যাপিত জীবন-০৭ : : ফাঁও খাওয়া

ইমরুল কায়েস এর ছবি
লিখেছেন ইমরুল কায়েস (তারিখ: রবি, ০৯/১১/২০০৮ - ৩:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একদা হলে ফাঁও খাওয়া-দাওয়ার রোল পড়িল । বাঙালি মাত্রই ফাঁও আলকাতরা পর্যন্ত খাইতে ওস্তাদ । সুতরাং এইরূপ খাওয়া-দাওয়া হইতে নিজেকে বিরত রাখা এই অধমের পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব হইল না । নির্বিবাদ ফাঁও খাইব মনে করিয়া জড়াইয়া পড়িলাম এবং তৎসংলগ্ন কি কি বিপদে
পড়িয়াছিলাম তাহাই আজকের ব্লগের আলোচনার বিষয় ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অত্যাসন্ন । হলের মান রাখিবার মরণপণ শপথ লইয়া ছাত্রকূল বৈকাল বেলায় মাঠে কঠোর অনুশীলন করিতে
লাগিল । বহুদিন ধরিয়া ক্রীড়াক্ষেত্রে শিরোপার মুকুট না পাইয়া হলের কর্তামহাশয়গণ (প্রভোষ্ট) ভুখানাঙ্গা দিন কাটাইতেছিলেন আর বোধকরি অন্য
হলগুলির কর্তাদের নানাবিধ কটুবাক্য শ্রবণ করিয়া দিন গুজরাইতেছিলেন । তাহাদের আর সহ্য হইবে কেন ? আর দেরী না করিয়া তাহারা নিজ নিজ
ঘড়িতে চাবি দেওয়া শুরু করিলেন , পারিলে রুমে রুমে গিয়া ছাত্রদের অনুশীলনের নিমিত্তে মাঠে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন । হলে খেলা খেলা করিয়া রোল পড়িয়া গেল ।

এই অধম প্রতিনিয়ত উৎকৃষ্টরূপে দিবা নিদ্রা সারে , আয়েসে ভুরি আর শরীরের ওজন বাড়াইয়া চলে আর সন্ধ্যা যখন প্রায় নামিয়া আসে তখন কুখাদ্য পরিবেশক কেন্টিনে যায় , দুপুরের খানিক পরে প্রস্তুত শুকনা পুরী , সিংগারা , সমুচা ,চপ ইত্যাকার দুষ্পাচ্য খাদ্যসামগ্রী গিলিয়া চলে । কেন্টিন সংলগ্ন দোকানে ছাত্রগনের নির্বিচারে কলাটা-মূলাটা-চকোলেট দুধটা খাইতে দেখিয়া শুকনা সমুচা গলা দিয়া আর নামিতে চাহে না । ইহারা হলের ক্রীড়াবিদ । মাত্রই মাঠে অনুশীলন করিয়া আসিয়া খাবার-দাবার উচ্ছেদ করিতে আসিয়াছে । তা করুক গে । কে না জানে এইসব কর্মে অতিমাত্রায় ক্যালরি ক্ষয়িত হয় , উহারা তো খাবার খাবেই । কিন্তু খাওয়া পরবর্তী তাহাদের কান্ডকারখানা দেখিয়া মনটা আরও উৎসুক হইয়া পড়ে । খাওয়ার পরে ইহারা শুধু বলে অ্যাথলেটিক্স । ব্যস কেল্লা ফতে আর খাবারের মূল্য প্রদানের কোন আবশ্যকতা থাকে না । মনে মনে ভাবি , যাই , গিয়া এটা সেটা খাইয়া বলি অ্যাথলেটিক্স । দেখি কি হয় ? কিন্তু ভীরু মন সায় দেয় না । যদি কিছু হইয়া যায় ।

অধমের রুমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামী ক্রীড়াবিদের বাস । ইতোপূর্বে দৌড়-লম্ফ -ঝাঁপ এইরূপ ক্রীড়ায় সে হলের পক্ষে নানান সাফল্য বগলদাবা করিয়াছে । এইবারেও তাহার উপর অনেক ভরসা । আমি তাহাকে শুধাইলাম আচ্ছা তাহাদের কলাটা-মূলাটা নির্বিচারে ভোজন এবং তৎপর বকেয়া প্রদান না করিয়া শুধুমাত্র অ্যাথলেটিক্স কথাটি পাড়িয়া সটকিয়ে পড়ার কারন কি ? সে আমাকে যাহা বলিল তাহাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ হইল , উত্তেজনাবশত হাত-পা কাঁপিতে লাগিল , বুকে ফাঁও খাওয়ার আশা জাগ্রত হইল । ক্রীড়াবিদদের মাগনা খাইবার জন্য নাকি একখানি বহি আছে । অনুশীলন করিয়া এটা-ওটা খাইয়া যাও আর বহিতে লিখিতে কও । বহির সমুদয় বিল হল হইতে দেওয়া হইবে । ব্যস আর কে পায় ? অচিরেই ক্রীড়াবিদের খাতাটায় নাম লিখিব বলিয়া মনস্ত করিলাম । নাম না হয় লিখিব কিন্তু কোন খেলায় লিখিব ? শরীরের যে হাল তাহাতে দৌড় বা লম্ফ কিছুতেই কিছু পারিব বলিয়া মনে হইল না । ভাবিলাম ঐসবে গিয়া কাজ নাই , সহজ কোন খেলায় নাম দিই । ভুলেও যদি খেলার মাঠে আসল প্রতিযোগিতার দিন যাইতে হয় তাহলে যাতে মানসম্মান যা অবশিষ্ট আছে তাহা নিয়া ফিরিয়া আসিতে পারি । অনেক ভাবিয়া চাকতি নিক্ষেপ খেলায় নাম লিখিয়া আসিলাম । ইহা আর
এমন কি খেলা হইবে ? একখানি চাকতি লইয়া দূরে ছুড়িয়া মারিলেই হইল , দৌড়-ঝাঁপের খাটুনিটা নাই ।

খাতায় নাম লিখিয়া ক্রীড়াবিদের সমুদয় সুবিধাদি উপভোগ করিতে শুরু করিলাম । দিবানিদ্রা সারিয়া দোকানে যাই আর মনভরে এটা-সেটা খাই । যেইদিন সন্ধ্যায় ছাত্র পড়াইতে যাইতে হয় সেইদিন ছাত্রের বাটিতে জল-খাবার খাইলেও দোকানেরটা ছাড়ি না । দোকান হইতে বিস্কুটটা-চানাচুরটা-সিগারেটটা আনিয়া রাখি , বেশী রাত্রির হইলে খাইব । অনুশীলনের কোন নাম নেই । অনুশীলনের বালাই কে করিতে যাইবে ? ইহারা তো আর দেখিতেছে না , বহিতে তো ক্রীড়াবিদ হিসাবে নাম আছেই ।

এইভাবে দিন ছয়েক ভালমন্দ মাগনা খাইয়া ভালই যাইতেছিল । কিন্তু সুখ আর কতই কপালে সয় ? সেইবার হলে চাকতি নিক্ষেপকারীর খুব আকাল পড়িল । সর্বসাকুল্যে একজন , সেটা যে এই অধম তাহা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । চাকতি নিক্ষেপের মত সহজ একখানি খেলা যাহাতে পায়ের কোনরূপ কষ্ট নাই মাথার কোনরূপ কষ্ট নাই তাহাতে আর ছাত্র থাকিবে না কেন ভাবিয়া আমি নিতান্ত ক্ষেপিয়া উঠিলাম । অবশ্য অধমের ক্ষেপিয়া উঠিবার আসল কারন ইহা নহে । কারনটা এক্ষন বলিতেছি ।

একমাত্র চাকতি নিক্ষেপকারী দেখিয়া প্রভোষ্ট মহাশয় তাহার প্রতি অধিক যত্মবান হইয়া উঠিলেন । তাহার কোনরূপ অনুশীলনের অসুবিধা হইতেছে কি না সে সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিলেন । কিন্তু আফসোস কেহই তাহাকে চাকতি নিক্ষেপকারীর কোনরূপ খোঁজখবর দিতে পারিল না । কতিপয় পরিচিত ক্রীড়াবিদ ছাত্রকে তিনি শুধাইলেন তাহারাও তাকে নিরাশ করিল । ছাত্ররা জানাইল এই নামের কোন চাকতি নিক্ষেপকারীকে তাহারা কোনদিন মাঠে অনুশীলনের নিমিত্তে দেখে নাই । মহাশয় মাগনা খাবারের বহিতে খবর নিলেন কিন্তু দেখিতে পাইলেন চাকতি নিক্ষেপকারী প্রতিনিয়ত নিয়মমাফিক খাইয়া গেছে । চাকতি নিক্ষেপকারী গেল কোথায় ? খবর পাঠানো হইল তাহার রুমে ।

সেইদিন বিকেল বিকেল ঘুম থেকে উঠিয়া দোকানে উত্তমরুমে খাইয়া আসিয়াছি । শরীরটা ম্যাজম্যাজ করিতেছিল । আরেকটা ঘুম পাড়িব কি না ভাবিতে ভাবিতে রুমে আসিয়া শুনিলাম এই বৃত্তান্ত । হলের কর্তাব্যক্তি কেউ একজন খুঁজিয়া গিয়াছে । বুঝিলাম , বাপো ইহা অনুশীলনের না যাইবার ফল ।
চাকতির মত এই অধমও হল হইতে নিক্ষিপ্ত হইতে পারে এই ভাবিয়া এবং খানিকটা ভয় পাইয়া একবস্ত্রে মাঠের দিকে রওয়ানা দিলাম । মাঠের ক্রীড়াবিদেরা অনেকেই দেখিয়া ভ্রু কোঁচকাইল । তাহাতে কাহার কি ? আগে নিজের জান , ইহাকে প্রথমে বাঁচাইয়া লই । সবার সাথে প্রবল বেগে দৌড়াইতে শুরু করিলাম । সর্বশেষ কতকাল আগে দৌড়াইয়াছিলাম বলিতে পারিব না সেটা নিদেনপক্ষে চার-পাঁচ বৎসরের কম হইবে না । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়া নিতন্ত কুড়েমিপনা পাইয়া বসিয়াছিল । ব্যায়াম নাই , খেলাধূলা নাই , দীর্ঘপথ হাঁটা নাই খালি খাওয়া-পড়া-ঘুম আর খাওয়া-পড়া-ঘুম । হাঁটার কাজে সাইকেল জাতীয় কোন ছোটকাট যন্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ থাকিলে হয়ত হাঁটিতামও না । এহেন শরীরে যে দৌড় মানায় না তাহা কে না জানে বিশেষত সেই দৌড় যদি ঘন্টা দেড়েকের হইয়া থাকে । দৌড় শেষে নিতান্ত মুটাইয়া পড়িলাম । দীর্ঘকাল পর শরীরের কলকব্জা জীবন ফিরিয়া পাইয়াছে । ইহাদের বেশী করিয়া সচল হইবার কথা থাকিলেও অবাক বিস্ময়ে দেখিলাম ইহারা পারিলে চিরতরে বন্ধ হইয়া যায় । হাত-পা আর নড়িতে চাহে না । বহু কষ্টে হাত-পা সমেত হলে প্রত্যাবর্তন করিতে সক্ষম হইলাম । আসিয়াই শুইয়া পড়ি, ঘুমের চেষ্টা করিতে থাকি । ঘুম আর ধরে না । রাত্রি যত গভীর হইতে থাকে হাত-পা ততই ব্যথায় ককাঁইতে থাকে । কানে ধরিলাম আর ফাঁও খাইবার আশা এই জীবনে করিব না । যাহা এতদিন খাইয়াছি ভুল করিয়া খাইয়াছি ।

পরদিন সবাই ক্রীড়াবিদের তালিকা হইতে হলের একমাত্র চাকতি নিক্ষেপকারীর নাম কাটা দেখিতে পাইল ।

-----------------------------------------------
উত্তর বাংলার অনাহারী যুবক


মন্তব্য

রেজওয়ান এর ছবি

(অট্টহাসি) ইমোটিকন দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

আলমগীর এর ছবি

ভাল লিখছেন।

রাফি এর ছবি

খুব খারাপ !!! এইভাবে রাজভান্ডার খালি করা ঠিক না। চোখ টিপি

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

ইমরুল কায়েস এর ছবি

রাজভান্ডার তো প্রজাদের জন্যই নাকি ?
----------------------------
কেউ একজন অপেক্ষা করে

Alvee এর ছবি

Gr8

নন্দিনী  এর ছবি

হুম ! ফাও খাওয়া ভালোনা । এতে নানাবিধ বিপর্যয় হতে পারে ঃ-)

নন্দিনী

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হা হা হা। মজা পেলাম ভীষণ হো হো হো

বিপ্লব রহমান এর ছবি

ওরে! গড়াগড়ি দিয়া হাসি
---
(বিপ্লব)


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হো হো হো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

হাসিব [অতিথি] এর ছবি

জটিলজজজজ হইসে দোস্ত;)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।