গিমিগল্প : চেরাগ

জিকো এর ছবি
লিখেছেন জিকো (তারিখ: শনি, ২৮/০৭/২০০৭ - ৩:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মৃদুলা বিরক্ত। দুটো কারণে। প্রথমত, এ গল্পে তাকে যা করতে হবে, তা ভেবে। দ্বিতীয়ত - গল্পে ঢুকে গেছি আমরা - বর্ষা, রুমি, আলিজারা এখনও আসছে না বলে। ক্লাশের কয়েক বন্ধু মিলে এসেছে নরসিংদী, অ্যাসাইনমেন্টের কাজে। পোড়োবাড়ি বা পুরনো ভাঙা দালান যা পায়, ফটো তুলবে। সবাই যে যার মতো বেরিয়েছে বিকেলে। কথা ছিল, সন্ধ্যার ঠিক আগে দেখা করবে চৌরাস্তার মোড়ে। তারপর রাতেই ঢাকার বাসে রওনা। কত প্ল্যান! এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে, অথচ ফেরার নাম নেই কারও। যোগাযোগ যে করবে সে উপায়ও নেই, মোবাইল ফোনে চার্জ শেষ মৃদুলার। চার্জ শেষ হবার জন্য অবশ্য গল্প-লেখকও দায়ী, গল্পের গাঁথুনিটা পোক্ত হবার জন্য।

কী ভেবে, সবই এ গল্প-লেখকের খামখেয়ালিপনা, পাশের পোড়োবাড়িটায় আবার ঢোকে মৃদুলা। পুরনো বাড়ির নকশা নিয়ে পড়াচ্ছে এবারের সেমিস্টারে। ইন্টারনেটে পুরনো দেশী স্থাপত্যের ভালো ছবি পাওয়া যায় না। নয়তো অন্যবারের মতো নেট থেকে নামিয়েই অ্যাসাইনমেন্টটা পার করে দিত।

মৃদুলা ঘুরছে। এ ঘর। ও ঘর।
আলো-আঁধার।
নির্জন। শান্ত।

জমিদাররা নাকি থাকতো এখানে। কতকাল আগে, কল্পনা করার চেষ্টা করে সে। কেমন জাঁকজমক জীবন ছিল তখন? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘরের কোণে দেখে-- এ গল্পের প্রথম মোচড় এটা-- একটা চেরাগ। পিতলের। টিভিতে দেখা আলাদীনের চেরাগের মতো। ঘষে দেখবে নাকি একটু?

ঘষতে থাকে মৃদুলা, চেরাগে, এই বুঝি বেরিয়ে আসবে সুদর্শন কোনো দৈত্য!

কিন্তু বেরিয়ে আসে না।
আসে না। কেউ না।
এলে কি আর গল্প জমে?

ধ্যাত, হাসি পায় মৃদুলার। চেরাগটা আগের জায়গায় রেখে আবার হাঁটতে থাকে সে।

স্লামালেকুম।

চমকে ওঠে মৃদুলা। ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অপরিচিত যুবক। সুঠাম দেহ। চেহারায় বিনয়। চুল থেকে অ্যান্টিড্যানড্রাফ শ্যাম্পুর হালকা গন্ধ।

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, যুবক বলতে থাকে, আপনি চেরাগ ঘষছিলেন, বেরিয়ে এলাম একটু আগে। দীর্ঘদিন বন্দি ছিলাম সেখানটায়, ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ আমায় বের করার জন্য।

মৃদুলার কথা আটকে যায়, ভয় পায় না, অবাক হয় বরং, টিভি বিজ্ঞাপনের মতো।

কিছু চাই আপনার? কোনো ইচ্ছা? বড়জোর তিনটা ইচ্ছা। চেষ্টা করবো পূরণ করার। অবশ্য জানি না, আমার ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা এখনও আছে কিনা। যুবক স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, ঘরের কোণে, পায়ের কাছে চেরাগ।

মৃদুলার বিশ্বাস হতে চায় না। আবার হয়ও। হতেও তো পারে। সবই সম্ভব। চেরাগ। ইচ্ছাপূরণ।

একটা বাড়ি চাই। ছোট্ট বাড়ি। ছিমছাম। নদীর ধারে। শুধু আমার হবে। সেখানেই থাকবো। মামার বাসায় ফিরে যাবো না আর। একনাগাড়ে বলে ফেলে মৃদুলা।

চুপচাপ। কিছুক্ষণ।

তারপর? জানতে চায় চেরাগের যুবক। শীতলক্ষ্যার পাড়ে একটা বাড়ি তৈরি হয়েছে, দোতলা, শুধু আপনার জন্য। পরের ইচ্ছা বলুন। আর দুটো। বদলানো যাবে না। ভেবে নিন।

ভাবতে থাকে মৃদুলা। কোনো ভাবনাই আসছে না মাথায়। কী ইচ্ছা তার? কী চায় সে? এমনিতে কত ভাবনা খেলে, কত স্বপ্ন আঁকে অলস সময়ে, অথচ এখন, কী চাইবে যুবকের কাছে?

অনেক মোমবাতি, নানা রঙের। সন্ধ্যা হলেই মোমবাতিগুলো জ্বলে উঠবে সে বাড়িতে। জানলা দিয়ে বাতাস বইবে অনেক। অনেক। তবু মোমবাতিগুলো নিভবে না।

মোমবাতি চাইছে মৃদুলা। তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় আর কিছুই আসছিল না। না মৃদুলার, না এই গল্প-লেখকের।

যুবক হাসে। মৃদুলা বুঝে উঠতে পারে না, সেও হাসবে কিনা, ঠিকই তো, চেরাগ পেয়ে কেউ মোমবাতি চাইলে যুবক কেন, গল্পের পাঠকরাও হাসবেন।

তারপর? ধীর লয়, নিচু স্বর যুবকের। শীতলক্ষ্যার পাড়ে সে বাড়িটায় জ্বলছে এখন শ' খানেক মোমবাতি। সন্ধ্যা হলেই জ্বলবে প্রতিদিন। তিন নম্বর ইচ্ছাটা বলুন এবার। শেষ ইচ্ছা। সময় নিয়ে ভেবে বলুন।

ভালো লেগে যায় যুবককে। হয়তো এমন করে কেউ কখনও শুনতে চায়নি মৃদুলার ইচ্ছার কথা। এই প্রথম জানতে চাইলো কেউ, কোনো যুবক, হোক সে চেরাগের, হোক সে গল্পের।

সে বাড়িতে যেতে চাই, এখানে আর না। শেষ ইচ্ছা মৃদুলার, যুবকের কাছে।

আপনার যা ইচ্ছা, বিনয়ী যুবক বলে, একটু পর আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন সে বাড়িতে। তবে-

মৃদুলার কৌতুহল হয়, ভয় পায় না। ভয় পেলে কি গল্প এগুতে পারে?

...তবে যাবার আগে আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে আপনার, যুবক বলে যায়, জানি না কিভাবে নেবেন তা, দু'শো চার বছর ছয় মাস একুশ দিন বন্দি ছিলাম এ চেরাগে, আজ আপনি মুক্ত করলেন, আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে। আর আমার বিশ্বাস, কোনো ক্ষতি করিনি আমি, শুধু একটা অনুরোধ, শেষ ইচ্ছাপূরণের আগে।

যুবক তার অনুরোধ জানায়।

কী বলবে মৃদুলা, ঠোঁট কাপে তার, বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ হয়, গল্পের খাতিরে এসব উপসর্গ নীরবে সয়ে যায় মৃদুলা।

এবং রাজি হয় যুবকের অনুরোধে। মৃদুলা ভাবে, যে যুবক সহজেই তার এত বড় ইচ্ছাপূরণ করতে পারে, একটা সামান্য অনুরোধ রাখতে পারবে না তার? জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়াই তো।

রাত বাড়তে থাকে।
চুমু খায়। যুবক।
জড়িয়ে ধরে। মৃদুলাকে।
আদর করে। অনেকক্ষণ।

আদর শব্দে মন ভরে না ঠিক, পাঠকের চোরা চোখ নিশপিশ করে আরও ডিটেইল জানার।

তবু ডিটেইলের তোয়াক্কা না করে, আদর শেষে, চেরাগের যুবক চলে যাবার প্রস্তুতি নেয়। আর গল্পের শেষ দিকে মৃদুলা দাঁড়িয়ে থাকে। তার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হয়নি এখনও। মোমবাতিঅলা বাড়িটায় ফিরিয়ে নেবার কথা ছিল যুবকের।

যুবক, ফিরে যাচ্ছ যে? তোমার অনুরোধ তো রাখলাম। আমার ইচ্ছাপূরণ? বাচনভঙ্গিতে মেলোড্রামা, দৃষ্টিতে অসহায় ভাব, মৃদুলার।

হাসে যুবক।
কোথায় পড়েন আপনি? যুবকের জিজ্ঞাসা।

ভার্সিটিতে, ঢাকায়, আর্কিটেকচারে, সরল উত্তর মৃদুলার।

হায়, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এখনও এসব চেরাগফেরাগ-ইচ্ছাপূরণে বিশ্বাস করেন? আর আপনি বুঝি নেট থেকে হিমুর কৌতুকটা পড়েননি?

তারপর গল্প-লেখকের স্থুল রসিকতার নিকুচি করতে করতে মিলিয়ে যায় যুবক, পোড়োবাড়ি থেকে। এ গল্প থেকেও।

- ইশতিয়াক জিকো / ২৭ জুলাই ২০০৭
_____________________________
১. বিশ্বে শতকরা ৫৬.৬৭ ভাগ পরিসংখ্যান বানানো হয় তাৎক্ষণিক।
২. জলদস্যু, হাঁটুপানির (২০০৬)। Djinectically Modified. বড়মণিদের কৌতুক, ঢাকা।


মন্তব্য

কারুবাসনা এর ছবি

ত্যবে, কে বলে গল্পকে আদর করা যায় না?


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

হ হিমুর ব্লগে পড়ছিলাম। পুর্নলিখন ভালো হইছে। হাসি

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

তারেক এর ছবি

ভাল লাগল। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

হিমু এর ছবি

পোড়াবাড়ি না পোড়োবাড়ি?

দেখি একটা খুঁজে বার করতে হবেহ্!


হাঁটুপানির জলদস্যু

জিকো এর ছবি

আপনি সঠিক।

পোড়োবাড়ি নিঃসন্দেহে। পোড়ো মানে খালি।

দুর্গ স্ট্রিংকে রিপ্লেস অল > একটা বানান ভুল > পোড়া কপাল!

হিমু এর ছবি

এই কাহিনী ঘিরে যদি একটা ভারতীয় "কিউ কি বাল ভি কাভি চুল থে" গোছের গিগাসিরিয়াল বানানো যেতো!

বিশালবক্ষা আভরণরঙ্গিনী মৃদুলা কাঞ্জিভরম পরে টয়লেট থেকে বেরিয়েছে। ফরাসী ছাঁটে কাটা থ্রি পিস স্যুট আর ইতালিতে সেলাই করা কুমিরের চামড়ার জুতো পরে চাদরের নিচে শুয়ে সেই ভুতুড়ে কোপারু যুবক। মুখে হাসি, হাসির ফাঁকে সিগারেট।

ধাম ধাম ধাম শব্দ হবে। তিন ধাপে যুবকের মুখের ওপর মনোযোগ দেবে ক্যামেরা (এটাকে কী বলে?)।

"পঢ়হে লিকখে হ্যায় আপ?" যুবকের মৃদু প্রশ্ন। কিন্তু প্রতিধ্বনি হবে মিনিট খানেক ধরে ... "হ্যায় আপ" "হ্যায় আপ" "হ্যায় আপ" ...।

কমার্শিয়াল ব্রেক। মৃদুলার ওড়না উড়ছে বাতাস, পেছনে চেরাগ থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। পোড়োবাড়িতে জ্বলছে সুরিয়া টিউবলাইটের আলোর কারিকুরি। গানের সুরে বলছে, "কিঁউ কি বাল ভি কাভি চুল থে ... থে ... থে ...।" তারপর মিনিট পাঁচেক উপাদেয় কমার্শিয়াল। বিভিন্ন রসেলি মডেলের ঊরুখন্ড, নাভিখাদ আর স্তনের খাঁজভাঁজের ফাঁকে মানুষের বিস্কুট, কুত্তার বিস্কুট, গাড়ি আর ইন্সুরেন্স কোম্পানির বিজ্ঞাপন।

আবার।

মৃদুলাকে এবার দেখানো হবে দশদিক থেকে। বিহ্বল চোখে সে তাকিয়ে আছে যুবকের দিকে। শব্দ হবে, ধাম ধাম ধাম ধাম ...।

কমার্শিয়াল ব্রেক।

আবার।

"হাঁ ম্যায় তো আর্কিটেকচার স্টাডি করতি হুঁ ভিশিয়াভিদিয়ালাযা মে ... লেকিন বাত কেয়া হ্যায় জ্বিনজী? আপ কিঁউ অ্যায়সে সাওয়াল পুছতেঁ হ্যায়?" ... পুছতেঁ হ্যায় ... পুছতেঁ হ্যায় ...।

ধাম ধাম ধাম ...।

আজকের পর্ব এখানেই শেষ।

আগলে এপিসোডমে কী দেখানো হবে তারওপর একটা আভাস দেয়া হবে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

জিকো এর ছবি

গোস্তাখি মাফ করবেন হিমু-এ-আলেমপনা।

গিগায় অরুচি; আমার বরং গোপন কূটইচ্ছা, এটাকে কেটেছেঁটে, টাইট করে কমার্শিয়াল বানানোর, কনডমের; এ পণ্য আমদানি ও প্রসারে এনজিওকর্তাদের উৎসাহে ঘাটতি হবে না।

গল্পের সব ঠিক থাকবে, শেষ শটে মিলিয়ে যাবে যুবক, তারপর ক্যামেরা উঁচু থেকে নেমে আসবে নিচে, ধীরে, ক্লোজআপে ফোকাস হবে মাটিতে পড়ে থাকা ব্যবহৃত ইউঅ্যান্ডমি। ভেসে উঠবে ব্র্যান্ড লোগো, সাথে মনোহরা শ্লোগান।

এক-আধটু পাল্টে মুঠোফোনের বিজ্ঞাপনও করা যায়।

তবে এসব কল্পনাতেই থাকুক। বিজ্ঞাপনের পথে আমরা না যাই। হাসি

রেজওয়ান এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।