একটা ছবি, একটা প্রশ্ন, একটা ফ্যাকাশে কষ্ট

মহাস্থবির জাতক এর ছবি
লিখেছেন মহাস্থবির জাতক (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/০৬/২০১১ - ১০:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বইটা পড়া অনেক আগেই। বড্ড কাঁদিয়েছিলো বেয়াড়া অক্ষরগুলো। যুদ্ধ, প্রেম, কৈশোর, বন্ধুত্ব, উত্তেজনা, বুদ্ধিমত্তা-সব মিলিয়ে নিটোল বেদনার্ত দাগকাটা পাঠোপকরণ। আমারও হাল্কা স্বপ্নালু ইচ্ছে হয়েছিলো আমার সন্তানের নাম রাশেদ থাকুক না হয়।

ছবিটা দেখলাম বড় পর্দায়। ইদানীং তো যাওয়াই হয় না প্রেক্ষাগৃহে, তারপরও ওখানটার অন্ধকার পরিবেশে যেন এক অনিবার্য জাদুবাস্তবতা থাকে। মুড়ে দেয় দর্শককে দৃশ্যের মোলায়েম চাদরে। আমি, আমরা ডুবে যেতে থাকি চলচ্ছবির ঘটনা থেকে ঘটনান্তরে। আবার ছবির শেষে আলো জ্বললে বিরহ ঘটিয়ে টানটান দাঁড়িয়ে উঠি কিছু স্মৃতি, কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু ব্যবহৃত আবেগ সঙ্গী করে।

বলছিলাম, অবশ্য বুঝে গেছেন এতক্ষণে অনেকেই, 'আমার বন্ধু রাশেদ'-এর কথা। আমার দেখা সাম্প্রতিক 'পিকচার'টি দেখেছেন অনেকেই। অনেকেরই শংসাবচন, আবেগাপ্লুত বর্ণন, সতর্ক আশাবাদ ইত্যাদি সঙ্গী করে ইতিবাচক দিকে পাল্লা ঝুঁকিয়ে দেখতে গেছি ওটা।
শুরুটা বেশ সাদামাটা, কিন্তু শুরু থেকেই কেন যেন অজানা আবেগি শঙ্কায় আর কেমন যেন অপ্রতিরোধ্য দমকা চেতনাপ্রবাহে আমি ভিজে যাচ্ছিলাম বারবার। সেটার প্রতিফলন আমার ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ডেও হয়ে থাকবে, আর চকচকে কনীনিকায়। আশ্বস্ত হচ্ছিলাম একটু। কারণ আবেগমোক্ষণ আগেই হয়ে যাক, পরে তাহলে আসল নাড়া-দেওয়ার মতো জায়গাগুলোয় ধরে রাখতে পারবো নিজেকে।

সময়ের সামনে-পেছনে টানাপোড়েনে বিবৃতিময় ভঙ্গিতে এগিয়ে চলে গল্প। একদমই বুড়িছোঁয়ার মতো করে ছুঁয়ে যাওয়া হয় রাজনৈতিক শীর্ষবিন্দুগুলো, অনেকসময় বেশ কিছু বাদসাদ দিয়েই। আসে না '৭০-এর ঘূর্ণিঝড়, নির্বাচন, আবার আসে ৩রা মার্চের অধিবেশনের কথা, কিভাবে যেন ঢুকে পড়ে ৭ই মার্চের আগুন, পর্দা কালো করে জানান দেয় ২৫শে মার্চ। কিন্তু, সবই বড্ড ওপরসা। 'দূরত্ব' ছবিটা করেছিলেন মোরশেদুল ইসলাম হুমায়ুনের ওপর বেশিই ভরসা করে। দৃশ্যনির্মাণ, সংলাপ-সবই 'পুতুল' উপন্যাসের সাথে টায়টায় মিলিয়ে ছবিটা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি, সম্ভবত নিজের পরিচালক সত্তার চাইতে হুমায়ুনের লেখক সত্তার এবং জনপ্রিয়তার ওপর বেশিই নির্ভর করে বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এবার অবশ্য দেখলাম কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।

তারপরও, সব মিলিয়ে ছবিটা টানছিলো না।

দুর্বল অভিনয়, আড়ষ্ট সংলাপক্ষেপণ, অনাকর্ষণীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে অবাস্তব ঘটনাবিন্যাস, সাদামাটা সম্পাদনা, (অপু রোজারিওর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক, এটা তাঁর সেরা কাজের মধ্যে নয় নিশ্চয়) অন্তত প্রথমাংশে গড়পড়তা ক্যামেরার কাজ, '৭১-এর নিতান্তই ভারহীন চিত্রায়ণ-কোনটাই স্বভাবতই উপাদেয় ঠেকে নি। পরিচালক যেন বেশ তাড়াতেই ছিলেন ছবিটা টেনে নিতে। অপেক্ষায় থাকছিলাম কখন আসে গল্পের সেই মাহেন্দ্রক্ষণগুলো, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলাপের উত্তেজনাথরোথরো পলঅনুপল, সেই যুদ্ধরুদ্ধ পরিবেশের ভেতর দিয়ে দুরুদুরু বুকে একটার পর একটা সাহসী কিশোরসংগ্রাম, সেই স্কুলের অপারেশন, সেই হাসপাতাল, সেই প্রচণ্ড দমবন্ধকরা শেষ দৃশ্যটা, যেটা আমার কাছে কল্পনারও বাইরে, অপার দুঃস্বপ্নের সম্ভাব্য সঙ্গী।

এলো সেগুলো, আর চলেও গেলো তেমন ছাপ না রেখেই। দর্শকেরা অনেকেই উপভোগ করছিলো ভরাট প্রেক্ষাগৃহে আলোআঁধারির রঙিন খেলা। সশব্দ আনন্দে উদযাপন করছিলো রাজাকার আজগর আলীর মৃত্যুভীত প্রাণভিক্ষার মুহূর্ত, মুহুর্মুহু করতালে অভিনন্দিত করছিলো বীর কিশোর রাশেদের 'জয় বাংলা' বলার দৃঢ় চতুর্মাত্রিকতা, ছবি শেষে বেরুনোর পর কেউ ভেজা চোখে এই নির্মাণের প্রতি নিবেদিত সনদ প্রদর্শনও করে থাকবে। আমারও চোখে অবাধ্য অশ্রুর দুই চুমুক।

কিন্তু, আমার সমালোচনামুখর মন মানে নি। যদিও ছবির পরের দিকে ক্যামেরার কাজ অনেক ভালো, ইবু আরো পরিণত, ঘটনাপ্রবাহ আরো তূর্ণ, এবং আক্ষরিকভাবেই অনেকটা জাফর ইকবালকে অনুসরণ করে সমাপ্তি টানা হয়, তারপরও না।

তাহলে প্রশ্ন, কেন আমার চোখে জল আসে অন্তত আমার মানদণ্ডে অনুত্তীর্ণ এই শিল্পকর্মের হিসেবে? ছবিটা দেখতে গিয়ে আবছাভাবে আমার মনে আসছিলো সদ্যদেখা আরেক অসাধারণ কিন্তু কী নিরাভরণ এক চলচ্চিত্রের কথা। সেখানেও দুই বালক, আরো ছোট বয়েসে, যুদ্ধের বাস্তবতায় কী দূরত্বে, অথচ আন্তরিকতায় কতই না নৈকট্যে, তার কথা। পরদিন আমার সারা বেলা বাজে কাটে, ভেজা হয়ে থাকে মনটা। ওটা নিয়ে একটা লেখাও লিখতে চেয়েছিলাম। যথারীতি পরিত্যক্ত। কী পেছনেই না সেটা ফেলে এই ৫৫ লক্ষ টাকার বাজেটের ছবিটাকে! তা যাক, কিন্তু আমার চোখে এই দুর্বল জল কেন?

ফিসফিসে উত্তর হাওয়ায় ভেসে আসে, জবাব জানে সবাই।

এটার কার্যকারণ মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের তীব্রতম আবেগের নাম।

কুৎসিত কিছু প্রচারণা ভাসে এখন: এটা জাতীয়তাবাদের আবেগ; মুজিব দেশদ্রোহী, কারণ ধরা দিয়েছিলো আর্মির হাতে; মোটেও স্বাধীনতা ঘোষণা চায় নি বা দেয়ও নি শেখের ব্যাটা, ব্যস্ত ছিলো শেষাবধি ক্ষমতা হাতাবে বলে; মুক্তিযোদ্ধারা মোটেও ধর্মনিরপেক্ষতা চায় নি, বা এটা একদম ছিলো না মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার অন্তর্গত; মানুষ এতো মরে নি মোটেই, দানবিক নির্যাতনের এতটা শিকার হয় নি নারীরা; রুশ-ভারতের চক্রান্তের ফসল বাংলাদেশ, সব ইসলামের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র...

মুক্তিযুদ্ধ, হায় বৃথা যায়, বৃথা যায়!

আরো দুঃখ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে বলে যাঁরা নির্বাচন বৈতরণী পার হলেন, সেই তাঁরাই তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধবধবে গণরায় পেয়েও এবং আদালত বিভাগের সমর্থন পাশে পেয়েও ফিরিয়ে আনতে পারলেন না '৭২-এর অকল্পনীয় মাত্রায় প্রগতিশীল সংবিধানটি।

যে-দেশের শাসনতন্ত্রের কপালে জ্বলজ্বল করতে থাকে ধর্মীয় অমোচনীয় চিহ্ন, কোন ঘৃণিত রসিকের প্ররোচনায় সেখানে টেনে আটকে রাখা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা নামের ব্যঙ্গটি? যে-রাজনীতিবিদদের মাথায় আসে না রাষ্ট্রধর্ম চিহ্নিত হলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কুঁকড়ে যায় সাম্প্রদায়িকতার বিকিরণে, তাঁরা কিভাবে সেই নাগরিকদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হন? যে-রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার অগ্রগামিতা নিয়ে এবং অগ্রনায়ক নিয়ে গর্ব করে থাকে, তারা কী করে মুক্তিযুদ্ধের স্তম্ভের গোড়ায় কদর্য কুঠারাঘাত করে? কী করেই বা রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার করে তোলে যুদ্ধাপরাধের বিচারটি এবং ‌হাস্যকর করে তোলে বিলম্বিত এবং শিথিল করে?

চিৎকার করে বলি, আর কতো প্রতারিত হবে বাংলা, বাঙালি? অসহ্য আবেগে যারা দেশে বিদেশে ছটফট করতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ নামের অপ্রতিরোধ্য বিষ রক্তে ঢুকেছে বলে, হাতে তুলে নেয় কেউ কলম, কেউ কিবোর্ড, কেউ প্ল্যাকার্ড, কেউ ব্যানার, কেউ হাজার হাজার পাতার পুরনো দলিল, কেউ ক্যামেরা, কেউ অর্থ-শুধু একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে, শুধু পূর্বপুরুষদের অকূল কষ্টের শ্রদ্ধানত মর্যাদা দেবে বলে, শুধু মুক্তিযুদ্ধ নামের স্বর্ণবর্ণ চেতনার বাস্তব রূপ দেখবে বলে, তারা আর কত কষ্ট সইবে, আর কত মূল্য দেবে ভালোবাসার, আর কত ভাসবে নোনা ব্যর্থ জলে?

পু: আগামী ৩রা জুলাই তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলনকারী পথিকদের আহূত হরতালে যে যেখানে পারুন, যেভাবে পারুন, একটু নাড়া দিন, একটু প্রতিবাদ করুন। আপনার জাত বা অনাগত সন্তানের বা ভালোবাসার স্বার্থরক্ষায় স্বার্থপর হোন।


মন্তব্য

guest_writer এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য।
গতকাল সন্ধ্যায়ই ছবিটা দেখলাম থিয়েটার ইন্সটিটিউট চট্টগ্রাম মিলনায়তনে। মোরশেদুল ইসলামের সেরা কাজগুলোর মধ্যে এটা পড়েনা মানি(তাঁর পরিচালিত দীপু নাম্বার টু আমার খুব পছন্দের একটা ছবি,অনেক বেশি জীবন্ত), তাও ছবি দেখার পর চোখ ভিজে গেল------একটাই কারণ,গল্পের মুক্তিযোদ্ধা রাশেদকে আগেই ভালবেসেছিলাম আর মুক্তিযুদ্ধ সর্বদাই আমার কাছে শুদ্ধতম আবেগের ব্যাপার
পুঃ তেল, গ্যাস রক্ষার এই আন্দোলনে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো এই টোকাইদের সাথে আছি সবসময়

নির্ঝরা শ্রাবণ

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

খুব খুব খুব প্রিয় একটা উপন্যাস...কিন্তু সিনেমা নিয়ে তেমন আশা রাখিনি, প্রিয় বইগুলোর রূপায়নে সিনেমা কখনই ভাল লাগেনি যে! একইদিনে দেখেছিলাম চমৎকার চলচ্চিত্র গেরিলা। তা দেখার পর, এই সাদামাটাভাবে বানানো সিনেমায় বোধহয় আরো হতাশ হয়েছি।

তবে হ্যা! শেষ দৃশ্যে যখন রাশেদকে মেরে ফেলছিল, চোখের কোণার পানিটি মুছেছি আস্তে করে...কারণ এ তো মুক্তুযুদ্ধ, এ তো ভালবাসা, এ তো আবেগ।

ত্রিনিত্রি এর ছবি

চমৎকার লাগলো। ঠিক, সিনেমার মেকিং হয়ত কিছুটা দুর্বল, অভিনয় আরো একটু দুর্বল -- কিন্তু তারপরেও বুকের মাঝে কাঁপন লাগে, অজান্তের হাত মুঠো হয়।

কারন এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ; আমাদের আবেগ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।