সচলে অচলদের গল্প

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি
লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৬/০৫/২০১৫ - ৪:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অক্ষমের অপারগতার স্বীকারোক্তি:

এই লেখাটা ঠিক নারী সপ্তাহ কে উদ্দেশ করেই নয়। সচলে বাল্যবিবাহঃ বাবামায়েরা কি জানেন তারা কী করছেন? লেখাটি পড়ে মনে এলো, এই ধরণের ঘটনা যে সকল কিশোরীর জীবনে ঘটেছে অথচ যারা লিখতে-পড়তে জানেনা, এরকম কত-শত কিশোরী/বালিকার মনঃপীড়ার কথা আমরা কোনদিনই জানবোনা।

আমার দেখা/জানা এমনই এক কিশোরীর জীবনের কিছু কথা:

সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। আমার গ্রামেরই ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারনে আমি গ্রামের কিছু হতদরিদ্র, সহজ-সরল মানুষের সাথে বড্ডই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও আমরা মানে আমার বাবা-মা-ভাই-বোন অর্থাৎ আমাদের পরিবারের সবাই শহরেই থাকতেন তবুও আমি ছুটিতে অথবা ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে হলেও গ্রামে চলে যেতাম।

যাহোক, মূল ঘটনায় আসি। যে কিশোরীটির কথা বলতে চাইছি তার পরিবার সম্পর্কে একটু বলি। তারা তিন বোন, এ সবার ছোট, বয়স ১৪/১৫ হবে। বড় দুটোই স্বামী পরিত্যক্তা। এদের সবাই-ই আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রায়শই কোন না কোন কাজে বহাল হতো। মেজোটা আমাদের বাড়িতে রান্নাবাড়ার কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। আমাদের গ্রামের বাড়িতে তখন প্রতিদিন তিনবেলায় প্রায় এক মন চালের ভাত রান্না হতো। হ্যাঁ. একেই বোধহয় বলে, 'ধান ভানতে শিবের গীত'।

যা বলছিলাম, কিছুদিন হলো এদের মাতৃবিয়োগ হয়েছে। ক্ষেতমজুর পিতা আবার একটি বিয়ে করেছে। সৎমার অভাবের সংসারে এদের অবস্থাটা বুঝতেই পারছেন! নূনতম স্নেহ-ভালোবাসা, সহমর্মিতা পেয়েছে বলেও মনে হয়না।

আর গ্রামের কিছু বর্বর পুরুষের কামলোলুপ দৃষ্টি এবং ঈঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা সহ্য করেও এরা নিজেরা পরিশ্রম করে বাপের ভিটেয় থেকে কোনভাবে দিন যাপন করছিলো। জীবনের অভিজ্ঞতায় জেনেছি, শারীরিকভাবে না হয়েও প্রতিদিনই এরা কতভাবে ধর্ষিত হতো!

তা, এরকমই একদিন, তখন বর্ষাকাল, আমি গ্রামেই ছিলাম, রাত প্রায় দশটা, তখনকার দিনে রাত দশটা মানে গ্রামে গভীর রাত, খবর পেলাম ছোট মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে। আমি একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম, খবরটা আগেই না জানার জন্যে। এরা তিন বোনই আমাকে 'ভাই' ডাকতো। তাদের ছোটখাটো সাধ-আহ্লাদ পুরণের জন্য আমার কাছেই হাত পাততো। সম্পর্কটাও বেশ গভীরই ছিলো বলা যায়। তাই মনের মাঝে কৌতুহল জাগলো। ফিসফিসে বৃষ্টির মাঝে একটি ছাতি মাথায় ওদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমার উপস্থিতিতে মুরুব্বিরা বিব্রত কেউ কেউ বিরক্তও হলো। জানতে পারলাম, গ্রামেরই এক টাউট শ্রেণীর লোক এই বিয়ের ঘটক। পাত্র পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়। শহরে থাকে। এই রাতেই হাজির হয়েছে, বিয়ে করতে।

ঘটকের নির্দেশে মেয়ের বাপ কাউকেই কিছু জানায়নি। বর আসার পরপরই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মসজিদ থেকে হুজুর আনা হয়েছে আর জ্ঞাতিগোষ্ঠীর দু-চারজন উপস্থিত হয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ কেউ অতি আগ্রহে জড় হয়েছে যদিও তারা কেউ-ই নিমন্ত্রিত নয়।

মেয়েটির বোনদুটো আমায় ঈশারায় আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললে, এ বিয়ের কথা কেউ জানতোনা। ঐ ঘটকের আ মেয়ের সৎমার যোগসাজসে
বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে বিয়ে ঠিক হেছে। এ যেন, বেশ্যাপাড়ায় মেয়ে বিক্রি করে েবার মতো। এখানে মেয়ের বাপের মতের কোন দাম নেই।

মেয়েটা প্রথমে রাজি না হওয়াতে বেশ মারধোর করা হয়েছে। সব শুনে আমি বিয়েতে বাধা দিতে চাইলাম। আমার কথায় মেয়ের বাপ বললে, 'আমি গরীব মানুষ, এদের খাওয়ানো-পরানো আমার দিয়ে সম্ভব নয়। বরের টাকা-পয়সা আছে, খেয়ে-পরে ভালই থাকবে'। আমি বয়সের বিষয়টি তুলে আরও কিছু কথা বলতে চাইলাম।

ঘরের বাইরে অনকগুলো কন্ঠের ফিসফিসানি শুনতে পেলাম। তার সহজ অর্থ, আমার যৌনচরিত্র নিয়ে বিশ্রী ঈঙ্গিত। এদের ধারনামতে আমার মতো একটি অবিবাহিত যুবকের এইসব নিম্নবর্গীয় অসহায় মেয়েদের সাথে সম্পর্কের একটিই মাত্র কারন হতে পারে যা যৌনসম্পর্কীয়। আমি বড্ড অসহায় বোধ করতে লাগলাম। তারপরও মেয়েটির কাছে গিয়ে তার মত জানতে চাইলাম। আমায় অবাক করে দিয়ে একঘর মানুষেরই সামনে সে কীনা বললে, 'আব্বা আমার বিয়ে দিচ্ছে, এতে আমার মা-খালাদেরও মত আছে, আপনি কেন মাঝে পড়ে বাগড়া দিচ্ছেন? আপনি যান, আমার কপালে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই হবে'। চলে এলুম। বলতে পারেন, পালিয়ে এলুম।

তার বিয়ের পরেও মাঝে-মধ্যে দেখা হয়েছে। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় 'ভাই' 'ভাই' বলে চেচিয়ে ডেকেছে। কেমন আছে জানতে চেয়েছি। খুব নিস্পৃহ ভাবেই জবাব পেয়েছি, 'এই আছি আপনাদের দোয়ায়'। পরে জানতে পেরেছি, লোকটির শহরে বৌ-ছেলে-মেয়ে আছে, লোকটি সরকারী চাকুরে। সপ্তাহে মাত্র একদিন মানে বৃহস্পতিবার রাতে আসে শুক্রবার বিকেলে চলে যায়। পরেরদিকে এই আসাটা অনেকটাই কমে গিয়েছিলো, তবে হ্যাঁ, প্রতি মাসের খোরপোষের টাকাটা পাঠিয়ে দিত। বড্ড জানতে ইচ্ছে হয়, এটা কি বিয়ে না যৌনদাসত্ব!

হঠাৎ কখনও সখনও সেই লোককে দেখেছি। বাইরের খোলসে নিপাট ভদ্রলোক, বোঝবার উপায়ই নেই যে এর ভেতরটা কত কুৎসিত-কদাকার!
একদিন বলেই ফেলেসিলাম, এমনটা না করে মাগীপাড়ায় গেলে কি চলতোনা! না, কচি ুদ খুব দরকার হয়ে পড়েছিলো, বাঞ্ছোৎ কোথাকার।
পরে জেনেছিলাম, মেয়েটার নামে দুই বিঘা জমি কিনে দিয়েছিল।

কিন্তু এই বয়স্ক লোকটি কী কোনদিনই ভাবেনি, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে এই এত্তটুকু একটা মেয়ের জীবন নিয়ে কী ছিনিমিনিই না খেললো! শুধুমাত্র তার একান্ত ব্যক্তিগত যৌনাকাঙ্খা মেটাবার জন্য এতটুকু একটা মেয়েকে সত্যিকার অর্থেই শারীরিক ও মানসিক ভাবে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো!

এই সামান্য কিছুদিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম। ওদের পাড়ার পাশ দিয়েই বাজারে যেতে হয়। 'ভাই' 'ভাই' আওয়াজে থমকে দাড়ালাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মাথাটা নিচু করে দাড়িয়ে থাকলো, মুখে কোন কথা নেই। দেখে ঠিক চিনতে পারিনি। বুড়ি হয়ে গিয়েছে। স্বামীটিও মারা গিয়েছে! তিনটি ছেলেমেয়ে। এই বয়সেও তাকে আবার লোকের বাড়িতে কাজ করতে হয়। কত কিছুই বদলে গিয়েছে কিন্তু সেই 'ভাই' ডাকটি বদলায়নি। পকেট হাতড়ে সেই ছোট্টবেলার মতো কিছু টাকা হাতে দিয়ে চলে এলুম। আমিও কোন কথা বলিনি। বলারতো আসলে কিছু নেই। জিজ্ঞেস করা কী উচিত ছিলো, 'কেমন আছিস'!

না, বলতে পারেন পালিয়ে এলুম। হ্যাঁ, আমার সেই যৌবন বয়সের সমাজের লোকনিন্দার ভয়, অপারগতায় একটি কিশোরীর স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে ব্যার্থ যে আমাকে ভাই মনে করে ভরষা করতো, এখনও করে!


মন্তব্য

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এর ছবি

পড়ার পড় আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না,শুধু মনের অজান্তে একটি বিকট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।
আপনিতো সামান্য হলেও চেষ্টা করেছিলেন।এই ব্যাপারে বাবা মাদের সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে তা চলতেই থাকবে মন খারাপ
চলুক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

এই ক্ষেত্রে বাবা মায়েদের চেয়ে সমাজ এবং সমাজকর্তাদের দায়ই অধিক। শিক্ষিত প্রৌঢ় লোকটি শুধুমাত্র তার ক্ষণিক কাম চরিতার্থের জন্য একটি দরিদ্র অসহায় কিশোরীর দেহ-মন ছিন্নভিন্ন করলো কোনরূপ বিবেকভাবনা ছাড়াই, আর আমরা তাই-ই করতে দিলাম!

বৃষ্টি স্নাত কবি এর ছবি

আহারে! আসলেই কত মন খারাপ করা একটা অভিজ্ঞতা! আল্লাহ্‌ মেয়েটার বাকি জীবনটা নিরাপদ করে দিন।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সে এখন আর মেয়ে নয়, এক বিধবা বুড়ি। জীবন বলতে তার আর কিছু বাকি নেই। হ্যাঁ, বলতে পারেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই সে বেঁচে আছে। এ পৃথিবীতে নারী এবং দরিদ্র হয়ে জন্ম নেওয়া অভিশাপ।

চরম উদাস এর ছবি

এরকম কত অজানা গল্প যে লুকিয়ে আছে চারপাশে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

জী। মন খারাপ

এক লহমা এর ছবি

দীর্ঘশ্বাস।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

মন খারাপ

রানা মেহের এর ছবি

আপনিতো অন্তত চেষ্টা ক‌রেছিলেন।
অনেকেতো তাও ক‌রেনা।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চেষ্টা না ছাই! যে চেষ্টায় কোন ফল হয়না সেটা গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। সে সময়ের গ্রামীন সমাজ বড়ই রক্ষণশীল ছিলো আর আমারও সাহসের বহর এতটা ছিলোনা। কিন্তু এত বছর পরেও আমার সে অনুশোচনা গেলোনা। সে যে ভাই বলে আমার উপর ভরষা করতো! তার সে ভরষার মর্যাদা দিতে পারলাম কই? কিন্তু সেতো বিশ্বাস হারায়নি। এখনও আমাকে ভাই-ই ডাকে। এ জনমে আমার এ ব্যর্থতার কালিমা ঘুচবেনা। আপনারা নারীকুল আমায় ক্ষমা করবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।