সাপের সঙ্গে দ্বৈরথ

রূপকথা এর ছবি
লিখেছেন রূপকথা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৬/০৮/২০০৮ - ৬:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূল: কেকে সামান কুমারা, শ্রীলংকা

আতুঁড় ঘরের ফটকটির সশব্দ কাতরানোর মতো আর্তনাদে যে নিস্পাপ মুখখানি এই মুহূর্তে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে পা রাখলো, সে আমারই সন্তান!
আর ঘরের মৃদু মোমবাতির আলোয় কফিনের মধ্যে শুয়ে আছে আমার প্রিয়তম স্ত্রী।

কী করব আমি? সেই মানসিক যন্ত্রনা ভুলতে আমি বুকের মধ্যে তুলে নিলাম আমার নবজাতককেই। এ ছাড়া আর কীই বা তখন করার ছিল আমার!
সেই দু:সহ যন্ত্রনা ভুলে ধীরে ধীরে আমার পৃথিবী আবার সবুজ হতে থাকলো। আমার সন্তান শিখে গেলো হামগুড়ি দিতে। শিখলো দাঁড়াতেও। একে একে ফুটতে শুরু করলো তার শাদা দাঁতগুলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সে কথা বলছে, যেমনটা বলে অন্য শিশুরা।

আমার হৃদয় শুধু ভালোবাসায়ই নয়, পূর্ণ হতে থাকলো পিতৃত্বে’র কেমন করা এক আকাঙ্খায়। প্রথমবারের মতো অনুভূত হওয়া সেই অনুভূতির কী নাম দেব আমি? আর কখনোতো এমনটা হয়নি আমার!

যখন পশ্চিম আকাশে সূর্যটা ঢলে পড়ে, কী এক লালিমা ভর করে আমার ঘরটিতে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। তবে কী প্রথমবারের মতো আমার ঘরে সূর্য হাসলো?
এক সময় আমার কন্যাটির পায়ের উরুগুলো হতে থাকলো চন্দ্ররেখার মতো। তার বুক স্ফীত হতে থাকলো পোশাক ফুঁড়ে। তার চোখদুটি সেসময় জ্বলজ্বল করছিল, অনেকটা তারার রং-এর মতো।

ঠিক এই সময়টাতেই অনেকটা হঠাৎ করে সাপটি মাটিতে এলো দিগন্ত কাঁপিয়ে। সন্তর্পণে আমি তাকে এড়িয়ে গেলাম, সাপটি আমাকে দেখতে পেলো না।
‘অনেকদিন পর আমার ক্ষুধা পেলো, আবারো।’

আর পৃথিবী টলতে শুরু করলো আবারো।
‘আবারো!’
এই তিন অক্ষরের শব্দটিই আমার কন্যা ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চারণ করতো। যাকে আমি ঠিক চিনতাম না।
চোখ, নাক, মুখ, কথা, হাঁটা-সব কিছু একই রকম। চিবুকের কাটা জন্মদাগটাও হুবুহু একই। সত্যি, এই কী আমার ছোট্ট, সুন্দর মেয়েটা, যে আমার রক্ত মাংস থেকে তৈরী?
আবারো সাপটি নড়ে উঠলো, ফোঁস ফোঁস শব্দে কেঁপে উঠলো পৃথিবী। কিন্তু ঠিক সেই দিনটির অনুভূতির মতোই আমি ক্রমাগত চূর্ণ হতে হতে আবারো নিজেকে ফিরে পেলাম কেমন করা ভালোবাসায়। আমার ছোট্ট মেয়েটির প্রতি যে ভালোবাসায় আমি আসক্ত হয়েছিলাম এক সময়-এ যেন সেই ভালোবাসা। আমার মাঝে যে বিষক্রিয়া কাজ করছিল তা এক লহমায় কেটে গেলো। তবে বিদায়ও নিল না চিরতরে।
যেদিন মেয়েটি অন্যের হাত ধরে চলে গেল আমার ঘর থেকে শেষবারের মতো, আমি নিরন্তর কেঁদেছিলাম। তখন কিন্তু সাপটিকে আমি একেবারে দেখিনি। কিন্তু সেই রাতে, ভোর হবার আগে সাপটি তার মাথা বের করতেই আমার চারদিকে হিস হিস শব্দটি ছড়িয়ে পড়লো। আর আমি দাঁড়ালাম ভয়াবহ এক সত্যের সামনে।
আমার রক্ত মাংসের ছোট্ট মেয়েটিকে আবিষ্কার করলাম সঙ্গমের বীভৎসতায়।
এটা নিশ্চিতভাবেই শয়তানী ছিল, যা শয়তান হয়তো নিজে তৈরী করেছে। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে সাপটিকে আমি আমার সমস্ত দেহের শক্তি দিয়ে প্রহার করতে থাকলাম। ব্যথায় একটু একটু করে কুকঁেড় যেতে থাকা সাপটির মাথা আর নাক রক্তাক্ত করে আমি চাইছিলাম, এটি যেন আর ফিরে না আসে।
সময়ের নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ে আমার চারপাশ থেকে একে একে মুছে যেতে থাকলো সাপটির সকল উপস্থিতি।

আর একদিন আমার মেয়ে ঘরে ফিরলো আর্তনাদ মাখা কান্না নিয়ে। উন্মত্তের মতোই সে ছুঁড়ে দিল নিজেকে আমার প্রতি। তার কপালে চুমু খেয়ে আলতো করে ছুঁয়ে আমি চেষ্টা করলাম শান্তি দিতে।

আবার সে আমার হলো। ক্রমাগত আমি তার বনস্পতির ছায়া হতে থাকলাম। আর ভালোবাসায় সিক্ত হতে থাকলো সে, যেমনটা বাবার কাছে হয় মেয়েরা।
এর পরই আরেক দিন, সাপটি গর্জন করে আমাকে মনে করিয়ে দিল কীভাবে আমার প্রিয় মেয়েটি একদিন ছেড়ে গিয়েছিল আমাকে।
প্রতিদিন আমি চাইতাম, সাপটিকে আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে এবং আশা আর প্রার্থনা করতাম, এটি যেন আর ফিরে না আসে। কিন্তু সব কিছুকে মিথ্যে করে, এটি তার কুৎসিত মাথা বের করত ঠিকই। যেন হঠাৎই মৃত্যু থেকে জেগে ওঠা। ক্রমশ আমি ক্লান্ত আর ভীত হতে থাকলাম, যদিও ছুঁেড় ফেলতে চাইতাম সবকিছু।
হঠাৎই যেন, সাপটি জীবন্ত হয়ে আমার সামনে রুদ্রমূর্তিতে ধরা দিল। আর আমাকে দংশিত করতে থাকলো তার বিষক্রিয়া দিয়ে। যদিও সেই বিষ আমি শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে আমার মেয়েকে দুই বাহুর মধ্যে আবদ্ধ করছিলাম। আমার দৃঢ় বাহুবন্ধন থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মেয়েটি। আর আমার মাঝে অদ্ভূত কিছু ছড়িয়ে দিয়ে ফেটে পড়লো আর্তনাদে।
সে অসহায়ভাবে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করল আর শেষে আমাকেই দায়ী করল তার অসহায়ত্বের জন্য, যেন অভিশপ্ত এক বাবা আমি।
সেদিন রাত গভীর হতেই আমার শরীর থেকে খুব দ্রুত বিষ নেমে যেতে থাকল। আর নিজেকে আমি আবিষ্কার করলাম চোখের জলে। মাথা দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকলাম মাটিতে। আমি একদমই তাকাতে পারছিলাম না আমার প্রিয় মেয়েটির মুখের দিকে, যে দাঁিড়িয়েছিল দু হাতে পাত্রভর্তি বিষ নিয়ে। যদিও তার হাত থেকে সেই বিষ ভর্তি পাত্র কেড়ে নিয়ে আমি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আর তার পায়ের কাছে নতজানু হয়ে কান্নায় ফেটে পড়ে ভিক্ষা চাইলাম করুণার।
অবশেষে দুজনেই দুজনার আশ্রয় হলাম আর বেদনায় আদ্র হয়ে পরস্পরকে ছুঁয়ে কাঁদলাম প্রবল আবেগে।
এবার পুরো মাত্রায় উন্মত্ত হয়ে আমি আক্রমণ করলাম সাপটিকে, চূর্ণ করতে থাকলাম সমস্ত শক্তি দিয়ে। আর নিষ্পেষিত করে ছুঁেড় ফেলে দিলাম আগুনে। লেলিহান অগ্নিশিখায় দেখলাম সাপটিকে দুমড়ে মুচড়ে যেতে এবং যেন শেষ বারের মতো একটা সুরেলা হাসি আমাকে রক্ষা করল সব অভিশাপ থেকে।

সেই দিন থেকে, এমনকি গাছের পাতার শব্দও আমাদের দুজনকে কী এক অনুভূতিতে জাগাতে থাকলো। ঘরের ছাদের ছোট্ট শব্দটিও আমাদের কাছে মনে হলো প্রকান্ড পাথরের শব্দ। ধীরে ধীরে বালিতে মুছে যেতে থাকল, সাপটির সর্বশেষ চিহ্ণটিও!
কিন্তু আরেক রাতেই আমি আমার পায়ের পাতায় শীতল একটা অনুভূতি টের পেলাম। এটা সেই অনুভূতি, যা আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা সময় বিজয়ের অনুরণন ছড়িয়েছিল।

এই অনুভতিতেই আমি পৃষ্ঠ হতে থাকলাম একে একে। আমার মেয়েকেও পীড়া দিতে থাকলো তা।
যদিও অনুভূতিটি বারবার ফিরে আসছিল, তবু আমাদের কোন তাড়া ছিল না-তা থেকে মুক্তি পাওয়ার। কারণ যখন অনুভূতিটি আসত, আমরা দুজনেই সর্বস্ব উজাড় করে অনুভূতিটি উপভোগ করতাম। আর অনুভূতিটি চলে যেতেই রাজ্যের লজ্জ্বা আর কান্না ভর করত দুজনকে ঘিরে। আমরা একে অপরের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারতাম না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না শুধু ওই অনুভূতিটি আমাদের গ্রাস করত।

গতকাল একটা বিকট শব্দ শুনলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম পাথরের স্তুপ আমাদের বাড়িটিকে ঘিরে ফেলল। সেই দৃশ্য দেখে মেয়েটি ভেঙ্গে পড়লো কান্নায় আর অভিশাপ দিতে থাকলো আমাকে, যেন সকল দুভার্গ্যরে জন্য আমিই দায়ী। সংক্রমিত কান্না আমাকেও ছুঁলো।

দুজনে মিলেই এবার চাইলাম, সাপটিকে চিরতরে শেষ করে দিতে। কিন্তু তা হয়তো আমাদের দুজনেরই সামর্থ্যরে বাইরে ছিলো। আর তাই তা একটু একটু করে বাড়তে থাকলো এবং অনেকটা দানব হয়ে আমাদের চারপাশে ঘুরতে থাকলো ভয়ংকর কিছু।

সাপটিকে হত্যা কিংবা ধ্বংস-কোনটাই কী আমরা করতে পারব না? সমস্ত শক্তি নি:শেষ করে আমরা প্রস্তুত হতে থাকলাম যে, আজ না পারলেও আগামী কোন এক দিনে আমরা সাপটিকে ঠিকই মারতে পারব। আমরা বিশ্বাস করতে থাকলাম, এটি মারা পরবেই। কিংবা হয়তো আরেকদিন, আমরা একসঙ্গেই মারা যাব, কোন এক শিলাখন্ডের পাশে।
---
লেখক পরিচিতি:
ছোট গল্পকার আর ঔপন্যাসিক-দুই পরিচয়েই পরিচিত শ্রীলংকান লেখক কে কে সামান কুমারা। তার প্রথম প্রকাশিত ছোট গল্প ‘ স্ট্রাগল উইথ আ সারপেন্ট’। প্রকাশের সময় ১৯৮৪ ইংরেজি। এ পর্যন্ত দুইটি উপন্যাসের রচয়িতা সামান কুমারার রয়েছে তিনটি ছোট গল্পগ্রন্থ।


মন্তব্য

সুমন সুপান্থ এর ছবি

ভালো লাগলো, রুপকথা । এটা কি সরাসরি সিংহলিজ ভাষা থেকে অনুবাদ করা ?
( চেনা যায়, পার্থ ? পুরোনো পুরোনো দিনের মুখ..... !)

---------------------------------------------------------

আমার কোন ঘর নেই !
আছে শুধু ঘরের দিকে যাওয়া

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

রূপকথা এর ছবি

না দাদা,অনুবাদটা ইংরেজী থেকে।
হ্যাঁ, চেনা যায়।
মনে পড়ে, মনে পড়ে, হৃদয় মেলতো পাখা......
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সবটুকু শুষে নেয়া ঘাম আর সবকিছু কেড়ে নিলেও স্মৃতিটা পোড়াতে পারেনি।
আর তাই করমচা রোদ খেলা করে এখনো........
ধন্যবাদ।

রূপকথা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দুর্দান্ত গল্প আর তার অনুবাদ

থার্ড আই এর ছবি

পড়তে গিয়ে এক বিন্দু থামিনি। কিছু পড়ছিলাম এমন মনে হয়নি বরং মনে হচ্ছিল আমি ঘটনাটা উপলব্দী করছি। মোট কথা আমি বাস্তবতায় ফিরে এসেছি যখন গল্পটা শেষ হলো।
অসাধারণ আপনার বর্ণনা শৈলী।
সচলে 'রুপকথা' মনে হয় আরেকটি সোনার পালক।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

স্নিগ্ধা এর ছবি

যদি আমি ঠিক বুঝে থাকি - খুব ব্যতিক্রমী এবং সাহসী একটা গল্প। লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য রূপকথাকে ধন্যবাদ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।