পিচ্চিতোষ গল্প ০১: মহারাজার বাইসাইকেল

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০৯/২০০৭ - ১২:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক দেশে ছিলো এক রাজা। একদম মহারাজা।

তার হাতিশালে ছিলো হাতি। মস্তবড় সে হাতি। তার কুলোর মত কান আর মূলোর মত দাঁত। আর ইয়া বড় এক শুঁড়। শুঁড় দিয়ে হাতি মাঝে মাঝে তার কান চুলকে নিতো।

হাতির নাম জানতে চাও? তার শরীর যত বড়, নাম তত ছোট। হাতির নাম ফুটু।

রাজার ঘোড়াশালে ছিলো ঘোড়া। সেইরকম টগবগে ঘোড়া, ঘাড়ভর্তি কেশর, মস্ত ঝুপ্পুস লেজ, লেজ দিয়ে ঘোড়া মাছি তাড়ায়। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়া সবক'টা দাঁত বার করে হাসে। রাজার ঘোড়াটার আবার একটা দাঁত ছোটকালে আইসক্রীম খেয়ে খেয়ে পড়ে গেছে, সেটা সোনা দিয়ে বাঁধানো।

ঘোড়ার নাম জানতে চাও? তার শরীর যত বড়, নাম তত ছোট। ঘোড়ার নাম ছোটু।

রাজার রাজাশালে, মানে রাজপ্রাসাদে রাজা নিজেই থাকেন। রাজা কিন্তু ছোট্টখাট্টো লোক, তেমন পালোয়ান নন। তাঁর ভাড়া করা পালোয়ান আছে। রাজার মস্ত গোঁফও নেই, তাঁর ভাড়া করা গোঁফোয়ান আছে। রাজা শুকনোপটকা লোক, তিনি মুড়ি দিয়ে চানাচুর সরষের তেল মেখে খেতে ভালোবাসেন।

রাজার নাম জানতে চাও? তার শরীর যত ছোট, নাম তত বড়। রাজার নাম আসমুদ্রহিমাচলজিৎ জয়জয়ধ্বনিহুহুঙ্কারমন্ডিৎ ভ্যূলোকদ্যূলোকগোলকরাজহাঁসেরপালকভেদী সেইরকমধমাধমবীরবিক্রমাদিত্য। রাজা নিজেই নিজের নাম মাঝে মাঝে ভুলে যান, তাঁর নিজের নাম মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে ভাড়া করা নামোয়ান আছে। রাজা কোন অংশ ভুল করলে সে ফিসফিসফিস করে আবার মনে করিয়ে দেয়। তবে রাজাকে রাজার নাম জিজ্ঞেস করবে এমন আস্পদ্ধা সেই দেশে কারো নেই। রাজা নিজেই মাঝে মাঝে "আমার নামটা যেন কী" বলে খেই হারিয়ে ফেলেন।

রাজা কিন্তু হাতিশালার হাতি ফুটুর পিঠে চড়েন না সহজে। তাঁর ভয় লাগে। হাতিটা বেজায় বড়ো!

রাজা ঘোড়াশালার ঘোড়া ছোটুর পিঠেও সহজে চড়েন না। ছোটুকেও তিনি ভয় পান। ছোটু বেজায় ফোঁস ফোঁস করে আর ঘাড় নাড়ে।

রাজা কোথাও যেতে হলে পালকি চড়ে যান। তাঁর পালকিটা বিশ বেহারার পালকি। দশজন ডানে আর দশজন বামে সেই পালকি নিয়ে হুমহুমহুম গান গাইতে গাইতে চলে। সাথে পাইকলস্কর সব ঘোড়ায় চড়ে রাজাকে পাহারা দেয়। লস্করের ভয়ে তস্করেরা রাজার পথ থেকে নেমে লুকিয়ে পড়ে।

একদিন রাজা দেখলেন, রাজবাড়ির গোয়ালা সাইকেলে চড়ে দুধ দিতে আসছে।

কী চমৎকার তার সাইকেলটা! বড় বড় গোলগাল দুইটা চাকা। লাল টকটকে তার শরীর। স্পোকগুলি সব রোদে ঝকমক করছে। গোয়ালার সাইকেলের পেছনে দুধের বড় পাত্র। সেখান থেকে সে রাজবাড়ির রাঁধুনিকে দুধ ঢেলে দেয় বড় হাতাওয়ালা মগ দিয়ে। তারপর চটপট আবার সাইকেল ঘুরিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যায় নিজের বাড়ির দিকে।

রাজার খুব শখ হলো তিনি সাইকেল চেপে এখন থেকে বেড়াতে বের হবেন।

তিনি তখনই মন্ত্রীকে ফোন করলেন। বললেন, "মন্ত্রী! সাইকেল আনো। সাইকেল চালাবো।"

মন্ত্রী বললেন, "তথাস্তু!"

তখনই সাইকেলের দোকান থেকে সাইকেল কেনা হলো। লাল সাইকেল গোয়ালা চালায় বলে একটা নীল সাইকেল কিনে দেয়া হলো রাজাকে। দাম নিলো দশ স্বর্ণমুদ্রা।

রাজা বললেন, "দাম বেশি নিয়েছে।"

মন্ত্রী বললেন, "সস্তা সাইকেল কি আর রাজন চড়তে পারেন? সবচে দামীটা কেনা হয়েছে।"

রাজা বললেন, "তাই তো!"

তার পরদিন ভোরবেলা রাজা সাইকেল নিয়ে বের হলেন। সাথে পাইকলস্কর সব ঘোড়ায় চড়ে।

কিন্তু রাজা তো সাইকেল চালাতে পারেন না। দুই গজ যেতে না যেতেই ধড়াম করে বামে পড়ে যান। তখনই দু'জন পাইক এসে তাঁকে তুলে ধরে, গা থেকে ধূলো ঝেড়ে দেয় সোনার ঝাড়ু দিয়ে। তারপর রাজা আরো দুই গজ যেতে না যেতেই ধড়াম করে ডানে পড়ে যান। আরো
দু'জন পাইক এসে তাঁকে তুলে ধরে, গা থেকে ধূলো ঝেড়ে দেয় রূপার ঝাড়ু দিয়ে।

এভাবে এক ঘন্টা ঝাড়ুর বাড়ি খেয়ে খেয়ে শেষে রাজা খুব ক্ষেপে গেলেন। বললেন, "গোয়ালাটাকে নিয়ে এসো! ও চালায় কিভাবে?"

গোয়ালার বাড়ি থেকে তাকে সাইকেলসুদ্ধু গ্রেফতার করা হলো।

সেনাপতি বললো, "জাঁহাপনা! হুকুম করুন ব্যাটাকে রিমান্ডে নিয়ে যাই। দুদিনে সাইকেল চালানো ভুলিয়ে দেয়া হবে।"

রাজা বললেন, "আরে বেয়াকুব, ওকে ভুলিয়ে দিলে তো শেষে আর আমারই শেখা হবে না।"

গোয়ালা বললো, "হুজুর সাইকেল চালাতে গেলে কয়েকবার আছাড় খেতেই হবে। এটিই নিয়ম। আমিও শুরুতে খেয়েছি।"

রাজা বললেন, "তুমি খেয়েছ বলেই সেটা নিয়ম? আমাকেও আছাড় খেতে হবে? ওসব চলবে না। আমাকে আছাড় না খাইয়ে সাইকেল চালানো শেখাও।"

গোয়ালা বললো, "হুজুর! এক কাজ করুন। আপনার সাইকেলটা আমাকে দিন। আমি একটু মেরামত করে দেই। তাহলেই আপনি আর আছাড় খাবেন না।"

রাজা রাজি হয়ে গেলেন।

গোয়ালা রাজার সাইকেল নিয়ে গেলো কামারের কাছে। বললো, "দোস্ত, এটাকে বাইসাইকেল থেকে ট্রাইসাইকেল বানিয়ে দাও তো!"

কামার রাজার বাইসাইকেলে আরেকটা চাকা ফিট করে দিলো।

গোয়ালার রাজার কাছে সেটা ফিরিয়ে নিয়ে বললো, "হুজুর, আপনার সাইকেলে কি দুটো চাকা মানায়? দু'চাকার সাইকেল চালাবো আমরা, যারা গরীব মানুষ, খেটে খাই। আপনি রাজা আসমুদ্রহিমাচলজিৎ জয়জয়ধ্বনিহুহুঙ্কারমন্ডিৎ ভ্যূলোকদ্যূলোকগোলকরাজহাঁসেরপালকভেদী সেইরকমধমাধমবীরবিক্রমাদিত্য, কমসে কম তিনটা চাকা তো আপনার সাইকেলে থাকতেই হবে।"

নিজের নাম শুনে রাজা খুব ঘাবড়ে গেলেন, নামোয়ান ফিসফিসফিস করে বললো, "ঠিকাছে।"

ঠিকাছে শুনে রাজাও বললেন, "ঠিকাছে।"

গোয়ালা হাঁপ ছেড়ে তার সাইকেল আর দুধের ক্যান নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো। রাজা তাকে একটা সোনার অঙ্কুশ উপহার দিলেন, বললেন, "কখনো যদি হাতি কেনো তো এটা কাজে লাগবে।"

পরদিন থেকে রাজা তাঁর তিনচাকাঅলা বাইসাইকেলে চড়ে বেড়াতে গেলেন। সাথে পাইকলস্কর ঘোড়ায় চড়ে। সেদিন আর তস্করেরা পালিয়ে গেলো না, তারা হাঁ করে রাজার সাইকেল চালানো দেখতে লাগলো পথের পাশে দাঁড়িয়ে।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

হিমু বাচ্চা হইলে আর রূপকথার গল্প শুনতে চাবে না। হাসি

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ফারুক হাসান এর ছবি

সাহিত্যের যে ধারাটি পরাবাস্তবিক বিমূর্ততাকে আলট্রাএক্সপ্রেশনিজমে আটকে রাখতে পারে না বলেই বিবেচ্য হয়ে এসেছে এতকাল,এই গল্পের লেখক তার বাইরে বেরুতে পারেন নি বলেই বোধগম্য হচ্ছে। গল্পটার প্রারম্ভে কিছুটা শ্লথ গতি অনুভূত হলেও নান্দনিকতায় এটি উত্তীর্ণ আর প্লটের ভাংচুরেও কিছুটা সৃষ্টিশীলতার ছোয়া বর্তমান। তবু, শেষ পর্যন্ত 'ট্রাইসাইকেল আবিষ্কার কি এই ভাবেই হইলো?' এই প্রশ্নের উত্তর লেখকের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। ফুটু আর ছোটু এই দুই চরিত্রের পরিষ্ফুটন লেখকের আরোপিত এবং পূর্বনির্ধারিত ক্লাইমেক্সের পদতলে পিষ্ঠ, বলাই বাহুল্য।

তথাপি, হিমুদেয় গল্প হয়ে উঠার সকল যোগ্যতাই এই গল্পের রয়েছে বলেই এই সমালোচোকের বিশ্বাস।
-ক্রিটিক

-----------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

হিমু এর ছবি

ক্রিটিক লোকটা ভালো না। ফাহা ভাই এর সাথে আর মিশবেন না। ও আপনাকে সিগারেট ধরাতে পারে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অমিত এর ছবি

আদতে তাইলে গল্প কোনটা দাড়াইলো !!! উপরেরটা না ক্রিটিসিজমটা ?

______ ____________________
suspended animation...

ফারুক হাসান এর ছবি

- ক্রিটিক এইমাত্র ফোনে আমাকে জানালেন-
সব সাহিত্যই সাহিত্য না। সমাজমনষ্কতা ও প্রগতিশীলতা ছাড়া সাহিত্য হিতকর নয়। এই গল্প আবার তা প্রমাণ করলো। এই গল্প কেবল মন্থন করা যায়, কালের পরিক্রমায় টিকবে কি টিকবে না, আলোচোনার টেবিলে থাকবে কি থাকবে না- তা বলার সময় এখনও আসে নি।
(একটা সিগারেট হলে টেবিলে রাখতে পারি)।

-----------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-

ফারুক হাসান এর ছবি

গল্পের ব্যর্থতার জন্য ক্রিটিককে দায়ী করার যে সূক্ষ্ম প্রচেষ্ঠা দেখা যাইতেছে তাতে ক্রিটিক নিতান্তই মর্মাহত @ অমিত

অমিত এর ছবি

আয়হায়, মর্ম এত সহজে আহতে হলে কেমনে হবে !! ক্রিটিকরে বইলেন উপশম হিসাবে একখান বিড়ি থাকল টেবিলের উপর।

______ ____________________
suspended animation...

হিমু এর ছবি

গ্রেস মার্ক দিলে কেমন হয়?


হাঁটুপানির জলদস্যু

ফারুক হাসান এর ছবি

চিন্তিত

-----------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

দ্রোহী এর ছবি

শিশুতোষ গল্পটার ভেতর কেমন জানি "কামড়াতে চাই" টাইপ গন্ধ পাচ্ছি!

হাসি


কি মাঝি? ডরাইলা?

অমিত আহমেদ এর ছবি

মন্দ কি দেঁতো হাসি


একটা ঝলসে যাওয়া বিকেল বেলা, একটা লালচে সাগরের জলে
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ছোটদের গল্প.....
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

দুর্বাশা তাপস এর ছবি

আমার তো ভালই লাগলো
---------------------------------------
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

সৌরভ এর ছবি

সবাই আসলে বড় হয়ে গেছে।
এই গল্পের মজা বোঝে নাই।

আমি তো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাইলাম।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

অনেকদিন আগেই দেখছিলাম। আজ খুজে বের করে পড়লাম। গল্পের শেষটা খুবই দ্রুত হয়েছে। আর একটা গল্প শোনাও না হিমু মামা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।