একটি স্বাভাবিক মৃত্যু ও কিছু বেহায়া প্রশ্ন

মহাস্থবির জাতক এর ছবি
লিখেছেন মহাস্থবির জাতক (তারিখ: সোম, ২৯/০৩/২০১০ - ৫:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তোমার জন্মের সময় কি তোমার পিতা উল্লাসে মুখর হয়েছিলেন রবিশ্লোকে,
সব দেবতার আদরের ধন,
নিত্য কালের তুই পুরাতন,
তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সী।
তুই জগতের স্বপ্ন হতে
এসেছিস আনন্দস্রোতে-
এই উচ্চারণে?

অথবা, তোমার মা তোমার আগে আরো একজন সন্তানকে বুকে নিয়েছেন, তাই তোমায়ও নিয়েছিলেন নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই?

কিন্তু, সন্তান তো নাড়িছেঁড়া ধনই, তাই তোমার প্রতি রক্তের টান কি তিনি অগ্রাহ্য করতে পারতেন কখনো? বা, পারছেন এখনো?

এখন যখন তুমি স্রেফ দ্বিমাত্রিক আলোকচিত্র, তখন কি এই অশ্লীল, কর্কশ সত্য তাঁর অন্তর্গত রক্তে লোহিত রক্তকণিকার বদলে অমসৃণ, শতকৌণিক বালুকাকণার মতো কষ্টকর বাস্তবতা বহন করে চলেছে? অথবা, নেহাৎ ছা-পোষা কোণঠাসা সংখ্যালঘু হওয়ার নিয়মিত অভ্যেসে তোমার মা-বাবাও তোমার না-থাকার এই খবরটা অগত্যা বলে মেনে নেয়ার নিয়ত সার্কাস করে চলছেন?

তুমি কি পড়ার বইয়ের ভেতর লুকিয়ে তোমার প্রাণ-কাড়া গল্পবইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে শঙ্কা আর খুশিয়ালির যুগলবন্দিতে? নাকি প্রথম ভাগের গোপালের মতো সবসময় মা-বাবার একান্ত বাধ্যগত হয়ে পড়াতেই ঢেলে দিতে মনপ্রাণ?

তুমি কি খেয়াল করতে সূর্য-ওঠার সেই পবিত্র মুহূর্তে মনটা কেমন অজানা সুরের সিম্ফনি বাজিয়ে উদাস বাউল হয়ে যায়? অথবা, সন্ধ্যে নামলে বুকের ভেতরটা কোন অচিন বিষাদ রাগিণী বাজিয়ে অনন্ত হাহাকারে আকাশের শূন্যতায় নিজেকে সঁপে দিতে চায়?

তুমি কি পড়তে বসে উদাস হতে বর্ষার মন-খারাপ করা জলধারায়, ভিজতে চাইতে প্রথম বর্ষার জলে যে-কোন মূল্যে? তুমি কি শীতের চটজলদি আঁধারিতে বেদনার্ত হয়ে উঠতে ভাষাহীন বিমূর্ততায়? তুমি কি হঠাৎ দখিন হাওয়ার কৃষ্ণচূড়া বাতাসে মুখ তুলে আবিষ্কার করতে নতুন রঙে রাঙানোর জন্যে হাতে রং-তুলি নিয়ে নেমেছে বাসন্তী সুখকষ্টময় দিনরাত?

নাকি আজকালের অন্য সবার মতো তুমিও ছুটতে শুধু বিদ্যালয় থেকে বিদ্যাবিপণীবিতানে, শুধু ভালো ফল করার আশায়, শুধু নামটা আরো ওপরে, আরো ওপরে তোলার ক্ষমাহীন, বিরতিহীন অনন্য দৌড় প্রতিযোগিতায়?

তুমি কি বুঝতে আমাদের এই সীমাবদ্ধ ভূখণ্ডে আজ কতটা, কতগুলো সমস্যা দেখা দেয়, দিচ্ছে কতদিক থেকে, অথবা, আমাদের তরুণতর প্রজন্মের মতো রাজনীতি ঘৃণা করে বা ভয় পেয়ে তুমিও সব সমস্যা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজের নৈতিকতায় স্থাপন করতে অমেয় আস্থা?

স্রেফ সুবিধেবাদী, ঝামেলা দেখে পিঠটান দেয়ার মতো চরিত্র তুমি কি ছিলে? না, তুমি আমাদের মুখে চুন এবং কালি মাখিয়ে তা ছিলে না।

কেন ছিলে না তুমি? তুমি কি ভেবেছিলে যা আমাদের বইতে পড়ানো হয়, যা আমাদের বড়রা উপদেশ দেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়, তা-ই সত্য, তা-ই শক্তিশালী?

তুমি কতোটা মূর্খ ছিলে এটা ভাবার মতন যে বন্ধুর বিপদে এগিয়ে আসতে হয়? তুমি ঠিক কতোটা বেয়াকুফ ছিলে এটা বলার জন্যে যে তোমার বন্ধুর বিপক্ষে যারা বলছে, তারা ঠিক বলছে না? তুমি ঠিক কতোটা অশিক্ষিত ছিলে এটা বোঝার জন্যে যে মানুষের যুক্তিবোধ দু'পেয়ে জানোয়ারদের কাছে নিতান্তই অর্থহীন?

আজ তুমি পেয়েছো সে-শিক্ষা; তোমায় দেয়া হয়েছে তা কড়ায়-গণ্ডায়, হাড়ে-হাড়ে।

একটাই আফসোস, সেটা কাজে লাগানোর কোন ক্ষমতা তোমার নেই, আর হবে না।

তুমি আসলেই একটা দলছাড়া, হিসেবছাড়া ছেলে বটে।

অথবা, তুমি কমবয়েসি ছেলে বলেই এমন সৃষ্টিছাড়া।

তুমি ভেবেছিলে তুমি মিটিয়ে দেবে তোমার বন্ধুর সাথে অন্যদের বিবাদ। তুমি ভেবেছিলে শান্তিবারি বর্ষণ করলে সব সমস্যা এক লহমায় বাষ্পীভূত হয়। তুমি ভেবেছিলে ওরাও তো তোমার বন্ধুই, কি-ই বা আর করবে তারা তোমায়! তুমি ভেবেছিলে নারী নিয়ে যে-বিবাদের সূত্রপাত হয়, তা বন্ধুত্বের কাছে আর শান্তিময় সমাধানের চেষ্টায় লজ্জাতেই মাথা নোয়াবে।

তুমি, আসলে, কী বোকাই না ছিলে!

তুমি কি রামায়ণে পড় নি সীতাকাণ্ডে সপ্তকাণ্ডের বিস্তৃতি? তুমি কি ঘুণাক্ষরেও শোন নি হেলেনের রূপ কিভাবে ভাসিয়েছিল হাজারটি জাহাজ, আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল অজস্র মহাবীর, বীর আর সৈনিক, সাধারণ দলের?

তুমি আসলে ভেবেছিলে মানুষের মতো যারা, যারা দিনরাত পাশাপাশি চলাফেরা করে, তারাও মানুষই হবে।

তুমি জানো নি এই সভ্যতা আমাদের কী সুচারুভাবে, কী ধারালোভাবে, কী অমোঘ নির্ভুলতায়, কী অব্যর্থ তিরন্দাজিতে অসভ্য, নৃশংস আর মুহূর্তে অপরিচিত করে তোলে!

তুমি টের পাও নি যারা পাশাপাশি থাকে, দু'পায়ে হাঁটে, তোমার ভাষায় কথা বলে, তারা নিমেষেই কিভাবে মাথায় শিং, হাতে-পায়ে ধারালো নখ, আর মুখে শ্বদন্ত গজিয়ে এক লহমায় নিজেকে পরিণত করতে পারে বেলজিবাব, মেফিস্টোফিলিস, লুসিফার বা আহরিমান-এ।

তুমি বুঝতেই পারো নি কেন আমাদের এই ক্ষুদ্র বদ্বীপটি আজ খুনি, ধর্ষক বা অপরাধীদের একটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

নাঃ, তোমার বিবেচনাবোধের আমরা প্রশংসা করতেই পারি না। কখনো না।

আমরা কখনোই তোমার মতো অহেতুক বন্ধুপ্রীতি দেখিয়ে আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়ার দুঃসাহস করি না। আমরা কখনোই অজানিত রিরংসার বা দখলদারিত্বের ক্রসফায়ারে পড়ে নিজেদের প্রিয় প্রাণ বা অন্য পছন্দের কিছু খরচ করবোই না, এমনকি ইঙ্গিত পেলে কাছেও ঘেঁষবো না। আমরা আগেভাগে ঘটনার ইঙ্গিত পেলেও দায়িত্ব হিসেবে তোমার অভিভাবককে কখনোই জানাবো না, বরং তুমি চলে গেলে গণমাধ্যমে জানান দেবো আমরা কিন্তু বলেছিলাম, আমরা কিন্তু জানিয়েছিলাম। আমরা ঝামেলা দেখলে চটপট আমাদের দোকানগুলো বন্ধ করে দেবো, কারণ আমাদের কাছে অপরিচিতের প্রাণের চাইতে আমাদের দোকানের মালের মূল্য বেশি। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে তোমার ওপর চলা অমানবিক অত্যাচার চোখ বিস্ফারিত করে দেখবো, কারণ, বিনে-পয়সায় এদৃশ্য রোজ রোজ দেখা যায় না। আমরা তোমার চিকিৎসা ঠিকমত করতে পারবো না, কারণ, আমরা চিকিৎসক বটে, কিন্তু, নেহাৎই ব্যস্ত।

কেমন লাগছিলো তোমার যখন তোমার পরিচিতেরা, যাদের কাছে তুমি বন্ধুর তরফ থেকে শান্তির বাণী নিয়ে যাও, ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমার ওপর?

কেমন লাগছিলো যখন তোমার শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত একের পর এক তোমার রক্তনালীর পথ উন্মুক্ত করছিলো?

কেমন লাগছিলো যখন দিনের আলোতেই সবার সামনে তারা তোমার কিশো্র গায়ের ওপর লাফাচ্ছিলো কয়েকজন মিলে, এবং এরপর তোমার মায়ের সামনেও?

তুমি কি বিমূঢ় হয়ে ছিলে সেই আক্রমণে, সেই কুৎসিত গালিগালাজে, সেই অতর্কিত, প্ররোচনাবিহীন হামলায়?

তুমি কি সাহায্যের জন্যে চিৎকার করে করে বুঝতে পেরেছিলে এর বিফলতা?

তুমি কি আতঙ্কে বরফ হয়ে গিয়েছিলে, কারণ তোমায় প্রচণ্ডভাবে আঁকড়ে ধরেছিল মৃত্যুভয়?

যখন অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণে তুমি আস্তে আস্তে মায়ের কোলে থেকেই ঢলে পড়ছিলে মৃত্যুর কোলে, তখন তুমি কি তোমার প্রিয় মানুষগুলোর মুখটা ভাবছিলে, অথবা তোমার প্রিয় মুহূর্তগুলো?

তোমার নিমজ্জমান চৈতন্য কি এই অন্তবার্তা তোমার প্রতিটি কোষে কোষে পৌঁছে দিচ্ছিলো যে, এই বর্বর দানবদের দেশে তুমি এর চেয়ে আর কম কিছুই পাবে না, কাজেই এখান থেকে এভাবেই তোমায় হৃদয় আর বিবেক নিয়ে লজ্জা পেয়ে পিছু হটতে হবে?

তুমি জানো না আজ তোমার ছবি, তোমার খবর পত্রিকায় এলে, তা স্রেফ খবর হিসেবেই আসে।

তুমি বোঝো না তোমায় দেখে, তোমার কোমল মুখচ্ছবি দেখে কেউ কেউ আহা-উহু করলেও কাল অন্য আরো চমকদার, আরো চটকদার স্নায়ুক্ষয়ী খবরে তুমি চাপা পড়েই যাবে।

তোমার বিচারের অপেক্ষায় কাল গুনবে তোমার স্বজনেরা, হয়তো বিচার হবে, হয়তো হবে না।

আমরাও ভুলে যাবো তোমায়। আর, আরেকজন তুমির হননে আমাদের স্মৃতি হয়তো আবারো চাঙা হয়ে উঠবে, হয়তো তোমায় আবারো কখনো আরেক টুকরো মনে পড়বে। কিন্তু, সমস্যার মূলে যাবে না কেউ। আর কালসাপের মতো আবারো সবার চোখের আড়ালে থেকে-যাওয়া সমস্যাটা দিনের আলোয় মাথা তুলে আরেকটা ছোবলে নিয়ে যাবে আরেকটা প্রাণ।

আমাদের মতো শুয়োরদের তুই আর ঘেন্নাও করিস না, অনিক। আমাদের মতো মানুষের চামড়া গায়ে-জড়ানো হিংস্র শ্বাপদদের জন্যে তুই আর বিচার চাওয়ার সভ্য দাবিও দেখাস না, সৌমেন। আমাদের মতো দায়িত্বহীন, অমানবিক, কলঙ্কিত সমাজের সদস্যদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিস তুই অবহেলায়, তাচ্ছিল্যে আর নির্বাক মৃত্যুতে। আমরা এমনিভাবেই হয়ে উঠবো, হয়ে উঠছি একটা আতঙ্কের উপত্যকার নিশ্চুপ শিকার, আর জিঘাংসু শিকারি।

তুই আমাদের দিকে আর ফিরেও তাকাস না রে। আমরা দু'হাত দিয়ে সারা পৃথিবী ঢাকলেও তোর দৃষ্টি থেকে আমাদের অপরাধী চোখগুলো ঢাকতে পারছি না।

পারছি না কিছুতেই।

সহপাঠী কর্তৃক চট্টগ্রাম কলেজিয়েট বিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যা


মন্তব্য

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি

দু:খজনক !!

স্নিগ্ধা এর ছবি

..................... বলার কিছু নাই আসলে .........

তিথীডোর এর ছবি

অবিশ্বাস্য!!
খবরের কাগজ খুলে থ হয়ে বসেছিলাম সেদিন... এইটুকু কিশোরেরা সামান্য ব্যাপারে সহপাঠীর বুকে ছুরি চালাতে পারে?
কোথায় যাচ্ছি আমরা?

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।