হাউন্ড অফ দ্য হোমলেস - ১,২

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: শুক্র, ১০/০৮/২০০৭ - ৮:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
প্রায় এক হাজার মাইল পার হয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম ইন্টারস্টেটের ধারে। পরনে ছাব্বিশ ঘন্টার বাসি এক সেট নোংরা কাপড়, চোখে নির্ঘুম রাতের লাল-হলুদ জোনাকি, অনভ্যস্ত শরীরে শ’তিনেক পাউন্ড বোঝা টানাটানি করার ক্লান্তি। মনে তবু তাজ্জব রকম অবান্তর কিছু প্রশ্নের ভিড়।

পেছনে তাকিয়ে ভাবছিলাম সফরের কথা। সকাল সাড়ে দশটার দিকে ব্যাটন রুজ থেকে রওনা। সাড়ে তিন বছরের একটু বেশি সময় ধরে যেই শহরটাকে নিজের বলে জেনেছি, সেখান থেকে বিদায়। পরের দেশের প্রথম শহর, আপন করে নেওয়া আমার অন্যা। যার নিঃস্বতাকে নিজের দৈন্য ভেবে মাথার মুকুট করেছি, সেই ধূলার রানীর রাজত্ব থেকে বিদায়। অনুভূতিটা মিশ্র। আমি যাকে কাছের বলে জেনেছি, তার কাছেও কাছের হবার আনন্দ। কতটা কাছের, সেটা বুঝতে পারার রোমাঞ্চ; অথচ একই সাথে সেই মুহূর্তটা বিচ্ছেদের হওয়ার কষ্ট, কাছে টেনে আনার পর আরো অনেকের মত আমিও তাকে ছেড়ে জৌলুসমুখী হওয়ার লজ্জা। এই হতচ্ছাড়া অঙ্গরাজ্য বা এই বর্ধনশীল শহরটার নাম শুনলেই নিজেকে এর একজন মনে হওয়ার আনন্দ, আবার একই সাথে তাকে ছেড়ে দূরে থাকার অপরাধবোধ। এ যেন বাঁধতে শেখা, তবু বাঁধা না। মনের বন্ধনকামী অংশের জন্য অনেক যত্নে একটি বন্ধন তৈরি করা, শুধুই মুক্তিকামী অংশকে সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দ দিতে। প্রথম কিছুদূর অস্থির লাগলো একটু। তারপর ডুবে গেলাম রাস্তা, মানুষ, আর দ্য ওডেসা ফাইলসে। কমফোর্টেবলি নাম্ব। কিছুদূর না যেতেই আবার একা, দুখী, অপরাধী। আরো কিছুদূর গিয়ে আবারো শুধুই অজানার পথের যাত্রী। এভাবেই দোল খাচ্ছিলাম নিজের মনে।

আচমকা মনে হল, এত সহজেই কাতর হয়ে গেলাম অন্যাকে নিয়ে? কোথায় হারিয়ে গেল বাংলাদেশকে কোনদিন না ভোলার প্রতিজ্ঞা? কোথায় লুকালো আর কাউকে ভাল না বাসার প্রতিশ্রুতি?

২।
প্রথম যাত্রাবিরতি ছিল মোবিল, অ্যালাবামায়। গালফ অফ মেক্সিকোর একেবারে পাশের ছোট্ট একটা শহর। পানি বরাবর তাদের বেশি টানে যাদের মাটি আছে অনেক। পানির পাড়ে তাই বিত্তবানের বিলাসের যাবতীয় ব্যাবস্থা আছে। সৈকতের পাড়ে ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি। টাকার কামড়ে অতিষ্টরা এখানে আসে টাকা খোয়ানোর মজা লুটতে। অনেকটা সাদাদের শখের বশে রোদে পুড়ার মত। হারিকেন ক্যাটরিনার বড় থাবা পড়েছিল নিউ অর্লিয়েন্স (লুইজিয়ানা), বিলক্সি (মিসিসিপি), আর মোবিলের (অ্যালাবামা) উপর। টিভিতে দেখেছিলাম এই তিন শহরেই ভাসমান ক্যাসিনো তুলে নিয়ে মাইল দুয়েক ভিতরে ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্য। দেখেছিলাম সুদৃশ্য হোটেলগুলোর ভাঙ্গা কাঁচ। গালফ কোস্টের শতবর্ষের পুরনো গাছগুলো নত হয়ে কুর্ণিশ করে ছিল যেন শ্রেয়তর সত্ত্বার সামনে। মাঝ বরাবর ভেঙ্গে খান খান হয়ে ছিল কজওয়ে এবং ইন্টারস্টেট।

ভাঙ্গা দালান, রংচটা রাস্তা, আর চাপা ক্ষোভে ভরা চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, কে এসেছিল এখানে? সবাই বলে হারিকেন, তবু আমার কেন মনে হয় স্রষ্টা?

এখনও যাবার পথে বিখ্যাত সাউদার্ন সোয়াম্পল্যান্ডগুলোর উপর দিয়ে যেতে হয়। সাড়ে ছাব্বিশ মাইল প্রশস্ত লেক পঞ্চেট্রেইন পার হয়ে আসার সময় আজও মুগ্ধ হয়ে দেখি পুনর্নিমিত কজওয়ের সৌন্দর্য। রাস্তার দুই ধারের উঁচু সবুজ গাছগুলো দেখে একই রকম শান্ত হয়ে যায় মন। বিলক্সির উপর দিয়ে আসার সময় শিপ আইল্যান্ডের কথা মনে করে লোম খাড়া হয়ে যায় সব সময়ের মত। মোবিলে কনক্রিটের চাকচিক্য দেখে শহুরে সভ্যদের মত যথারীতি প্রণোদিত হই রাতারাতি ভাগ্যান্বেষণের নামে ক্যাসিনোয় ভাগ্যনিধন করতে।

পকেটে যার কিছু আছে, জগতে তার সবই আছে। যার কিছু নেই, তার নাকি ইশ্বর আছে। সেই ইশ্বরই কি এসেছিল হারিকেনের রূপ ধরে?

লুইজিয়ানাকে দেওয়া হয়েছিল ঈর্ষনীয় ভৌগোলিক অবস্থান। উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর নিউ অর্লিয়েন্স থেকে মিসিসিপি নদীতে দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাবতীয় শস্য ও পণ্য আদান-প্রদান হত। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই নদী যে স্রেফ মিসিসিপিকে শাসনের জন্য অর্ধেক আমেরিকা কিনে নেওয়া হয়েছিল ফ্রান্সের কাছ থেকে। পার্শ্বক্রিয়া হিসেবে লুইজিয়ানা পেয়েছিল হরেক সংস্কৃতির এক অমূল্য মিশ্রণ। কিছুকাল পরে বিপুল পরিমাণ তেলের সন্ধান পাওয়া যায় লুইজিয়ানার মাটির নিচে। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আর সুফলা জমিও ছিল। সত্যিকার উন্নয়নের পেছনে বিনিয়োগ না করে সবাই মেতে উঠলো টাকা মেরে দেওয়া আর ক্যাসিনো তৈরির উৎসবে।

বিলক্সি তেল পায়নি। তবে অনেক রিফাইনারি পেয়েছে। তার চেয়েও বেশি পেয়েছে সংগ্রামের ঐতিহ্য। বিলক্সির একটু দূরে মিসিসিপি শিপ আইল্যান্ড বলে একটি ছোট্ট দ্বীপ আছে। আফ্রিকা থেকে দাসবাহী জাহাজগুলো এখানে ভিড়তো। ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকাকালীন বিশাল একটি দুর্গ গড়ে তোলা হয় এখানে। তরতাজা দাসদের এখান থেকেই চালান দেওয়া হত আমেরিকার বিভিন্ন কোণায়। সেই দুর্গ ও দ্বীপ টিকে আছে সভ্যতার উৎকর্ষ ও শুভশক্তির ঝাণ্ডা হয়ে। আজ বিলক্সি মানে সভ্যতা নয়, শুধুই সৈকত ও ক্যাসিনো।

মোবিলও ভরে আছে রিফাইনারিতে। এক কালে এখানে অনেক যুদ্ধজাহাজ ভিড়তো। আজকে শুধু খোলস আছে কিছু। এখানেও ক্যাসিনো আর হোটেলের ছড়াছড়ি। অনেক ভেবেও কিছু পাওয়া যায় না আর মোবিলকে নিয়ে বলবার মত। এই তিনটি শহর একই সাথে ভুগেছে ক্ষমতাবানদের উপেক্ষায়। ক্যাটরিনা সেজে স্রষ্টা কি বঞ্চিতের ক্ষতগুলোই উন্মোচন করে গেলো?

(চলবে)


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এক রোডট্রিপ শেষ না হতেই আরেকটা শুরু হয়ে গেছে। চেষ্টা করবো যেটুকু পারি লিখতে। ভাল লাগলো সচলের লেখাগুলোয় চোখ বুলিয়ে। মডুদের ধন্যবাদ নতুন ফিচারগুলোর জন্য।

সৌরভ এর ছবি

চলুক তাহলে।
পড়লাম।

------ooo0------
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

আমরাও চলছি হাসি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

অমিত এর ছবি

লুইজিয়ানা, মিসিসিপি আর অ্যালাবামার উপর I-10 ধরে যাওয়াটা ছিল খুবই ডিপ্রেসিং। তবে সোয়্যাম্পল্যান্ডের উপর দিয়ে যাওয়াটা ছিল অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা।
_____ ____________________
suspended animation...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সহমত। ধন্যবাদ।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

ফাটাফাটি লাগছে ... আরও লেখ ...

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

সাথেই ভ্রমণ করছি।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সিরাত এর ছবি

হ্যাঁ, আমারও বেশ ভাল লাগলো। চলুক

তিথীডোর এর ছবি

যার নিঃস্বতাকে নিজের দৈন্য ভেবে মাথার মুকুট করেছি, আমি যাকে কাছের বলে জেনেছি, তার কাছেও কাছের হবার আনন্দ। কতটা কাছের, সেটা বুঝতে পারার রোমাঞ্চ; অথচ একই সাথে সেই মুহূর্তটা বিচ্ছেদের হওয়ার কষ্ট, কাছে টেনে আনার পর আরো অনেকের মত আমিও তাকে ছেড়ে জৌলুসমুখী হওয়ার লজ্জা। এ যেন বাঁধতে শেখা, তবু বাঁধা না। মনের বন্ধনকামী অংশের জন্য অনেক যত্নে একটি বন্ধন তৈরি করা, শুধুই মুক্তিকামী অংশকে সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দ দিতে।

এই লাইনগুলো খুব মন টানল।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মরুদ্যান এর ছবি

এই পুরানো সচলেরা এখন আর ব্লগিংই করেন না! (ইশতিয়াক বাদে)

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।