ভাঙ্গা আয়নায় কাঁটা শরীর

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি
লিখেছেন তাহসিন আহমেদ গালিব [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৯/০৪/২০০৯ - ৮:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রত্যেক মানুষ-ই তার নিজের কল্পনার জগতে বিচরণ করতে পারে। তেমনি রুবাইয়াতও পারে কল্পনা করতে, স্বপ্ন দেখতে, কল্পনার রঙ্গিন ঘুড়ি রঙ্গিন আকাশে উড়াতে। রুবাইয়াতের মত কল্পনাবিলাসী মেয়ে কমই দেখা যায়। তার কল্পনার সীমা ছিল বিস্তৃত। কিন্তু আকাশের যেমন মেঘ আছে, তেমনি কল্পনার আকাশেও মনে হয় মাঝে মাঝে মেঘ এসে জমা হয়। তাই হয়তো কারও কারও কল্পনা শুধু কল্পনাই থেকে যায়।

রুবাইয়াত তার বাবা-মা'র একমাত্র সন্তান। ছোটবেলায় মা'র মুখে শোনা গল্পগুলোর একটি চরিত্র কখন যে সে হয়ে উঠতো, সে নিজেও সেটা জানতো না। আর তাই কোনো কোনো গল্পে যখন রাজকুমার-রাজকন্যার মিল হতো না, তখন মনের অজান্তেই তার চোখের কোণে পানি চলে আসতো। কিংবা যখন গল্পে রাজা তার ছোট্ট মেয়েকে বনবাসে পাঠিয়ে দিত, তখন তার কষ্টের সীমা থাকতো না। তার মনে ভয় হতো, সে ভাবতো একদিন হয়তো তার বাবাও তাকে বানবাসে পাঠিয়ে দিবে, কিংবা এমন কোনো জায়গায় যেখানে সর্বময় শুধু অন্ধকার-ই-অন্ধকার। এমনিতেই সে তার বাবাকে প্রচন্ড ভয় পেত। এভাবেই দিনে-দিনে তার বয়স বাড়তে লাগলো।

রুবাইয়াত-এর বাবা-মা'র মধ্যে খুব একটা ভালো সম্পর্কের কথা কখনো শোনা যায় নি। প্রায় রাতেই তাদের বাসা থেকে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেত। সকালবেলা যখন রুবাইয়াত স্কুলে যাওয়ার জন্য মা'র কাছ থেকে বিদায় নিতো, তখন মা'র চোখের কোণে পানি দেখে মাঝে মাঝে তার মনে নানান প্রশ্ন জেগে উঠতো। বলতে গেলে বাবার আদর সে পায়-ই নি। স্বাভাবিক কারণেই তার সবচাইতে প্রিয় মানুষ ছিল তার মা। তাই যখন মাকে বাবার হাতে মার খেতে দেখতো সে, তার দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতো। বাবার প্রতি এক ধরনের ঘৃণাবোধ থাকার কারণে সে তেমন বাবার কাছেও যেত না। তার যেদিন আট বছর বয়স হল, জন্মদিনের উপহার স্বরূপ তার বাবা তাকে একটা সুন্দর ছেলে পুতুল কিনে দিয়েছিল। সে উপহারটা পেয়ে অনেক খুশি হয়, আর মনে মনে ভাবে এই পুতুলটাকেই সে বড় হয়ে বিয়ে করবে। এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিলো।

কিন্তু সেইদিনের-ই রাতের কথা; রুবাইয়াতের বাবা-মা'র মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হয়। সে শুনতে পায় তার মা মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদছে। এক সময় সে তার মা'র কোনো কান্না আর শুনতে পারে না। হঠাৎ একটা চিৎকারে চারিদিক কেঁপে উঠে। ঘুম ভেঙ্গে সে বাবা-মার রুমের দরজার ফাঁকা অংশ দিয়ে দেখতে পায় তার মা ফ্যান এর সাথে ঝুলে আছে আর তার বাবা বিছানার পাশে মাথা নিচু করে মেঝেতে নিঃশ্চুপ বসে আছে। রুবাইয়াতের বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না যে তার বাবাই তার মাকে মেরে ফেলেছে। ওইদিন রাতেই সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।

১১ বছর পরের কথা...

রুবাইয়াত একদিন বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু মেয়ের পরিচয়ে নয়, তার বাড়ি ছেড়ে পালানোর পর যারা তাকে আশ্রয় দিয়াছিলো, তারাই তাকে ওই বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যায়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! রুবাইয়াতকে যখন তার মা গল্প শোনাতো, সে গল্পে রাজাও তো তার মেয়েকে বনবাসে পাঠাতো। কিন্তু একসময় যখন রাজার ভুল ভাঙ্গতো, সে তার মেয়ের কাছে ভুল স্বীকার করে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসতো। কিন্তু রুবাইয়াত এর ক্ষেত্রে কেন এমনটি হল না? ১১ বছর পর তার বাবাই বা কেন তাকে চিনতে পারলো না? নিজেকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। রুবাইয়াতও হয়তো সবকিছু মেনেই নিয়েছিল, কেননা সে তার সৎ ভাইকে নিজের ভাই-এর মত করে ভালবাসতে শুরু করে। রুবাইয়াতও চিনতে পারে, তার সৎ মা আর কেউ নন, তার বাবার অফিসের-ই একজন কলিগ। যখন মা বাসায় থাকতেন না, মাঝে মাঝেই বাবা উনাকে বাসায় নিয়ে আসতেন। এখন রুবাইয়াত অনেক কিছুই বুঝতে পারে, যা সে আগে হয়তো বুঝতো না। তার সৎ মার প্রতিও তার বাবার অনেক ভালবাসা; এটা সে বুঝতে পারে, যা কিনা তার নিজের মা’র ক্ষেত্রে সে কোনদিন দেখে নি।

রুবাইয়াতকে এখন তার বাবা আর আগের নামে ডাকে না। তার নাম এখন সুফিয়া। তাদের বাসার বারান্দার পাশে ছোট্ট স্টোর-রুমটায় তাকে থাকতে দেয়া হয়েছে। রুমের আসবার-পত্র বলতে খুব সামান্যই ছিল। একটা ছোট মাদুরের বিছানা, একটা পুরোনো বই-এর সে্লফ আর একটা ভাঙ্গা কাঁচের আয়না। রুবাইয়াতের মনে পড়ে গেল এই আয়নাটার কথা। এটা তার মার অনেক প্রিয় একটা জিনিস ছিল। প্রায় রাতেই যখন বাবা বাসায় ফিরতেন না, মা তখন এই আয়নাটার সাথে কথা বলতো আর খুব সুন্দর করে সাজতো। মার সাজগোজ করার খুব সখ ছিল। মাঝে মাঝে রুবাইয়াতের ও মনে চাইতো সাজতে, তার মাকে গিয়ে বলতে, “মা আমাকেও একটু সাজিয়ে দাও না!” মা নিশ্চয়ই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারতো না। কপালে টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, কানে দুলও নিশ্চয়ই পড়িয়ে দিত। তারপর সে মাকে বলে মায়ের চুরিগুলোও চাইতো। যদিও তার হাতে ওগুলো অনেক বড় হত, তবুও হাত উঁচু করে রেখে হলেও তো সেগুলো পড়া যেত। কিন্তু সে তার মাকে এই কথাগুলো কোনদিন বলতে পারে নাই, কেননা মা আয়নাটার সামনে বসলেই সবসময় কাঁদতো। আজ তার মা নেই, কিন্তু মায়ের রেখে যাওয়া স্মৃতিটুকু পেয়ে রুবাইয়াত যেন তার মাকেই নতুনভাবে ফিরে পায়।

সেদিনের পর থেকে রুবাইয়াত-ও প্রতিদিন রাতে সেই আয়নাটার সামনে এসে বসতো। মার মত করে সাজতো, চোখে কাজল দিত, মার কথা মনে করে কাঁদতো। অবশ্য এভাবে খুব বেশিদিন কাটে নি তার। মাস তিনেক পর-ই সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তার আশ্রয়দাতা তাকে কোনো এক নাম না জানা মানসিক হাসপাতালে রেখে আসে। আর সেখানেই কেটে যায় রুবাইয়াত-এর জীবনের বাকিটুকু সময়। চলে আসার আগে সে তার মায়ের একমাত্র স্মৃতি, সেই আয়নাটা নিয়ে আসতে অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে তার হাতের রক্তই শুধু ঝরে যায়, অমানুষ পিতার হৃদয়ে তাতে এতটুকু ভাবোদয় হয় না।

এভাবেই রুবাইয়াত-এর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সবার কাছে অজানাতেই থেকে যায়।
তার গল্পের শেষটা তাই গল্প-কথকের কাছে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠে।
রুবাইয়াতকে নিয়ে পরে সে একটি কবিতাও লিখে, যার শেষ দুই লাইন হচ্ছেঃ

“কেউ জানে না, আয়না জানে, নিস্তব্ধতায়...
আর জানে শেকল পড়ানো মনুষ্য এক। প্রশ্নোত্তরহীন!”

তাহসিন গালিব


মন্তব্য

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বর্ণনা কি আপনি সচেতন ভাবেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের করেছেন ?? আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে কী পারতেন না ??
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

অতিথি লেখক এর ছবি

বর্ণনা আমি সচেতন ভাবেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের করেছি। আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে পারতাম।

১১ বছর পর... কথাটির পর আরও তিনটি প্যারা ছিল। সেসময় রুবাইয়াতের বেড়ে ওঠা নিয়ে কথা আছে এবং পরবর্তীতে তার বাড়ি ফেরার ঘটনা বর্ণনা করা ছিল। কিন্তু তা এখানে দেয়া হয় নি। কারণ হিসেবে ভেবেছিলাম কেউ হয়তো পড়বেই না... কিন্তু আমার ভাবনায় বিরাট ত্রুটি ছিল। আপনাদের আগ্রহ দেখে ভরসা পেলাম। যদি কেউ বলেন, প্যারা তিনটা আমি মন্তব্য ঘরে প্রকাশের চেষ্টা করে দেখবো; যদিও ব্যাপারটা খুব একটা ভাল দেখাবে না হয়তো।
ধন্যবাদ।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

মন্তব্যের ঘরেই না হয় দিয়ে দেন ওই তিন প্যারা। আর এরপর থেকে গল্প লিখলে পুরোটাই দিয়েন। আমার ব্যাক্তিগত মত হলো, গল্পের আবার ছোট-বড় কি, ভাল লাগলে যে কোন দৈর্ঘ্যের লেখাই পড়া যায় কিন্তু, তা সে অণুগল্পই হোক, না বড় গল্প।

সচল জাহিদ এর ছবি

রুবাইয়াতের গৃহপরিচারীকা হয়ে নিজের বাসায় ফিরে আসার নাটকীয়তা ছাড়া গল্পটি সুন্দর ও সাবলীল। সুহানের (শব্দশিল্পী) সাথে সহমত, আপনি গল্পটিকে আরেকটু বিস্তৃত করতে পারতেন।

-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার সাথে একমত।
গল্পটা কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করেছি। 'অতিথি লেখক' বলে পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না।
গল্পটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চলুক

খুব চমৎকার লাগল।

অতিথি লেখক এর ছবি

থ্যাংকু জনাব!

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পের নামটা সুন্দর..

(জয়িতা)

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বি ধন্যবাদ জয়িতা।

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব সহজ সরল, কিন্তু মজাদার |

তন্ময়

tanbangla.blogspot.com

অতিথি লেখক এর ছবি

সহজ সরল বুঝলাম... কিন্তু মজাদার কিভাবে ঠিক বুঝলাম না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।