দিনলিপি : বন্যা, বিদ্যুৎহীন, কাঁচামরিচ এবং একশ' বস্তা চাল

জিকো এর ছবি
লিখেছেন জিকো (তারিখ: শনি, ০৪/০৮/২০০৭ - ৫:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
ঢাকার পূর্বাঞ্চলে বসবাস, বাঁধের বাইরে, বন্যার পানি তাই বাড়ির সীমানায়। ভাবতে ভালো লাগছে, প্রতিবারের মতো এবারও 'বন্যাকবলিত' হবার সুনামটা ধরে রাখতে পারবো। তবে যত যাই হোক, মিডিয়ার চোখে আমরা 'বন্যার্ত' বা 'বানভাসি' হবো না। দুর্জনদের প্রলাপ, এটা নাকি আর্থসামাজিক অবস্থানগত কারণ।

ঠোঁট উল্টাই। এত বুঝে কাজ নাই।

২.
এ মাসের প্রথম দিন, টানা নয় ঘণ্টা ছিলাম বিদ্যুৎহীন। যে এলাকায় থাকি, সেখানে নয় ঘণ্টার হিসাব এমন কিছু না, পত্রিকার খবর হতে গেলে টানা প্রায় তিন দিন বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়, যেমনটা থেকেছি সপ্তাহখানেক আগে। ফলাফল, তিন নম্বর পৃষ্ঠায় দুই কলামের খবর, তাও বিদ্যুৎ আসার এক দিন পর, তবু তো ছেপেছে, কৃতজ্ঞতা জানাই, কারণ এমনিতে যা কিছু ভাআলো, শুধু তার সঙ্গেই থাকেন কিনা তারা।

ফুলস্পিডে ফ্যান ঘোরে। এত বুঝে কাজ নাই।

৩.
গতকাল কাঁচামরিচ কিনেছি ২০০ টাকা কেজি দরে। ভালো। পাঁচদিন আগে ছিল ৮০ টাকা কেজি। বিজ্ঞজনের খিস্তি : এইসব সো-কল্ড মধ্যবিত্তের হুতাশ, সাময়িক আহাজারি, ফুকো রুদ্দি পোন দানোর ফল আর এখন ব্লগে লেখার আইটেম। আরও ভালো।

মাথা চুলকাই। এত বুঝে কাজ নাই।

৪.
গেল মাসের শেষ রাত কেটেছে শিল্পকলার নাট্যশালায়, জাপানি নাটক একশ' বস্তা চাল দেখে। বাড়ি ফিরেছি ঝুমবৃষ্টিতে। ফিরেই রুটিনমাফিক লোডশেডিং উপভোগ আর যাবতীয় প্রথাযাপন।

একশ' বস্তা চাল একটি চমৎকার বাজে নাটক। পাণ্ডুলিপি ইউজো ইয়ামামতো'র। নির্দেশনায় গোলাম সারোয়ার, নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের উপপরিচালক তিনি। প্রযোজনায় শিল্পকলা একাডেমী নিজেই। আর প্ররোচনায় দুর্নীতি দমন কমিশন। জাপান দূতাবাস প্রযোজনা সহযোগী ছিল।

এ নাটক মঞ্চায়নের আরেক উদ্দেশ্য, সরকারি মেসেজ দেয়া। বাজে মনে হবার অন্যতম কারণ এটি। অবশ্য সরকার নাটকের মাধ্যমে জনগণকে মেসেজ দিতেই পারে, যেহেতু ধরে ধরে সবাইকে আফিম খাওয়ানো কষ্টসাধ্য।

নাটকের পটভূমি ১৮৭০ সালের। মেইজি সময়কার। কাহিনী এমন : নাগাওকা অঞ্চলের মানুষ খেতে পারছে না, আর্থিক অনটন খুব। পাশের অঞ্চল থেকে একশ' বস্তা চাল আসে, বিলি করার জন্য। কিন্তু নাগাওকার প্রধান উপদেষ্টা চাল বিলি না করার সিদ্ধান্ত নেন। এই চাল বেচে একটা স্কুল ঘর বানাতে চান। এমনিতেই ক্ষুধা, তার ওপর এমন সিদ্ধান্ত, ক্ষেপে যায় সামুরাই যোদ্ধারা। কাতানা (সামুরাই তলোয়ার) নিয়ে ঘেরাও করে প্রধান উপদেষ্টার বাড়ি, পারে তো তখনই ঘ্যাচাং।

শেষ অঙ্কে উপদেষ্টা বোঝান পাবলিকসম সামুরাইদের: চাল বিলি করলে তা দু দিনেই ফুরিয়ে যাবে, আর চাল বেচার টাকা স্কুলের পেছনে খরচ করলে শিক্ষিত হবে জনগণ, তখন একশ' কেন, হাজার বস্তা চাল উৎপাদন করা যাবে।

সামনের সারির দর্শকরা অন্ধকারে বসে হাততালি দেন।

এদিকে, মঞ্চে উপস্থিত সামুরাই যোদ্ধারা গাঁইগুঁই করে, যুক্তিতর্কে পারে না, শেষে জাপানি স্টাইলে গুরুবাদিতার জয় হয়, শ্রদ্ধায় তারা হাঁটু গেড়ে বসে, মাথা নত করে উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শিতার কাছে।

নাটকের আলোক নির্দেশনায় ছিলেন ঠাণ্ডু রায়হান। মঞ্চের কোণে তিনি উজ্জ্বল আলো ফেলেন। আর উপদেষ্টা সেখানটায় গিয়ে আশার বাণী কপচান, ওরে দ্যাখ, ওই তো আলো, নতুন সূর্য, সুন্দর আগামী অপেক্ষা করছে। আবহ সঙ্গীতের লয় বাড়তে থাকে।

নাটক শেষ হয়।
ভাবনা শুরু হয়।

ভাবনার প্রথম স্তর নাটকের পরিণতি নিয়ে, যেখানে হাইলাইট হয় প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত, সাময়িক সমাধানে না গিয়ে স্থায়ী সমাধানের পথের ব্যবস্থা করা। অথবা ভিন্নপাঠে: ভবিষ্যতে সুখের জন্য বর্তমানের কষ্টকে সহ্য করে যাওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।

কিন্তু একশ' বস্তা চাল বেচে স্কুলের ভৌত অবকাঠামো তৈরি আর সেখান থেকে শিক্ষিত-স্বাবলম্বী হয়ে দারিদ্র্যমোচন করার যে স্বপ্ন-- এ দু'য়ের মাঝে অসংখ্য ধাপ ও নিয়ামক আড়ালে থেকে যায়, উপদেষ্টার 'রোডম্যাপ' পরিস্কার হয় না। স্বপ্নটা বরং সরকারি-সরকারি মনে হয়।

মঞ্চে সামুরাইরা মেনে নেয়। কিন্তু ২০০৭ এর বাংলাদেশে বসে আমার খটকা দূর হয় না; কেমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?

হ্যাঁ, সেটা দ্বিতীয় স্তরের ভাবনা। নাটকের মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবি। কেন ১৪০ বছর আগের কাহিনীওলা এই জাপানি নাটক বেছে নিলো সরকারি প্রতিষ্ঠান? শুধু কি জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়ন?

উনিশ শতকে জাপানে মেইজি শাসনামল নিয়ে যারা জানেন, তারা তো জানেনই, তাও মনে করিয়ে দিই, মেইজিদের কারণে জাপানে বেশ বড় পরিবর্তন আসে, শিল্পায়নে এগিয়ে যায় তারা, এবং তার জের ধরে ১৯০৫ সালে ক্ষমতায় আসে মিলিটারি।

নাগাওকার এ ঘটনাকে আদর্শ হিসেবে প্রচার করতেন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি।

বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কি সেই নীতি সমর্থন করতে বলে?

এর একটা উত্তর পাই নাটক মঞ্চস্থ হবার আগে দেয়া বক্তব্য থেকে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মো: মোখলেস উর রহমান এসেছেন প্রধান অতিথি হয়ে, আগেরবার মঞ্চায়নেও তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর দেখা ভালোলাগা নাটক এটি। দর্শকদের বললেন, নাটকটি অনেক আগের হলেও এ সময়ের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই যে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে, এবং বাড়ছেই, তা যেন আমরা সহ্য করি দাঁতে দাঁত চেপে। নয়তো দুর্নীতি দমবে না, সুনীতি প্রতিষ্ঠা হবে না।

তারপর শুরু হলো আমলাবাজি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গান গাইলেন। বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে স্বর ওঠানামা করে কোরআনের আয়াত দিলেন। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উদাহরণ দিতে মকবুল ফিদা হুসেনের সাম্প্রতিক প্রেম টানলেন, ভারতের এপিজে আবদুল কালাম পাড়লেন। উঁচু রসবোধের প্রমাণ দিতে গিয়ে অভিনেত্রী শাবনূর নিয়েও কি এক ফোড়ন কাটলেন। সেই সাথে মাইক্রোফোনকে সাক্ষী রেখে হাসির মতো শব্দ করলেন অনেকবার।

নাটকটা দেখবো বলে প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁতে দাঁত চেপে এসব সহ্য করেছি!

আর দেখুন, নাটক দেখে সহ্যক্ষমতা আরও বাড়ছে আমার। এভাবে বাড়তে থাকলে কাঁচামরিচের ২০০ টাকা কেজি দর অথবা তিন দিন বিদ্যুৎহীনতায় ডেসার নিস্পৃহ মনোভাব-- কোনো ব্যাপার না, পানিভাত!

এবং তারপর দুম করে আমরা একদিন সামুরাই হয়ে যাবো, আর বাংলাদেশি স্টাইলে মাথা নত করবো প্রধান উপদেষ্টার কাছে।

তবু শেষ হবে তো এ নাটক?

- ইশতিয়াক জিকো / ৪ আগস্ট ২০০৭
_____________
ছবিসূত্র : নিউ এজ পত্রিকা


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সরকার বাহাদুরও আমাদের অপটিমিস্ট হতে বলছেন? রোডম্যাপ ধরে হাঁটলে দেহে থাকবে লাবণ্য, মনে থাকবে আনন্দ, জীবন হয়ে উঠবে মধুময়। আশা করি এর পর কিভাবে বারান্দায় টবে মরিচ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, এর ওপর কিছু সরকারী প্রতিবেদনও উঠতে বসতে টেলিভীষণে দেখানো হবে। আর মরিচ না খেলে কী হয়?


হাঁটুপানির জলদস্যু

কারুবাসনা এর ছবি

মিলাবে না,সাগর ভর্তি তেল,
কিছুই মিলাতে চেয়ো না এখন।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

দারূণ দিনলিপি।
একটা জিজ্ঞাসা। সরকার কি কোনো রোডম্যাপ দিয়েছে? কত তারিখে?
নির্বাচন কমিশন দিয়েছে শুনেছিলাম।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সৌরভ এর ছবি

বেশ অর্থবহ নাটক দেখেছেন মনে হচ্ছে।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অসাধারণ লেখা। স্মার্ট গদ্য ধারালো ছুরির মতো কাজ করে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বাচ্চারা কেউ ঝামেলা করো না,
উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করো না,
চুপচাপ বসে থাকো।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

দিগন্ত এর ছবি

জাপানে কিন্তু ব্যাপারটা নাটক ছিল না, জাপান কিন্তু মেইজি আমলে সত্যিই এগিয়েছিল। কোজুমি হয়ত সেটা নিয়ে রাজনীতি করছে ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

জিকো এর ছবি

শোহেইল মতাহির চৌধুরী:
সরকারের কোনো রোডম্যাপের কথা শুনিনি এর মধ্যে।

দিগন্ত :
ঠিক। ১৪০ বছর আগে জাপানের নাগাওকার সেই সত্যি ঘটনা অবলম্বনেই নাটকটা। আর মেইজি আমলে জাপান উন্নতি করে, সত্যি। আর তারপর মিলিটারি যে ক্ষমতায় আসে, তাও সত্যি।

তবে শিল্পকলা একাডেমী এবং দুর্নীতি দমন কমিশন, দুটো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক সংস্থা, যখন ১৪০ বছর আগের জাপানের সাথে তুলনা দিয়ে বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতিকে সহ্য করতে বলে, তখন নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য রহস্যময় লাগে।
____________________________
জিকোবাজি | ফটো গ্যালারি | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।