সাতজন সমকালীন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী কবির কবিতা

কুঙ্গ থাঙ এর ছবি
লিখেছেন কুঙ্গ থাঙ [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৪/০২/২০০৯ - ১:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সমরজিৎ সিংহ
মা তৃ ভা ষা

এ রাত তোমার নামে উৎসর্গ করলাম
এই রাতে আমার শিয়রে বসে থাকো
আমি মানি, ভুল হয়েছে আমার
ভুলে রেখে এসেছি তোমাকে
আহা জন্মভুমি
এই রাত আমার সঙ্গেই থাকো
কী নীরব রাত্রি, কথা বলার ভাষাটুকুও নেই

আমার অক্ষমতার জন্যে এই দশা
কপালই আমকে বলে,
ওই যে পাথুরে ঘাটের ওপার থেকে
আমার দোষেই অভিশম্পাত দিচ্ছে ওরা
আকাশ থেকে ঝরছে আগুরে ফুলকি
কপালে, সব আমার দোষেই
আজকের রাতে তুমি আমাকে বাঁচাও
এ রাত তোমার নামে উৎসর্গ করলাম
তোমার নামেই।

|| সমরজিৎ সিংহের জন্ম ত্রিপুরার আগরতলায়। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পত্রিকা ত্রিপুরা চের সম্পাদনার কাজে ছিলেন দীর্ঘদিন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আধুনিক ব্যক্তিরূপের ভেতর দিয়ে কবিতার অধরাতে ধরতে চেষ্টা করেন। আসাম ও কলকাতার বিভিন্ন ছোট কাগজে বাংলা কবিতা লিখে থাকেন। বাংলাতে তার লেখা 'মাধবীলতা' গ্রন্থটি গোটা পশ্চিমবঙ্গে আলোড়ন তুলেছিল একসময় ||


রঞ্জিত সিংহ
আ জ ও সে আ সে

আর
বিধবা নদীটি এসেছিল
আমাদের উঠান পর্যন্ত।
মন্দ্রিত রৌদ্রের মতো কী শান্তি
স্বপ্ন দেখেছিল সে।
বিশ্রামহীন তিনরাস্তার কোন পুলিশপয়েন্টের মতো
উদভ্রান্ত এখন।
তৃষ্ণাথরথর বুক চাপরিয়ে কেঁদে কেঁদে
আমার কাছে চেয়েছিল দু'ফোটা জল
আমি নিরুপায় ভয়ে লজ্জায়
ঘরের ভেতর নিঃশব্দ বসেছিলাম
এখনও আমি ভিজে উঠি চোখে -
নিষ্তেজ আমি
এমন নিম্নজ!

আর
বিধবা নদীটি এসেছিল
আমাদের উঠান পর্যন্ত।

|| রঞ্জিত সিংহ নব্বই দশকের কবি। জন্ম ভারতের অসমে। অনন্য রুপকল্প ও শান্ত সমাহিত বয়ান ধরনের পাশাপাশি রাজনীতিশ্পর্শী এক গভীর হাহাকার তার কবিতায় ছুঁয়ে যায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : 'মোর ইমারঠার মোর প্রেমর কবিতা' ||


দিল্স লক্ষীন্দ্র সিংহ
কো ন এ ক অ র্থ হী ন জী ব নে র প্র তি

বলেছিলে আমাকে কানে কানে
মনে মনে
গহিনে
এক জীবনের অর্থহীন ক্রোধ আর অহমিকাকে
নারকেলের খোসার মতো খুলে ফেলে দাও
ছুঁড়ে ফেলে দাও ব্যর্থ জন্মভার
দুরে
ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেখছি এই আশ্চর্য জীবন
একটি নিগুঢ়, নরোম কবিতার গোপন আকঙ্খায়

হাতের তালুতে কার রক্ত
হৃদয়ের,
নাকি ভগবানের?

|| দিল্স লক্ষীন্দ্র সিংহের জন্ম অসমের করিমগঞ্জ জেলার দুল্লভছড়ায়। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী কাব্য ও সামাজিক আন্দোলনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন দিল্স (দুখীনি ইমার লেইরাপা শৌ) এর রূপকার। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে 'থরো', 'মণি বিসারেয়া', 'ইমালাম', 'না কাদি তি লোকতাক' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নাটক লিখেছেন 'কল্লিঙ' এবং 'এরে হে টেইপাঙ নিদান'। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় অনুবাদ করেছেন সফোক্লিসের 'আন্তিগোনে' এবং এলিয়টের 'ওয়েস্টল্যান্ড'।||


বিশ্বজিৎ সিংহ
কো থা য় আ ছো

কোথায় আছো তুমি, সুখে নাকি ক্ষুধায় ?
ভীষন ইচ্ছে দেখবো তোমাকে
দুহাতের ভেতর বন্দী করে নেবো
দেহের দরজা খুলে ঢুকতে চেয়েছি বলে
উপবাসী আমি বিন্দু থেকে সিন্ধু পেতে চাই, যাবার আগে
কোথাও হয়না যাওয়া আজকাল,
অনন্ত পথের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে আছি জলের ছায়াতক না পড়া জঠরে
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অনেক গল্প হলো
সাদা-কালোয় উৎভ্রান্ত
নগ্ন সুখ একাকী রইলো প্রতীক্ষায়।

কোথায় আছো তুমি, সুখে নাকি ক্ষুধায়?
ক্ষুধাতো জন্মান্ধ
রক্তে স্নান নিয়েছে যাত্রার পথ
আরও দীর্ঘ হয়ে গেল বৃষ্টির আকাঙ্খা
আতঙ্কের মাঝে ভেঙে গেল উৎসব
ফেরার পথে যখন বৃষ্টি এলো -

ক্ষুধার ভেতরে আমি প্রতীক্ষায় আছি।

||বিশ্বজিৎ সিংহ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী কাব্য জগতে পরিচিত নাম। জন্মস্থান মৌলবীবাজারের কমলগঞ্জে হলেও পেশাগত কারণে বর্তমানে ত্রিপুরায় স্থায়ী বসবাস করছেন। মার্কসিস্ট নান্দনিকতার জায়গা থেকে কবিতাকে দেখতে চেষ্টা করেন। মিতবাক ও চিত্রকল্পময় তার কবিতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: 'ইশ্বর মাঙসে মেইথঙে' ||


অভয় কুমার সিংহ
বি চ্ছি ন্ন অ নু ভু তি সি রি জ - ৩

এক.
ইটখোলার পথে দেখা
দেখেও আমি দেখিনি
তবু তুমি ডেকেছিলে -অভয় !

কৌতুকের হাসি মৃত্যুময়।

দুই.
ঘরখানি ভরে আজ খনিজ আবহাওয়া।

তিন.
মুহুর্তে মুহুর্তে আমি হয়েছি অজ্ঞান
তোমার প্রতিটি স্পর্শে, এ কি মৃত্যু, এ কী অবসান !
বুঝেছি তখন
প্রেম মানে অনন্ত মরণ।

|| অভয় কুমার সিংহের আসল নাম চাম্পালাল সিংহ। জন্ম শিলচরের কচুধরমে। আশির দশকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় মাতামে নামের একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার কাজ করতেন। দৃশ্যকল্প আর অনুভুতি নিয়ে শব্দ সাজিয়ে যান এজন্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী কবিতায় তিনি বৈশিষ্ঠ্যপুর্ণ। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: 'কাব্যময় এরে রাতিহান', 'হাবিত্তাউ ইতিহাস' ||


শুভাশিস সমীর
আ য় না

দু্ইজনে মিলে আমরা হয়েছি এক
একজনে করে, আরজন শুধু দ্যাখে
দুইধারে এক আয়না বসানো আছে
আরও একজন উঁকি দেয় থেকে থেকে ।

মাটি ক্ষয় হলে মাটিকে গিয়েও মাটি
আয়না তখন কোথায় মিলিয়ে যায়
তোমার নিকটে গেলে কেন তুমি মিছে
পাঠিয়ে দিয়েছো দুয়ের অন্তরায়?

দুইজনে মিলে এক, তবু এক নই
আর কে সে করে মাঝখানে আনাগোনা
চোখ ঝিমুলেই পথখানি সোজা কতো
আয়নার নেই সাধ্য যে রেখা টানা।

|| শুভাশিস সমীরের জন্ম মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জে। বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী দুই ভাষাতেই লিখে থাকেন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ; সেনাতম্বীর আমুনগৎতো সেম্পাকহান পড়িল অদিন, নুয়া করে চিনুরি মেয়েক। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় অনুবাদ করেছেন বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রুদ্রচন্ড। গত বছর সেরা নাট্যদল হিসাবে আরজু স্মৃতি পদকে ভূষিত নাট্য সংগঠন মণিপুরী থিয়েটারের সাথে যুক্ত আছেন জন্মলগ্ন থেকেই ||


সন্তোষ সান্তান
স ম্প র্ক সি রি জ - ২

ইস্কাপনের বিবির সাবঅল্টার্ন য়াবেরুনীর সৌন্দর্যে নিপুন এক কবিতা লিখে যাব, এমন সময় হাতের তালু দাবী করে রাজসুলভ ভাগ্যলিপি। যে শিল্পের টানে একজন জন্মকবি দারিদ্রের সাথে সংসার পাতে, সেই নির্বাক শিল্প ছড়িয়ে থাকে অতিচেতনায়, যুক্তির বাইরের কোন পৃথিবীতে। ইশ্বরের লীলা যেন মাকড়শার জাল। ইশ্বরও এখন বৃদ্ধ। তাকেও স্ট্রাগল করে বাঁচতে হয়। আকাঙ্খায় পূর্ণ আজ পিতলের বাটিখানা। প্রতি পদক্ষেপে বিধিনিষেধ, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ট্যাবু সান্ধ্য আরতির মৃদঙ্গের তালে তালে নাচে নারীদের কন্ঠ। জয়দেবের গীত শুরু হলে আসরের বৈষ্ণব-নামাবলী থেকে নেমে আসেন অষ্টসখির প্রানধন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ, ময়ুরকন্ঠী রঙের নামবাচক এ বিশেষ্যের দ্বিতীয় অক্ষরটি যুক্তবর্ণ; "ষ" ও "ণ", এ দুই ব্যঞ্জনের মাঝে ছোট্ট একটি ফাঁকও খুঁজে পেলাম না, যেখানে অনায়াসে ঢুকিয়ে দেতে পারব বর্ণিল কিছু মানবতা। এদিকে "ক" খুব একলা, তার সাথে মিশে আছে "ঋ" কার, একা থাকলে তার গায়ে মেখে দিতাম কনেরাঙা মমতা; আর কলঙ্কিনী রাইয়ের জন্য খয়েরি রঙের কিছু স্মৃতি। কলঙ্কিনী রাই আসলে এমন একটি নাম যার কোনো সর্বনাম নেই, আছে শুধু আকিঁবুকিহীন দুঃখীনি বিশেষন।আমরা জানি, বিশেষ্যের সাথে বিশেষনের ব্যবহার আত্মিক তৃপ্তি এনে দেয়।

ঘোমটার মতো শাদা কুয়াশা পৃথিবী মায়ের কোলে ছড়িয়ে পড়লে অবুঝ এ মন বৈষ্ণব-খড়ম, অহংকারী সানগ্লাস, অপরূপ কবিতা সব রেখে বৃন্দাবনের দিকে সরে পা বাড়ায়।

*য়াবেরুনী - কাঁচুলি বিশেষ। আগে মনিপুরী মেয়েরা শরীরের উর্ধ্বাংশে ব্যবহার করতো।
*জয়দেব - আষাঢ় মাসে মনিপুরীদের কাঙ উৎসবের সময় কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ গাওয়া হয়

|| সন্তোষ সান্তান নতুন শতাব্দীর কবি। প্রতিস্ঠান বিরোধিতার তার্কিক জায়গা থেকে হিউমারের মধ্য দিয়ে পেশ করেন কবিতা। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষার মাসিক সাহিত্যপত্র "নুয়া এলা"য় নিয়মিত লেখেন ||


সূত্র: মনিপুরী সাহিত্য সংগ্রহ। ভুমিকা ও অনুবাদ- শুভাশিস সিনহা। ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০০৭।
ছবি: শক্তিকুমার সিংহের পেইন্টিং


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

ছবিটা দেইখাই ভোদড় হইয়া গেলাম ! প্রেমে পইড়া গেলাম ! কবিতা পড়তাসি এখন ...

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

কুঙ্গ থাঙ এর ছবি

শিরোনামে একটা ভুল থেকে গেছে। এগুলি কবিতা নয়, কবিতার অনুবাদ।

ফেরারি এর ছবি

চমৎকার লাগলো - শুধু একথা বলার জন্য লগিন করলাম।

তীরন্দাজ এর ছবি

ইটখোলার পথে দেখা
দেখেও আমি দেখিনি
তবু তুমি ডেকেছিলে -অভয় !

কৌতুকের হাসি মৃত্যুময়।

সবগুলোই অদ্ভুত অদ্ভুত সুন্দর। অনুবাদ আপনি করেছেন?

অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে।

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

কুঙ্গ থাঙ এর ছবি

নীচে সুত্র দেয়া আছে...

জিজ্ঞাসু এর ছবি

অনুবাদ পড়ে ভাল লাগল।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

খন্দকার সোহেল এর ছবি

দেহের দরজা খুলে ঢুকতে চেয়েছি বলে
উপবাসী আমি বিন্দু থেকে সিন্ধু পেতে চাই, যাবার আগে
কোথাও হয়না যাওয়া আজকাল,
অনন্ত পথের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে আছি জলের ছায়াতক না পড়া জঠরে

অসম্ভব ভালো লাগলো। ... অন্যগুলোও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।