হাউস অব লর্ডস প্রাঙ্গনে যুদ্ধাপরাধীচক্রের বিতর্কিত সেমিনার

আরিফুর রহমান এর ছবি
লিখেছেন আরিফুর রহমান [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৩/০৬/২০১০ - ৫:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী বিচারের উদ্যোগ ও প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যে যুক্তরাজ্যে গৃহীত একটি উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। জাস্টিস কনসার্ন নামে একটি ভূঁইফোড় সংগঠন যুক্তরাজ্যের অল-পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ (এপিপিজিএইচআর) -এর মাধ্যমে এ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এ ঘটনায় এপিপিজিএইচআর-এর ভাইস চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভবেরির ভূমিকা নিয়েও বিভিন্ন মহলে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের প্রধান আশ্রয়দানকারী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। জাস্টিস কনসার্ন সেরকমই একটি সংগঠন, যার কোনও তৎপরতাই এর আগে যুক্তরাজ্যে দেখা যায়নি।

জাস্টিস কনসার্ন নামের এ সংগঠনটি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রয়াসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ইউ কে অল-পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ওপর ভর করার অপচেষ্টা চালায়। প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রচেষ্টায় তারা সফলতাও অর্জন করে এবং ২৩ জুন যুক্তরাজ্যে হাউস অব লর্ডসে এপিপিজিএইচআর-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ : আন্তর্জাতিক মান বিচার’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। জাস্টিস কনর্সানের তৎপরতা থেকে বোঝা গেছে যে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ সেমিনারকে খুবই গুরুত্ববহ করে তোলা এবং এতে বাংলাদেশের সরকার পর্যায়ের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করা। কিন্তু এ উদ্যোগে জাস্টিস কনসার্ন কেবল ব্যর্থই হয়নি, বরং তারা যে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত তা ফাঁস হয়ে যায়। ফলে এপিপিজিএইচআর-এর এ সেমিনারটি সম্পর্কে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, এপিপিজিএইচআর আয়োজিত সেমিনারটিতে উপস্থিতির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যোগাযোগের জন্যে যে টেলিফোন নাম্বারটি দেয়া হয়েছিল, সেটিতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালিয়ে গত ২১ জুন কথা বলা সম্ভব হয়েছে। এ সময় টেলিফোনটি ধরেন জাস্টিস কনসার্নের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। সেমিনারটির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‌জাস্টিস কনসার্ন আর এ আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত নেই। এটি আয়োজন করছে এপিপিজিএইচআর।’
এরপর এপিপিজিএইচআর অফিসে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার একজন কর্মকর্তা জানান, ‌এরকম কোনও ইভেন্ট-এ এপিপিজিএইচআর-এর সম্পৃক্তির কথা তাদের জানা নেই। এপিপিজিএইচআর-এর অফিস থেকে এরকম জানানো হলেও যুক্তরাজ্যে ওয়ার ক্রাইম স্ট্র্যাটেজি ফোরামের (WCSF) একজন সংগঠক জানিয়েছেন, ‌লর্ড অ্যাভবেরি তাদের সেমিনারে উপস্থিত থাকার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে তারা সুনির্দিষ্ট তথ্যপত্র উপস্থাপন করে জানিয়েছেন, এর সঙ্গে জামায়াতচক্র সংশ্লিষ্ট থাকায় উদ্যোগটির উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে বলে তারা এতে যোগ দেবেন না।

জানা গেছে, সেমিনারটি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ-এর উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে বলে প্রচার করা হলেও, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের টেলিফোন নাম্বারটি জামায়াত ঘরানার সুপরিচিত এক সংগঠকের। এটি নিশ্চিত হওয়ার পর ‘ওয়ার ক্রাইম স্ট্র্যাটেজি ফোরাম’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত একদল তরুণ বিষয়টি আরও বিশদভাবে জানার চেষ্টা চালান। তারা সাইটটি সম্পর্কে জানার জন্যে বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হন। তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে, যুক্তরাজ্যে জামায়াত-শিবির ঘরানার একটি সাপ্তাহিক ইউরোবাংলার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী কামাল শিকদারের নামে এই ডোমেইনটি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে, যিনি এক কালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির এর কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। সাইটটি রেজিস্টার করার সময় তার ব্যক্তিগত বাড়ির ঠিকানাও ব্যবহার করা হয়েছে। জাস্টিস কনর্সানের ওয়েবসাইটটিতে ‘কনটাক্ট আস’ এবং ‘অ্যাবাউট আস’ সহ বেশ কয়েকটি পেইজও সবার জন্যে উন্মুক্ত নয়। এর আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ- যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গোপনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন এবং যুক্তরাজ্যে আসার পর বাংলাদেশ ফোরাম অব ইউরোপ (BFE)-এর নির্বাহী সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ ফোরাম অব ইউরোপ যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ থেকে আসা শিবির কর্মীদের সংগঠন হিসেবে সুপরিচিত, যাদের আয়োজিত আলোচনাচক্রে কথিত যুদ্ধাপরাধী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকেও অতীতে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। এছাড়াও বিএফই এর সাথে আইএফই (Islamic Forum of Europe – IFE) নামের আরেকটি জঙ্গী-মৌলবাদ সমর্থক বিতর্কিত সংগঠনের যোগাযোগের বিষয়টিও সর্বজনবিদিত। উল্লেখ্য, আইএফই এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম হল – যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী কথিত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনউদ্দিন, যার বিরুদ্ধে একাত্তরের বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার সুষ্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। (এখানে এবং এখানে দেখুন)।

জানা গেছে, বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সেমিনারটিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এমনকি এ সেমিনারটিতে লর্ড অ্যাভবেরির ভূমিকা নিয়েও নানা সংশয় দেখা দিয়েছে। এ সেমিনারে ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন, অতএব এটিতে উপস্থিত না হলে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়বে ইত্যাদি যুক্তি দেখানো হয় জামাতমনস্ক লবিস্টদের পক্ষ থেকে। কিন্তু ‘ওয়ার ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম’-এর তথ্যপত্র থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে এ সেমিনারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকেও এতে কেউ যোগ দিচ্ছেন না।

তবে জাস্টিস কনসার্ন নামের সংগঠনটি এরপরও তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এরই অংশ হিসেবে আগামী ২৫ জুন শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে সংগঠনটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদের সভাপতিত্বে কুইন মেরির ম্যাসন লেকচার থিয়েটারে ‘বাংলাদেশ : গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং বাক-স্বাধীনতা’ শীর্ষক একটি সেমিনার। এতে প্রধান ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন যথাক্রমে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সেক্রেটারি ব্যারিস্টার মাহবুব হোসেন এবং ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা
বাদল।

মুক্তাঙ্গন থেকে ক্রসপোস্টিং.


মন্তব্য

সুরঞ্জনা এর ছবি

জামাতের তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে।
এই সব গোছানো পরিকল্পনার বহর দেখেও আমাদের শঙ্কিত হওয়া উচিত, এদের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কাজ-কর্ম কত সরল।
এসবের মাঝেও আশা জাগে এই জন্য, যে কিছু মানুষ ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছেন, হোক দেশে, হোক বিদেশে।
অনেক ধন্যবাদ পোস্টের জন্যে। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক এই তথ্য।
............................................................................
জগতে সকলই মিথ্যা, সব মায়াময়,
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয় ।

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

আরিফুর রহমান এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সংঘবদ্ধতা এখন সবচেয়ে জরুরী...
ধন্যবাদ পোস্টের জন্য
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

এতো কিছু করেও কি ইতিহাস বদলে দেয়া যাবে! এগুলো হচ্ছে আপাত বাঁচার জন্য খড়কুটো!

--- থাবা বাবা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।