ধর্মসার- (১) লাও-ৎসু ও 'তাও' এর বাকি অংশ

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি
লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২১/১১/২০১১ - ৪:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ধর্মপ্রচার নয়, বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে যৎসামান্য জানার প্রচেষ্টা মাত্র।

ধর্মসার- (১) লাও-ৎসু ও 'তাও'
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42052

ধর্মসার- (১) লাও-ৎসু ও 'তাও' এর বাকি অংশ

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগে চীনের চু রাজ্যে লাও-ৎসু এর জন্ম হয়। লাও-ৎসু এর দার্শনিক চিন্তা ভাবনা রূপ পেয়েছে পাঁচ হাজার স্পষ্ট অর্থ সম্বৃদ্ধ বাক্যাংশ নিয়ে গঠিত ৮১টি ছোট কবিতার একটি গুচ্ছে। এর নাম 'তাও-তে-চিং' বা 'সঠিক পথের ঠিকানা'। যেহেতু লাও-ৎসুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক আছে সেহেতু এই বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব নিয়েও বিতর্ক বিদ্যমান। গ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত, (১) 'তাও চিং' (১ - ৩৭ অধ্যায়), (২) 'তে-চিং' (৩৮ - ৮১ অধ্যায়)। অনেক পশ্চিমা পন্ডিতের মতে 'তাও-তে-চিং' গ্রন্থটি প্রকৃত পক্ষে বিভিন্ন গ্রন্থকারের বিভিন্ন সময়ের লেখা নিয়ে সংকলিত।

গ্রন্থটির বানী অতি সহজ। মানুষের জীবনে একটা স্বাভাবিক ছন্দ আছে, যা আমরা সমাজের ও নীতির শাসন দিয়ে নষ্ট করেছি। ক্ষমতার লোভ, বিদ্যার অহংকার, সভ্যতার আদবকায়দা ইত্যাদি এসে সহজ জীবনের মুক্তি, সৌন্দর্য ও আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। মানুষকে সেই আদিম মুক্ত অবস্থায় ফিরে যেতে হবে।

"কিছু করতে গেলেই ভন্ডুল হবে;
আঁকড়ে ধরতে চাইলেই ফসকে যাবে।
জ্ঞানী কিছু করেনা, তাই তাঁর হাতে কিছু ভন্ডুল হয়না।
সে কিছু আঁকড়ে ধরতে যায়না, তাই কিছু ফসকায়না।"

তাবলে 'তাও'বাদী সমাজের বাইরে গজদন্ত মিনারের চুড়ায় বাস করেনা। সমাজে বাস করা স্বাভাবিক জৈবধর্ম। 'তাও' এর পথও তাই। জ্ঞানী সমাজে বাস করে কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করেনা, সাধারনের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়, মাটিতে পা না দিয়েও হেটে যায়। কিছু না বলে কিছু না করে সে তাঁর প্রভাব ছড়ায়। আপন নির্বিকার সত্তায় অবস্থান করে সে হয় অপরের অনুকরণীয়। তাঁর মত, প্রচারের অপেক্ষা রাখেনা, প্রতিষ্ঠা কর্মের উপর নির্ভর করেনা।

"যে অন্যকে জানে সে বিদ্বান;
যে নিজেকে জানে সে জ্ঞানী।
যে অন্যকে জয় করে সে বলবান;
যে নিজেকে জয় করে সে শক্তিমান।"

যে জ্ঞানী ও শক্তিমান তাঁর প্রচারের প্রয়োজন নেই, জোর জবরদস্তির প্রয়োজন নেই।

"সে নিজেকে প্রকাশ করেনা
তাই সে ভাস্বর।
সে নিজেকে সমর্থন করেনা
তাই তাঁর যশ সুদূরপ্রসারী।
তাঁর অহংকার নেই
তাই সকলে তাঁর গুণগ্রাহী।
তাঁর দম্ভ নেই
তাই সকলেই তাঁর কাছে অবনত।"

আকাশ ও পৃথিবীর অস্তিত্ব নিজের জন্য নয়, তাই তারা অনন্তকাল বিশ্বকে ধারণ করে আছে। তেমনি যে জ্ঞানী নিজের সত্তা ভুলে যায়, তাঁর সত্তা চিরস্থায়ী হয়। যে নম্র সেই উন্নত, যে যত বিনয়ী সে তত মহান।

"যদি সকলের চেয়ে বড় হতে চাও,
সকলের নিচে এসে দাঁড়াও।
যদি সকলের আগে যেতে চাও,
সকলের পিছে চল।"

"হে রাজন, মহাপন্ডিতকে নিয়ে বেশী মাতামাতি করবেননা,
তাহলে পন্ডিতি দেখাবার জন্য প্রজাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়বেনা।
দুষ্প্রাপ্য জিনিসকে বেশী কদর করবেননা
তাহলে রাজ্যে চোরের সংখ্যা বাড়বেনা।
যা দেখলে লোভ বাড়ে তা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিন
মানুষের মন তাহলে চঞ্চল হবেনা।
দূরদর্শীদের রাজত্বে
মানুষের মাথা থাকে খালি পেট থাকে বোঝাই।
ওদের মাত্রাহীন উচ্চাশা দমন করুন
সুস্থ সবল শরীর গড়ে তুলতে বলুন।
নিষ্কর্মা না হয়েও যারা কীর্তির পিছনে ছোটেনা
এ পৃথিবীতে তারাই সুখী।"

"তোমার তরোয়ালে যদি অত্যধিক ধার লাগাও
তাহলে সে তরবারি দীর্ঘস্থায়ী হবেনা।
যখন মনি-মানিক্যে সোনা-রূপায় ভরে উঠবে তোমার ঘর
তখন অবশ্যই তা নিরাপদে রাখতে পারবেনা।"

"সাহসী সৈন্য কখনও নিষ্ঠুরতা দেখায়না,
প্রকৃত যোদ্ধা কখনই ধৈর্যচ্যুত হয়না।
বিখ্যাত বিজয়ীরা কখনই
ছোট ব্যাপারে রণহুঙ্কার দেয়না।"

নিজেকে সরলভাবে বোঝ

"জ্ঞানকে নির্বাসনে পাঠাও, বুদ্ধিকে করো বিতাড়ন,
মানুষ তবেই হবে শতগুণে লাভবান।
নিজের সহজ অনুভূতিকে করো বিকশিত,
তোমার নিজের যা প্রকৃতি তাকেই আঁকড়ে থাকো।
স্বার্থপরতা সংযত করো,
ইচ্ছার লাগাম টেনে ধরো।"

সমাজের নিয়মকানুন ও সভ্যতার উন্নয়নের চাপে পড়ে যা কিছু সৎ ও শুভ তা বিলীন হয়ে যায়।
কৃত্রিম বন্ধন হতে মুক্তিকামী মানুষ প্রকৃতির সহজ পথ খুঁজবে।
জ্ঞানীর পথ জীবের অন্তরের পথ। আর 'তাও'বাদী তার স্বাভাবিক পথিকৃৎ।

'ঝাঁপি খুলে বহু পুরাতন একটা নোটবই পেলুম। তখনকারদিনে আমাদের দেশে ইন্টারনেটের সুবিধা ছিলনা। বই-পুস্তক ঘেঁটেই যা কিছু পাওয়া। কখন, কোথায়, কিভাবে এগুলো পেয়েছিলাম তা আর এখন মনে করতে পারিনা তাই সূত্র জানাতে পারবোনা। ক্ষমা করবেন।'

চলবে

পৌঢ়ভাবনা


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

খুব ভাল লাগল, কেমন অন্যরকম স্নিগ্ধতার পরশ ছড়ানো। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভাল লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম।

ধন্যবাদ, সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ।

নিটোল এর ছবি

চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ, আপনার আগ্রহের কারনেই এই লেখাটি।

ভাল থাকবেন।

উচ্ছলা এর ছবি

যে নিজেকে জয় করে সে শক্তিমান।

আপনার এই লেখাটার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য মনে দাগ কেটে গেছে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনপকে, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য মনযোগ দিয়ে পড়বার জন্য।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, একেবারে মোক্ষম সময়ে এই পোস্ট। দারুণ কাজে দেবে আমার। অপরূপ স্নিগ্ধতার ছোঁয়া পেলাম!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্যে উৎসাহিত বোধ করছি।
চীন সফর আন্নদদায়ক হোক।

রনি এর ছবি

চলুক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সময় দিয়ে পড়বার জন্য ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।