ভূমি পুত্রের স্বপ্ন - ২ : (চলেশ রিছিলের জন্য)

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি
লিখেছেন মাসকাওয়াথ আহসান (তারিখ: রবি, ০১/০৭/২০০৭ - ২:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রান্নার চুলোর পাশে রনকার চোখ যখন ধোঁয়ায় লাল- হাঁসদার স্বপ্ন দেখায়, 'আবার সিসব দিন ফিরি আসবিক'। শিশুরা গোল গোল হয়ে খেলা করে। কেউ গিয়ে দৌড়ে একটা কাদা পানির পুকুরে ঝাঁপ দেয়। কাদা পানির মধ্যে মোষের মতো শরীর ডুবিয়ে রাখে।

সাহেবরা ফিরে যাওয়ার পর এক বছর চলে গেছে। টাকা-পয়সার অভাবে স্কুলটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শামসুল জোতদারের লেঠেলরা রোজ রাতে সাঁওতাল পল্লীতে হানা দেয়। গ্রামের বউ-ঝিরা আশঙ্কায় জেগে থাকে। যেকোন সময় সম্ভ্রমের ওপরে আঘাত আসতে পারে। হাঁসদার রাজশাহী গিয়ে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। ডিসি মহোদয় মন্ত্রী মহোদয়কে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় হাঁসদারকে পুলিশ সার্কিট হাউসের গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়। একজন লেখকের বাসায় গিয়ে হাঁসদার কান্নায় ভেঙে পড়ে। লেখক হাঁসদারের কাঁধে হাত রেখে বলেন, 'তোমাকে নায়ক করে উপন্যাস লিখছি। তুমি ইতিহাসে থেকে গেলে'। এক বার্ধক্যময় প্রশান্ত নির্মিলিত হাসি- তার সঙ্গে মিশে থাকা শিল্পতৃষ্ণা।

- চা খাবে হাঁসদার?

পন্ডিতেরা কথায় কথায় চা খান। কিন্তু কি করে বোঝাবে হাঁসদার তার ভাতের খিধে।

গাবতলী থেকে ঠিকানা বের করে ধানমন্ডিতে হাঁসদার লেখিকার বাসায় পৌঁছে। লেখিকা ব্যস্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হাঁসদারের দিকে তাকিয়েও চিনতে পারেন না। দারোয়ান জানায় উনি দাওয়াতে যাচ্ছেন। রাতে ফিরবেন। হাঁসদার গুলশানে যায়। এনজিও নির্বাহী আপার বাসায়। বারান্দায় একটা গাছের গুঁড়ির ওপর হাঁসদারকে বসতে দেয়। বাড়ির কাজের মেয়েটা হাঁসদারকে স্যান্ডউইচ খেতে দেয়। একটা পাহাড়ি মেয়ে। হাঁসদারের দিকে সে মায়ার চোখে তাকায়।

ম্যাডাম বলেন, 'তোমাদের জন্য ফান্ড যোগাড় করতে চেষ্টা করছি। ডেনমার্কে একটা কনফারেন্স আছে। ওখান থেকে ফিরেই ডেনিস এমব্যাসির সঙ্গে কথা হবে। তোমরা একটা প্রজেক্ট পেয়ে যাবে এ বছরের শেষ নাগাদ'।
হাঁসদার কি করে বোঝাবে আগামী সাতদিনে ওলাওঠায় কমপক্ষে সাতজন মানুষ মারা যাবে। কলের পানি এতো নিচে নেমে গেছে যে, কল চাপলে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ আসে- যেন কোনো তৃষ্ণার্ত মানুষের আর্তনাদ। চট দিয়ে মুড়ে রাখা পরিত্যক্ত টিউবওয়েল দেখে জ্যোৎস্না রাতে মনেহয় নরমুন্ড। বাচ্চাদের বই পুস্তক, স্লেট পেন্সিল নেই। স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায় যায়। হয়তো গিয়ে শুনবে মায়াবতী ঘর ছেড়েছে। মহাজনের বাসায় বাসন ধোয়ার কাজ নিয়েছে। রনকার বুক শুকিয়ে গেছে। শিশুটা ধুলোর উঠোনে কেঁদে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাঁসদার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, শুকনো স্যান্ডউইচ তার গলা দিয়ে নামে না।

হাঁসদার উদভ্রান্তের মতো রাস্টা দিয়ে হাঁটতে থাকে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার শক্তি নেই তার। পকেটে পয়সাও নেই তার ফিরে যাবার। আর কোন মুখ নিয়ে ফিরবে সে! অবাক হয়ে দেখে একটা লোক ভাঙা ইটের টুকরো ঘষে ঘষে রাস্তায় কি সব লিখছে।

হাঁসদার একটা চায়ের স্টল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢক ঢক করে খায়। কতোদিন পর পুরো এক গ্লাস পানি খেলো। বুকের মধ্যে খালবিল অন্ননালী শীতল করে দিয়ে পানি নেমে যায়। চোখ বন্ধ করে, মনে হয় সে যেন স্কুল ঘরের মধ্যে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনছে। সাঁওতাল শিশুরা বৃষ্টির মধ্যে হৈ-হুল্লোর, দাপাদাপি করছে। রনকা হা করে বৃষ্টির জল গলায় নিচ্ছে। তার কালো টিকালো মুখ বৃষ্টিতে ধুয়ে চকচক করছে। চোখের মণি ধুয়ে সাদা ধবধবে। আশেপাশের ডোবায় ব্যাঙ ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। চারপাশে জীবন জেগেছে। পালক ধুয়ে লাল ঝুঁটিঅলা মোরগ দৌড়াদৌড়ি করছে। সাঁওতাল পল্লীতে আজ জীবনের উৎসব!


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সাথে আছি শেষ পর্যন্ত ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সাথে আছি শেষ পর্যন্ত ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

??? এর ছবি

শেষ হয়ে গেল? নাকি আরো আসছে?

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমাদের সময়ের বিশুদ্ধ মানুষগুলো কেমন করে যেন অকালেই হারিয়ে যায়!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি

ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ এবং ধুসর গোধূলি।

সুমন রহমান - গল্পটির ওখানেই শেষ ছিল। তবে আমাদের বিষণ্ণতার শহরের আরও নতুন নতুন গল্প আসবে আশা করি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।