কলারাডো - ধুসর আর সবুজের পাগলপারা মিশ্রন - ৩

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
লিখেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ (তারিখ: সোম, ১৬/০৭/২০০৭ - ৭:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চ্যানচ্যানানো খিদা নিয়ে ক্যানিয়ন শহরে ফিরে গিয়ে ভালো কোন খাবারের দোকান খুঁজতে ইচ্ছে করছিল না। এর মধ্যে ভেজিটেরিয়ানগুলো সাবওয়ে থেকে ভেজি বার্গার কিনবে বলে বিশ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখল। খিদায় মনে হচ্ছিল শালাদের কানে থাপ্পড় মেরে বলি তাড়াতাড়ি কর। কোন রকমে একটা দোকানে ঢুকেই গোবদা গাবদা বার্গার, চিকেন নাগেট, আর হীম শীতল ভ্যানিলা খেলাম।

এমনিতে রাফটিং করে ভীষন টার্য়াড তার উপর পেটে পড়েছে ভারী খাবার! শরীরটাকে মনে হচ্ছিল দু'মনি বস্তা। নড়তে ইচ্ছে করছিল না আর। তবু কোনরকমে রয়েল গর্জ ট্রেন ভ্রমনের জন্য ট্রেনে গিয়ে উঠলাম আমরা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইছে।

রয়্যাল গর্জ আসলে একটা জায়গার নাম। আরক্যানসা নদীরে (Arkansas) আরকানসাস না কইয়া আরক্যানসা কেন কয় আল্লাই জানে। এই নদী পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দু পাশের খাড়া পাহাড়ের খাঁজে সরু একটা জায়গাকে রয়্যাল গর্জ বলা হয়। রয়্যাল গর্জ নামে একটা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে জায়গাটা নিয়ে ব্যবসা করার জন্য। সেই প্রতিষ্ঠানেরই একটা রেল ভ্রমনে আমরা গিয়েছি।

৭। রয়্যাল গর্জ ট্রেন ভ্রমন

রেলে দুধরনের কামরা আছে। কাঁচে ঘেরা, ডিনার সহ একটা ভিস্তা ক্লাস আরেকটা সস্তা কোচ ক্লাস। স্বভাবতই আমরা কোচ ক্লাসে টিকেট কেটেছি। উঠে বসতে এসির ঠান্ডা বাতাসে আমার ঘুম চলে আসল। বসে বসে ট্রেনের ভিতর থেকেই কিছুক্ষন ছবি তুললাম আমরা।

৮। গাগান ও শ্রীকান্ত, মাথার উপর ঝুলন্ত ব্রীজের একাংশ৮। গাগান ও শ্রীকান্ত, মাথার উপর ঝুলন্ত ব্রীজের একাংশ

এক পর্যায়ে ট্রেনটা আসল ঝুলন্ত এক ব্রীজের নীচে। ততক্ষনে রোদও পড়ে এসেছে। তাই আমরা কোন রকম শরীরটাকে তুলে নিয়ে ছুটলাম ছাদখোলা একটা বগিতে। সেখান থেকে এতো সুন্দর লাগল পুরো পরিবেশটা, যে মনে হচ্ছিল যেন কোন স্বর্গোদ্যানে এসে পড়েছি।

৯। রয়েল গর্জ জায়গাটা এতো সরু যে রেললাইন ঝুলান হয়েছে দুপাশের পাহাড়ে লোহা গেঁথে

১০। ঝুলন্ত ট্রাম থেকে ঝুলন্ত সেতু

ঘন্টা দুয়েকের উপরে ট্রেন জার্নির পর আমরা ট্রেন থেকে দেখা উপরের ঝুলন্ত ব্রীজের সন্ধানে ছুটলাম। ঝুলন্ত ব্রীজটার মালিকও রয়েল গর্জ কোম্পানী। এর আশেপাশে ঝুলন্ত দড়ির ট্রাম, পায়ে দড়ি বেঁধে বাঞ্জির মতো রাইউ, পৃথিবীর সবচেয়ে খাড়া ট্রেন রাইড যেটা পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে নামে, একটা চিড়িয়াখানা - এসব আছে। আমরা সেখানে পৌছেছি সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় আর রাইড গুলো বন্ধ হয় সাতটায়। পার্কযদিও খোলা থাকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত তবুও করার তেমন কিছু থাকেনা।

১১। ঝুলন্ত সেতুর সামনে হোঁতকা আমি

১২। ঝুলন্ত সেতু থেকে আরকানসা নদী
তবু আমরা টিকেট কেটে ঢুকলাম। ঝুলন্ত ট্রামে করে এপাশে থেকে বাঞ্জি জাম্প দেবার ওখানটায় গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে ওটা সহ বাকি রাইডগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কি আর করা অগত্যা ব্রীজের উপর দিয়ে ঘোরাঘুরি করে ফিরলাম।

১৩। No Fishing!! হাজার ফিট লম্বা বড়শী দিয়ে মাছ মারবে কে?১৩। No Fishing!! হাজার ফিট লম্বা বড়শী দিয়ে মাছ মারবে কে?

ফেরার সময় আমি ড্রাইভ করছি। গাগান আর অমিত বায়না করল "স্কাইলাইন ড্রাইভ" দিয়ে যেতে হবে। সকালে রাফটিং করার সময় তাদেরকে তাদের নৌ-পরিচালক ছেলেটি বলেছে এটা নাকি "Cool"। ঠিক হ্যায়।

কিছুদুর গিয়ে স্কাইলাইন ড্রাইভে উঠলাম। মূল রাস্তার সমান্তরালে কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা একটি রাস্তা। ঢোকার মুখে দেখি লেখা ওয়ান ওয়ে ড্রাইভ। মাজেজা কি বুঝলাম কিছুদূর যাবার পর।

স্পীড লিমিট বলা ১০ মাইল/ঘন্টা। রাস্তার আকৃতি দেখে আমি মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি। পাহাড়ের খাদটা আমার ডানদিকে, তাই আমি খাদটা দেখতে পাচ্ছিনা। ডানদিকে আমার পাশে বসেছে মৌটুসী, পিছনে গাগান, অমিত। এরা চেঁচামেচি শুরু করেছে।

মৌটুসী বলছে, "সুমন আল্লাহ আল্লাহ করো"। গাগান বলছে, "মেহবুব ভাই জারা লেফট সাইড পে যাও না"। আমি হেসে "এপাশে জায়গা নেই, রিল্যাক্স হয়ে বসো" বলতেই আমার মৌটুসী দিল এক ঝাড়ি। "জানো এইদিকে কি অবস্থা, সোজা চালাও"। ভয়ে আমারও হাত-পা ঘামা শুরু হল।

১৪। স্কাইলাইন ড্রাইভে সমতল জায়গায় কয়েকজন

উপরে খানিকটা গিয়ে একটা সমতল জায়গার মত জায়গায় গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে। সেখানে গাড়ি রেখে নেমে বুঝলাম আসলে কত ভয়াবহ খাড়া জায়গাটা। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে সূর্য ডোবা দেখে নামা শুরু করলাম। নামার সময় বামে একটা খাদ পড়ল,নীচের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরে উঠল আমার। মানে মানে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে শেষমেষ নেমে এলাম আমরা।

এরপর কলারাডো স্প্রীংস শহরের দিকে চললাম আমরা। সেখানে ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় ভরপেট খেয়ে আগে থেকে ভাড়া করে রাখা হোটেলের উদ্দেশ্য চললাম।

এদিনের হোটেল ছিল ট্রাভেলজ। অমিত রেনো ৯১১ ছবির উদাহরন দিয়ে বলে যে হোটেলের কামরায় ব্যালকনি মুখী বড় জানালা আছে। সেটা দিয়ে নাকি "রেনো ৯১১" ছবিতে সেক্স করা দেখায়। এক চোট হাসির পর জানালার পাশে শুতে যাওয়া অমিত আর শ্রীকান্তকে সাবধান করে দিলাম - যাই করুক জানালা দিয়ে যেন দেখা না যায়। দেঁতো হাসি

স্যানফ্রানসিসকো এমনিতেই গে বিবাহের জন্য বিখ্যাত। আবার গাগানের আচরনও সন্দেহজনক। তাই গাগানকে পই পই করে বলে দিলাম লাথি খেয়ে কালকে হাটতে না পারলে কিন্তু আমার কোন দোষ নেই। দেঁতো হাসি

এইরকম একচোট হাসি ঠাট্টার পর ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। নাহ, রাতে কোন গ্যাঞ্জাম হয়নি।

(চলবে...)


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ফটো ভিডিও আর বর্ণনা মিলে আমার তো ভ্রমণ হয়ে গেল।
নামগুলো মুখস্থ করে নিয়ে গল্প করলে কেউ ধরতেই পারবে না যে ঐখানে আমি যাইনি।
মিডিয়ার কি দারুণ ব্যবহার। চিয়ার্স।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

থ্যাঙ্কস।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ফারুক হাসান এর ছবি

আমিও ঠিক এই কথাটিই ভাবছিলাম। @ শামোচৌ
দারুন।চলুক@ এসএমামু

-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

??? এর ছবি

মাল্টিমিডিয়া ব্লগিং আর গতানুগতিক লেখালেখির পার্থক্য কোথায় -- এই লেখাটা এর একটি উজ্জ্বল ডেমনস্ট্রেশন। শোমচৌ যথার্থ বলেছেন, মিডিয়ার দারুণ ব্যবহার! একই সাথে আরেকটা জিনিস আমি ভাবছি। ভিজুয়াল রিসোর্সের প্রাপ্যতা এবং ব্যবহার কোনো লেখার সম্ভাবনাকে কোনোভাবে ব্যাহত করে কিনা? লেখার কাজও অভিজ্ঞতাকে পুনরুৎপাদন করা। অভিজ্ঞতা ডিজাটাইজড থাকলে, কখনো কখনো, লেখা হয়ে উঠতে পারে স্রেফ ভিজুয়ালের কমেন্ট্রি। আবার নাও হতে পারে। লেখা হয়ে উঠতে পারে ঐ ভিজুয়ালের প্রতিদ্বন্দ্বী। কাউন্টার ইন্টারপ্রিটেশন।

মা.মু. র পোস্টের পঠন আমার মনে এসব ভাবনার দোলা দিল। ধন্যবাদ তাকে।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আসলে আগে লিখেছি পরে ছবি আর ভিডিও দিয়েছি। সুতরাং মিডিয়াগুলো আসলে লেখার পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন ট্রেন ভ্রমন বর্ণনার সময় ইচ্ছে করে ছোট রেখেছি, ছবির মাধ্যমে এক্সপ্লোর করা যাবে বলে। রীচ কনটেন্ট ব্যবহার করতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাই কেঁচে গেল কিনা তাই ভাবছি। অবশ্য এই জায়গাটাতেই ইন্টারনেট মিডিয়া ট্রাডিশনাল মিডিয়াকে ছাড়িয়ে যায়।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।