রাজহাঁসের মায়া

নীল রোদ্দুর এর ছবি
লিখেছেন নীল রোদ্দুর [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৬/১১/২০১০ - ১০:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঠিক আর দশটা দুপুরের মত, সেই দুপুরেও ছোট্ট অরণ্য বসে ছিল পুকুর পাড়ে, বাঁশের ধাপে বসে, জলের মাঝে পা চুবিয়ে, মনের আনন্দে জলকেলিতে মেতেছিল তার ছোট্ট দুখানি পা। শৈশবের কমনীয়তা তুলেছিল ঢেউ জলের মুকুরে। তার তুষার ধবল রাজহাঁসের বাচ্চাটা খেলে বেড়াচ্ছিল পুকুরের এ মাথা থেকে ও মাথা, তুলে জলতরঙ্গের মূর্ছনা... কি শান্ত মধুর এক ছবি। এই ছবিটা রোজ দেখা যায় ময়ূরকণ্ঠ গাঁয়ে। এই গাঁয়েই অরণ্যের কৃষক বাবা মায়ের অদিবাস। একটা মেটে ঘরের মধ্যিখানে, রোজ রাত্তিরে চাঁদের আলো বাসা বাঁধে, আকাশের চাঁদে অমাবস্যা থাকে, কিন্তু অরণ্যদের সেই কূটিরে পড়ে না তার ছায়াটুকুও। বাবা মা আছে মহা সুখে, তাদের চাঁদের টুকরো বুকে জড়িয়ে।

 

ভোর বেলা অরণ্যের ঘুম ভাঙ্গে পোষা পায়রা ঝাপটানিতে। সাথে পাল্লা দিয়ে জানালায় ডাকে চড়ুই পাখিরা। কে যেন তাদের ব্যস্ত করে রাখে পাখির কিচির মিচিরে অরণ্যের ঘুম ভাঙ্গাবার মেলাতে। সকালবেলা, ঘুম ভেঙ্গে জড়িয়ে ধরে বাবার গলা। মায়ের মিষ্টি চুমে ঝলকায় অরণ্যের চোখদুখানি। মাটির চুলোয় খড়ির আগুনে চলে মায়ের রান্না। সেবেলায় আগুনের আভায় রাঙ্গা হয়ে ওঠে অরণ্যের মা সখির মুকটুকুনি। তারপর বাবা চলে যায় চাষের মাঠে। আর অরণ্য ছোটে তার রাজহাঁসের বাচ্চাটা নিয়ে... জঙ্গলে বনেবাঁদাড়ে চলে তার নিত্য খেলা। দুপুরে সূর্যিমামা অরণ্যকে চোখ রাঙ্গালে, সে সারা গায়ে ধুলো কাঁদা মেখে ফেরে বাড়ি। মায়ের কপট রাগের বকুনি খেতে খেতে সেরে নেয় স্নান। তারপর কখন যেন, ছায়াঘেরা শান্ত কুটিরে, অরণ্য ঢলে পড়ে নিদ্রাদেবীর কোলে... বাবার হৈচৈ এ সে ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন প্রায় বেলা গেছে ডুবে। সূর্য তখন লাজুক বধূর মত সর্বাঙ্গে রক্তজবার ছোঁয়া মেখে চলে গেছে সবার চোখের আড়ালে। আকাশে একটি দুটি করে তারা ফুঁটে। অরণ্যের বাবার হাতের বাঁশি সুর তোলে সন্ধ্যারাতের বাতাসে। বাবার কোলে মুগ্ধ হয়ে অরণ্য সে গান শোনে। কানদুটো তার এমনি করে করেই গান শিখে ফেলেছে। বাবার বাঁশিতে এখন সেও ছোট ছোট ফুঁ দিতে শুরু করেছে। আর তাতেই খুশিতে বাদ্য হয়ে বাজে মায়ের হাসির ঝর্ণাধারা।

 

সেদিনও বাবার বাঁশি হাতে রাজহাঁসটা নিয়ে ছিল সে পুকুর পাড়ে বসে। বাঁশিতে দু’একটা ফুঁ দিয়েছে যেই, অমনি কোত্থেকে এক কুচবরণ কোকিল এসে বসল পুকুর পাড়ের পাকুর গাছে। অরণ্যের বাঁশি একটু থামলেই কোকিলটা সুর তোলে কুহু কুহু স্বরে। অরণ্য থামে, কোকিল গায়। অরণ্য গায়, কোকিল থামে... বেশ মজাতো! অরণ্য বাবাকে শোনায় কোকিলের কথা। পর দিন আবার ছুটে যায় হেথায়। কোকিল আসে। এমনি করে কাটে সেই পুরো বসন্তটা। তারপর আর আসে না। অরণ্যের মন খারাপ। বছর ঘুরে আবার বসন্ত এলে একদিন অরণ্যের মন খারাপের বেলা সাঙ্গ করে আবার কোকিলটা এসে বসে সেই পাকুড় গাছে। অরণ্য হাসে... সেইবার কোকিল আসে তার কোকিলনীকে সাথে নিয়ে। এইফাঁকে অরণ্য বেশ ভালো বাজাতে শিখে গেছে। সেই পুকুরে পাড়ে যেন এবার গানের মেলা বসেছে। মাঝে রাজহাঁসটা মন খারাপ করে থাকে আর জল তোলপাড় করে প্যাঁকপ্যাঁক করে। মন খারাপ সে গলায় প্যাঁকপ্যাঁকানি ছাড়া সুর বেরোয় না বলে। রাজহাঁসের চোখের জল মেশে পুকুরের জলে। অরণ্য কিন্তু বাড়ি ফেরে তার রাজহাঁসটাকেই কোলে নিয়ে।

 

একভোরে অরণ্য ঘুম ভেঙ্গে দেখে, নেই তার রাজহাঁসটা, নেই তো নেই, কোত্থাও নেই। অরণ্য জলে খোঁজে, মাঠে খোঁজে, বনে খোঁজে, হাটে খোঁজে... নেই কোত্থাও নেই। বুক ভাসে তার চোখের জলে, এত্তো মায়া তার রাজহাঁসে। কোথায় গেলো সে অরণ্যকে ছেড়ে! অরণ্য একা পুকুর পাড়ে বসে কাঁদে। পুকুরের জল এখন শান্ত, নেই তাতে জলতরঙ্গ। আজ নেই তাতে রোদের খেলা, আজ নেই সেথায় গানের মেলা। গাছের শাখে কোকিল জোড়া, তবু আজ অরণ্যের বাঁশি বাজে না। একটু একটু করে বেলা গড়ায়। তারপর হঠাৎ বিকেলের আলো সোনালি হয়ে উঠলে, কোকিল জোড়া নেমে আসে অরণ্যের ঠিক দুপাশে। রিনরিনিয়ে সুধায় তারে, মনের ব্যথা কিসের তরে? ধ্যান ভেঙ্গে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, কোকিলেরা কথা বলছে! কথা বলছে তারই বাঁশির সুরে! বুকের মধ্যে কে যেন ঢোল পেটাচ্ছে! সেই ঢোলের বাজনা কমলে, সে তার রাজহাসির কথা বলে। তার বুকের মানিক রাজহাসিটা চলে গেছে তাকে ফাঁকি দিয়ে। কষ্টে তার চোখে জোয়ার আসে। কোকিল দুটো উঠে পড়ে অরণ্যের কোলে। তাদের মাথা অরণ্যের ব্যথার জলে ভেজে। কোকিলেরা বলে, “আর কেঁদোনা অরণ্য সোনা! তোমার ব্যথায় রাজহাঁসের মায়া। পুকুরের জলের কণায় কণায় রাজহাঁসের ছায়া! ঐযে তোমার চোখের জলে ভিজল মোদের মাথা, আমরা হলেম তোমার ব্যথায় বাঁধা। যেদিন হবে এ ব্যাথার ছুটি, সেদিন তবে মোদের মুক্তি! আর কেঁদোনা অরণ্যমণি!” অরণ্যমণি.. কেঁদে কেঁদে ফেরে বাড়ি!

 

সেই ভোরে, অরণ্যর ঘুম ভাঙ্গে কোকিলের ডাকে। তাদের মেটে ঘরের জানালা ফোঁকরে বসে ডাকছে কোকিল। কোকিলনী বলে, বাইরে এসো অরণ্যসোনা, আজ আমরা যাবো তোমার রাজহাঁসের খোঁজে, তুমি যাবে কোকিলের পিঠে চেপে, আর আমি উড়ব সাথে সাথে! অরণ্য বেরিয়ে আসে চটপট, টুপ করে চেপে বসে কোকিলের দুডানার মধ্যিখানে। উড়ে চলে আর চলে, এগ্রাম থেকে ওগ্রামে, এদেশ থেকে ওদেশে, এই নদী থেকে সেই নদীতে, কত্ত কিছু দেখে সে, কি সুন্দর পৃথিবীতে সে বাস করে! কিন্তু তাতে কি তার মন ভরে? তার  চোখ আঁতিপাতি করে খুঁজছে তার শুভ্রধবল রাজহাঁসটাকে। যেতে যেতেই হঠাৎ চোখে পড়ে এক ঝলমলে জলাধার! তার মাঝে একখন্ড সাদা তুলোর মত রাজহাঁস! অরণ্য নামে সেই জলাধারের পাড়ে, ডাকে তার রাজহাঁসকে। রাজহাঁসও জলতরঙ্গ ছুটিয়ে চলে আসে জলের ধারে। অরণ্য দুহাত বাড়ায় তার রাজহাঁসর পানে, কিন্তু অবাক ব্যাপার সে কিছুতেই নাগাল পায়না হাসের ডানা! রাজহাঁসও তার দুহাতে দেয় না ধরা! কি করবে ভেবে না পেয়ে, সোনাযাদু বসে থাকে চুপটি করে, ম্লানমুখে! ঠিক তখনই জলের মাঝে কিসের যেন ঝড় ওঠে, ঝলমলে জলের ঝলকানিতে চোখ বুঝি যায় ঝলসে! অরণ্য দেখে, জলকুমারী উঠে এসেছে জলের গভীর হতে। দাঁড়িয়ে আছে তারই সামনে। এতো স্বচ্ছ জলের শরীর তার, তাতে আলো পড়ে হীরে ঠিকরানো আলোর মত চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে। সে মুখে জলের হাসি। সমস্ততায় যেন জলের ছন্দ! এমন সুন্দর তো সে কল্পনাও করতে পারে না। এ সে কোথায় এসে পড়েছে! বিশ্ব চরাচর ভাসছে জলে, সে নিজেও যেন ভেসে আছে আলোকিত জলের সমুদ্রে! কোকিল দুটো গায়েব। তার রাজহাঁস ডানা ঝাপটাচ্ছে জলকুমারীর পায়ের কাছে। তখন জলকুমারী বলে ওঠে, তুমি এসেছো তোমার রাজহাঁসের খোঁজে, কিন্তু সে তো হারিয়ে গেছে তোমার কাছ থেকে! ও এখন আমাদের। অরণ্যমণির চোখে জল আসে, সুধায় সে, তোমরা কারা? জলকুমারী উত্তর দেয়, আমরা সুন্দর! যে সুন্দর লুকিয়ে থাকে ভালোবাসার বুকের মাঝে! কবিতার পরতে পরতে, সবুজ পাতায় রোদের যে ঝলকানি দেখে তোমরা মুগ্ধ হয়ে যাও, তারও গভীরে! যে গানে তোমরা সুর দাও, তারই অন্তর সুধার মাঝে! ময়ূরকন্ঠ গাঁয়ে তোমাদের বাড়িতে যে সুখ ভাসে, সেই সুখই হলেম আমরা, সেই সুখের স্বরূপ, এরই নাম সুন্দর! তুমি তোমার মাকে না বলে আজ চলে এসেছো, তোমার মায়ের চোখের জলের মাঝে যে ভালোবাসা আছে, সেই হলেম আমরা। তোমার রাজহাঁসের বুকের মাঝে ছিল সেই ভালোবাসা। গলায় তার সুর ছিলো না, তাই কোকিলের মত গাইতে পারেনি, তোমার বাঁশির সুরের ছন্দে সে বলতে পারেনি তোমার সাথে কথা। কিন্তু সেই ছিলো তোমার খেলার, তোমার হাসির, তোমার বাঁশির সবচেয়ে বড় অনুরাগী। সে তো তুমি বোঝনি। তার বুকের মাঝে অভিমানে ঝড় উঠেছিল, তুমি তার জলতরঙ্গের খেলা ভুলেছিলে বলে, তোমার বাঁশির সুরে সে সুর দিতে চেয়েছিল, পারেনি বলে। তাই অভিমানের বেলা সাঙ্গ করে সে চলে এসেছে আমাদের অসীম সুন্দর জগতে! দেখো, তার সুন্দর তোমায় আজ এখানে টেনে এনেছে!

 

অরণ্যের কাছে যাদুমন্ত্রের মত লাগে! সে বলে উঠে, আমার রাজহাঁস ফিরিয়ে দাও আমাকে। জলের হাসি হেসে বলে জলকুমারী, এখন নয় অরণ্যমণি। তুমি যেদিন বুঝবে তোমার রাজহাঁসের হৃদয়ের গান, সেদিন সে ফিরে যাবে। জলের মাঝে জল হয়ে যাও অরণ্য সোনা, কবিতার মাঝে কবিতা। বুকের মধ্যে দেখো তোমার মায়ের বুকের ভালোবাসা! হয়ো বাবার প্রানের ছায়া। বাঁশির সুরে তুলো তোমার মনের গান। তোমার গান, তোমার প্রান, তোমার জীবন যেদিন ভালোবাসার জীবন্ত স্বত্তা হয়ে উঠবে, সেদিন পাবে তুমি তোমার রাজহাঁস। নইলে...

-নইলে কি?

জলকুমারী বলে, তোমার মায়ের চোখে জল, তোমার বাবা পাগলের মত তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। রাজহাঁসের মত ওরাও হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে তোমার বাড়ির চড়ুইও। চিৎকার করে উঠে অরণ্যমণি, না! কাঁচের মত ভেঙ্গে যায় জলকুমারী আর রাজহাঁস। চমকে উঠে দেখে সে, সে আছে তাদের মায়া ভরা, ছন্দে গড়া ছোট্ট ঘরে। তার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গেছে বাবা-মা দুজনেরই। ভয়ে লুকায় মায়ের বুকের মাঝে, হুঁ হুঁ করে কাঁদে অরণ্যমণি। বাবা সুধায় ছেলেকে, “কি হয়ছে সোনা? স্বপ্ন দেইখা ডরাইছ? ডরের কিছু নাই, এইযে আমরা তোমার লগেই আছি”।

 

পরেরদিন সকাল থেকে আর আসে না সেই কোকিলদুটো, যারা রিনরিনিয়ে বাঁশির সুরে কথা বলত, বাঁশির সাথে সুর মিলিয়ে গায়তো। বাপে-ছেলেতে গান বাঁধে, সে গান ভেসে বেড়ায় তাদের সুখের ঘরের বাতাসে বাতাসে। ছেলেটার বাঁশির সুর তো নয়, যেনো যাদু, তাতে যেন মনের কথা চুঁইয়ে চূঁইয়ে পড়ে। গর্বে অরণ্যমণির বাপ-মায়ের চোখের কোণে জল আসে! তারা কাঁদে, সুখে!


মন্তব্য

বইখাতা এর ছবি

বেশ ভাল রূপকথা! হাসি

আশরাফ [অতিথি] এর ছবি

আমার কাছে লেখার মান খুব চমৎকার লেগেছে, কিন্তু লেখার পেছনের গল্পটায় আঠা একটু কম কম।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

রূপকথা বিষয়টাই অসাধারণ! এক সময় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বদৌলতে প্রচুর রূপকথা পড়েছি - গ্রীম ভাইদের রূপকথা, চীন দেশের রূপকথা, রাশিয়ার রূপকথা আরো কত কী! শিশুদের জন্য বর্তমানে ভালো লেখার সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় আগামী প্রজন্মের জন্য আফসোস হয়। এদেরকে বোধহয় হ্যারী পটার পড়েই বড় হতে হবে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তিথীডোর এর ছবি

সুন্দর! হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

রানা মেহের এর ছবি

ভারি কমনীয় আর মায়াভরা গল্প।
সত্যিকারের রুপকথার মতো।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।