সত্যের খোঁজে কারিতাতঃ ১-১

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি
লিখেছেন রিয়াজ উদ্দীন (তারিখ: বুধ, ২২/০৪/২০০৯ - ৭:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

অনুবাদের ভূমিকা

বহুল আলোচিত রাজনৈতিক দর্শনগুলোকে গল্পে ফুটিয়ে তোলার অনবদ্য প্রয়াস স্টীভেন লুকস -এর 'দি কিউরিয়াস এনলাইটেনমেন্ট অফ প্রফেসর কারিটাট"।বলা হয় ‘সফি’স ওয়ার্ল্ড’ দর্শনশাস্ত্রকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছে গল্পের আকারে সেই একই কাজ রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে করে দেখিয়েছে স্টীভেন লুকসের এই উপন্যাস। উপন্যাসটিকে বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে প্রাসঙ্গিক ভঙ্গিতে তুলে ধরার একটি চেষ্টাতেই এই সিরিজের শুরু।সাধারন পাঠকদের জন্য এই গল্পটিকে উপভোগ্য করার জন্য মূল চরিত্র বা প্লটের কিছুটা ব্যখ্যা দেয়া জরুরি মনে হয়েছে। এই প্রয়োজনটিকে বিবেচনায় রেখেই গল্পের শুরুতে, পাদটিকায় অথবা প্রতি খন্ডের শেষে কিছু ব্যখ্যা সংযোজনের চেষ্টা করা হবে। বলে রাখা ভাল এর অনেকটাই এই অনুবাদকের অনুমান বা ধারনা আশ্রয়ী। কাজেই তার ভুল-ত্রুটী গুলো মূল রচয়িতার উপর আরোপ করা যেমন ঠিক হবেনা তেমনি ব্যখ্যার ক্ষেত্রে বিদগ্ধ পাঠকদের কল্পনা বা বিশ্লেষনের সু্যোগও যে থেকে যায় তাও আগে থেকেই পরিষ্কার থাকা ভাল। তবে এইসব তথাকথিত ব্যখ্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়াটাও কোন কোন পাঠকদের জন্য বেশি আনন্দের হতে পারে।অনুবাদটি কতটা ভাবাশ্রয়ী আর কতটা অক্ষরাশ্রয়ী হচ্ছে তা মূল লেখাকে অবিকৃত রাখা আর বাংলা পাঠকদের পরিচিত আবহের সাথে সামঞ্জস্য রাখার দ্বিমুখি উদ্দেশ্যের পাশাপাশি অনুবাদকের বোঝার সীমাবদ্ধতার টানাপোরেনে কোথায় গিয়ে ঠেকছে সেটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল।

নিকোলাস কারিতাত
এই গল্পের মূল চরিত্র নিকোলাস কারিতাতের সাথে ফরাসি দার্শনিক নিকোলাস কারিতাতের নামের বিশেষ মিল রয়েছে। দার্শনিক নিকোলাস কারিতাতকে এনলাইটেনমেন্ট যুগের আদর্শের ভিত্তি স্থাপনে মূল কান্ডারি বিবেচনা করা হয়। দার্শনিক হিসাবে তার প্রভাব আজকের দিনেও বেশ গভীর। ফরাসি বিপ্লবিদের হাত থেকে অনেক দিন পালিয়ে থাকার পর কারাবাসে কারিতাতের রহস্যজনক মৃত্য হয়। ফরাসি বিপ্লবের ভাবগুরু হলেও পরবর্তিতে এদের গঠিত সরকারই তাকে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করে। কারিতাতের মূল উদ্দেশ্য সত্যান্বেষন হলেও রাজনীতির খাতিরে নিজের সত্যবোধের সাথে তিনি আপোষ করেন নি। তার নামটির সাথে এই গল্পের প্রধান চরিত্রের মিলকে তাই কাকতাল ভাবা কঠিন। বাস্তবের কারিতাত কারাবাসে রহস্যজনক মৃত্যুর মুখে পড়েন আর এই গল্পের কারিতাত জেলখানা থেকে পালিয়ে যান।এটাই তাদের প্রধান পার্থক্য। এছারা গল্পের প্রয়োজনে তার পরিবারের কাঠামোতেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে বাস্তবের কারিতাতের একমাত্র কন্যা এলিজা এই গল্পেও বহাল। তবে তার ভাইটি বাস্তবের অতিরিক্ত। সেই অর্থে দুই কারিতাতের মিল কেবল আক্ষরিক বলে বোধ না হলেও এদের মধ্যে যে অমিলটুকু এসেছে তা এই গল্পে উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেবার জন্যই। বাস্তবের কারিতাত যক্তি-বুদ্ধির মই চেপে সত্যে উপনিত হবার চেষ্টায় ছিলেন। এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

--------------------------------------------------------------------
সত্যের খোঁজে কারিতাত

-পর্ব ১-
(প্রথম খন্ড)

বন্দি হলেন কারিতাত

আটপৌরে জীবনে অধ্যাপক করিতাতের সবচেয়ে প্রিয় ব্যবহারের বস্তু বোধকরি তার চশমাটি। বন্দি করার মুহুর্তে এই চশমাটিকেই তারা দিল গুড়িয়ে। আশপাশের জগতকে পর্যবেক্ষেনে করিতাতের শক্তি কমে যাওয়ার সাথে সাথে এদের নিয়ন্ত্রনটাও তার ওপর যেন আরো পোক্ত হল। এই অবস্থায় অনুমানের উপর ভরসা করা ছাড়া আর গতি নেই তাঁর।

যাই হোক, গোড়ার কথায় আসা যাক। কারিতাতের ডাকনাম নিকোলাস। তার জীবন ছিল বেশ সাদামাটা। রূপালী ফারের পার দেয়া কাল আলখাল্লা গায়ে নিজের পড়ার ঘরে বসে বসে পড়শোনায় ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করত সে। এনলাইটেনমেন্ট যুগের সব মহারথিদের সাথে তার রাত জাগা বিতর্কের মুহূর্তগুলো এভাবেই কাটাত কারিতাত। সেই রাতে একটু দেরিতেই শুতে গেল কারিতাত। অস্বস্তির দরুন ঠিক ঘুম আসছিল না। বাকি বন্ধুদের পরিনতির কথা ভাবছিল সে- এসব জেনেও সে পালিয়ে যেতে চায়নি। রাজনীতির নামে নিজের চিন্তাচেতনার সাথে আপোষ করাকে সে সযত্নে এড়িয়ে চলত। নিজেকে সে জ্ঞান অন্বেষনের পথেই সপে দিয়েছে, সে একজন দার্শনিক – জ্ঞান বিজ্ঞানের ধারনাগুলোকে ইতিহাসের চোখ দিয়ে দেখা তার কাজ। সেই অর্থে নিজেকে একজন গুরুত্বহীন লোক বলে ভাবে নিকোলাস। তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার মুক্ত জীবন শেষ হয়ে আসছে।

সদর দরজায় হঠাৎ জোরালো শব্দে তন্দ্রা কেটে গেলে সে উঠে বসল আর কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করল। বুঝতে পারল পালানর কোন সুযোগ নেই। চারিদিক থেকে বাড়িটি ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালাতে গেলে গুলি করে বসতে পারে। বাইরে আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে দরজায় শব্দ আরো বেড়ে গেল। বিছানা থেকে উঠে সে চষমা চোখে দিল। গাউনটা গায়ে চাপিয়ে গাঢ় অন্ধকারে হলঘর পেরিয়ে দরজার দিকে সতর্ক পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল কারিতাত। দরজার কাছে পৌছানর আগেই বেশ জোরাল শব্দ কানে আসল তাঁর, কাঠের দরজাটি আস্তে আস্তে হেরে যাচ্ছে আঘাতের তীব্রতার কাছে। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে তারই জানান দিচ্ছিল দরজাটি। আর একটি আঘাতের মুখে তালাটিকেও হার মানতে হল। দরজার কাছে পৌছে দেখল আধো আলোতে দরজার বাইরে চারজন সৈনিক দাঁড়িয়ে। কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকেই বাতিগুলো জ্বালিয়ে তারা তার পড়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কারিতাতও তাদের পেছন পেছন যাচ্ছিল। এদের মধ্যে যেটি নেতাগোছের সেটির বয়স সবচেয়ে কম। হঠাৎ ভাবলেশহীন চোখে কারিতাতের দিকে তাকিয়ে সে বলল উঠল, “চটপট তৈরি হয়ে নিন প্রফেসর”।

এরপরই তার চশমার উপর নেমে এল অকারন আক্রমন । সে যখন শোবার ঘরের দিকে যাচ্ছিল হঠাৎ সুঠামদেহী এক সৈন্য ঘোত ঘোত করতে করতে তার চশমাটি খুলে নিল আর মেঝেতে ফেলে মুহূর্তেই পা দিয়ে গূড়িয়ে দিল। চষমার ফ্রেমটি ভাঙ্গার মট-মট শব্দ আর এর দুমরানো চেহারাটি কারিতাতের মনে হতাশা ছড়িয়ে দিল। এই চশমাটি ছাড়া চারপাশটা ঝাপসা হয়ে ওঠে, আলোর ছটা যায় হারিয়ে। এই মুহুর্তে অন্ধ জীবন নিয়ে জেমস থার্বারের আশাপ্রদ বর্ণনার কথা মনে পড়ল কারিতাতের – যখন তোমার চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যায় তুমি কি দেখতে পাবে তার ওপর এই বাহ্য জগতের নিয়ন্ত্রন কমে আসবে, আর তোমার কল্পনার জগত হবে অবারিত। তুমি তখন নির্দ্বিধায় ভেবে নিতে পার তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনিটি অতি সুন্দরি অথবা সামনের দালানটি অতি সুরম্য; এমনকি সূর্য না উঠলেও তুমি ধরে নিতে পার সুর্যিমামা ঠিক আকাশের কোনে হাসছে। তবে এই ভাবনাগুলো এই অবস্থায় কারিতাতের ঠিক কাজে আসলনা। বিশেষ করে মিলিটারিয়া-র সামগ্রিক অবস্থা তার জন্য ঘোর হতাশার কারন হয়ে দাড়াল।

মিলিটারিয়ার সামরিক জান্তার সবশেষ অভি্যানটিই ছিল সবচেয়ে বেশি শঙ্কার কারন। যে কোন মূল্যে ‘দৃশ্যমান হাত’ নামধারি বিদ্রোহি গেরিলাদের সমুলে উৎপাটনের শপথ নিয়ে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে আজ এই জান্তা। এই অরাজকতার মাঝে কোন অভিযানটি এই গেরিলাদের আর কোনটি সরকারের পোষাবাহিনীর তা ঠাহর করাও মুস্কিল। কিছুদিন আগেও গেরিলারা বাম আর ডান এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছিল। হত্যা আর বোমাবাজির জন্য এরা নির্বিচারে পরস্পরকে দুষেছে। এদের বিভক্তিটা এতটাই প্রকট হয়ে দাড়াল যে এরা এক অংশ আরেক অংশের কাজ সম্পর্কে কিছুই জানত না। তবে নিশ্চয় করে বলা যায় এই দুই হাতেই রক্তের দাগ লেগেছিল। আজ রেলস্টেশনে বোমা তো কাল ব্যংক ডাকাতি। একদিন রাজধানিতে খোদ পুলিশের প্রধান কার্যালয় আগনে পুড়ে খাক। একদিকে গেরিলাদের হাতে অপহরন হচ্ছে ব্যবসায়ীরা আর অন্যদিকে সেনারা হত্যা করছে আইনজীবিদের। হাজারে হাজারে লোক উধাও, অনেককেই হেলিকপ্টার থেকে ছুরে ফেলে দেয়া হয়েছে সাগরের পানিতে। কারিতাতের বন্ধু আর পুরোন ছাত্রদের বেশিরভাগই অজ্ঞাতবাসে। রাস্তায় নম্বরপ্লেটবিহিন গাড়ি নির্দ্বিধায় চড়ে বেড়াচ্ছে। আঁততায়ী আর খুনির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে নির্বিঘ্নে । সেনা, নৌ আর বিমান বাহিনী শতধা বিভক্ত হয়ে যে যার মত কৌশল আর শত্রু ঠিক করে নিয়েছে। বিভক্তির প্রশ্নে সামরিক বাহীনি আর ‘দৃশ্যমান হাত’ কেউ কারুর চেয়ে পিছিয়ে ছিলনা। (চলবে)

রিয়াজ উদ্দীন


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

তাড়াহুড়োতে এক্ষুনি পড়তে পারবো না কিন্তু মহৎ প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসা জানিয়ে যাই। একটাই আশঙ্কা, গোটা উপন্যাস অনুবাদ করা তো সোজা কথা নয়, ধৈর্য্য রাখতে পারবেন আশা করি। তিন চার প্যারা ক'রে অনুবাদ করলে তো সারা জীবন লেগে যাবে, অ্যামাজন বলছে প্রায় ২৬০ পাতার বই এটা।

রিয়াজ উদ্দীন [অতিথি] এর ছবি

আপনার আশংকা অমুলক নয়। তবে বইটিকে বেশ যত্ন নিয়ে পড়ার এর চেয়ে ভাল অজুহাত আর খুজে পেলাম না। আর শুরু না করলে ধৈর্য রাখার প্রশ্নটিইত আসতনা। এই সব মিলিয়ে শুরু করে দিলাম আর কি। এছাড়া একই কাজ ক্রমাগত করতে করতে নাকি উৎপাদনশিলতা বাড়ে। এটাওতো আশার কথা - কি বলেন ভাই পাঠক? আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

রানা মেহের এর ছবি

ভালো লাগলো

প্রথম প্যারা পড়ে ১৪ ডিসেম্বরের কথা মনে পড়ে গেল কেন জানি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

রিয়াজ উদ্দীন [অতিথি] এর ছবি

প্রথমবারের মত কোন গল্প অনুবাদের চেষ্টা করছি। দেখা যাক কোথায় গিয়ে ঠেকে। আপনার ভাল লাগার ব্যপারটি বেশ উৎসাহ ব্যঞ্জক।

তীরন্দাজ এর ছবি

বাহ্! দারুন একটি কাজ শুরু করেছেন ভাই। আশা করছি চালিয়ে যাবেন শেষ অবধি। নিজেও অনুবাদ করি।

আপনার অনুবাদের ভাষা খুব ভালো লেগেছে। শুভকামনা রইলো।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

রিয়াজ উদ্দীন [অতিথি] এর ছবি

আপনাদের মত আগ্রহী পাঠক থাকলে এগিয়ে যাওয়াটা অনেক সহজ হবে। ধন্যবাদ উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য।

রণদীপম বসু এর ছবি

ভালো কাজ নিঃসন্দেহে ! চালিয়ে যান ভাই। অপেক্ষায় থাকবো।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রিয়াজ উদ্দীন [অতিথি] এর ছবি

সাহস দেবার জন্য ধন্যবাদ রন'দা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প করে পোস্ট করব আশা রাখছি।

রিয়াজ এর ছবি

পরের পোষ্ট এখানে

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

দ্রুত ২ লিখে ফেলুন। ভাল লাগছে।

রিয়াজ এর ছবি

আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।
একটু ব্যস্ত ভাই; শিগগির নামাতে পারব আশা রাখছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।