চোরে চোরে মাসতুত ভাই - থিফ থিফ আর কাজিন

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি
লিখেছেন তাহসিন আহমেদ গালিব [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০২/০২/২০১০ - ৯:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকদিন আগের কথা, কোন এক দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রের পাঠক কলামে কোন এক মহোদয় ব্যক্তি "চোরে-চোরে মাসতুত ভাই" এর ইংরেজী অনুবাদ করেন, "থিফ থিফ আর কাজিন", কাথাটা মনে রাখার মতই ছিল। আজ অনেকদিন পর কারও কারও জীবনের সাথে এর কিছু মিল খুঁজে পেলাম। লিখতে বসে অনেক ঘটনাই হয়তো চলে আসবে যার কোন মানে হয় না, কিংবা যার অনেক মানে হয়। শুরুতেই বলে নেয়া ভাল, আমার লেখায় অনেকগুলো অসঙ্গতির আগমন ঘটতে পারে যার বাস্তব বা অবাস্তব মিল অনেকের সাথে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যের সহয়তায় ভর্তি হয়েছে বা হবে, তারা এখানেই থেমে যাবেন - এই আমার বিনীত অনুরোধ।

শুরু করছি...
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালে কিছু কিছু ছাত্রের আচরণ চোখে পড়ার মত ছিল। ক্লাস টিচারের নাম টমেটো কেচাপ(আমাদের দেয়া নাম), তার কাছে প্রাইভেট পড়া মানে হচ্ছে পঁচিশ-এ-পঁচিশ; এই পঁচিশটা নম্বর ব্যাবহারিকের। বাকি রইলো পঁচাত্তর; কোন সমস্যাই না। টেস্ট-প্রিটেস্ট এর আগে সেই টিচারের বাসার আম বাগানে ছেলেপুলে আম কুড়াতে গেলে অনেক কিছুর সন্ধান পেত। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারলেই বাজিমাত! আমার ধারণা মতে, বাংলার ঘরে ঘরে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মুখে-মুখে আমার বর্ণিত কাহিনী শোভা পায়। ঘটনা এমন যে, এ আর নতুন কি?

এ আর নতুন না ঠিক, কিন্তু নতুন বলেও তো একটা কথা আছে। আছে... আছে... অনেক কিছুই আজকের বাজারে নতুন। রোজকার পত্রিকা যা হকার নিয়মিত বাসার বারান্দায় ছুড়ে ফেলে রেখে যায়, এই ঘটনা রোজকার; নতুন না হলেও সমস্ত পত্রিকা জুড়েই নতুন খবরের সমারোহ। তাই বলি যে, নতুন; সবই নতুন। তুমি-আমি-সে যাকে পুরাতন ভেবে ভুল করি, তাও এক অর্থে নতুন। পৃথিবীতে কিছু কিছু ঘটনা আছে যা কেউ মেনে নিতে চায় না, আবার তা অস্বীকার করার সামর্থ্যও তার নেই। মেনে নেয়ার অস্থিরতা আর মানতে না পারার ব্যাকুলতা যখন তাকে গ্রাস করে তখন সম্ভবত নিজের আত্মার চিৎকারে দূরের মাঝিও হাতের বৈঠা ছেড়ে বিশ্রাম নেয়ার ভান করে, হয়তো সেই চিৎকারে তার শরীরে আকস্মাৎ ক্লান্তি নেমে আসে।

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, কথাটি এক অর্থে সত্য এবং অন্য অর্থে দুর্বোধ্য। দুর্বোধ্য এই অর্থে যে আমরা রাজা, রাজত্ব এই কথাগুলোর সাথে পরিচিত হতে শিখি নি। কথাগুলো আমাদের সামনে উচ্চারিত হলেই কেন যেন ভোগের চিন্তা মাথায় আসে, রাজকন্যা-প্রাসাদ-দাস-দাসীর অভাব অনুভব করি। সেই অর্থে আমরা সবাই রাজা না। তবে কেউ কেউ তো বলা বাহুল্য রাজা হবেই হবে। সেই সিংহাসনের দিকে কিছু বুঝদার জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি সর্বদা নজর রাখেন। ভাবতে অবাক লাগে মাঝে মাঝে কারা যেন রাজার পোষাক পরিধান করে রাজ দরবার, সিংহাসন, রাজকন্যা ইত্যাকার অতি লোভনীও জিনিসগুলোর মালিক হয়ে যায়। সেইসব জ্ঞানী বাবারা কি তাহলে মাঝে মাঝে ঘুম নয়নের দখলে চলে যায় নাকি পুরোটাই নিয়মতান্ত্রিক?

গল্পের যা বিষয়বস্তু তা হল, আমার দেখা মতে প্রত্যেক বছর কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জাদু বিদ্যার বলে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করে এবং বহুকালের ধারায় যা সকলের চোখের সামনেই হয়ে আসছে। সবাই স্বর্গে যেতে চায় কিন্তু কেউ মরতে চায় না; ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। ২০০৬ সালে যখন মেডিকেল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল, সেই থেকে বন্ধু রজত দাস গুপ্ত অনেক চিন্তায় চিন্তায় দিন কাটায়, রাত জাগে। আমরা আম-ছাত্ররা ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরি, খাই-দাই-গেমস খেলি-মোবাইলে মেসেজ মারামারি করি, রাত করে ঘুমাই, ঘুমের মাঝে হাবিজাবি স্বপ্ন-ট্বপ্নও দেখি; কিন্তু রজত তার ব্যাতিক্রম। সে স্বপ্ন দেখে একদিন মেডিকেল পরীক্ষার দিন আসবে, সে পরীক্ষা শেষে হল ত্যাগের পর জানতে পারবে ঈশ্বরের কৃপায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় নাই, যার ফলশ্রুতিতে ফলাফল - ঢাকা মেডিকেল। বাস্তবে হয়েছেও তাই, কারও কারও কপাল পুড়লেও রজত দাসের বেলায় ঈশ্বরের কৃপা ছিল অসীম। কিন্তু দেখি, যাদের পোড়া কপাল সব বুঝি জড় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিপায়-চাপায়। দেয়ালে চাপা পরে অনেক মেধাবীর শ্রম আবার হয়তো কেউ কেউ ধুম-ধারাক্কা পার্টি দেয় বাসার ছাদে, ফুর্তি আর উল্লাসে মাতোয়ারা হয়।

গল্প কথকের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, আবুল কাশেম মেধাবী একজন ছাত্র। মফস্বলে বড় হওয়া কাশেম ছোটবেলায় চাচার মুখে কোন একদিন শুনেছিল, "মস্তবড় শহরে নাকি একখানা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। টিভিতে দেখা দোয়েল পাখির সেই রাস্তাটির মোড়ের আসে-পাশেই আহা সেই জায়গা। আকাশে বাতাসে শুধু জ্ঞান আর জ্ঞান। এত শুনাম শুনে কাশেম এর জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়"। তো, একদিন এভাবে, মনের সুপ্ত বাসনা আর পিতা-মাতার দিলের দোয়া নিয়ে একদিন সে ঢাকায় আসে। সহি-সালামতে পরীক্ষাও দেয়। কিন্তু না... বাবা কাশেম, তুমি কি জানতে না যে অল্প মেধাবীদের এখানে ঠাঁই মেলে না। তোমাকে আরও চারখানা নম্বর পাওয়া লাগতো যে! ভাঙ্গা মন নিয়ে কাশেম বাড়ি ফিরে।

অপরপক্ষে, রকি এই শহরের ছেলে। বাবা মস্ত বড় ব্যাবসায়ী। স্কুল-কলেজ ছেলের মন মতই ছিল। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নাম না জানা নেতা বাবার কোলোজ ফ্রেন্ড, তাই ঢাকার নামকরা সেই কলেজেও ভর্তির জন্য কোনো খেতা পুড়তে হয় নাই। কলেজ পাশের পর ভর্তি নিয়ে চিন্তা (শুধু কি ছেলের বাপের, বল্টু'মিয়া ইনিস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি-এর একজন ছেলেরও) । গল্পের নায়ক, রকি - ইন্টার পাশের পর খায়-দায়, প্লেস্টেসনে গেম খেলে, মাঝ রাতে মোবাইলে শুরু হয় কথার উৎসব। শুধু কি তাই, নিজের যোগ্যতা প্রমানে প্রথমে ভর্তি হল গীটারের স্কুলে; গাও বাংলাদেশ গাও, তারপর কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড করে একদম পাংখা অবস্থা। কিন্তু দিন থেমে থাকে না। অনেক সূর্যাস্তের শেষে একদিন তার পরীক্ষার তারিখ চলে আসে। ঢাকার ছেলে বলে কথা, ঢা.বি.-তে পড়বে, এ আর নতুন কি? গল্প কথকের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, বিশেষ এক ক্রমিক নম্বরের ভর্তি ফরম কিনলে নাকি অনেক ফালতু টাইপের একটা কলেজে পরীক্ষার সীট পড়ে, যেখানে নকলের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। রকি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অতঃপর ৩০০+৩০০, ছয়শো টাকার ফরম কিনে সে তিন হাজার দিয়ে। এটাকে বলা হয় জোড়া ফরম, কেউ কেউ সাংকেতিকভাবে আদর করে কবুতর ফরম নামেও ডাকে। সেই কবুতর ফরমের বদৌলতে রকি আর আইনস্টাইনের দূর সম্পর্কের নাতি কেরামত আলি পরীক্ষার হলে এক গাড়িতে চড়ে গন্তব্যে যায়। পরের দিন অতি প্রতীক্ষিত ফলাফলের আসায় একদিকে আবুল কাশেম দোয়া ইউনুস চল্লিশ বার খতম দেয়, আর এইদিকে রকির মোবাইলে তার ডেডি'র টেক্সট আসেঃ "কনগ্রাচ্যুলেশন মাই সান, ইউ ডিড্ ইট। ঢাকা ভার্সিটি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ!" দুবাই, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক... যাহ্! বাবা, এইবার নাকি তেল দিয়ে ঘুমাহ্!

শেষ কথা-
রকি কিংবা আবুল কাশেম, নাম দুটি কাল্পনিক। বাস্তবে এমন নামের কারও সাথে গল্প কথকের কোনোদিন দেখা মেলে নি। হয়তো বাস্তবে 'রকি' বা 'আবুল কাশেম' নামধারী কারও অস্তিত্ব নেই কিন্তু তাদের উপস্থিতি আজ সবার চোখে পরার মত।


মন্তব্য

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

সত্যটাকে দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, আপনার লেখার হাত তো জুশিল্লা।

এরকম 'চিপা দুর্নীতি'র কারনেই নতুন প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ আজ জ্ঞানহীনতা কে সঙ্গী করে সস্তা জনপ্রীয়তা আর আলগা-ভাবের পেছনে ছুটছে।

ক্ষমা করো প্রভূ।

===============================================
রাজাকার ইস্যুতে
'মানবতা' মুছে ফেলো
টয়লেট টিস্যুতে
(আকতার আহমেদ)

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ!
আমারও বলতে ইচ্ছে করে- "ক্ষমা করো প্রভূ, ক্ষমা করো!"

অতিথি লেখক এর ছবি

সব কি ঠিক? এই আমি গ্রাম থেকে স্কুল জীবন শেষ করে ঢাকা এসে কলেজ পাশ করে ঢাবিতে ভর্তি হয়েছি এবং ভালো ভাবে পাশ করে আজ চাকুরীও করছি। মেধার মূল্য আছে। ঢাবিতে আপনার কাহিনী খুব একটা মিলে বলে আমার মনে হয় না। যাক তবে আপনার লেখার হাত চমৎকার। খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন।

==========
কামরুজ্জামান স্বাধীন

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি

সব ঠিক কিনা জানি না, আমি এখানে আমার কিংবা অনেকের কথা উল্লেখ করি নাই। আমি কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর কথা জানাচ্ছি।

আপনার মেধা আছে, আপনি পার পেয়ে গিয়েছেন।
তবে আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন যে ছেলেটা ১২০ নম্বরে ৬০ পায়, আর যে ৬১ পায়; তাদের মধ্যে খুব একটা কি তফাৎ আছে?

প্রত্যেক বছর কমপক্ষে ২০০ বা তদোর্ধ্ব সীটের পরীক্ষার্থী পার্টনার নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে এবং তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন নিজের আসন পাকাপোক্ত করছে। এমনকি তার বন্ধুরা সকলেই তাদের সম্পর্কে অবগত থাকে, কিন্তু কিছুই বলার থাকে না, বন্ধু বলে কথা!

ঢাবিতে আপনার কাহিনী খুব একটা মিলে বলে আমার মনে হয় না।

আপনি বিগত বছরগুলোর বিশেষ করে "ক-ইউনিট" এবং "ঘ-ইউনিট"-এ ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন করে দেখেন, তাদের অনেকেই উল্লিখিত পন্থা অবলম্বন করে নিজেদের ভর্তি নিশ্চিত করেছে। আমার জানামতে আমার-ই বন্ধু আছে ৫-৬জন; কাহিনী কি এখনো মিলছে না? নাকি মিলছে, কোনটা??

মফস্বলের যে ছেলেটির কথা বলা হয়েছে, সে আমার এক বন্ধু। এই বছর ৩,০০০ তম'র কাছাকাছি মেধাস্থান। ভর্তিকৃতদের শেষ রোলটি যদি হয় ২,৯৯৯ তম... তাহলে কি তাকে খারাপ ছাত্রের তালিকায় ফেলে দেয়া যাবে? অথচ দুর্নীতি করে যেই ৫০-১০০জন ছাত্র ভর্তি হচ্ছে তারা খুব মেধার পরিচয় রাখে? একটু ভেবে দেখুন বিষয়টা।

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

দারুণ লেখা

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।