গণতন্ত্রের সমাপ্তি কোথায়?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০৫/২০১৪ - ১১:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

বাংলাদেশে গণতন্ত্র এক কালে ছিলো হ্যালির ধূমকেতুর মতো। বহু বছর পর একবার দেখা যেতো। সামরিক জান্তা যেমন খুশি তেমন ভাবে একে গড়তেন, ভাঙতেন, কোলে রেখে খেলতেন। গত দুই দশকে সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গণতন্ত্র এখন ধূমকেতু থেকে লোকাল বাস হয়েছে। বিপুল আওয়াজে চলে, বিবিধ জটে আটকা থাকে, এবং কিছুদূর পরপর বিরতি নেয়।

আজকের যুগে সবাই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। হিসাববিজ্ঞানের লোক আইন নিয়ে বলছে, বটতলার উকিল বলছে প্রযুক্তি নিয়ে। যার কোনো বিশেষ যোগ্যতাই নাই, সে হয়ে উঠছে সংবিধান বিশেষজ্ঞ। অন্যদিকে প্রকৃত জ্ঞানী মানুষ বিনয় করে নিজেকে অজ্ঞ বললে গালি খাচ্ছেন মানসিক প্রতিবন্ধী হিসাবে। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই বস্তা বস্তা উপদেশ। সবার হাতেই আছে প্রফেসর শঙ্কুর সেই বিখ্যাত বটিকা ইন্ডিকা। সবাই বাতলে দিচ্ছেন কী সেই অব্যর্থ ওষুধ যা দিয়ে এক লহমায় বদলে যাবে সময়, কেটে যাবে আঁধার, প্রতিষ্ঠিত হবে স্বাধিকার ও গণতন্ত্র।

আমি নিতান্ত মূর্খ মানুষ, তাই গণতন্ত্রের পুষ্টিগুণ বা পথপরিক্রমা নিয়ে ধারণা কম। গাড়িতে কোন্‌ তেল ভরলে মাইলেজ বাড়বে কিংবা কোন্‌ পথে চললে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছবে তা নিয়ে জানার এবং বলার মানুষ অনেক। আমি শুধু ভাবি গাড়ি কেন কিছুদূর পরপর থেমে যায়। জানতে চাই গণতন্ত্রের সমাপ্তি কোথায়, যেই অধিকার এবং উপজীব্যের সমন্বয়ে গণতন্ত্রের প্রবর্তণ তার সীমারেখাগুলো কোথায়।

২.

রাষ্ট্র এবং সমাজ দুটি ভিন্ন বিষয় হলেও পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত। একটি আইনী নিয়মের নিগড়ে আটকা, অন্যটি নৈতিক নিয়মের প্রত্যাশায়। রাষ্ট্র নাগরিককে স্পষ্ট ভাবে বিরত রাখে কিছু কাজ থেকে, সমাজ মানুষকে প্রচ্ছন্ন ভাবে প্রভাবিত করে কিছু কাজ না করার ব্যাপারে। জীবন নামের রেলগাড়ি এই দুই লাইনের উপর দিয়েই চলে, তাই একটি লাইন পিছিয়ে পড়লে অন্যটিরও সুফল থেমে যায়। রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনায় যা-কিছু উঠে আসে, ভিন্ন নাম এবং আঙ্গিকে তার একটি রূপ তাই সমাজেও খুঁজে পাওয়া যায়।

গণতন্ত্র এবং সমঅধিকার একই ধারণা থেকে উৎসারিত তেমনই দুইটি বিষয়। ঠিক যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সমাজতন্ত্র ও সাম্যের ধারণাও একই আলোকে দেখা যায়। এই শব্দযুগলের প্রতিটিরই অভীষ্ট লক্ষ্য অনর্জিত থেকে যায় যেকোনো একটির অনুপস্থিতিতে।

যেই সমাজে প্রতিটি মানুষ সমান না, যেই সমাজে আমির-ফকির পাশাপাশি বসার অধিকার নাই, সমঅধিকারহীন সেই সমাজ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করলেও মূল্য লক্ষ্য অর্জিত হয় না। সংবিধান যতো উন্নতই হোক না কেন, তার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে ঠিকই সামাজিক অনাচার চলতে থাকে। এর অন্যতম উদাহরণ আমেরিকার সংবিধান, সমাজ, ও গণতন্ত্র।

আমেরিকার সংবিধান বেশ অন্ধকার সময়ে লিখিত এক অসামান্য দলিল যাতে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো সুস্পষ্টভাবে লিখিত আছে। তবুও আমেরিকায় শত বছর ধরে দাসত্ব চলেছে, নারীদের ভোটাধিকার সীমিত রাখা হয়েছে, সাদা-কালোতে বিভেদ রাখা হয়েছে। স্বাধীনতার পর দুইশ’ বছর লেগেছে আমেরিকার সমাজ তার রাষ্ট্রের সমান আধুনিক হতে।

এর বিপরীত চিত্র সেই আমেরিকারই গণতন্ত্রে খুঁজে পাওয়া যায়। আমেরিকার গণতন্ত্রে সব মানুষের ভোট সমান না। প্রতি চার বছর অন্তর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এলে কেউ সরাসরি রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করেন না, বরং কিছু নির্বাচককে নির্বাচিত করেন, যারা পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। যেহেতু সমাজেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত, তাই এই অদ্ভুতুড়ে নিয়ম থাকার পরও কোনো সংকট দেখা যায় না।

৩.

রাষ্ট্র এবং সমাজ চিরকাল সমান্তরালে চলে না। আইনী বা নৈতিক বিবেচনায় চূড়ান্ত সংকটে পতিত হলে প্রায়ই এই দুইয়ের মধ্যে গুবলেট হয়ে যায়, কোনো একটি অন্যটির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। কাগজে-কলমে ব্যাপারটা অকল্পনীয় হলেও তার প্রভাব সব সময় মন্দ না। সতীদাহ প্রথার মতো অন্যায্য আচরণ বন্ধে সমাজ যত না সোচ্চার ছিলো, তার চেয়ে রাষ্ট্র সচেষ্ট ছিলো বেশি। সমাজ আলোকিত হয়ে এরকম প্রথাকে রহিত করেনি, বরং ঔপনিবেশিক শাসকরা জোর করে এটি বন্ধ করেন।

তাই বলে সমঅধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও সকল অধিকার স্বীকৃত না। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, এবং সম্মতিক্রমেই কিছু বিষয় গণতান্ত্রিক চর্চার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। কিছু চিন্তা, কিছু আবেগ, কিছু ইচ্ছা, কিছু চাওয়া আছে যেগুলো জনমত পক্ষে থাকলেও অগ্রহণযোগ্য। এর মূলে আছে হাজার বছরের অর্জিত উপলব্ধি। যেই পশ্চিমা গণতন্ত্র আমরা অনুসরণ করি, তা আকাশ থেকে আসেনি। অনেক প্রজন্মের ত্যাগ এবং দুর্ভোগের উপর দাঁড়িয়ে আছে এর বর্তমান কাঠামো। প্রতিটি রাষ্ট্রই ইতিহাসের রাস্তায় পিছু হটার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে।

স্বাভাবিক অবস্থায় গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন-সাপেক্ষে যেকোনো কিছু করবার অধিকার। যত বেশি গণতন্ত্র, তত বেশি অধিকার। আজ যেমন খুশি কাপড় পরার অধিকার, কাল যে খুশি বলার অধিকার, পরশু যেখানে খুশি যাওয়ার অধিকার। এই ক্রমবর্ধমান অধিকারবোধের সাথে পরিচিত হওয়া এবং অন্যের অধিকারকে দ্বিমত পোষণ করলেও মেনে নেওয়াটুকু গণতন্ত্রের মূল দ্বন্দ্ব। গণতন্ত্রে প্রতিদিনই মানুষ নতুন কোনো অধিকারের সাথে পরিচিত হচ্ছে, ব্যাক্তিগত স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে নতুন কোনো দুয়ার খুলছে। অগ্রহণযোগ্য বিষয়গুলোকে অনেকেই যেকোনো দরজার খুলবার এই ‘অধিকার’-এ বাধা দেওয়া ভেবে ভুল করেন। যারা এই ভুল করেন, তারা ধারণা করেন গণতন্ত্র মানে শুধুই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। তারা ভুলে যান যে গণতন্ত্র মানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান চোখে দেখা, সমান অধিকার দেওয়া, সমান সম্মান দেওয়া। শাসনপদ্ধতি এখানে উপলক্ষ মাত্র। এই কারণেই কোনো প্রকার ‘গণতন্ত্র’ মানুষে মানুষে বিভেদের অনুমতি দেয় না। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, শিক্ষা, বিত্ত, লিঙ্গ, কিংবা অন্য যেকোনো কিছুর কারণে অসম আচরণ গণতন্ত্রে অনুমোদিত না।

৪.

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গণতন্ত্রের সংকট নিয়ে আলাপচারিতা প্রত্যক্ষ করে ঘুরে-ফিরে তাই একটাই কথা মাথায় আসে -- আমরা কেন গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল নিয়ে আলাপ না করে রঙ-রূপ-ঢং নিয়ে এত আলাপ করছি? গণতন্ত্র কীভাবে আকাশ ছুঁবে সেটা বিবেচনার আগে কি গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা জানা প্রয়োজন না? হাজার বছর টিকে থাকার মতো গণতন্ত্র হতে হলে তো তাকে পিরামিড আকৃতির হতে হবে, তাহলে কেন আমরা লাটিমের মতো টপ-হেভি গণতন্ত্র নিয়ে এত আলাপ করছি?

পৃথিবীর প্রতিটি গণতন্ত্রের ভিত্তিমূলে আছে সমঅধিকারের ভিত্তিতে গঠিত একটি সমাজ। সেরকম একটি সমাজ গড়ার লক্ষ্য থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। অনেকেই গড় করে বলে দেন, গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। তাই কি? স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কোন্‌ শ্লোগান ধ্বনিত হয়েছিলো? “অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারলে যা খুশি করার অধিকার চাই”, নাকি “অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই”?

এই যে শোষণমুক্তির কামনা, বাঁচার মতো বাঁচতে চাওয়া, এটাই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেটা গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, না সমাজতন্ত্রের হাত ধরে আসছে তা গৌণ। কারণ এখানে সমাজের একটি ঐক্যবদ্ধ চাওয়াকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রের কাঠামো দেওয়া হয়েছে। বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছে, কারণ তাদের মানুষ হিসাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর মনে করা হতো, তাদের সাব-হিউম্যান বলে বিবেচনা করা হতো। নির্বাচনে জয়ী হয়েও ক্ষমতা না পাওয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, বেশি দামে চাল-পাট-রুটি-কাগজ কিনতে হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। বাঙালি তার স্বাধিকারের আন্দোলন করেছে কারণ মানুষ হিসাবে পাকিস্তানিদের চোখে তার সমঅধিকার ছিলো না। অথচ কালের পরিক্রমায় এই ‘চৌধুরী সাহেব সিনড্রোম’ খুব হিসাব কষে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা মূল উদ্দেশ্য ভুলে উপলক্ষ নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত।

দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার ৪৩-তম বছরে এসেও আমরা পাকিস্তান আমলের কিছু ঘৃণ্য চিন্তা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা আজও অসাম্প্রদায়িক মুসলমানদের দূষিত মুসলমান মনে করি। আমরা আজও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিশেষত হিন্দুদের গণিমতের মাল মনে করি। সোজা ভাষায়, আমাদের সমাজে আজও অনেক মানুষ সাব-হিউম্যান। আমরা গণতন্ত্রের নামে হাজারও মাতম করে বাতাস ভারি করে ফেলি, কিন্তু এই মৌলিক ত্রুটির দিকে নজর দেই না। এই দোষ তো শুধু হাসিনা-খালেদা-এরশাদের না, এই দোষ আমাদের প্রত্যেকের। এটা তো আমাদের প্রত্যেকের দোষ যে আমরা গণতন্ত্রকে লোক ভুলিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং তদপরবর্তী সময়ে নিজের ইচ্ছা পূরণের সাঁকো হিসাবে দেখি। এটা আমাদের সবার দোষ যে আমরা হিন্দু দেখলেই ভারতীয় বলে খোটা দেই, মালাউন বলে গালি দেই, দাদা-দের দেশে কবে চলে যাচ্ছে সেই প্রশ্ন করি, তাদের দেশাত্মবোধ নিয়ে সন্দিহান হই।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূল সমস্যা হলো নির্বাচন না হওয়া। আইনত বৈধ হলেও ৫ই জানুয়ারি ২০১৪-র জাতীয় নির্বাচন অনেকের চোখেই প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের সেই অবস্থান যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, তা নয়। পদ্ধতিগত বিবেচনায় এটা গণতন্ত্রের বেশ বিব্রতকর উদাহরণ। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে কি আদৌ কোনো গুণগত পরিবর্তন এসেছে? অকপট সত্য লিখলে সবাই “দালাল” বলবে, কিন্তু প্রশ্ন করতেই হয় যে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের যেই রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কার্যকলাপ, তা গণতন্ত্রের ভিত্তিমূলে থাকা ধারণাগুলোর সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? মুদ্রার অপর পিঠে কিছুটা কম মাত্রায় হলেও আওয়ামী লীগও একই দোষে দুষ্ট।

প্রতিটি পক্ষই কোনো না কোনো বিবেচনায় সমাজের কিছু অংশকে সাব-হিউম্যান বিবেচনা করছেন। জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান নতুন কিছু না। পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত তারা অসাম্প্রদায়িক বাঙালিদের সাব-হিউম্যান বলে মনে করে। পথে পেলে রগ কেটে এবং ঘরে পেলে ধর্ষণ করে ধরাধাম কলঙ্কমুক্ত করে। হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা খোলামেলা ভাবেই ঘোষণা দিয়েছে যে এই ভূমিতে আল্লাহর আইনের বাইরে কেউ থাকতে পারবে না। আমাদের বেড়ে উঠার সময়টায় বিএনপি ছিলো আওয়ামী-বিরোধী, ডানপন্থী, ক্যারিশম্যাটিক, (অতীত উপেক্ষা করে) ভবিষ্যৎমনা মানুষের দল। তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপে ধর্মের লেবাস ছিলো, ধর্মকে ব্যবহার করার প্রবণতা ছিলো, কিন্তু তারা ব্যাক্তিজীবনে তেমন একটা ধার্মিক ছিলো না এবং দল হিসাবে এত খোলামেলা ভাবে সাম্প্রদায়িক ছিলো না। ২০০১ থেকে ক্রমঅবনতির ধারা অনুসরণ করে আজকে তারা ঘৃণ্য রকম সাম্প্রদায়িক এবং সুবুদ্ধিরহিত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে।

প্রতিপক্ষকে বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করা বা তাকে আপত্তিকর কিছু হিসাবে দেখানো খুবই পুরনো এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক অপকৌশল। কিন্তু তাই বলে যাকে-তাকে ‘নাস্তিক’ বলে আখ্যা দেওয়া, কথিত নাস্তিকতার অভিযোগে কাউকে খুন করে ফেলার সমর্থন দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও নির্যাতিতদের কটাক্ষ করা, বা মানবতার ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধীদের রক্ষার্থে দেশ ও নীতি বিসর্জন দেওয়া কোনো রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য না। অথচ এই “বৃহত্তর জামায়াতে ইসলামী” বলে অভিহিত রাজনৈতিক অক্ষ এই অগ্রহণযোগ্য আচরণের প্রতিটির দোষে দুষ্ট।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ “চেতনা” বিবেচনায় এই অবস্থানগুলো থেকে এগিয়ে, কিন্তু তাই বলে তাদের অবস্থানও নির্দোষ নয়। ধর্মীয় উন্মাদনায় মত্ত জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার বদলে আওয়ামী লীগ সেই ভাষাতেই কথা বলছে, পাঠ্যপুস্তক “সংশোধন” থেকে খাস জমি দিয়ে দেওয়া পর্যন্ত যাবতীয় দাবি মেনে নিচ্ছে, খোলামেলা ভাবে দাবি করছে যে “মদিনা সনদ” অনুযায়ী রাষ্ট্র চালিত হচ্ছে। অন্যান্য দিকে সঠিক অবস্থানে থাকলেও তারা ঘোষণা দিয়ে সমকামীদের সাব-হিউম্যান করে রেখেছে। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের মতো এদের মেরে ফেলা বা দেশান্তরের কথা না বললেও যেকোনো প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার কথা প্রায়ই শোনা যায়। তাদের শাসনামলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্বিচার নির্যাতন হয়েছে। সাথে আছে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে বাদবাকি মুসলিম বিশ্বের সাথে মিশে জাত্যভিমান।

৫.

এ-কারণেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সংকট নির্বাচনে নয়, সমঅধিকারের অভাবে। এই দেশে আজও বিনা বিচারে স্কুলছাত্রকে জেলবন্দী করে রাখা যায় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের খুশি রাখতে। এই দেশে আজও স্রেফ গুজব রটিয়ে হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া যায়। এই দেশে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিন মাসে তিন হাজার হিন্দু খুন হন। এই দেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার দায়ে হিন্দুদের হত্যা-নির্যাতন করা হয়। এই দেশে নারী সাংবাদিক পিটিয়ে, কর্মজীবি নারীদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে, এবং নাস্তিক নিধনের ডাক দিয়ে হেফাজতে ইসলাম পুরষ্কৃত হয় রেলওয়ের খাস জমি পেয়ে। এই দেশে বিএনপি-পন্থী শিক্ষিত লোকজন কেঁদে দুকূল ভাসিয়ে দেয় সাম্প্রদায়িক উষ্কানি দেওয়া মাহমুদুর রহমানদের জন্য। এই দেশে সুশীল সমাজ সকাল-বিকাল তেল-গ্যাস-বন-বাতাসের জন্য কাঁদলেও হিন্দু নির্যাতনের সময় নিরব।

এমনটা যেখানে অবস্থা, সেই সমাজ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত না। এই রকম ধ্যান-ধারণা গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না। পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই ধরনের চিন্তা-ধারার বিস্তার রোধে সচেষ্ট, কারণ এখানেই গণতন্ত্রের সমাপ্তি হয়। আমেরিকায় নারীদের কোনো ভাবে নিগড়বন্দী করার পক্ষে কথা বললে সেই ব্যাক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সেখানেই সমাপ্তি হয়। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে মিথ্যাচার করলে কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং ইহুদিবাদের (বা অন্য যেকোনো ধর্মের) বিরুদ্ধে জাত্যভিমানী কথা বললে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এলেও ক্ষমতাচ্যূত করা হয়। এমনকি মিশরের মতো দেশেও মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার কারণে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতাচ্যূত হয়েছে, সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে।

গত নির্বাচনের আগে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন আলোচনায় এই দিকগুলো উঠে এসেছে। অনেকেই বলেছেন যে নির্বাচনের ফলাফলের চেয়ে গণতন্ত্রের মান উন্নয়ন জরুরী। কিন্তু এই পর্যায়ের পর প্রতিটি আলোচনাই মোড় নিয়েছে নিজ পছন্দের দলের প্রতি সুবিধাজনক অবস্থানের দিকে। কেউ এই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন যে নির্বাচন স্থগিত হওয়া উচিত। এই সিদ্ধান্তের সাব-টেক্সট ছিলো আওয়ামী লীগ বাদে অন্য কারও হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া, বিদেশি শক্তিকে ডেকে আনা, প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। অন্য পক্ষের উপসংহার ছিলো, নিজেদের অবস্থান সংশোধনের আগ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটকে কোনো প্রকার ছাড় না দেওয়া। এই সিদ্ধান্তের সাব-টেক্সট ছিলো যেকোনো মূল্যে প্রতিপক্ষকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা।

সমাজে যদি সমঅধিকার না থাকে, তাহলে কি এই সমস্যার কোনো পদ্ধতিগত সমাধান আদৌ সম্ভব? গণতন্ত্রকে যা-খুশি-তাই করার অধিকার হিসাবে না দেখে তার সীমারেখাগুলো স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন নয় কি? ধর্ম বা বর্ণের কারণে কোনো মানুষকে সাব-হিউম্যান বলে গণ্য করা গণতন্ত্রে কঠোরতম ভাবে নিষিদ্ধ। ব্যাক্তিজীবনে কেউ চাইলে নারী, ভিনদেশি, বা ভিন্নধর্মীদের অপছন্দ করতেই পারে, কিন্তু তাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠার সব রকম চেষ্টা নিষিদ্ধ থাকা উচিত। এই বোধ, এই সমতা যেই সমাজ ও সংবিধানে নেই, সেই রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু মাত্রই সাব-হিউম্যান। সেই সমাজে গণতন্ত্র মানে তো শুধুই দলবাজি ও ক্ষমতার খেলা।

গণতন্ত্র রক্ষার জন্য হাসিনা-খালেদাকে ‘মাইনাস’ করে দেওয়া কারও প্রিয় পদক্ষেপ। গণতন্ত্র রহিত করে দেওয়া এই দশকে মার্কিনপন্থীদের প্রিয় পদক্ষেপ। যেকোনো ভাবে আওয়ামী লীগকে গদিচ্যূত করা বাকিদের পছন্দের পদক্ষেপ। এর কোনোটা কি সমঅধিকারের সমস্যার সমাধান করবে?

গণতন্ত্র স্থগিত করা তাই কোনো সমাধান না, বরং পশ্চাৎপদ সমাজের ভ্রূকূটি উপেক্ষা করে হলেও সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যারা এই ধরনের মতবাদ প্রচার করে আসছে সেই উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠিকে নিষিদ্ধ করতে হবে, সাম্প্রদায়িকতার জন্য রাখতে হবে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান। যার মার্কা যেটাই হোক, সব মানুষকে সমান সম্মান না দিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করা যাবে না। কেউ চাইলে আমেরিকাপন্থী, ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, বা সৌদীপন্থী রাজনীতি করতেই পারেন। সেটা গণতন্ত্রে যার যার অধিকার। কিন্তু কোনো দেশ, নীতি, ধর্ম, বা চেতনার অজুহাতে মানুষকে সাব-হিউম্যান বলে গণ্য করা নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র বেঁচে আছে না মরে গেছে, তা বুঝতে নির্বাচনের বুথে যেতে হবে না, টকশো-তে ঝড় তুলতে হবে না, ফেসবুকে কান্নাকাঁটি করতে হবে না। যেতে হবে চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গের মতো জামায়াত-অধ্যুষিত এলাকায়, যেতে হবে স্থলবন্দরে, যেতে হবে হবে সীমান্তবর্তী এলাকায়। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেল কি না, তা নিয়ে উতলা না হয়ে দু-দণ্ড সময় কাটাতে হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাথে। জানতে হবে উগ্র ধর্মান্ধদের রোষের কারণে কতটা শান্তিতে আছেন তারা। জানতে হবে নিজের দেশে কতটা নিশ্চিন্ত তাদের জীবন। জানতে হবে তারা নিজ দেশ থেকে পালানোর পথ খুঁজছেন কি না। জানতে হবে কেউ তাদের সাব-হিউম্যান বলে গণ্য করছে কি না।

কারণ সেখানেই গণতন্ত্রের সমাপ্তি।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু

একেবারে শিকড় খুঁজে নির্মোহ বিশ্লেষন বোধহয় একেই বলে। কিন্তু আপনার এত লম্বা বিরতি দিয়ে লেখা কি ঠিক? যদি ও আপনি লেখেন কম, তারপরও সচলে যাদের লেখা খুব মিস করি তাদের মাঝে আপনি একজন।

মাসুদ সজীব

স্যাম এর ছবি

চলুক চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

বরাবরের মতই ইশতিয়াক রউফিয় বিশ্লেষন। শুধু এই কারণেই আপনার এত বিরতি দিয়ে লেখা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায়। আপনি যত খুশি বিরতি নিন। শুধু এভাবে আমাদেরকে পুষিয়ে দিলেই চলবে।

----ইমরান ওয়াহিদ

Fallen Leaf এর ছবি

"কেউ চাইলে আমেরিকাপন্থী, ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, বা সৌদীপন্থী রাজনীতি করতেই পারেন।"

চীন পন্থী, রাশিয়া পন্থী, মাও পন্থী, মার্ক্স পন্থী, বিপ্লব পন্থী, রবিন হুড পন্থী আরো কতকি আছে বাংলাদেশে!!! চোখ টিপি

অতিথি লেখক এর ছবি

আরো দুই পন্থী ইদানিং বেশ চলছে, ভুঁইফোঁড়পন্থী এবং একমেবাদ্বিতীয়মপন্থী

----ইমরান ওয়াহিদ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখাও নেই দীর্ঘ সময় ধরে? রাজনীতি নিয়ে লেখায় আপনাদের কে সচলের পাঠকরা মিস করে।

মাসুদ সজীব

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

বামপন্থীদের হিসাব করতে গেলে আমার আরও দুইটা মাথা লাগবে। আমি তো ঠাট্টা করে বলি যে বামাত-দের বিভিন্ন রকম চিন্তাধারা এবং পল্টিবাজির ম্যাপিং করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই কোয়াড কোর প্রসেসর তৈরি করতে হয়েছে। নয়তো সিঙ্গেল কোর দিয়েই চলতো আরো কিছুদিন।

শব্দ পথিক এর ছবি

আমরা আজও অসাম্প্রদায়িক মুসলমানদের দূষিত মুসলমান মনে করি।

এই ব্যাপারটা ধীরে ধীরে প্রলয়ঙ্করী রূপ নিচ্ছে, ২৫ বছর আগেও ধর্ম নিয়ে হয়তো এতো উন্মাদনা ছিলোনা।

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সেটাই ... এই সমস্যার সমাধান কোথায়, জানি না। হয়তো বাড়তে বাড়তে আরও বিশ্রী অবস্থায় যাওয়ার পর মানুষের হুঁশ হবে।

এক লহমা এর ছবি

খুব ভাল লাগল ইশতিয়াক। ৫ তারা অবশ্যই।
আপনার এই লেখা সমস্ত স্কুলে অবশ্যপাঠ্য প্রবন্ধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

বর্তমান গণতন্ত্রের সঙ্গে লোকাল বাসের তুলনাটা মজারু হয়েছে। লেখা বরাবরের মতই উপাদেয়।

গোঁসাইবাবু

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক খুব ভাল লাগল!

-আনন্দময়ী মজুমদার

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

যুক্তিগ্রাহ্য তথ্যসম্বৃদ্ধ লেখা। চলুক

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বাংলাদেশের গনতন্ত্রের বড় সমস্যা হলো এটা স্থান কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় দেখা দেয়। ঢাকায় সে গনতন্ত্র সাতক্ষীরায় সে গনতন্ত্র নেই। চট্টগ্রাম শহরে একরকমের গনতন্ত্র আবার ফটিকছড়ি বা সাতকানিয়ায় অন্যরকম। শাসনতন্ত্র এক হলেও স্থানীয় সরকারের শক্তি সামর্থ্যে সুষমতা নেই। ফলে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সবখানে একইভাবে প্রয়োগ করা যায় না। তাছাড়া তাত্ত্বিক গণতন্ত্র আর প্রায়োগিক গণতন্ত্রের মধ্যে যোজন যোজন ব্যবধান আদিকাল থেকেই রয়ে গেছে এদেশে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র শক্তিমানদেরই হাতিয়ার হয়ে থাকে। বর্তমান যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে আগামী দশ বিশ বছরেও এর কোন পরিবর্তন আশা করা যায় না যতই সুষ্ঠু নির্বাচন হোক না কেন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

তাত্ত্বিক গণতন্ত্র আর প্রায়োগিক গণতন্ত্রের মধ্যে যোজন যোজন ব্যবধান আদিকাল থেকেই রয়ে গেছে এদেশে

ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

রাজনীতির এই তাত্ত্বিক আর প্রায়োগিকের যোজন যোজন ব্যবধান শুধু এদেশে বা শুধু গণতন্ত্রে না, সবখানেই রয়ে গেছে। কম্যুনিজম এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মন মাঝি এর ছবি

আইন তো অনেক আছে, নতুন করে শুধু আইন করে কোন লাভ হবে না। আসল কথা হল আইন যথাযথ ভাবে, বৈষম্যহীণ এবং ব্যতিক্রমহীণ ভাবে সর্বক্ষেত্রে ও সবসময় প্রয়োগ করতে হবে। সেই ব্যবস্থাটাই আগে করতে হবে। নচেৎ কাজীর গরু গোয়ালে না থেকে কেতাবেই থাকবে শুধু। যেমন এখন আছে, ছিল সবসময়। কিন্তু এটা কে করবে? এটা করার মত মানুষ, দল, প্রতিষ্ঠান কোথায় বাংলাদেশে? কোনদিনই কি ছিল, কিম্বা অদূর ভবিষ্যতে এমনটা হওয়ার কোন সুদূরতম সম্ভাবনাও কি আছে?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, যদি না থাকে (বিদ্যমান অকথ্য দ্বিমেরু মাফিয়াতন্ত্রের অন্ধচক্রের কথা বলে লাভ নেই) - তাহলে কেন নেই? এটা না হলে তো আপনার 'সম-অধিকারতত্ত্ব' বা মানুষের বিমানবিকীকরণ-প্রতিরোধ বাস্তবায়ন করা যাবে না! আপনি যদি আশা করেন, বিদ্যমান তামসিক দ্বি-বা-ত্রিমেরু মাফিয়াতন্ত্রের কোন এক মেরু দিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা যাবে, তাহলে শুধু বলবো - ধন্য আশা কুহকিণী! ০১৪ সালে এই পোস্টটা আপনাকে আবারও দিতে হবে, আর আমার কাছ থেকেও এই একই কমেন্ট পাবেন!! আপনি বা অন্য কেউ হয়তো বলবেন, তাহলে কাজটা আর কেউ করবে। কিন্তু আপনার মূল পোস্টের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট এবং আমরা সবাই সেটা জানিও - সমাজের সর্বাঙ্গেই পচন ধরে গেছে। প্রচণ্ডরকম আত্নকেন্দ্রিক আর ফ্র্যাগ্মেন্টেড হয়ে গেছি সবাই। নির্দ্বিধায় ও বিন্দুমাত্র পক্ষ-বিপক্ষ, ধর্ম-বর্ণ-মতপার্থক্য বা ব্যক্তিস্বার্থ-কোটারিস্বার্থ-শ্রেণীস্বার্থ বা অন্যকোন সংকীর্ণ রিজার্ভেশন ব্যাতিরেকেই প্রতিটি মানুষের মৌলিক ও পূর্ণ মনুষ্যত্ব, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা, সম-অধিকার ও সম-মর্যাদা স্বীকার ও তা সক্রিয়ভাবে সুরক্ষা বা ডিফেণ্ড/প্রোটেক্ট করার মত কাউকেই - কোন দল, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক ক্রিটিকাল মাস - কাউকেই আসলে দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকেই শুধুমাত্র নিজেকে বা নিজের একেবারে অব্যবহিত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা অন্ধত্বসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী ছাড়া বাকি সবাইকে কমবেশি বিমানবিকায়িত করছি। কোনই কমন প্ল্যাটফর্ম বা এভিনিউ এখন আমাদের অবশিষ্ট নেই বললেই চলে (বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে), যেখানে সবার আগে আমরা সবাই সমানভাবে পূর্ণ মানুষ, তারপরে আর কিছু।

সুতরাং, প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো (কে করবে) - কেউ নাই! আইন যাই থাকুক না কেন, সেই আইনের বইকে সিঁড়ি বানিয়ে কোন শেরপার সহযোগিতা ছাড়াই হিমাল্যের চূঁড়ায় বা এভারেস্টে উঠে যেতে পারলেও, সেই আইনের যথাযথ, সর্বজনীন, ব্যতিক্রমহীণ ও বৈষম্যহীণ প্রয়োগ করার ইচ্ছা ও শক্তিসম্পন্ন কোন ক্রিটিকাল মাস, বা কোন ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে নাই বর্তমান সময়ে।

দ্বিতীয় প্রশ্নের (কেন নাই?) উত্তর - আমার জানা নাই! তবে যেকোন সমাধানের জন্য এটাই সবচেয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অনেক বিশাল-বিশাল মাথাওয়ালা পণ্ডিতপ্রবররা এটা নিয়ে নিরন্তর মাথা ঘামিয়ে চলেছেন - আমি আর কি বলবো। আপনি বরং একটা ট্রাই দিয়ে দেখতে পারেন। আমি হয়তো সাধারণ বোধবুদ্ধি থেকে এটুকু বলতে পারি - এই অবস্থা এই দেশের বা অন্তত বর্তমানের মানুষের সীমাহীণ লোভ, অন্ধ-স্বার্থসর্বস্বতা, চরম আত্নবিশ্বাস ও আত্নমর্যাদাবোধ-হীণতা, প্রচণ্ড হীণমন্যতা, ডিফিটিজম এবং এম্প্যাথিক্ষমতা-হীণতার ফসল। সেইসাথে সম্ভবত আমাদের জাতিগঠন-প্রক্রিয়ায় কোথাও একটা বিরাট খামতিও রয়ে গেছে, যার ফলে আমরা কোন কমনগ্রাউণ্ডে সংহত হতে পারছি না। ঘুরে-ফিরে এটা আবার সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক-অর্থনৈতিক কারন, যার ব্যপকভিত্তিক সমাধান না হলে আইন করে কোন সমাধান দূরে থাকুক - সেই আইন প্রয়োগ করার ইচ্ছা ও শক্তিসম্পন্ন কোন গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা ক্রিটিকাল মাসও পাওয়া যাবে না। অথচ অন্যান্য উপকরণের পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ ছাড়াও এইরকম মানসিকতার পরিবর্তন বা বিচ্যুতি প্রতিরোধ করা কঠিন। একেবারে catch–22 অবস্থা। আমি কোন আশা দেখছি না।

****************************************

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গণতন্ত্রের সবচেয়ে সুবিধা হলো বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর শাখা ইউনিট সারাদেশের আনাচে কানাচে অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে। ধরেন কোনো এক কানাগলি, যে গলিতে দশটা ফ্যামিলি থাকে মাত্র, যেখানে কিছু হইলে পুলিশের হাজির হইতে মিনিমাম তিন ঘন্টা লাগে, সেই গলিতেও ছাত্রলীগ/ছাত্রদলের একটা ইউনিট কমিটি আছে। দল বিপদে পড়লে এরা ঐ গলিতেও একটা মিছিল করে। সারাদেশে এই নেটওয়ার্কটার কারনেই লীগ/দলরে এদেশ থেকে মাইনাস করা সম্ভব না। ১/১১র পর তো কম চেষ্টা হয়নি।

আবার এই সুবিধাটাই দলগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় অসুবিধা। কারন এই যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইউনিট কমিটির সদস্য... দলীয় রাজনীতি করার তারও একটা উদ্দেশ্য আছে। চেতনা, দেশপ্রেম ইত্যাদির পাশাপাশি কিছু দলীয় সুবিধাও সে আকাঙ্খা করে। দল ক্ষমতায় গেলে নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবে।
হয়তো কানাগলির একমাত্র পান বিড়ির দোকান থেকে দৈনিক ৫টা সিগারেটই মাগনা খায়, তবু খায় পাওয়ার শো করতে। আর ঐ দোকানদার কিন্তু তখন মনে মনে এরে গালি দেয় না, গালি দেয় দলরে... দলের শীর্ষ নেতারে... দলের ক্ষমতারে...

সাংগঠনিক ভিত্তি টিকিয়ে রাখতে তাই দলগুলোকে দেশের সবগুলো সেক্টরে 'নিজেদের লোক' রাখতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশাসন, শ্রমিক থেকে ব্যাবসায়ী, আইনজীবী থেকে বুদ্ধিজীবী... সবখানে।
দল বিপদে পড়লে প্রতিটি সেক্টরে তাই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। অথবা প্রতিটি সেক্টরেই লোকজন প্রশাসনিক 'বিশেষ সুবিধা' পেতে নিজেকে দলীয় এজেন্ট হিসেবে দেখতে ভালোবাসে।
ফলে সবগুলো সেক্টর কলুষিত হতে হতে এখন শেষ পর্যায়ে।
আর সবক্ষেত্রে এই দলীয়করন হয়ে গেলে জনগনের সমঅধিকারের দিকে গণতন্ত্র আর নজর দেবে না। উল্টোটাই ঘটবে। স্বাভাবিক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

এক লহমা এর ছবি

যথার্থ চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

"স্বাভাবিক" ... শেষটা কষ্টদায়ক বাস্তবতা। মন খারাপ

সাফি এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।