমেরিকা থেকে যখন দেশে ফিরে আসতে হল তখন আমি দেখলাম আমার চারপাশের সবকিছুই কেমনযেন পাল্টে গেছে।বন্ধুবান্ধব আগে যারা ছিল তাদের অনেকেই দেশের বাহিরে ,দেশে যারা আছে তারা বিয়েসাদি করে সন্তান-সন্ততি নিয়ে থিতু হয়েছে।প্রথমদিকে এরা অনেকেই আসত আমার সাথে দেখা করতে।সান্ত্বনা দিত,বলত দেখিস একসময় দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।অনেকেই এসে আমাকে দেখে বলার মত কোন ভাষা খুঁজে পেত না।এখন কেমন লাগছে,শরীরের কি অবস্থা এরকম দুচারটা কথা বলে চা-নাস্তা খেয়ে চলে যেত। শুধু বন্ধুবান্ধবই নয় নানান রকম লতায়-পাতায় আত্বীয়স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশী যাদের সাথে গত দশ বছরেও কোন যোগাযোগ হয়নি তারাও আসত।বলত ভাগ্যকে কি আর কখনও খন্ডানো যায় দেখ দেশেই কিছু করা যায় কিনা,বসে থেকো না মনের উপর চাপ বাড়বে -এইসব কথাবার্তা আরকি। এইসব হল ভদ্রলোকের কথা।অভদ্রলোকের কথাও কিছু কিছু কানে আসত আমার।মোড়ের চায়ের দোকানদার সেদিন নাকি আমাদের বাসার কাজের ছেলেটাকে বলেছে “হইব না আম্রিকা নানান বেজাতের দ্যাশ,ঐহানে কার লগে কি করছে কে জানে,সব পাপের ফল,আল্লার বিচার”। হ্যাঁ,আল্লার বিচার নিয়েই আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম।ধীরে ধীরে আমাকে দেখতে বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত লোকের আসা যাওয়া কমে যেতে শুরু করেছিল এবং এখন বলতে গেলে আর কেউই আসে না।

মিশিগানে থাকার সময়ও দেশে আমার বাসায় আমার জন্য আলাদা একটা ঘর ছিল।আমার সব ব্যবহৃত পুরানো কাপড়-চোপড়,বইপত্র,ক্রীড়া -সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পাওয়া পুরস্কার ও সনদগুলো মা সাজিয়ে রাখতেন।মাঝে মাঝে আমাকে মনে পড়লে নাকি তিনি এগুলো পরিস্কার করতেন আর আমার স্মৃতি হাতড়াতেন।এবার দেশে আসার কিছুদিন পরই আমার স্মৃতিধন্য ঘরটি ছেড়ে দিতে হল,আশ্রয় নিতে হল ছাদের একটা চিলেকোঠার ঘরে।ছোটভাই নতুন বিয়ে করেছে ওর নাকি একটা বড় রুম দরকার।আমি আপত্তি করলাম না।আসলে বুঝতে পারছিলাম আমি ধীরে ধীরে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ছি।এরকমই হয়!
ছাদের ঘরটিতে আমি আমার আলাদা জগত তৈরী করে নিয়েছি।তিনবেলা নিচ থেকে খবার আসে আর আমি চৈত্রের দুপুরে শহরের কাকদের সাথে আড্ডা দেই।সময় কাটে বড় বিষন্নতায়।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে,মনে পড়ে বন্ধুদের কথা,স্মৃতি হাতড়াই ওদের সাথে তোলা ছবিগুলোতে,আমার জন্মদিনে ওদের দেয়া উপহারে। পনেরটার মত বিশেষ বই আছে আমার,বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সময় চাপ কমানোর জন্য এগুলো আমি পড়তাম।এদেরকে আমি বলতাম চাপরোধীবিদ্যা।মাঝে মাঝে এই বইগুলোই বারবার পড়ি,চোখ ভিজে আসে আমার।

আমার পরিচিত পৃথিবী যে পাল্টে গেছে ,চেনা মানুষগুলো অচেনা ঠেকছে এর কারন একটাই-আমি আমেরিকাতে পড়তে গিয়ে দুইপা হারিয়ে ফিরে এসেছি।লং ড্রাইভে যাচ্ছিলাম আমি আর আমার এক বন্ধু।প্লেয়ারে চলছিল আমার পছন্দের গান জন ডেনভারের i am leaving on a jet plane dont know when i will back again……।আসলেই আমি জানতাম না এভাবে আমাকে ফিরে আসতে হবে।লরিটা নাকি বেশ বড়ই ছিল।অনেকে বলেছে বেচেঁ আছি এটাই নাকি ভাগ্য(!)।আমি আমার পাদুটো হারালাম সাথে আমার বন্ধুটিকেও।মাঝে মাঝে ভাবি ঐসময়ে বন্ধুটির চলে গেলেই ভাল হত,দেশে এসে ঝামেলা করতে হতনা।আমি আমার কাটা পাদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকি।চোঁখ চকচক করে ওঠে।

আগে রাস্তঘাটে পঙ্গু লোকজন দেখতাম।একজন ভিক্ষুককে পঙ্গু দেখলে আমার কোন অসুবিধা হত না কিন্তু মধ্যবিত্ত গোছের একজন শিক্ষিত যখন দেখতাম স্ক্র্যাচ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বা বেমানানভাবে বসে যাচ্ছে রিকসায় তখন আমার মনের মধ্যে একধরনের প্রশ্ন জাগত এই লোকটা বেঁচে আছে কেন?বেঁচে থেকে সে কি পাচ্ছে?দুনিয়ার হাজারো লোকের অস্বাভাবিক দৃষ্টি উপেক্ষা করে সে কিভাবে বেঁচে আছে তা কিছুতেই মাথায় ঢুকত না আমার,বিকলঙ্গতার চেয়ে আত্বহননই শ্রেয় মনে হত আমার।

হ্যাঁ,আত্মহত্যাই শ্রেয় এটা আরও বেশী করে মনে হল যখন আমি পাদুটো হারালাম।বিদেশে পড়তে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম ওগুলোর একটা গতি হওয়া দরকার,বাবা মাকে একবার অন্তত দেখে মরি এরকম সাত পাঁচ ভেবে আমি কায়েস হাসান যে কিনা যথার্থ মানুষ হওয়ার জন্য ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলাম সেই আমি দেশে মৃত্যুর জন্য ডিসেম্বরের এক শীতের সকালে স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে ঢাকায় পৌছালাম।

প্রথমদিকে আমি ভেবেছিলাম আত্বঘাতি হওয়াটা এমন কঠিন কিছু হবে না,বিশেষত নাস্তিক ধরনের লোকের যখন পরকালের কোন চিন্তা নেই।কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ব্যাপারটা যত সহজ হবে বলে চিন্তা করেছিলাম ততটা সহজ হচ্ছে না।আমি প্রথমে ফাঁস দিয়ে চেষ্টা করলাম।ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার রশি ফ্যানের সিলিংএ বাঁধলাম।কিন্তু আমার মনে হল সুইসাইড নোট বিষয়ক কিছু লেখা হয়নি,বাসার লোক ঝামেলায় পড়বে।খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লাম।কেন জানি কিছুই লেখা হল না।ঝিম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষন।মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।
দ্বিতীয়বার আত্মহত্যার চেষ্টাটা খুবই হাস্যকর ছিল।শ্বাস বন্ধ করে ছিলাম একটানা অনেকক্ষন।চিন্তা করেছিলাম এভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ করে মারা যাব।কিন্তু সবাই জানে এভাবে মরা যায়না।
আমেরিকাতে আমি নানাভাবে মানুষের আত্মহত্যা দেখেছি।কেউ হাতের শিরা কেটে সব রক্ত বের করে মরেছে,কেউ গ্যাসের চুলার জ্বলন্ত শিখার নিচে মাথা দিয়ে মরেছে। দ্বিতীয়বার ব্যর্থ আত্মহনন প্রচেষ্টার পর আমি বুঝতে পারলাম এরকম কোনভাবেই আমার হবে না।তাই শেষবার আমি খুব কাপুরুষতার সাথে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়ে আত্বহননের কথা ভাবলাম।

পানিভর্তি একটা কাচের গ্লাসে গুনে গুনে পনেরটি ট্যাবলেট মিশিয়ে আমি বসে থাকি,আমার চিলেকোঠার ঘরের ঘড়িটিতে সময় গড়িয়ে যায়,রাস্তার মোড়ের কুকুরটি করুনসূরে ডাকতে থাকে আমার মরা হয়না।পঙ্গু,অপাংক্তেয়,বিচ্ছিন্ন এই আমি একটি আত্মহত্যার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকি।
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

আপনি শুধু দুঃখভরা লেখা লেখেন কেন? !! মানুষের জীবনে দুঃখ ভাল কিন্তু বেশী দুঃখ ভাল না।
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অতিথি লেখক এর ছবি

বেঁচে থাকলে অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকা......ওদিকে আত্নহত্যাও করে ফেলা যাচ্ছে না...এ এক জটিলতাই বটে।
কি যেন টান এসে বাধ সাধছে বারবার। এক্ষেত্রে বোধয় মরবার শখ, মরবার কারণটাতে যথাযথ কনভিন্সড না। নেসেসিটি ইজ নট দ্যাট গ্রেভ্‌। হাসি

আমরা আসলে আত্নহত্যা কেন করতে চাই? আমার যেটা মনে হয়, আমরা আমাদের চেনা গন্ডির ভীতরে যখন আর থাকতে চাই না তখনই আত্নহত্যা করতে চাই। চেনা গন্ডি কিন্তু খুব সাধারন বিষয় নয়। এই গন্ডির লেয়ার মানুষে মানুষে ডিফারেন্ট।
উদাহরণ স্বরূপ এই কায়েস হাসানের ই যদি ক্ষমতা থাকত- মায়ামি বিচের পাশেই একটি সুদ্দৃশ্য অট্টালিকায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেবার ,যেখানে ২৪ ঘন্টা সেবায় নিয়োজিত থাকবে সহকারীবৃন্দ...যেখানে এই জন্মে পরিচিত কারো সাথে কক্ষনো দেখা হবার সুযোগ নেই...তাহলে কি আত্নহননের কথা মনে আসত তার? না। আত্নহত্যা সংক্রান্ত সকল ব্যাখ্যাই বোধয় এই ধারনা থেকে দেয়া যায়। হোক তা শারীরিক কোন কারণে অথবা মানসিক কোন কারণে আত্নহত্যা করতে চাওয়া।

একারণে মাঝে মাঝে আমার আত্নহত্যা করতে ইচ্ছা করেনা বরং সমাজ বদলে, একদম নতুন একটা সমাজে যেতে ইচ্ছে করে......যে খানে কেউ আগে থেকে পরিচিত থাকবে না..একেবার নতুন করে - প্রথম থেকে জীবন শুরু।

কালবেলা

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালই বলেছেন কালবেলা।ধন্যবাদ।
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।

হিমু এর ছবি

শিরোনাম সংশোধন করে নিতে পারেন, আত্বহনন নয়, আত্মহনন।

আশা করি মনে কিছু করবেন না, বানানটা চোখে পীড়া দিচ্ছে দেখে জানালাম।


হাঁটুপানির জলদস্যু

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

অতিথি লেখক কি শিরোনাম বা লেখা সংশোধন করতে পারে?
................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...

অতিথি লেখক এর ছবি

"You do not have sufficient wrokflow permission to edit."
বানান সংশোধনের ক্ষ্যামতা নাই হিমু ভাই।অতিথি লেখক(!) যে।

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।