একটি ছোটগল্প

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩১/০১/২০০৮ - ১২:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:
মধুদীঘি মাটির ভাঁজে চৈত্রের তেজ, কোদালের কোপ পড়তেই জবজব করে বেরোয়, সাপের জিভের মতো। সাত-আট হাত ইস্তক খোঁড়া হয়ে গেলো, অথচ জলের দেখা নেই। এই ভরা চৈত্রে অবশ্য জল থাকার কথাও নয়, কিন্তু মধু-দীঘি বলে কথা। মানুষ বলে, এই দীঘির জল কখনওই শুকোবে না, পৃথিবী উল্টে গেলেও নয়। এই যে ভরা চৈত্র মাস, চারদিকে জলের হাহাকার, অথচ এখনও এই দীঘির একপাশে, পশ্চিমের কোণ্টায় এখনও গভীর কালো জল। কিন্তু পূব থেকে এই জল অবধি প্রায় বিঘা চারেক জায়গা শুকিয়ে গেছে, বুক চিতিয়ে থাকা মাঠ, এটুকুতেই এখন খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। বাকিটুকু অবশ্য দমকল বসিয়ে শুকোনো হচ্ছে। রাজেত মাতব্বরের ছেলে বাকি চেয়ারম্যান মধু-দীঘিতে মাছ ছাড়বে বলে পনের বিঘার এই দীঘিকে নতুন করে কাটাচ্ছে। লোকে অবশ্য বলে, এলাকার রাস্তার জন্য বরাদ্দ টাকা দিয়েই নাকি দীঘি কাটা হচ্ছে। তা হবে হয়তো, কিন্তু লোকে তো আর টাকার জন্য এই চৈতালী রোদে পিঠ পোড়াচ্ছে না, পোড়াচ্ছে অন্য কারণে, সামান্য ক’টা টাকা ছাড়াও খন্তা-কোদাল হাতে নেওয়ার পেছনে বড় হেতু রয়েছে। এতো আর যে সে দীঘি নয়, এ যে মধু-দীঘি, যার বয়সের গাছ-পাথর নেই। যার ইতিহাসও মুখে মুখে বহুদূর ইস্তক চলে গেছে, চলতে চলতে বদলেও গেছে বহু রকমে। শোনা যায়, ব্রিটিশদের বেঙ্গল গেজেটেও এই দীঘির নাম তোলা আছে। লোকে এই দীঘির জল নিয়ে যায়, রোগ-ব্যাধি সারাতে, বাও-বাতাস কাটাতে, আরও কতো কাজে তার শেষ নেই। তবু মধু-দীঘির জল কমে না, সে অবশ্য পুরোনো কথা, কিন্তু গত বছর দশেক ধরে মধু দীঘি শুকিয়ে যাচ্ছিলো, পনের বিঘার মধ্যে প্রায় বার-তের বিঘা বুক চিতিয়ে ওঠে, প্রতি শীতে, বৈশাখের ঢল না নামা অবধি চিতোনো বুক চোখে পড়ে, মনে হয় সাত-আট হাত মাটির গহীনে শুয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক কোনও দানব, কিংবা হাতপামুখে বয়সের দাগ নিয়ে কোনও বৃদ্ধ। মাটি খোঁড়া চলছে পুরোদমে। চিকন করে মাটির সিঁড়ি রেখে গর্ত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে, পারে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে মনে হবে অসংখ্য খোপ কাটা হয়েছে, নক্শাদার বরফিও মনে হয়। সকাল থেকে তাই মানুষের ভীড় এখানে, মাটি কাটতে কাটতে কখন কার ভাগ্যে কি জোটে বলা যায় নাকি? যদিও রাজেত মাতুব্বর হাতে একটা লাঠি আর মাথায় শুকনো গাব পাতার মাথাল দিয়ে কখনও দীঘির চারপাশে, কখনও চিকন মাটির সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা নেমে গিয়ে মাটি কাটিয়েদের নজরদারি করছেন। কিন্তু এই রাজেত তো সেই রাজেত নয়, এখন বয়স হয়েছে, হাক দিলে লোকে শোনে না খুব একটা, সামনা সামনি অবশ্য খানিকটা সম্ভ্রম দেখায় কিন্তু একটু আড়াল হলেই বলে, “শালা বুইরা শকুন, মরেও না। হিন্দু মাইরা জমি দখল করছে, এ্যাহন ছেলেরে চেয়ারম্যান বানাইয়া মোছলমানের হক্কের গম বেইচা দীঘি কাটতাছে। মনে হয় শাবল দিয়া গাইড়া থুই এই দীঘির মইদ্যে”। পঞ্চাশ বছর আগে রাজেত মাতুব্বরের সামনে বা অগোচরে এই কথা কেউ বললে তার অবস্থা কী হতো বলা মুস্কিল। কারণ এই রাজেত মাতুব্বর তখন রাজেত শেখ, জমিদার মনোরঞ্জন বাড়–জ্যের নায়েব। কি হিন্দু, কি মুসলিম সব প্রজার সামনে মূর্তিমান ত্রাস। জমিদার মনোরঞ্জন বাড়ুজ্যের সুনাম মানুষের মুখে মুখে কিন্তু যখনই রাজেত শেখের নাম আসে তখনই মানুষ ছেলেপুলে নিয়ে ঘরে দোর দেয়। তখন অবশ্য জমিদারির শেষ পর্ব, চারদিকে কেমন ভয়, তবে ভয়টা শুধু হিন্দুদেরই। দেশ ভাগ হয়ে গেছে, নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে তখন রাজেত শেখদেরই জয়-জয়কার। ঠিক এই সময়ই রাজেত শেখ তার আরও সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে গভীর রাতে জমিদার বাড়িতে ডাকাতি করে। ঢেকিঘর থেকে ঢেকি তুলে নিয়ে এসে জমিদার-ঘরের দোর ভেঙে তারপর ঘরে ঢোকে। শুধু চোখ দু’টো বের করে কালো কাপড়ে সম্পূর্ণ মুখ ঢাকা। তারপরও মনোরঞ্জন বাড়–জ্যে ঠিকই চিনে ফেলেন রাজেত শেখকে। হাক দিয়ে ওঠেন, “রাজেত, তুইও?” রাজেত আর কি করে, রামদা দিয়ে গলা থেকে মাথাটা নামিয়ে দেয় জমিদারের। সেই রাতে অনেক ঘটনাই ঘটে, তবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চপলাকে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং ধর্ষণের পরে তাকে হেলই-খালের বিষ-কাঁটালি ঝোঁপের মধ্যে ফেলে রাখা। এরপর আর জমিদারি তো দূরের কথা, ওই বাড়িতেই বা থাকে কে? এমনিতেই অবশ্য যেতে হতো, যাওয়া শুরুও হয়েছিল কিন্তু সে রাতের পর যেনো আর কেউ দাঁড়াতে চাইলো না। তবে শেষ পর্যন্ত জমিদারের এক বিধবা বোন, শরবিন্দু থেকেই গেলো, ভিটেটুকু আঁকড়ে। তাও আর কতোটুকু, রাজেত শেখ তখন ওই বাড়ির ষাট-সত্তর বিঘে দখল করে বসে আছে। শুধু ঠাকুর ঘরটা আর কদম-ছায়া ঘেরা পশ্চিম-পুকুরের এক কোণে জমিদার বাড়ির নিজেদের শ্মশ্মানটুকু ছাড়া সবটাই রাজেতের দখলে। রাজেত তখন আর শেখ না, রাজেত তখন মাতুব্বর। সবাই চলে যায়, শুধু শরবিন্দু দিন-রাত কাঁদে। পশ্চিম-পুকুর, দিনের বেলায়ও সেখানে কেউ যেতে সাহস করে না। শরবিন্দু সারাদিন ওই পুকুরের চারপাশ ঘুরে বেড়ায়, সেখান থেকেই কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পায় তাই রাঁধে। বিধবা মানুষ, সেই নয় বছর বয়সে এই বাড়িতে ফিরে এসেছিল, এ বাড়ির কোথায় কি আছে তাতো শরবিন্দুর চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না, ওর অসুবিধে তাই হয় না খুব একটা। একটা মাত্র পেট, কচু সেদ্ধ, বেতের আগা ভর্তা সবতো হাতের কাছেই। শুধু কয়েকটা চাল হলেই চলে যায়, তা শরবিন্দু এদিক ওদিক ক’বাড়ি হাঁটলেই একমুঠো চাল ঠিক জোগাড় হয়ে যায়। আর এ চাল জোগাড়ে বেরিয়েই শরবিন্দু শুনিয়ে আসে জমিদার বাড়ির গোপন গোপন সব কথা। “আলো তোরা তো জানিস নে, ওই বাড়ির প্রেতিটা ধূলোয় যে মোহর লুকোনো। এইতো সেদিন পশ্চিম-পুকুরের ধারে শাক তুলতি তুলতি দেখলাম কচুরির মইধ্যে ডুবোনো ঘড়া, দেইখেই ভয় পালাম, ওখান দিয়ে তো হাঁটপার জো নাই, হাঁটতি গেলি পরে ফোঁস ফোঁস শব্দ, এখন এই অবেলায় আর নাম নেবোনি, সে ফোঁসফোঁসানি শুনেই টের পাওয়া যায়, এ অজাত-কুজাত নয়, এক্কেবেরে তেনারা গো, ঠুকরে দিলি আর দেখতি হবে নানে; তা আমারে অবশ্য তেনারা রেয়াত দিয়ে দেন, বিধবা মাইরে কি হবে বল দিকিনি? কিচ্ছু হবিনে, গত জম্মের পাপের ভারা যে এখনও পুন্নি হয়নি, আমার তো আরও বাঁইচে থাকতে হবে, তাই আমারে তেনারা দেইখেও দেখে না” Ñ এরপর শরবিন্দুর গলা নেমে আসে অনেক নীচুতে। যে বউটির কাছে দু’মুঠো চাল চাইতে আসা, তার ঠিক কানের কাছে মুখ নিয়ে শরবিন্দু আরও অনেক কিছু বলে, সেসব কিছুই শোনা যায় না, অন্ততঃ বাইরে থেকে। শরবিন্দুর বলা গল্প ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সবাই জানে, এই জমিদার বাড়ির চারদিকে পোঁতা আছে সোনার মোহর ভরা কলস। আকবরি মোহরও পাওয়া যেতে পারে খুঁজলে। শরবিন্দু অবশ্য মাঝে মাঝেই তামার কিছু পয়সা নিয়ে এদিক-ওদিক যায়, বউঝিদের হাতে দিয়ে চাল-ডাল কিংবা পুরোনো কাপড় নিয়ে আসে। তবে এলাকায় সবচেয়ে পুরোনো গল্প হলো মধুদীঘিকে নিয়ে। পুরোনো গল্প খুব, তাও শরবিন্দুর মুখে মুখে যেনো নতুন আর বিশাল হয়ে যায় ধীরে ধীরে। শরবিন্দুর মিশি নেওয়া দাঁত, দীঘল শরীর, সাদা থান, ময়লা হতে হতে পুরু হয়ে গেছে, এবরো-থেবরো করে ছাঁটা চুলের মাথাটা সমেত শরবিন্দুকে দেখায় ইতিহাসের মতো। চৈত্রের তেতে থাকা মাটির ওপর দিয়ে সরসর করে শরবিন্দু এইসব গল্প বলে কখনও কারও কাছ থেকে দু’টি টাকা, কিংবা একটি আঁধুলি, কখনও মুঠোখানেক চাল নিয়ে ফিরে আসে, তারপর ওর এখতিয়ারে থাকা জমিদার বাড়ির অংশে প্রতিদিন চুলো জ্বালে, ভাতের ভেতর যা কিছু জোগাড় করতে পারে তাই ফেলে দিয়ে সেদ্ধ করে নেয়, চুলোর আগুনেই খেয়েদেয়ে ভাঙাচোরা ঘরের এক কোণে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবে। ভাবে যতোদিন ও বেঁচে আছে এভাবেই জমিদার বাড়িতে বাতি জ্বালবে, তারপর আর কি? বারো ভ’তে লুটে খাবে। এখনই যে যেভাবে পারে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। গাছ-গাছালি ভর্তি বাড়ি, বছরের ফল-পাকুড় আর দেখার কি জো আছে? কুড়িয়ে-বাড়িয়ে নিয়ে যায়। অবশ্য কেউ ভয়ে বাগানের দিকটা মাড়াতে চায় না। এই বাগানে ঢোকা মানে সাক্ষাত মৃত্যু, মনসা’র ছানাপোনারা কিলবিল করছে। কেবল শরবিন্দুকেই ওরা চেনে। শরবিন্দু ভাঙা-চোরা ঠাকুর দালানের পৈঠায় বসে দেখে মধুদীঘি কাটা হচ্ছে। রোদের তেজে দীঘির ভেতর নেমে যাওয়া মানুষদের মনে হয় মহিষের মতো। আজকাল তো এই এলাকায় আর মহিষ দেখা যায় না, জমিদার বাড়িতে মহিষ আনা হয়েছিল হাল বওয়ানোর জন্য। এতো জমি, গরুগুলো পারতো না। তাই একপাল মহিষ আনা হলো। কিন্তু ফাল্গুন-চৈত্র মাসে অসহ্য গরমে মহিষগুলো এই মধুদীঘিতে নেমেছিল, কি আশ্চর্য দুপুরে ওরা নামলো, বিকেল নাগাদ ওদের উঠোতে গিয়ে দেখা গেলো একটা মহিষও নেই, পরদিন সবগুলো মহিষ ভেসে উঠলো মধুদীঘির জলে। সবাই কতো কি বলাবলি করলো, তারপর তো এই দীঘিতে আর কেউ নামতো না আর। পশ্চিম পুকুর কাটা হলো, দক্ষিণেও বাড়ির ছেলেদের জন্য পুকুর কাটানো হয়েছিল। দীঘি পড়ে থাকতো, শীতে গ্রীষ্মে বর্ষায় দীঘির ভেতর ঘাই মারতো অজানা সব মাছ, পারে দাঁড়ালে কেউ কেউ দেখতে পেতো ঢেকির মতো গজাল মাছ স্থির হয়ে রোদ খাচ্ছে। সেই দীঘি, এখন কি হয়ে গেছে। শরবিন্দু তাকিয়ে থাকে অপলক, কালো মুনিষরা মাথায় করে দিঘীর ভেতর থেকে মাটি তুলছে। কালো মিশমিশে মাটি। প্রতিদিনই এই মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে চিৎকার-চেচামেচি শোনা যায়, কোদালের কোপের সঙ্গে এটা সেটা উঠে এলেই চেঁচামেচি। রাজেত মাতুব্বর নিজে গিয়ে মাটির নীচ থেকে উঠে আসা জিনিসটা তুলে আনে বা কাউকে দিয়ে তুলে আনিয়ে ধুয়ে ধুয়ে সাজিয়ে রাখে উঠোনে। উঠোর ভরে গেছে নানা ধরনের জিনিসপত্রে। পেতলের কলসি, কাসার জামবাটি, ধামা, জগ, কতো কি? কিন্তু শরবিন্দু জানে, এখনও অনেক কিছুই বাকি। আসল জিনিসের তো এখনও কিছুই ওঠেনি। “আরে এই দীঘি কাটার সময় মানুষের রক্ত লেইগেছিল। দু’দু’টো কুমারী বলি হয়েছিল জানিস? সাত ঘড়া মোহর ঢেইলেছিল। সাত মন ধান, সাত মন গম, মুশুরি, কলই, সব ফসল দিতে হয়েছিল সাত মন করে। তারপর দুধ ঢেলে ছিল কতো ঘড়া তার শেষ নেই। পুরুত ঠাকুর কি বইলেছিল জানিস? জানিস না? তবে শোন। পুরুত ঠাকুর বলেছিল, যা যা এই দীঘিতে ঢালা হইচ্ছে, সব সোনা হইয়ে যাবে। তাহলেই বোঝ, এর তলায় কি আছে” Ñ দীঘি-কাটিয়েদের বাড়ি বাড়ি হেঁটে শরবিন্দু গল্প বলে যায়। মধুদীঘির তলায় লুকিয়ে থাকা ভাণ্ডারের গল্পে প্রতিদিনই কেউ না কেউ কোদাল হাতে চলে আসে, যদিও তাদের ডাকা হয়নি, তবু তারা আসে। খালেক-মালেক যদিও প্রথম থেকেই এই মাটি-কাটিয়েদের দলে ছিল। শুধু কি এই দীঘিকাটা? বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ওরা যা কিছুই করেছে একসঙ্গে করেছে। এমনকি বিয়েটা পর্যন্ত একই দিনে একই গ্রামে করেছে। ওদের গ্রাম থেকে বেশ দূরেই শ্বশুরবাড়ি। একই গ্রামের মেয়ে হওয়ায় ওদের বউদের মধ্যেও সম্পর্কটা খালেক-মালেকের বন্ধুত্বের মতোই। রাজেত মাতুব্বর যেদিন দীঘি কাটার জন্য ডেকে এলো, পরদিন ওরা দু’জনে একসঙ্গেই শুরু করেছিল দীঘি কাটার কাজ। প্রতিদিন সকালে শুরু হয়, শেষ হতে হতে সেই সন্ধ্যে। বৈশাখের ঢল নামার আগেই শেষ করতে হবে কাজ। বৃষ্টি একবার নেমে গেলে আর দেখতে হবে না, পাতাল থেকেও তখন পানি উঠতে শুরু করবে, এক রাতেই ভরে যাবে দীঘি। বহু কষ্টে অনেকগুলো দমকল বসিয়ে পানি সেচে ফেলা গেছে। পাঁচটা দমকল টানা দুই সপ্তাহ পানি সেচেছে। ভাগ্য ভালো যে আশে-পাশে অনেকগুলো পুকুর আছে, চৈত্র মাস বলে সেসব পুকুরে পানি ছিল না। সেগুলো এখন পানিতে টইটুম্বুর। খলবল করছে সিংগি-মাগুর, চৈতালি কৈ আর খলসে। কিন্তু মধুদীঘিতে জলের দেখা নেই। ওরা এখন মাটি তুলতে একবার নীচে নামলে শুধু দীঘির ওপরের আকাশটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। তার মানে গর্ত একেবারে কম হয়নি। চারপাশে মাটি কেটে অনেক চওড়া পার বাঁধানো হচ্ছে, রাজেত মাতুব্বর আর তার চেয়ারম্যান ছেলে নাকি এইখানে কলাগাছের বাগান করবে। কলার ব্যবসা এখন জমজমাট, বছরে যদি লাখ খানেক টাকার কলা আর কয়েক লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয় তাহলে আর কিছুর দরকার আছে নাকি? মাটি কাটা মুনিষরা মাটি কাটে আর এই সব হিসেব করে। তবে মাঝে মাঝেই একেকজন চিৎকার দিয়ে ওঠে, “ও ইদ্রিস দ্যাখতো এইডা কি ওঠলো? ” কি আবার? মালাউনগো হাড্ডি। চেয়ারম্যানের বাপেরে ডাক দে, আইসা তুইলা নিয়া যাবেনে। শালার কপাল দ্যাখছসনি? জমিজমা বাড়িঘর সব দখল করছে, এ্যাহন এই দীঘি কাটতে গিয়াও একটার পর একটা জিনিস ওঠফার লাগছে। হ, হুনছি চেয়ারম্যানের বাপ জমিদার বাড়–জ্যেরে এক কোপে খুন করছিল। তারপর জমিজমা বাড়িঘর সব দখল কইরা লইছে। আমাগো বাপে তখন কি করছিলো ক দি? কি আর করবে, বইসা বইসা বাল ছিঁড়ছিলো। শালা আমার তখন জন্ম হইলে দেখতি কি করতাম। শালা এ্যাহন একটা হিন্দুও নাই যে কিছু দখল-টখল কইরা নিবো। ওরা মাটি কাটতে কাটতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চেয়ারম্যানের বাবার সৌভাগ্যে ঈর্ষিত হয়। তারপর চৈত্রের রোদে গা পুড়িয়ে মাটি কাটে, দীঘির পার বাঁধে। তারপর সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরার জন্য দীঘির ভেতর থেকে উঠে আসে, তখন ওদের সারা গায়ে মাটি লেগে থাকে, দেখতে তখন কেমন যেনো লাগে ওদের। শুধু একদিন খালেক-মালেক দীঘির ভেতর থেকে উঠতে একটু সময় নেয়। সবার চোখ এড়িয়ে ওরা কি যেনো একটা সামান্য মাটি-চাপা দিয়ে ওপরে উঠে আসে। তারপর সবাইকে পেছনে ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। ঃ ভালোই হইছে, আইজ মনে হয় আমাবইশ্যা। কেউ আমাগো দ্যাখফেনানে। ঃ হ আমি তরে ডাইকা তুলবানে। তুই আবার ঘুমাইয়া পড়িস না য্যান। ঃ তুই কি কইস, ঘুম আসফেনে নি। তর কি মনে অয় ক দি? ঃ কি জানি? কলসিডা পিতলের। ওজন দেখছিস? কতো অবে ক তো? ঃ মনে হয় আইধ মন। ঃ কলসির মুখটা আবার কি দিয়া জানি আটকানো। আমি কোদালের আগা দিয়া মাটি সরাইয়া দেখছি। ঃ তুই কিন্তু আমারে কইস নাই, আমি দ্যাখলাম তোর চোখমুখ জানি কেরম ওইয়া গ্যাছে। আমি একটু আউ¹াইয়া আইসা দেহি তোর হাতে কলসিডা। আমিইতো কইলাম, চেয়ারম্যানের বাপেরে খবর না দেওয়ার লাই¹া। তহনই মনে হইলো যা থাকে কপালে, রাইতে এই দীঘিতে আইসা আমরা দুইজনে কলসিডা তুইলা নিয়া যাবানে। ঃ বুদ্ধিডা বালই। তয় আমার মনে অয়, আরও কেউ কিছু পাইছে, চুন্নুর কোমরে কী জানি একটা গুঁজা দ্যাখলাম, লুঙ্গিডা ফুইল্যা রইছে। ঃ যে পাইছে পাউক, আমরা যা পাবো তা কিন্তু দুইজনে সমান ভাগ কইরা নিবো, ঠিক আছে? ঃ তোরে থুইয়া আমি কোনও দিন কিছু খাইছি? আইজও খাবো না। তুই ঠিক সময়মতো বাইর ওইস কইলাম। ঃ ঠিকাছে। সেই সন্ধ্যাটা ওদের কাছে অন্যরকম মনে হয়। ভ্যাঁপসা গরম, খালেকের বউ রহিবোন আধ-ভাঙা একটি কড়াইতে দু’ফোঁটা সর্ষের তেলে তিন কোয়া রসুন ছেড়ে পুড়িয়ে কালো করে তাতে সেদ্ধ হেলেঞ্চা শাক ছেড়ে দেয়। খালেক চুলোর আগুন থেকে বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে ভাবে, হয়তো এই দৃশ্য খুব শিগগিরই বদলে যাবে। ভাঙা কড়াইয়ের বদলে নতুন সিলভারের কড়াই দেখতে পায় ও চুলোর ওপর। বিড়িটা ধরিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে ও টানে, তারপর কি মনে করে সেখান থেকে উঠে যায়। মালেকের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর মালেকের বউ চেহারোন ছোট্ট মেয়েটাকে ঘুম পারায়। মাটির ঘর যদিও, তারপরও একটু খানি বারান্দার মতো আছে, সেখানেই পাটি বিছিয়ে মালেক ঝিমায়, ঝিমুতে ঝিমুতে স্বপ্ন দেখে, অ™ভ’ত কোনও স্বপ্ন, যার আগা-মাথা হাত-পা কিছুই নেই। স্বপ্নের ভেতর ঘুমিয়েও পড়ে হয়তোবা। কতোক্ষণ কে জানে, অসুখে ভোগা মেয়েটা প্রতি রাতেই একটা নির্দিষ্ট সময়ে কেঁদে ওঠে, পাড়া জাগিয়ে কাঁদতে থাকে আজও। মালেক তখনই আবার জেগে ওঠে। জেগে উঠেই মনে হয়, আরে খালেক তো ওকে ডাকতে এলো না। রাততো কম হয়নি মনে হয়, তাহলে শালা নির্ঘাত ঘুমিয়ে পড়েছে। মালেক দ্রুত বিছানা ছাড়ে, প্রশ্রাবও পেয়েছে খুব, উঠোনের এক কোণায় বসে পড়ে ও। তারপর বেশ একটু হাল্কা হয়ে উঠে ঘরের দাওয়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো শাবলটা নিয়ে খালেকের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। “ও দোস্তো, কি ঘুম ঘুমাইলা? ওঠো, রাইতো বিয়ান ওইয়া গ্যালো, ও দোস্তো” Ñ মালেকের গলা এই নিশুতিতেও স্বরহীন শোনায়। কে জানে আবার যদি কেউ জেগে যায়। খালেকের দরমার বেড়ার দরোজা ধরে ঠেলতেই ঘরের ভেতর থেকে খালেকের বউয়ের গলার আওয়াজ শোনা যায়, “কিডা ভাইজান নি? এতো রাইতে কি ব্যাপার? উনিতো আপনাগো বাড়ির দিকিই গেলো মনে ওইলো। সে তো সেই আগ-রাইতে। এ্যাহনও ফিরলো না। আমিতো ভাবলাম আপনাগো বাড়ি গিয়া হুইয়া রইছে। কী ওইছে ভাইজান?” Ñ বলতে বলতে চেহারোন বাইরে এসে কাউকে দেখতে পায় না। শুধু ওদের বাড়ির পশ্চিম পাশ দিয়ে দুড়দাড় শব্দে কাউকে নেমে যেতে দেখে। ঠিক তখনই ছেলেটা কেঁদে ওঠে। ও চলে যায় ছেলেকে ঘুম পারাতে, শেষে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে। “খালেক শালা, বেঈমান, আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন। আমিই তোরে দেহাইলাম, আর তুই আমারে থুইয়া এ্যাকলা গ্যাছস সোনার কলস উঠাবার। খাড়া আমি আসফার লাগছি, শালা শুয়ারের বাচ্চা” Ñ মালেকের এক হাতে শাবল, লুঙ্গি কাছা মেরে মধুদীঘির দিকে দৌঁড়–তে দৌঁড়–তে ওর মুখ থেকে আগুন বেরুতে থাকে। দীঘির পারে এসে ও থমকে যায়, এখনও চারদিকে ছড়ানো ছিঁটানো মাটির ঢিঁপি, সমান করা হয়নি। নীচের দিকে তাকালে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। তারপরও ওর মনে হয়, ভেতর কি যেনো একটা নড়াচড়া করছে। ও নিশ্চিত হয়, মালেকই ওই কলসটা তুলে আনতে নীচে নেমেছে। ও নিজেও একটা মাটির সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করে। চোখে কিছুই দেখা যায় না যদিও, কিন্তু ও তো সারাদিন এখানেই ছিল, একটা আন্দাজ তো আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় সেখানে, যেখানে সন্ধ্যায় সামান্য মাটি দিয়ে কলসিটা ঢেকে রেখে গিয়েছিল। আর তখনই দেখতে পায় খালেক কলসিটা প্রায় তুলে ফেলেছে। যদিও দীঘির পার থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না আঁধারে, কিন্তু দীঘির ভেতরে নেমে বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে খালেকের হাত, কোদাল দিয়ে মাটি পরিষ্কার করে কলসিটা প্রায় তুলে এনেছে। মালেকের সমস্ত শরীর দিয়ে আগুন বেরুতে থাকে, আর ওর হাতের শাবলটি ঠিক গিয়ে নামে খালেকের আবছা মাথার ওপর, আঁধার থেকে পিচ্ করে মালেকের মুখে কি যেনো ছিঁটে এসে লাগে, খানিকটা বোধ হয় ঠোঁটের ওপরও লেগে থাকবে, নোনতা স্বাদটা তাই বুঝতে মালেকের কষ্ট হয় না। কিন্তু মালেকের তখন হুঁশ নেই, ও কলসিটা তোলার চেষ্টা করে। খালেকের কথা ওর আর মনে থাকে না, শুধু ওর খালি পা টের পায়, দীঘির মাটি ভেজা, শুধু ভেজা নয়, খুব দ্রুত ওর পা ডুবে যায়। ও প্রাণপন চেষ্টা করতে তাকে কলসিটা তুলে নিতে, তুলে নিয়ে ওপরে উঠতে হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু ওর হাত চলে না, শাবলটা ছিটকে পড়ে কোথাও, ও হাত দিয়ে ভেজা মাটি সরাতে থাকে, কিন্তু ওর হাঁটু ডুবে যায়, কলসিটাও মনে হয় ডুবে যাচ্ছে দ্রুত, ও হাতড়াতে থাকে জলের তলায়, হাতড়ে হাতড়ে জলের ভেতর কলসির বদলে একটা মানুষ শরীর ওর হাতে ঠেকে, ও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কলসিটা খুঁজতে থাকে। শুকনো মাটির ভেজা-গন্ধ নাকে এসে লাগে, যদিও গন্ধটা ঠিক মাটির মতো নয়, কিন্তু তাতে কি? ও কলসিটা খুঁজতে থাকে, সোনার মোহর ভরা কলসি, যদিও জল বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে। সে রাতে শুধু শরবিন্দুই মধু দীঘির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জলের শব্দ শুনেছিল।

মন্তব্য

আরশাদ রহমান এর ছবি

পড়লাম। ভালো লাগলো!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

শিরোনামে প্রকাশনার কথা না লিখে লেখার নীচে দিলে হতো। উপরে কেমন কেমন লাগছে।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আরে দিদি ওয়েলকাম ব্যাক। আপনার অসুস্থতার সময় ইমেইল করব করব করেও করা হয়নি। এখন ভাল আছেন নিশ্চয়ই।

শোহেইল ভাইয়ের সাথে গলা মেলাই, শিরোনামে প্রকাশের স্থান বললে বিজ্ঞাপনের মত শোনায়। অনুরোধ করি, গল্পর শিরোনাম শিরোনামে যাক আর কোথায় প্রকাশিত সেটা গল্পের শেষে যাক।

ধন্যবাদ।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আশা করি সুস্থ হয়ে উঠেছেন ।
সচলায়তনে আপনার নতুন গল্প পড়তে চাই ।
খালেক-মালেকদের মৃত্যু কিংবা ডুবে যাওয়ায় কিছুই বদলায়না আসলে- মাতব্বর,চেয়ারম্যান কিংবা জমিদারদের চেহারা পাল্টায় শুধু ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।