অবক্ষয়

ঝরাপাতা এর ছবি
লিখেছেন ঝরাপাতা (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/০৮/২০০৭ - ৮:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিখিলেশ বাবু। আমার মাষ্টারমশায়। সেই ছোটবেলায় যেদিন প্রথম বাবার হাত ধরে, গাঁয়ের মেঠো পথ বেয়ে, সবুজ ঘাসে পা মাড়িয়ে এক বুক ধুকপুকানি নিয়ে টিনের চালার পাঠশালায় পা রেখেছিলাম, সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম তাঁকে। দিব্যকান্তি, ঋজু মাষ্টারমশায় এসে বাবার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন, সযত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। সত্যি বলতে কি সেই প্রথম দিন থেকেই আমি মাষ্টারমশায়ের গুনমুগ্ধ শিষ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর হাত ধরেই আমার জ্ঞানচক্ষুর পাপড়িগুলো উন্মেষিত হয়েছিল সত্যের নির্মল আলোকে। তিনি যখন আমাদের কবিতা পড়াতেন তখন এক অবিমিশ্র ভালো লাগায় মন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যেতো, তন্ময় হয়ে যেতাম সবাই অপূর্ব এক অব্যক্ত শিহরণে। তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন, সদা সত্য কথা বলিব, মিথ্যে বলা মহাপাপ, অন্যায়কারী আর অন্যায় সহ্যকারী উভয়েই সমান অপরাধী এই রকম আরো কতো কি। তিনি চেয়েছিলেন আমাদের হৃদয় গোলাপকে শুদ্ধতায় পরিস্ফুট করতে।

সময় কেটে গেলো পল, মিনিট, ঘন্টার কাঁটা পেরিয়ে, আমি ও প্রাথমিকের ল্যাঠা চুকিয়ে ঢুকলাম মাধ্যমিকে। তখনো নিখিলেশ বাবু আমার নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতেন, উৎসাহ দিতেন। আমার মাঝে তিনি অমিত(!)সম্ভাবনার বীজ দেখতে পেয়েছেন, এমন কথাও অনেকবার বাবাকে বলেছেন বলে শুনেছিলাম।

সে যাই হোক। আমি ক্রমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে ভর্তি হলাম দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের একটিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রঙিন ভুবনে আমিও সব রঙিন রঙিন কাজে জড়িয়ে পড়লাম। তখন আমি নিখিলেশ বাবুর দেয়া ধ্যান-ধারণা থেকে যোজন যোজন দূরে। গ্রামের সোদাঁ মাটির গন্ধ আমি ভুলে গেছি নতুন টাকার কড়কড়ে গন্ধে, ঠুনকো মূল্যবোধের ধব্জা ওড়ানো যে নির্বোধের কাজ সে আমি বেশ ভালই বুঝতে শিখেছি ততদিনে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অধ্যায় শেষ করে দু'একটা অপারেশনেও নেতৃত্ব দিয়ে ফেলেছি। আমি ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছি, বাঘ যেমন প্রথম রক্তমাংসের স্বাদ পেলে পাগল হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি আমি ও ক্ষমতার মোহে উন্মাদ হয়ে উঠলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট যখন শেষ করলাম তখন আমার দল ক্ষমতায়। আমার গুরু তখন সরকারের ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তিনি আমায় তার পি. এস. করে নিলেন। এখন আমি ও অনেক ক্ষমতাধর। আমার এক ইশারায় অনেকে মুহুর্তে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে আবার অনেকেই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। আমার মুখে গর্বের হাসি, অহংকারের ছায়া। হ্যাঁ তুমি পেরেছো। আরো অনেক কিছু পারবে।

আজ আমার খুব টাইট সিডিউল। সকালে মন্ত্রী সাহেবের দুটো জনসভা, তারপর শিক্ষকদের অনশন ভাঙ্গা, শিক্ষানীতি সংস্কারের বৈঠক আরো....। আমি বেরিয়ে পড়ি।

অসংখ্য প্রতিশ্রুতি আর সংগ্রামী বক্তব্য দিয়ে ময়দান উত্তপ্ত করি। জনসভা শেষে দুপুরে মন্ত্রীর সাথে যাই সচিবালয়ের বাইরে আন্দোলনরত শিক্ষকদের অনশন ভাঙ্গাতে। শিক্ষকদের একাংশ অনশন ভাঙ্গলেন মন্ত্রীর শরবত খেয়ে, আরেক অংশ তখনো দূরে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। তারা দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন করে যাবেন বলে সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। মন্ত্রী এখন শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন। আমি কালো সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে বিদ্রোহী শিক্ষকদের নেতাকে খুঁজে চলেছি। হঠাৎ দূরে একজনের উপর চোখ আটকে গেলো। আমার মাষ্টারমশায় নিখিলেশ বাবু না? সেই ঋজু শরীর আর নেই কিন্তু সেই গৌরবর্ণের নির্বিকার মুখ আজো এক দেখাতেই চেনা যায়। তাঁর হাতে প্ল্যাকার্ড- অবিলম্বে ১0% বেতন বৃদ্ধি চাই। হঠাত আমার মনে পড়ে যায় সেই পন্ডিতমশায় আর লাট সাহেবের তিন পাওয়ালা কুকুরের কথা। আমি ভাবি, ১0% বেতন বৃদ্ধির জন্য কতো নিখিলেশ বাবুকে দিনের পর দিন অনশন করতে হয় আর আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের বেতন বাড়াতে লাগে কলমের একটি মাত্র খোঁচা!

আমার উপর এখন গুরু দ্বায়িত্ব পড়েছে। শিক্ষকদের যে একাংশ অনশন করে যাচ্ছেন তাদের সাথে সমঝোতা করতে হবে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাদের আন্দোলন বানচাল করে দিতে হবে। সেই শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধিদের একজন আমার ছেলেবেলার মাষ্টারমশায়- নিখিলেশ বাবু। আমি আজ তাঁর সাথে মিটিং-এ বসবো, মুখোমুখি হবো। তাঁকে আশ্বস্ত করবো সব দাবি মেনে নেয়া হবে বলে; যিনি আমাকে প্রথম শিখিয়েছিলেন 'মিথ্যে বলা মহাপাপ, সদা সত্য কথা বলিবে'। তিনি আমাকে বিশ্বাস করে এক বুক শান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যাবেন।

আর- আরেকটি আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার সাফল্যের পালক যুক্ত হবে আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে।

আমি একদিন মন্ত্রী হবো।


মন্তব্য

ঝরাপাতা এর ছবি

লেখাটি ২০০৬, জুলাই-এ শিক্ষক আন্দোলনের সময় লেখা।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

অসম্ভব টাচ করে গেল
কিছু বলার নেই আসলেই, হতাশ লাগছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাইরে প্রবল রোদ
পথে কাজহীন যুবকেরা
ভেতরে খেলা করে,সম্মিলিত যোগাযোগে
রোগের সাথে ক্ষয় রোগ

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ঝরাপাতা এর ছবি

ধন্যবাদ জ্বিনের বাদশাহ।

ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

গত বছর শিক্ষকদের ধর্মঘট যখন চলছে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে শিক্ষকদের দাবি পূরণ সম্ভব নয়। ঠিক একই সময়ে একটি পত্রিকায় খবর এলো, সশস্ত্র বাহিনীর জন্যে একশো কোটি টাকা ব্যয়ে হেলিকপ্টার কেনা হবে।

তখন একটি লেখায় আমি লিখেছিলাম, এই হেলিকপ্টার আমাদের অতিরিক্ত কী নিরাপত্তা দেবে? অথচ এই টাকা দরিদ্র শিক্ষকদের জীবন আরেকটু সহনীয় করতে পারতো। এই শিক্ষকরা আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করেন, আমরা তাঁদের উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের টাকায় খুশি করতে চাই অপার সুবিধাভোগীদের।

এই নিখিলেশবাবুরা ক্ষমতার অভিলাষ করেন না, জবরদস্তি করেন না, ব্যক্তির বা রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনে আগ্রহী নন। সুতরাং তাঁদের আর দেখবে কে?

আপনার লেখাটা ভালো লাগলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ঝরাপাতা এর ছবি

ধন্যবাদ জুবায়ের ভাই। ওই হেলিকপ্টার কেনা হলেই তো ওদের সুবিধা। সেখান থেকে পার্সেন্টেজ খাওয়া যাবে। তাই গরীবদের কথা ভাবার অবসর তাদের কোথায়?

সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম এই ঘটনাটার কিছুদিন আগে আব্দুল মান্নান ভুইঁয়ার একটা মন্তব্যে। সাংসদদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, আমাদের বেতনের অংকটা এতো কম যে বিদেশ সফরে গেলে সেটা বলতে খুব লজ্জা লাগে। তাই বেতন বাড়ানো হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের রাজনীতিকদের লজ্জা লাগে তাদের বেতন উন্নত বিশ্বের দেশগুলির মন্ত্রী সাংসদদের বেতনের চেয়ে কম বলে। আর বছরের পর বছর জাতির মেরুদন্ড নির্মাণ করা শিক্ষকদের দিনের পর দিন অনশন করতে হয় সেই বিশ বছরের পুরনো স্কেল পরিবর্তনের জন্য। সত্যিই সেলুকাস। জনাব ভুঁইয়াকে জানাতে চাই, আপনার লজ্জা লাগলেও আমাদের লাগে না। তাই যখন কোন ভিনদেশী বন্ধু জানতে চায় তখন অকপটে বলি তোমাদের চারশ টাকায় আমাদের দেশে অনেক পরিবারের চলে এক মাস।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

থার্ড আই এর ছবি

বাঘ যেমন প্রথম রক্তমাংসের স্বাদ পেলে পাগল হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি আমি ও ক্ষমতার মোহে উন্মাদ হয়ে উঠলাম।

---------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

ঝরাপাতা এর ছবি

শুধু উদ্ধৃতি দিলেন, আপনার বক্তব্য তো দিলেন না।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।