গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ

এম. এম. আর. জালাল এর ছবি
লিখেছেন এম. এম. আর. জালাল (তারিখ: মঙ্গল, ০৯/১২/২০০৮ - ৯:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৩৯তম বার্ষিক সেমিনার ২০০৮
১৩-১৪ জুন, ২০০৮
আয়োজক-বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ

গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ

ডা. এম এ হাসান

যুদ্ধ, সংঘাত, জীবন এবং সভ্যতা:

“History of civilization is written in blood and tears”

যুদ্ধ মানেই নিষ্ঠুরতা এবং মানবতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন। তবুও কখনো যুদ্ধ করতে হয় নিজেদেরকে বাঁচাবার জন্য, আত্মরক্ষা করবার জন্য, একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখবার জন্য। তাই প্রতিরোধ যুদ্ধের সাথে আগ্রাসী যুদ্ধের রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান। প্রতিটি আগ্রাসী যুদ্ধই রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী পরিচালিত একটি ঙৎমধহরুবফ ঈৎরসব। একে রাষ্ট্র পরিচালিত সংঘবদ্ধ সর্বোচ্চ পর্যায়ের সন্ত্রাস বলা যেতে পারে। সম্পদ, জীবন, মানব মর্যাদা এবং সভ্যতা বিনাশী এই যুদ্ধের নিষ্ঠুর যাঁতাকলে সাধারণ জনগণই অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিষ্ট হয়। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আঘাতে বিশেষভাবে আক্রান্ত হয় নারী ও শিশুরা। কোন কোন যুদ্ধে আহত ও মৃতদের মধ্যে ৯০ ভাগই ছিল সাধারণ জনগণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৫ কোটি মানুষের মধ্যে ২.৬ কোটি ছিল বিভিন্ন দেশের সেনা সদস্য, ২.৪ কোটি ছিল নারী ও শিশুসহ সাধারণ জনগণ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নিরীহ জনগণের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে এবং ৯ মাসব্যাপী পাইকারী গণহত্যা এবং নির্যাতনের ফলে প্রায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হয় বলে ধারণা করা হয়। এই বিপুল সংখ্যক নরনারীর তুলনায় সকল পক্ষের সেনাসদস্য ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা অতি নগণ্য। এ প্রেক্ষাপটে সকলকে অনুধাবন করতে হবে- যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে কি ভয়ংকর এক অপরাধ।

আত্মরক্ষা ও জীবনের অধিকার মানুষের সর্বোচ্চ অধিকার হলেও এ অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে অনাদিকাল থেকে। তারপরও এই যুদ্ধের মধ্য থেকে, ধ্বংসের মধ্য থেকে, ছাই এর মধ্যে থেকে নতুন জীবন ও সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে অতীতে। অপরাধ সংঘটিত হবার পর মানুষের অনুভব, অনুশোচনা ও বোধোদয়ের কারণে মানুষকে বাঁচাবার ও সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখবার প্রণোদনা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে, যুদ্ধকে পরিহার করবার লক্ষ্যে অনুশোচনামূলক সংস্কারকে বেছে নেয়া হয়েছে, মূল্যবোধের নতুন সূচক নির্মাণ করা হয়েছে, নতুন দর্শন সৃষ্টি করা হয়েছে। এশীয় এবং সেমিটিক আগ্রাসী শক্তি Hyksos (Shephards) কর্তৃক খৃষ্টপূর্ব ১৭০০-১৫৭০ শতকে মিশর আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতেই ইহুদী সভ্যতার বিকাশ ঘটে। মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখবার জন্যই মুসার মূল্যবান গ্রন্থ Torah (The Law), Song of Solomon এবং Song of Deborah-রার মত অমর র্কীতির সৃষ্টি হয় সংঘাতোত্তর সমাজে। খৃষ্টপূর্ব ১২৩০ শতকে মিশরীয় রাজা Merneptah-র সময় এই ইহুদীরা মিশর থেকে বিতাড়িত হবার পর সমাজে সৃষ্ট আঘাত পুনরায় মানবতার বিজয়গাঁথা রচনায় ভূমিকা রাখে। সংঘাতময় মিশরীয় সমাজে রচিত হয় Hymn of Akhenaton (1360 B.C), The Wisdom of Amenemope. খৃষ্টপূর্ব ৫৮৬ শতকে ব্যবিলনীয় শাসক Nebuchadnezzar কর্তৃক জেরুজালেম ধ্বংসের পর সেখানকার মানুষের আহুতি মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা বিকাশে ভূমিকা রাখে। যুদ্ধ, সংঘাত ও বিদ্রোহের মধ্যেই ইহুদী ধর্ম থেকে সৃষ্ট হয় খৃষ্ট ধর্ম। এদিকে কলিঙ্গ যুদ্ধে নিষ্ঠুরতা ও মানবতার মৃত্যু সম্রাট অশোককে বুদ্ধ ধর্ম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করে। যুগে যুগে মানুষ হত্যা, ধ্বংস ও নিষ্ঠুরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। এভাবে বিশ্বযুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাবার জন্য বিশ্বস¤প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধের সীমারেখা বেঁধে দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে তৈরি হয় জেনেভা কনভেনশন, রচিত হয় যুদ্ধাপরাধ আইন, নির্দিষ্ট হয় গণহত্যার সংজ্ঞা।

যুদ্ধ ও সংঘাত অবসানে যেমন নতুন দর্শন ও মানবতার পক্ষে রায় ঘোষিত হয়েছে, অনুভবের নতুন ভূমি রচিত হয়েছে, তেমনি Paradoxically দর্শন ও doctrine-এর জন্যও যুদ্ধ হয়েছে। জার্মান দার্শনিক নীটশের বিভ্রান্ত দর্শন এর উদাহরণ। তিনি জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেছেন। ক্ষমতাধরদের কর্তৃত্বের কথা বলেছেন, ম্যাকিয়াভ্যালি যেমন সিজারের বন্দনা করেছেন তেমনি তিনি নেপোলিয়নের প্রশংসা করেছেন। তিনি যুদ্ধ ও আধিপত্যবাদের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি নারীর দাসত্বকে সমর্থন করেছেন। তাঁর দর্শনে উচ্চারিত megalomania ও নিষ্ঠুরতা জার্মান জাতির মানসে সঞ্চারিত হয়ে যুদ্ধে উন্মাদনা সৃষ্টি করে।

কোন কোন ধর্ম আপাতদৃষ্টিতে শান্তির কথা বললেও এর মর্মবানী সঠিকভাবে অথবা ভ্রমাত্মক কারণে যুদ্ধকে উস্কানী দেয়। জাতিগত ভাবেও কোন কোন জাতি কলহপ্রবণ ও যুদ্ধবাজ হয়ে থাকে। Aldoux Huxley যর্থাথই তাঁর ‘Ends and Means' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন “The various civilizations of the world have adopted fundamentally different attitudes towards war. Compare the Chinese and Indian attitudes towards war with the European. Europeans have always worshipped the military hero and, since the rise of Christianity, the martyr. Not so the Chinese. The ideal human being, according to Confucian standards, is the just, reasonable, humane and cultivated man, living at peace in an ordered and harmonious society. Confucianism, to quote Max Weber, ‘prefers a wise prudence to mere physical courage and declares that an untimely sacrifice of life is unfitting for a wise man.’ Our European admiration for military heroism and martyrdom has tended to make men believe that a good death is more important than a good life, and that long course of folly and crime can be cancelled out by a single act of physical courage.” সা¤প্রতিক বিশ্বে ক্ষমতাধর দেশগুলোর রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির অবিভাজ্য অংশ এই যুদ্ধ।

তারপরও সাধারণ মানুষ সব সময় মানবতার পক্ষে রায় দিয়ে আসছে। যুদ্ধকে প্রত্যাখ্যান করছে। অস্ত্র ছেড়ে অলিভ পাতাকে বেছে নিয়েছে।

খৃষ্টপূর্ব তিন শতক থেকে অর্থাৎ আলেকজান্ডার এর সময় (336-323 B.C) থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কমপক্ষে দেড় ডজন বড় মাপের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। এসব যুদ্ধের কোন কোনটি চলেছে শতবর্ষব্যাপী কিংবা তারও বেশি সময় ধরে। ফ্রান্স ও বৃটেনের মধ্যকার যুদ্ধ চলেছে একশ’ পনেরো বছর ধরে। একশ’ পঁচানব্বই বছরব্যাপী চলেছে খ্রিস্টান ও মুসলমান স¤প্রদায়ের মধ্যকার ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড)। চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, আটিলা দ্য হুন ইত্যাদি মঙ্গোল ও হুনদের নৃশংস যুদ্ধ, আলেকজান্ডারের যুদ্ধ, কলিঙ্গ যুদ্ধ, ওয়াটার লুর যুদ্ধ, ক্রিমিয়ার য্দ্ধু, রাশিয়া-জাপান যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কম্বোডিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়া-ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়ার যুদ্ধ, রুয়ান্ডা-কঙ্গো-শ্রীলঙ্কা ও এলসালভাদরের গৃহযুদ্ধ, পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সর্বশেষে সংঘটিত আফগান ও ইরাক যুদ্ধ, পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার জাতিগত সংঘাতসহ সকল ধরনের যুদ্ধ এবং সংঘাতগুলো পর্যালোচনা করলে অনুধাবন করা যায় যে সব যুদ্ধই মানব বিধ্বংসী ও মানবতাবিরোধী। তবে ভয়ঙ্কর যুদ্ধগুলোর মধ্যেও কিছু নিয়মনীতি মানা হয়েছে। অনেক যুদ্ধেই সাধারণ মানুষ, নিরস্ত্র মানুষ, আত্মসমর্পণকারী যোদ্ধা, যুদ্ধবন্দি, নারী ও শিশুদেরকে খুব কম আঘাত করা হয়েছে।

যেখানে রাজার সাথে রাজার যুদ্ধ হয়েছে, জাতি ও ব্যক্তির অহংবোধের সংঘাতের কারণে যুদ্ধ হয়েছে, কোন ধর্ম বা আদর্শ প্রচারের জন্য যুদ্ধ হয়েছে সেখানে নারী ও শিশুদেরকে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কম আঘাত করার একটি সচেতন প্রচেষ্টা ছিল। তবে পরদেশ লোভী, সম্পদ লোভী প্রায় সব যোদ্ধাই বিজিত দেশের ধনসম্পদের সাথে সাথে নারীদেরকেও পণ্য ও সম্পদ হিসাবে গণ্য করেছে। এরমধ্যে যারা নিষ্ঠুর, রক্তপিপাসু, সম্পদ ও নারীলোভী ছিল তারা দেশে দেশে কেবল নির্বিচার হত্যাকান্ডই ঘটায়নি; সেই সাথে ধ্বংস করেছে সুন্দর স্থাপনা, লুটে নেওয়া যায় না এমন ধরনের সম্পদ, কীর্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র এবং নির্যাতন করেছে সেখানকার নারীদেরকে। পৃথিবীর মানুষ নারীদেরকে বিবেচনা করেছে জমি-জেরাত, ভোগের সম্পদ ও গৃহপালিত জীব হিসাবে। আর আগ্রাসী ও বিজয়ীরা তাই স্বাভাবিকভাবেই নারীকে সবসময় বিজিত দেশের সম্পদ, ধনরতœ ও লুটের মাল হিসাবেই বিবেচনা করেছে। তাই তারা অরক্ষিত নারীকে নির্যাতন করেছে, বন্দী করে ধরে নিয়ে গেছে, যথেচ্ছ ভোগ করেছে, কখনও রক্ষিতা হিসাবে রেখে দিয়েছে, কখনও বিয়ে করেছে, কখনও সওদা করেছে, কখনও বা এদের স্থান হয়েছে পুরাকালের বেশ্যালয়গুলোতে।

অনেক যুদ্ধেই বিশেষ কোন জাতি বা গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ জাতি বা ধর্মাবলম্বীকে ঘৃণা ভরে নির্যাতন করে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে তাদের জন্মের চাকা থামিয়ে দেবার জন্য।
ভয়ংকর ঘৃণা ও বিদ্বেষের সাথে শত্র“পক্ষের প্রতিটি সৈনিককে বীভৎসভাবে খন্ড-বিখন্ড করা হয়েছে। তাদের পক্ষে সাধারণ নরনারীকেও নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করা হয়েছে। বলাৎকার করা হয়েছে তাদের মর্যাদা ও অধিকারকে। এ আক্রমণ থেকে শিশু, নারী কেউই রেহাই পায়নি। ইতিহাসের নায়ক আলেকজান্ডার ও ক্রুসেড খ্যাত সালাউদ্দীন আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন কীভাবে বন্দীর প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করতে হয়। বন্দীর প্রতি সেই মর্যাদা, সাধারণ মানুষের প্রতি সেই সমীহ বজায় রাখেনি অধিকাংশ নরপতি এবং সেনা নায়কেরা। বিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া বিশ্বযুদ্ধ ও বড় বড় যুদ্ধগুলোতে এমন সব মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে যা সাধারণ মানুষ ও তাদের সম্পদকে আঘাত করেছে। কোন কোন অস্ত্র তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার গন্ডি অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে তার বিষক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এসব অস্ত্রের আঘাতে পঙ্গু হয়েছে এবং হচ্ছে সাধারণ জনগণই।

স্থান ও কালোত্তীর্ণ এ collateral damage-কে ক্ষমাহীন অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে অপরাধীর শাস্তি বিধানে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ব সমাজ। তারপরও বিশ্বব্যাপী আইনের শাসন ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ন্যায়ের অধিকার, বিচারের অধিকার ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা সংক্রান্ত আইনগুলো প্রণীত হয়েছে। গত দুশ’ বছরের যুদ্ধগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যেখানেই জাতিগত বিদ্বেষ, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা, যুদ্ধ এবং ভায়োলেন্সের কারণ হিসাবে কাজ করেছে সেখানেই নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো ব্যাপকহারে সংঘটিত হয়েছে। প্রতিটি প্রতিশোধ যুদ্ধ ও প্রতিহিংসাপূর্ণ আঘাত (Reprisal Actions)-এর সাথে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জেনেভা কনভেনশনের মাধ্যমে যুদ্ধের নিয়মনীতি, যুদ্ধবন্দি এবং নিরীহ জনসাধারণসহ নারী ও শিশুর প্রতি আচরণগুলোকে সংযত ও সীমিত করার আইন পাশ করেছিল লীগ অব নেশনস। একই সাথে ব্যক্তি এবং স্থাপনার ওপর আক্রমণগুলোকেও সংযত ও সীমিতকরণের আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ যুদ্ধের এইসব আইনকানুন ও জেনেভা কনভেনশনের বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও আমরা দেখেছি সভ্য, অসভ্য সব ধরনের শক্তিমানরাই নিজেদের হীনস্বার্থ ও প্রতিহিংসার কারণে আঘাত করেছে সাধারণ মানুষকে। এদের রোষানল ও ভয়ঙ্কর নির্যাতন থেকে শিশু ও নারী কেউই রেহাই পায়নি। এটা অবশ্য সত্যি যে যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ বর্তমান পৃথিবীতে ব্যাপকহারে বেড়েছে। এমনকি শিশুরাও ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধে। বিশেষ করে গণযুদ্ধ ও স্বাধীনতার যুদ্ধগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এইসব যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের মধ্যে যৌক্তিকতাও রয়েছে। ইরিত্রিয়ার যুদ্ধসেনাদের প্রতি পাঁচজনের একজন নারী। আর তামিল লিবারেশন টাইগার্সের প্রতি তিনজনের একজন নারী। বিশেষ করে এলটিটিই’র নারীরা আত্মঘাতী বোমা বহনকারী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের শারীরিক বৈশিষ্টের কারণে এ কাজগুলো তাঁরা পুরুষদের তুলনায় নির্বিঘ্নে করতে পারছেন। এছাড়া নারীরা তাদের যৌন আবেদন ও স্পর্শকাতরতার কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক রক্ষণশীল দেশ ও সমাজে নানা বাধার মুখেও সহজ প্রতিরোধ্য নয়। এসব কারণে বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধে নারী ও শিশু প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে ঢাল হিসাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে যুদ্ধে নারী স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেভাবেই সম্পৃক্ত হোক না কেন তাঁর প্রতি প্রতিপক্ষের আচরণ ও আঘাত পুরুষ যোদ্ধা ও সাধারণের চেয়ে সবসময়ই ভিন্ন হয়। একজন নারী শুধু যোদ্ধা হিসাবে বিবেচিত হন না, মানুষ হিসাবেও বিবেচিত হন না, তিনি বিবেচিত হন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে একজন নারী হিসাবে, তাদের ভোগের পণ্য হিসাবে, নানাবিধ দুর্বলতার আধার হিসাবে।

এছাড়াও যুদ্ধ ও যুদ্ধক্ষেত্রগুলো যখন প্রচলিত নিয়ম ভেঙে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং যখন তা কোন সীমান্ত বা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না তখনই নিরীহ জনগণ ও নারীরা এই যুদ্ধের ফাঁদে আটকে যান। বাইরের আগ্রাসনের চেয়ে গৃহযুদ্ধগুলোতেই নারীরা বেশি আক্রান্ত হন। এতে নিরীহ নিরপরাধ নারীরা শুধু ভয়ঙ্কর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণেরই শিকার হন না, যুদ্ধে স্বামী সন্তান হারিয়ে, স্বজনহারা হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন।

যুদ্ধ ও সংঘাতে মানবাধিকার আইনের প্রয়োগ:

এসব কারণেই যুদ্ধাপরাধ আইন ও গণহত্যা সংক্রান্ত আইনগুলোর শক্ত প্রয়োগ প্রয়োজন। যুদ্ধ ও সংঘাতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অপরাধী চক্র প্রায়শই স্বাধীনতা যুদ্ধগুলোকে বিদ্রোহ বলে অভিহিত করে আন্তর্জাতিক আইনের বলয় অতিক্রম করতে চায় বলেই মানবাধিকার আইনের প্রবক্তরা বলেন-IHL is applicable in times of armed conflict, whether international or non-international. International conflicts are wars involving two or more states, and wars of liberation, regardless of whether a declaration of war has been made or whether the parties involved recognize that there is a state of war. Non-international armed conflicts are those in which government forces are fighting against armed insurgents, or rebel groups are fighting among themselves. Because IHL deals with an exceptional situation– armed conflict– no derogations whatsoever from its provisions are permitted. In principle, IHRL applies at all times, i.e. both in peacetime and in situations of armed conflict. .... Certain human rights are never derogated. Among them are the right to life, prohibition of torture or cruel, inhuman or degrading treatment or punishment, prohibition of slavery and servitude and the prohibition of retroactive criminal laws.

যুদ্ধাপরাধ আইন সংক্রান্ত বিভ্রান্তি এড়াবার জন্য এ আইনের পরিধি জনমানসে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধ আইন সেই সমস্ত অপরাধকে বিবেচনায় আনে যা কিনা যুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত হয়। এতে আক্রমণকারী ও তার সহায়ক শক্তি জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গ করে, যুদ্ধ ও সংঘাতে প্রযোজ্য আইনের সীমা অতিক্রম করলে তা যুদ্ধাপরাধ বলে পরিগনিত হয়। উদাহরণস্বরূপ- উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যা বা বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে আক্রমণ করে যুদ্ধ সংগঠন বৈধ নয়।

শত্র“র দেহ খন্ডবিখন্ডকরণ, তাঁকে বন্দী করে নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, সাধারণের সম্পত্তি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সবই অবৈধ। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতালসহ প্রতিরক্ষাবিহীন স্থান ও স্থাপনার উপর আঘাতও যুদ্ধাপরাধ। এমনকি লক্ষ্য বস্তুর বাইরে সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস সাধন, হত্যা ও শারীরিক ক্ষতিসাধনও যুদ্ধাপরাধ (উদাহরণস্বরূপ; জগন্নাথ হল হত্যাকান্ড)। অন্যায়ভাবে আটকিয়ে অথবা পরিকল্পিতভাবে কষ্ট ও দুর্ভোগ সৃষ্টিও যুদ্ধাপরাধ। জেলে হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধগুলোর অন্যতম। এটা মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ। এর উদাহরণ মেজর নাদের পারভেজ কর্তৃক বরগুনা জেল হত্যাকান্ড ও নারী নির্যাতন। ফরিদপুর জেলে নারী নির্যাতন আরেকটি যুদ্ধাপরাধের দৃষ্টান্ত। মানবতাবিরোধী অপরাধ আইনের পরিধি অনেক বিস্তৃত। সেখানে হত্যা, ধর্ষণ, গুম থেকে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত। ৭১-এ এদেশের মাটিতে এমন অসংখ্য অপরাধ হয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটেই ৭১-এর যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আইনগত বিভ্রান্তি এড়াবার জন্য কোনটি যুদ্ধাপরাধ, কোনটি গণহত্যা এবং কোনটি মানবতাবিরোধী অপরাধ তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

গণহত্যার সংজ্ঞা ও পরিধি:

১৯৪৮ সনের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০ (৩) এ-র অধীনে গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় যা বিশ্বময় প্রতিরোধে সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। এই গণহত্যা বলতে বুঝায় এমন কর্মকাণ্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় স¤প্রদায় বা নৃতাত্তি¡কগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে।
সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ২৬০ (৩) এ-র অনুচ্ছেদ-২ এর অধীনে যে কর্মকাণ্ডকে আইনগতভাবে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা হল-
(ক) পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদেরকে হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ।
(খ) তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন।
(গ) পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংসসাধনকল্পে এমন জীবননাশী অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে তারা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
(ঘ) এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া যাতে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর জীবন ধারণে শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নয়, সেই সাথে তাদের জন্ম প্রতিরোধ করে জীবনের চাকাকে থামিয়ে দেয়া হয়।
(ঙ) একটি জাতি বা গোষ্ঠীর শিশু সদস্যদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্মপরিচয় ও জাতিগত পরিচয়কে মুছে ফেলাকেও গণহত্যা বলা হয়।
ঐতিহাসিক কারণে এই গণহত্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় যে দায়বদ্ধ, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এটা প্রতিরোধকল্পে প্রণীত আইনগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
রেজ্যুলেশন ২৬০ (৩) এ-র অনুচ্ছেদ তিন অনুযায়ী গণহত্যাসাধন শুধু শাস্তি—যোগ্য অপরাধ নয়; গণহত্যা পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ যারা এ কাজে উদ্বুদ্ধকরনে সম্পৃক্ত থাকবে তারাও এই অপরাধের কারণে বিচারাধীন হবে। এই উদ্বুদ্ধকরণের ব্যাপারটি সরাসরি হোক, নিভৃতে হোক কিংবা জনসমক্ষে উত্তেজক বক্তব্যের মাধ্যমেই হোক তা সমভাবে গুরুতর অপরাধ। গণহত্যা সাধনে ব্যর্থ প্রয়াস বা এ জাতীয় প্রচেষ্টার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী বিচারযোগ্য অপরাধী হবে।

অপরাধী ও অপরাধ সংক্রান্ত বিশ্লেষণ:

১৯৭১-এ এদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া ঘৃণ্য অপরাধের একটিও জাতিসংঘ, মানবাধিকার হাইকমিশন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো কর্তৃক সত্যিকার অর্থে বিশ্লেষিত হয়নি। গণহত্যার সংজ্ঞা সম্পর্কে বিতর্ক ও মতভেদ থাকতে পারে, তবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ১৯৭১-এ এ দেশের মাটিতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডকে আমরা যে নামেই অভিহিত করি না কেন তার বিচার হতে হবে। ’৭১-এর নয় মাসে বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত যাবতীয় অপরাধের জন্য আমরা দায়ী করতে পারি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ভুট্টোকে। দায়ী করতে পারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অক্সিলারী ফোর্স রাজাকার, আলবদর, আলশামস, ইপিসিএফ ও রেঞ্জার্সসহ পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের সকল সদস্য, তাদের দোসর, শান্তি কমিটির সদস্য এবং বিহারীদেরকে।

আমরা যেমন দায়ী করতে পারি ইয়াহিয়া, টিক্কা, রাওফরমান আলী, জাহানজেব আরবাব প্রমুখ শীর্ষ পাকিস্তানি কর্মকর্তাদেরকে তেমনি দায়ী করা যায় তাদের অধস্তন সেনা অফিসার মেজর নাদের পারভেজ ও মেজর শেরওয়ানির মত ব্যক্তিকে। প্রধান উসকানিদাতা হিসেবে বিচার হতে পারে পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর। এ ক্ষেত্রে যখন প্রশ্ন উঠবে বাংলাদেশে গণহত্যার ব্যাপারে আমরা আর কাদেরকে দায়ী করতে পারি তখন জোরের সাথেই জানিয়ে দিতে হবে যে আমরা অবশ্যই সেই সমস্ত বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে বিচারাধীন করতে পারি যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ’৭১-এ গণহত্যা সাধনে সম্পৃক্ত হয়েছিল।
অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডে নিহতদের সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল-হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য এবং হত্যাযজ্ঞের প্রকৃতি। উদাহরণ হিসাবে কম্বোডিয়ার বিষয়টিকে টানা যায়। সে দেশে ১.৭ মিলিয়ন লোকের নির্মম হত্যাকাণ্ডকে সমগ্র বিশ্ব গণহত্যা বলেই জানে। সাধারণ ধারণায় বিষয়টিকে গণহত্যা বলে মনে হলেও আইনের দৃষ্টিতে সেটি হল ঈৎরসব ধমধরহংঃ যঁসধহরঃু ড়ভ সঁৎফবৎ। ঐ সময় কম্বোডিয়ার মাটিতে শুধু শিক্ষিত ও উঁচু পর্যায়ের লোক হবার কারণে তথাকথিত বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী পোলপট সরকারের হাতে যে বিপুল সংখ্যক লোক নিহত হয় তাদের চশমা ও হাড়গোড় দিয়ে তৈরি হয়েছে পাহাড়। এ হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য যেহেতু একটি জাতি বা গোষ্ঠী না হয়ে শুধু দেশের বুদ্ধিজীবী ও বিত্তবান শ্রেণী হয়েছিল তাই এটা গণহত্যা বলে বিবেচিত হবে না। ১৯৭১-এ বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ ও সামগ্রিকভাবে হিন্দু স¤প্রদায়কে নির্মূল করার সাথে সাথে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে এদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরকে। এ কারণে তারা যেমন স্থানে স্থানে হানা দিয়ে, বেছে বেছে তরুণদেরকে আটকিয়ে, চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের জন্য, তেমনি ঘরে ঘরে হানা দিয়ে তাদের সহযোগী শক্তি আল-বদর বেছে বেছে দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও গুম করে নির্মমভাবে তাঁদেরকে হত্যা করেছে দেশকে মেধাশূন্য করবার জন্য। সাধারণ অর্থে এ অপরাধকর্ম গণহত্যা বলে বিবেচিত হলেও আইনগতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি Crime against humanity of murder এর আওতাধীন হবে। এতে ন্যায়বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না এবং বিচারের সময়সীমা সকল প্রতিবন্ধকতা মুক্ত থাকবে। এরপরও বিষয়টি অনেকের কাছে একটি খবমধষ ঢ়ধৎধফড়ী বলে মনে হবে।

গণহত্যা প্রমাণের বিষয়টি শক্ত বিষয় হলেও ’৭১-এ বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডগুলোকে গণহত্যা বলে অস্বীকার করবার কোন পথ নেই। যেখানে হিন্দুকে হিন্দু বলে হত্যা করা হয়েছে বা হিন্দু নারীর স্বামীকে হত্যা করে, তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, হিন্দুর জন্ম ঠেকাবার জন্য তখন তা গণহত্যা বলেই প্রতিষ্ঠিত হবে। এমন ঘটনা অসংখ্য ঘটেছে। বাঙালিকে যখন বাঙালি বলে নিধন করা হয়েছে তখনও তা গণহত্যা বলেই বিবেচিত হবে।

১৯৭১: অপরাধ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ও কতিপয় অপরাধী:

১৯৭১ সনে ২৫ মার্চ ঘুমন্ত বাঙালী জাতির উপর অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ও তাদের দোসররা যে যুদ্ধ শুরু করে তা কোন অভ্যন্তরীণ সংঘাত, নাগরিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সাধারণ দমন বা দাঙ্গা ছিল না। এটা কোন বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ দমনও ছিল না। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত গণহত্যা এবং একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করবার নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়া। বেপরোয়া হত্যা, গণধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ এবং অন্যায়ভাবে নিরপরাধ মানুষগুলোকে বন্দী করে পাকিস্তানি শাসকেরা অন্যতম বৃহৎ একটি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকর্ম সম্পন্ন করে। এরপর তারা প্রতারণামূলকভাবে একটি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিদ্রোহ বলে অভিহিত করে তাদের সীমাহীন অপরাধগুলোকে লঘু করার চেষ্টা করে।

যে সকল রাজাকার, আলবদর, আল মুজাহিদ, ইপিসিএফ-এর সদস্য পাকিস্তানি সেনাদের দোসর হয়ে হত্যা, ধর্ষণ ও গুম সাধনে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেছে বা এই সব নষ্টকর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে তাদের অনেকেই নিজেদেরকে নিস্কলুষ হিসাবে দাবী করে সামগ্রিক অপরাধকে লঘু করবার চেষ্টা করছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দলিল দস্তাবেজ এর অভাবেই এমনটা সম্ভব হচ্ছে।

প্রকৃত সত্য হল এই যে, পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা ’৭১-এর ন’মাসে এক কোটিরও বেশি বাঙালীকে ঘর ছাড়া করে Forced migration-এ বাধ্য করে। এটাই তো একটা বড় যুদ্ধাপরাধ। প্রমাণ রয়েছে যে প্রথম ছয় মাসে হত্যা ও ধর্ষণের পর সম্মান ও সম্পদ লুট করে ভিটে মাটিতে আগুন দিয়ে ৬৯.৭১ লক্ষ (মার্চ-আগস্ট, সূত্র: বাংলাদেশ ডকুমেন্টস পৃষ্ঠা-৪৪৬, ভারত সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত) সংখ্যক হিন্দুদেরকে দেশ ছাড়া করে তারা ethnic cleansing- এর কাজটি সমাধা করেছিল। তারা দেশে প্রায় তিন হাজার হিন্দুকেও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক রতন লাল এই প্রক্রিয়ায় ধর্মান্তরিতদের মধ্যে একজন।

ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চলতি গবেষণা অনুযায়ী পাকি হানাদার ও তাদের দোসররা ১৯৭১ সালে দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চালায় তাতে প্রায় আঠারো লাখ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে বিজ্ঞানভিত্তিক একটি গবেষণায় (সূত্র: ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গবেষণা)। এর বাইরে আরো হিসাব রয়েছে।

এ যাবৎ গণকবর ও গণহত্যা স্পট আবিষ্ক্ৃত হয়েছে প্রায় ৯২০টি। ৮৮টি নদী ৬৫টি ব্রিজের উপরে হত্যা নির্যাতনের শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। চার লাখ ষাট হাজার নির্যাতিত নারীর পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনে পাকি দোসররা সহায়তা করলেও পাকিস্তানি বাহিনী নিজেরাই এই সমস্ত ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যায় অংশ নেয়। ধর্ষিতা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেক পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের নাম উল্লেখ করেছে।

’৭১-যারা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছে তাদের অনেকেরই ধারণা যে নিজ হাতে গুলি না চালালে বা ধর্ষণকাজে নিজে অংশ গ্রহণ না করলে আইনের বিচারে তারা নিস্কলুষ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, যে সমস্ত অক্সিলারী ফোর্সের সদস্য হত্যা, ধর্ষণে সহায়তা করেছে এবং অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে তাদের প্রত্যেকেই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। জেনে বুঝে ঘাতক আলবদর বাহিনীর সদস্য হওয়ার কারণে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের অধিকাংশ সদস্যেরই বিচার হতে হবে ন্যায়ের স্বার্থেই। তৎকালীন জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, মুসলীম লীগ, পিডিপি ও জামায়াতে উলেমার যে সব নেতা এবং শান্তি কমিটির সদস্য বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে মুক্তিকামী জনতা নির্মূলে প্রণোদনা সৃষ্টি করেছে, অস্ত্র নিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পত্তি বিনাশে কোন না কোনভাবে ভূমিকা রেখেছে, স্বাধীন বাংলাদেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংঘঠিত করেছে তারা সবাই আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞায় ক্ষমাহীন অপরাধ সাধন করেছে।

আলবদর সদস্য তথা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামাত সদস্যের মিথ্যাচার ও অভিযোগ অস্বীকারের প্রেক্ষাপটে তাদের নিজস্ব পত্রপত্রিকা এবং তাদের স্বলিখিত দলিলগুলো পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান নিজামীর প্রকৃত পরিচয় বেরিয়ে এসেছে ৭১-এর “দৈনিক সংগ্রাম”-এর পাতায় পাতায়। গোলাম আযম ১৯ জুন ৭১-এ যখন পিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাত করে পাকিস্তানি আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আহŸান জানায় এবং ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ শুক্রবারে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে শিক্ষা গ্রহণরত রাজাকারদের শিবির পরিদর্শন করে তাদেরকে উজ্জীবিত করে তখন তার অবস্থান ও পরিচয় সুচিহ্নিত হয়ে পরে।

পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ‘SUN SET AT MIDDAY’ শীর্ষক একটি গ্রন্থের লেখক তথা জামাতের ভূতপূর্ব আমীর মহিউদ্দীন চৌধুরী তার আত্মকথার ৬৬ পাতায় উল্লেখ করেন I was elected Secretary of District PDM and then District DAC. I was selected Secretary and then elected as Amir of District Jamaat-e-Islami in 1968. I was holding the post of District Jamaat till dismemberment of East Pakistan in 1971. In 1971 when peace committee had been formed to cooperate with Pakistan Army to bring law and order in East Pakistan, I was again elected Secretary, District Peace committee. wZwb Av‡iv D‡j­L K‡ib Among twenty District Amirs of Jamaat-e-Islami, peace committee presidents and secretaries only one’s citizenship was cancelled through Government Gazette, Bangladesh government had declared prize if that one could be arrested or killed, and that one was this humble author.

৭১-এর পর এই ব্যক্তি পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ড. আলী আশরাফ করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধানের পদটি ছেড়ে দিলে ঐ পদে মহিউদ্দিন চৌধুরী যোগ দেয়। এটা ছিল ৭৩-এর ২৬শে জানুয়ারীর ঘটনা। ইতোপূর্বে ৭২-এর ২৬শে মে, লাহোরে পৌঁছলে তার অভিজ্ঞতার বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন They recognized me and embraced me and laughed in a loud voice. I came to my senses and recognized them. One was Dr. Habibullah, brother-in-law of Nargis and the other was Ashraffuzzaman, Dhaka university student and a veteran Al-Badar leader. Dr. Habibullah was al-ways clean shaved; Now he had grown big mustaches that made difficult to recognize him, and Ashraf was clean shaved also; before hand he had very small beard.
After a stay of ten days at Sajjad murads residence we proceeded to Lahore as we were the guests of central Jamaat. We reached Lahore on 26th May 1972 at about 8 O’clock at night. Three Bengali speaking Jamaat workers including one Maulana Ali Hussain, a student of Dhaka University and an Al-badar and also and acquaintance of Dr. Habibullah and his wife came to Lahore station.

এখানেই স্পষ্ট হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যার খলনায়ক আশরাফুজ্জামান খান ও ড. হাবিবুল্লার সাথে জামাত ও আল বদরের সম্পর্ক।

কেন ৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত জামাতের প্রতিটি কর্মী এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে বিচার করতে হবে সে বিষয়টি পরিস্কার হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত “The Vanguard of Islamic Revolution: Jamaat-e-Islami of Pakistan” নামক গ্রন্থে। জামাতের গঠন ও সামাজিক ভিত্তির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এর ৬৬, ৬৭ পাতায় উল্লেখ করা হয় Not surprisingly the IJT was pushed further into the political limelight between 1969 and 1971 when the Ayub Khan regime collapsed and rivalry between the People’s Party and the secessionist Bengali party, the Awami League, resulted in civil war and the dismemberment of Pakistan. The IJT, with the encouragement of the government, became the main force behind the Jama’at’s national campaign against the people’s party in West Pakistan and the Awami League and Bengali secessionists in East Pakistan.36 The campaign confirmed the IJT’s place in national politics, especially in May 1971, when the IJT joined the army’s counterinsurgency campaign in East Pakistan. With the help of the army the IJT organized two paramilitary units, called Al-Badar and Al-shams, to fight the Bengali guerrillas. Most of Al-Badar consisted of IJT members, who also galvanized support for the operation among the Muhajir community settled in East Pakistan.37 Mati’u’r-Rahman Nizami, the IJT’s nazim-i a’la (supreme head or organizer) at the time, organized Al-Badar and Al-Shams from Dhaka University.38 The IJT eventually paid dearly for its part in the civil war. During clashes with the Bengali guerrillas (the Mukti Bahini) numerous IJT members lost their lives. These numbers escalated further when scores were settled by Bengali nationalists after Dhaka fell.

এসব তথ্য জানা প্রয়োজন ইতিহাসকে জানবার জন্য এবং সত্যকে জানবার জন্য। এর সবটাই সম্ভাব্য বিচারের জন্য দলিল হিসাবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
৭১-এর নয় মাসে দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার মধ্য দিয়ে যে অপরাধ সংঘটিত হয় তা কতটা বহুমুখী এবং কতটা বিস্তৃত ছিল তা অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ না করলে স্পষ্ট হবে না।

গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিবরণ:

“১৯৭১-এ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের দোসরগণ এ দেশের মাটিতে প্রায় ৫৩ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে। মোটা দাগে তারা ১৭ ধরনের যুদ্ধাপরাধ, ১৩ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ৪ ধরনের গণহত্যাসংক্রান্ত অপরাধ ঘটায়।

একাত্তরের গণহত্যাযজ্ঞ যে কতটা ব্যাপক, ভয়ঙ্কর ও পরিকল্পিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পাকিবাহিনীর অসংখ্য গণহত্যা স্পটের কয়েকটি চিত্র দেখলেই।
বাড়িয়া গণহত্যায় একই দিনে পাকি আর্মি হত্যা করে দুশ’জন নিরীহ গ্রামবাসীকে যাঁদের মধ্যে পঁয়তাল্লিশজন ছিলেন নারী। একইভাবে তারা ছাব্বিশাতে সাতজন নারীসহ চল্লিশজন, গোলাহাটে একশ’ জন নারীসহ চারশ’ তেরজন, বানিয়াচং থানার জিলুয়া-মাকালকান্দিতে ছাব্বিশজন নারীসহ একশ’জন, কড়াইকাদিপুরে ষাটজন নারীসহ তিনশ’ একষট্টিজন, হাতিয়া-দাগারকুঠিতে চল্লিশজন নারীসহ তিনশ’জন, সিলেটের বুরুঙ্গাতে হিন্দু স¤প্রদায়ের একশ’জন, শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে পঞ্চাশজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া খুলনার চুকনগর, বরিশালের আগৈলঝাড়া, মাদারিপুরের হাওলাদার জুট মিল, বরগুনা জেলখানা, জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ানসহ দেশব্যাপী অসংখ্য গণহত্যা স্পটের বিবরণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সন্নিবেশিত হয়েছে ‘যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’ এবং ‘যুদ্ধ ও নারী ’গ্রন্থে।
১৯৭১ সনে কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যার নৃশংসতার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে। বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকারে পরিণত হন ৩৬৬ জন গ্রামবাসী, মারাত্মক আহত হন আরও ১৩৪ জন।
এক সকালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর সহযোগী দালালরা প্রায় পনেরো’শ পুরুষকে বরইতলা গ্রামের রেল লাইনের পাশে জড়ো করে মিটিংয়ের নাম করে। তারপর এই লোকদের প্রায় অর্ধেককে উপস্থিত দালালরা আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত ইত্যাদি বলে পাকিস্তানি আর্মির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

অবশিষ্ট লোকদের একজনের বাহু অন্যের সঙ্গে বেঁধে রেল লাইনের ওপর বসিয়ে দেয়া হয় এবং ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ ধরনের শাবলের আঘাতে একে একে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা হয় প্রত্যেকের মাথা। এরপর মৃতদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এত কিছুর পরও যাঁদের দেহ একটু আধটু নড়াচড়া করছিল তাঁদের ওপর বেয়নেট চার্জ করা হয়।
সিরাজগঞ্জের বাগবাটির ভাদুরীচন্দ্র পাল জানিয়েছেন পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংস, নির্বিচার হত্যাকান্ডের কথা।

১৯৭১ সনে ভাদুরীচন্দ্র পাল বাগবাটি গ্রামে ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি তখন কুমোরের কাজ করতাম। সে সময় গ্রামে চুরি ডাকাতি খুব বেড়ে গিয়েছিল। তাই আমরা কয়েকজন মিলে রাতে পাহারা দিতাম। পাকিস্তানী বাহিনী যেদিন আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সেদিন আমার খুব পরিশ্রম হয়েছিল। তাই অন্য পাহারাদার যাঁরা ছিলেন তাঁদের বললাম, ‘আমি খুব ক্লান্ত, আজ রাতে পাহারা দিতে পারবনা।’ রাতে আর্মি এলে আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে আমাকে অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু তাদের ডাকাডাকিতে আমার ঘুম না ভাঙলেও গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। দেখলাম আমার ঘরের টিনের চালে গুলি এসে পড়ছে। তখন আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম চারিদিক শ্মশান হয়ে গেছে; কোথাও কোন লোকজন নেই। আমাদের বাড়ির পাশেই একটি ব্রিজ ছিল। দেখলাম পাকিস্তানি আর্মি ব্রিজের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটো মেশিনগান ফিট করে অবিরাম গুলি ছুঁড়ছে। এ সময় রাস্তায় আমার ভাই মন্টু চন্দ্র পাল ও চাচাতো ভাই সূর্যকান্ত পালের সাথে দেখা হয়। আমি তাঁদের বললাম, ‘তোদের পালানোর কোন পথ নেই।’ তারা তখন বাড়িতে চলে গেল, আর আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এ সময় দু’জন আর্মি দু’দিক থেকে এসে আমাকে ধরার চেষ্টা করে। আমি তখন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বাড়িতে যেয়ে উঠি। আমার বাবা তখন বাড়ির উঠানে বসেছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘বাবা, তুমি এখানে বসে, এদিকে তো আর্মি এসে গেছে। তোমাকে মেরে ফেলবে।’ বাবা বললেন, ‘আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে মারবে না, তোমরা পালিয়ে যাও।’ আমি তখন পালানোর জন্য কিছু জামা কাপড় ব্যাগে ঢুকাচ্ছিলাম। এমন সময় তারা গুলি করতে করতে আমাদের বাড়ির দিকে এল। আমি তখন ব্যাগ ফেলে দৌড়ে বাঁশঝাড়ে যেয়ে লুকিয়ে পড়ি। সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল। আমি দেখলাম, তারা আমার বাবাকে ধরে হাত বেঁধে বন্দুক দিয়ে দুটো বাড়ি মারল। তারপর বাবাকে তাদের ট্রাকের পেছনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করল। এ সময় তারা আমাদের বাড়িঘর গাছপালায় আগুন লাগিয়ে দেয়। গাছপালা আগুনে পুড়ে আমার গায়ে পড়তে থাকে।

“আমি তখন মনে করলাম, এখানে থাকা নিরাপদ হবেনা। বাঁশঝাড়ের পাশে শিয়ালের একটা গর্ত দেখতে পেলাম। ভাবলাম, শিয়ালের এই গর্তে ঢুকে প্রাণ বাঁচানো যাবে। প্রথমে দু’পা সেখানে ঢুকাতেই গর্তের মধ্যে আটকে গেলাম। ঐ গর্তের ভেতর তখন শিয়াল ছিল। প্রায় দু’ঘন্টার বেশি সময় ধরে আমি ঐ গর্তের ভেতরে ছিলাম। এমন সময় আর্মির বাঁশির আওয়াজ শুনে বুঝলাম তারা চলে গেছে। এরপর অনেক কষ্টে ঐ গর্ত থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে আসি। আমার শরীরের অনেক জায়গা সে সময় ছিড়ে কেটে গিয়েছিল। বাড়িতে এসে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখলাম। দেখি আমার বাবা, চাচা, ভাই সবাই মাটিতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। তারা আমার চাচা ও জ্যাঠার মাথায় গুলি করে। তাঁদের মাথা থেকে ঘিলু বের হয়ে মাটিতে পড়েছিল। আমার ভাইকেও মাথায় গুলি করা হয়।

“আমরা লাশ নিয়ে দাহ করতে যাব এমন সময় শুনতে পেলাম আর্মি আবার আসছে। তখন লাশগুলো ওভাবে রেখেই নদীর ওপারে পালিয়ে যাই। ভয়ে সেদিন আর ফিরে আসিনি। পরদিন বাড়িতে ফিরে লাশগুলো গলিত অবস্থায় দেখতে পাই। সেগুলো থেকে তখন গন্ধ বের হচ্ছিল। তখন আমরা কয়েকজন মিলে লাশগুলো কুয়োর মধ্যে ফেলে দেই। এরপর পুকুর পাড়ে যেয়ে দেখি সেখানে আর কয়েকটা লাশ পড়ে আছে। সে লাশগুলো শিয়ালে কামড়ে খন্ড বিখন্ড করে রেখেছিল। ঐ লাশগুলো সেখানেই আমরা মাটিচাপা দিয়ে রাখি। আমাদের পরিবারের যে চারজন শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন, সূর্যকান্ত পাল, যুধিষ্ঠির পাল, মন্টু চন্দ্র পাল ও গৌরচন্দ্র কর্মকার।”

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা সবচেয়ে বর্বরোচিত এবং নৃশংস গণহত্যা চালায় সৈয়দপুর শহরের কাছে গোলাহাটে।
১৩ জুন পাকিস্তানি আর্মি সৈয়দপুরের ১৫০ জন লোককে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁদেরকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার নাম করে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে নেয়া হয়। কৌশলে বন্দীদের পরিবারের বাকি সদস্যদেরকেও স্টেশনে আনা হয়। এই ফাঁকে চালানো হয় নির্বিচার লুটপাট।

ট্রেনের চারটি বগির পেছনের দুটোতে উঠানো হয় নারী ও শিশুদের এবং বাকি দুটোতে পুরুষদের। দু’কিলোমিটার যাবার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের একটি কালভার্টে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। তারপরই শুরু হয় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। একজন একজন করে নামানো হয় আর খোলা তলোয়ারের কোপে দু’খণ্ড করে ফেলা হয় তাঁদের দেহ। জানালা ভেঙে যাঁরা পালাতে চেষ্টা করেছিলেন তাঁদেরকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। গোলাহাটে পাকিস্তানিদের এই হত্যাকাণ্ড থেকে সেদিন তেইশজন পুরুষ পালাতে সক্ষম হলেও নারী ও শিশুদের কেউ পালাতে পারেনি। উপর্যুপরি ধর্ষণ শেষে নারীদেরকে হত্যা করা হয়। ঐদিন গোলাহাটে পাকিবাহিনী ৪১৩ জনকে হত্যা করে।

সে দিন গোলাহাটের গণহত্যা থেকে অলৌকিকভাবে জীবন বাঁচিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন তপনকুমার দাস, পিতা-হরিপদ দাস। তিনি সেই ৭১-এ সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে অবস্থিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প এর কথা বলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীদেরকে যেমন নির্যাতন করে জোরপূর্বক কাজ করিয়ে নেয়া হত, সেই রকম কাহিনীর কথা তিনি বলেছেন। যুদ্ধাপরাধের মধ্যে যে ধারাগুলো Crime of torture, Forced Labour, Slavery, Outrages upon personal dignity বোঝায় তার সবটুকুই প্রযোজ্য হয় ঐ ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, “একদিন শোনা গেল পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ঘাঁটি স্থাপনের জন্য সৈয়দপুরে একটি এয়ারপোর্ট নির্মাণ করা হবে। সেখানে কাজ করার জন্য একদিন আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমার বয়স একুশ-বাইশ বছর। আমার মতো এই এলাকার প্রায় প্রত্যেক যুবককেই তখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা সৈয়দপুর হাইস্কুল ও দারুল উলুম মাদ্রাসা ছাড়াও আরও দু’একটা জায়গায় ক্যাম্প করে, সেখানে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। বলা হয়, বিহারিরা যাতে আমাদের উপর অত্যাচার করতে না পারে সেজন্য ক্যাম্পে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা ছিল একটা প্রতারণা। আমরা যাঁরা এই ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাদের পাহারায় ছিলাম তাঁদের প্রত্যেককেই প্রতিদিন সকাল ছ’টায় সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে হাজিরা দিতে হত। আমাদের দিয়ে সেখানে পুরো তিন মাস শ্রমিকের কাজ করানো হয়। সেখানে আমরা ইট টেনেছি, পাথর টেনেছি, ইট বিছিয়ে “সোলিংও” করেছি। সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যে ছ’টা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে তারা আমাদের দিয়ে কাজ করিয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি। এভাবে কাজ করতে করতে আমাদের মনে হচ্ছিল এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো। কাজের মধ্যেই আমাদেরকে প্রচণ্ড মারপিট করা হত ও মানসিক যন্ত্রণা দেয়া হত। পেয়ারা নামে আমার এক বন্ধুকে একদিন ইলেকট্রিক চাবুক দিয়ে এমনভাবে মারল যে সে প্রায়ই মরেই যায়।”

তিনি উল্লেখ করেন, “তিন মাস পর দু’দিনের জন্য বাড়ি ফেরার পর জামাতে ইসলামী নেতা মওলানা আব্দুল কাইয়ুম, মতিন হাশমীসহ কিছু লোক তাকে আবার নিয়ে গেল পাকিস্তানি মেজর গুল ও হাবিলদার মেজর ফতেহ খানের নিকট। তারপর ঘটে গেল গোলাহাটের সেই ঘটনা।”

ছাব্বিশে মে বালাগঞ্জের বুরুঙ্গাতে সংঘটিত হয় আরো একটি নারকীয় গণহত্যা। শেরপুর থেকে ক্যাপ্টেন দাউদ খানের নেতৃত্বে পাকি আর্মি এখানে আসে। তারা মিটিংয়ের নাম করে প্রায় একহাজার গ্রামবাসীকে স্থানীয় স্কুলমাঠে জড়ো করে। তাঁদের মধ্যে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, তাঁর ছোট ভাই এবং তাঁর বাবা ছিলেন।
শ্রীনিবাস চক্রবর্তী জানান, এদের মধ্য থেকে বেছে নেয়া হিন্দু স¤প্রদায়ের প্রায় একশ’জন নিরীহ লোককে লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে ব্রাশ ফায়ার করে পাকিসেনারা। চোখের পলকেই মানুষের মাথা, দেহ, হাত-পা সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর হাতে গুলি লাগে। এ সময় একটা একটা করে গুলি করছিল পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে মরার মতো পড়ে থেকে শ্রীনিবাস চক্রবর্তী অলৌকিকভাবে রক্ষা পান।

এরপর কেরোসিন ঢেলে মৃতবৎ সবার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলে যারা তখনও বেঁচে ছিল তারা আগুনের তাপে চিৎকার করে ওঠে। আর্মি তখনও মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে পারেনি। চিৎকারের শব্দ শুনে তারা ফিরে আসে এবং গুলি চালায়।
এত সব কিছুর পর আর্মি কিছুদূর চলে গেলে মানুষ পানি পানি বলে চিৎকার করে ওঠে। তাতে পাকি সেনারা ফিরে এসে আবার গুলি চালায়। ঐ সময় একটা গুলি এসে লাগে শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর পিঠে। তারপরও ঈশ্বরের ইচ্ছায় শ্রীনিবাস গণহত্যা স্পট থেকে সরে যেতে সক্ষম হন। শুধু হিন্দু বলেই অনেককে গণহত্যার শিকার হতে হয়েছে ৭১-এ।

বুদ্ধিজীবী হত্যার খন্ডচিত্র ফুটে উঠেছে অধ্যাপক ফরিদা বানুর বক্তব্যে। শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু বলেন, ১৪ই ডিসেম্বর ৭১-এ এক ফোঁটা পানি ছিল না কোয়ার্টারের ট্যাপে। মহসিন হলের হাউজ টিউটর ছিলেন-শহীদ গিয়াসউদ্দীন। থাকতেনও মহসিন হলের হাউস টিউটর কোয়ার্টারে। পানি না পেয়ে পানির পাম্পের মিস্ত্রি খুঁজতে বাসা থেকে নীচে নেমে গেলেন গিয়াসউদ্দীন সাহেব। আগের দিন ডিএসপি পরিচয়ধারী এক ব্যক্তির আচমকা টেলিফোনের কথাটি তখন তাঁর মাথায়। পুলিশের এক অফিসার ১৩ই ডিসেম্বর তাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিল ৭১ ও ৭২ নম্বর ফ্ল্যাট দুটো খালি করে দিতে হবে পাকিস্তানি মিলিটারীদের জন্য। এসব কথা ভাবতে ভাবতে লুঙ্গি পরেই তিনি এখানে ওখানে ছুটছিলেন মিস্ত্রীর জন্য। সে সময় ফরিদা বানু তার স্বামীকে নিয়ে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। সকাল ৮টা হবে। ঠিক সে সময় কাঁদামাখা ইপিআরটিসির মাইক্রোবাস বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। খাকি শার্ট পরা চার-পাঁচ জন লোক ঐ বাস থেকে নেমে এল। ওদের দু’ জনের হাতে রাইফেল। একজনের গায়ে কালো সোয়েটার। সে সময় তারা দেখলেন যে, তাদের একজন প্রভোষ্ট অফিসের সামনে টেলিফোনের লাইন কাটছে। এর চার/পাঁচ মিনিট পর তারা দরজায় ঠক ঠকালো। সে সময় তাদের ভাই গোলাম কিবরিয়া দরজা খুলে দিলে মাইক্রোবাসে আসা দুইজন আগন্তুক ঘরে প্রবেশ করল। একজনের হাতে রাইফেল। এসে খোঁজ করল গিয়াসউদ্দীনকে। তিনি বাসায় না থাকায় তারা প্রথমে চলে গিয়ে আট/দশ মিনিট পর আবার ফেরত এল। সারা ঘরময় গিয়াসউদ্দীনকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাঁকে না পেয়ে গোলাম কিবরিয়াকে ওরা চেপে ধরল। তারা জিজ্ঞাসা করল, গিয়াসউদ্দীন কোথায়? গিয়াসউদ্দীনকে খুঁজে পাবার জন্য তারা তখন তাকে ধরে নিয়ে গেল। যেখানটায় পানির পাম্প ছিল সেখানটায় নিয়ে গেল। এর মধ্যে মাইক্রোবাসটি প্রভোষ্ট অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল, গিয়াসউদ্দীন ওখানেই ছিলেন। তাঁকে আটকিয়ে, হলের গার্ড আব্দুর রহিমের গামছা দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে ফেলে ঐ দস্যুরা। এরপর তাঁকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে গেল। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু প্রগতিশীল অধ্যাপককেও এমনভাবে গুম করে ফেলা হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), অধ্যাপক রশীদুল হাসান (ইংরেজী), অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), ড. ফয়জুল মহী (ইসলামী শিক্ষা), ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক ও ডা. মুর্তজা।

৪ঠা জানুয়ারী এদের ক্ষত বিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায় মীরপুর গোরস্থানে। নৃশংস অত্যাচারের পর এঁদের স্বহস্তে গুলি করে আশরাফুজ্জামান নামক আলবদরের এক ঘাতক। এই বিষয়টি ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘পূর্বদেশ’-এ প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এই সময়ে আশরাফুজ্জামানের ডায়েরীটি প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যে গাড়িতে করে শিক্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয় তার চালক মফীজউদ্দীন পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য জানায়। আল-বদর, ইপিসিএএফ এবং অবাঙালি আলমুজাহিদ বাহিনীর সমন্বিত অপরাধের কুখ্যাত দৃষ্টান্ত এটি।

ঢাকার বাইরে বুদ্ধিজীবী হত্যার না বলা কাহিনীগুলো উঠে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসতুরা খানম এর বক্তব্যে। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে কতিপয় ঘাতকের কথা। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আসলাম, লে. কর্নেল তাজ, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন তারেক-এই সমস্ত ব্যক্তি কীভাবে বুদ্ধিজীবি হত্যায় সম্পৃক্ত হয়েছিল তা ভুক্তভোগীর জবানবন্দীতে স্পষ্ট হয়েছে।

১৯৭১ সনের ২৫ নভেম্বর। মাসতুরা খানম তখন তিন ছেলের মা। পাকিস্তানি রাজশাহী দখলের পর ঘাঁটি গেড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজে। এপ্রিলের শেষ দিকে চারঘাট থানার আলাইপুর গ্রামে মাসতুরা খানম সপরিবারে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু জুলাইয়ের শুরুতে রাজশাহীতে ফিরে আসেন। রেডিয়োতে বারবার কাজে যোগ দেবার কথা শুনেই ফিরে আসেন তাঁরা। তাঁদের রাজশাহী শহরের বাড়িটা তখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ২৫ নভেম্বর মাসতুরা খানম ঘোড়ামারায় বাবার বাড়িতে ছিলেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে তৎকালীন রেজিস্ট্রারের অবাঙালি স্টেনো তৈয়ব আলী মীর আবদুল কাইয়ুমকে নাম ধরে ডেকে বলেন, ‘একজন ক্যাপ্টেন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, একটু আসুন।’ শরীর খারাপ থাকায় আগামীকাল দেখা করবেন বলার পরও দু’মিনিটের জন্য আসতে বলে লোকটি। লুঙ্গির উপর শার্ট চাপিয়ে আইডি কার্ড হাতে নিয়ে বেরিয়ে যান কাইয়ুম সাহেব। এমতাবস্থায় হতভম্ব হয়ে বাবা ও ভাইকে ডাকাডাকি করছিলেন মাসতুরা খানম। এ সময় তৈয়ব আলী ফিরে এসে জানায় যে পাকি সেনারা কথা বলতে বলতে তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে।

এরপর স্বামীর আর কোন খবর পাননি তিনি। মাসতুরা খানমের গর্ভে তখন সাত মাসের সন্তান। স্বাধীনতার পর ৩০ ডিসেম্ব^র বোয়ালিয়া ক্লাবের কাছে পদ্মার চরের বাবলা বনে একটি গণকবর পাওয়া যায়। সেখানে এক দড়িতে চৌদ্দ জনের লাশ বাঁধা ছিল। এই চৌদ্দ জন শহীদের মধ্যে ছিলেন মীর আবদুল কাইয়ুম। শীতের দিন বালুর চাপে তাঁর লাশ প্রায় অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

ক্যাম্পে আটক নিরীহ নারীদের ওপর পাকি সেনাদের বর্বরতার বিবরণ পাওয়া যায় ঝিনাইদহের রিজিয়া খাতুনের জবানবন্দি থেকে। যুদ্ধের শুরুতে পাকিবাহিনীর আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় ধরা পড়েন রিজিয়া খাতুন। শৈলক‚পার রাণীনগরের কাছে পাকিবাহিনীর এক ক্যাম্পে তিনি বন্দী হন। দুর্বিষহ ও ভয়ঙ্কর ছিল সেই বন্দী জীবন। আলোবাতাসহীন ছোট একটা কক্ষের মধ্যে আরও মেয়েদের সঙ্গে তাঁকে থাকতে হত। কিল, ঘুষি, লাথি এসব ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। এর পাশাপাশি চলত পাকিদের উন্মুক্ত পাশবিক নির্যাতন। এই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে রিজিয়াসহ অনেককেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গলায় দেবার দড়ি তো দূরে থাক কাপড়টুকু পর্যন্ত তিনি পাননি। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদেরকে কাপড় পরতে দিত না। ব্লাউজ, কামিজ এসব পরে থাকতে হত। ক্যাম্পে এভাবে নির্যাতনে নির্যাতনে তিনি একসময় অন্তঃসত্ত¡া হয়ে পড়েন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা ওষুধ প্রয়োগ করে তাঁর গর্ভস্থ সন্তানকে নষ্ট করে দেয়।

পাকিস্তানি সেনাদের বীভৎস পাশবিক লালসা থেকে ন’বছরের শিশু সন্ধ্যাও রেহাই পায়নি। একাত্তরের জুন মাসে ঝালকাঠির কুড়িয়ানা আক্রমণ করে তারা। সন্ধ্যা, তার মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ছুটে পালাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁরা সবাই ধরা পড়ে আটক হন কুড়িয়ানা স্কুলে পাকি সেনাদের ক্যাম্পে। তাঁরা চারদিন ঐ ক্যাম্পে আটক ছিলেন। কিন্তু তাদের নির্মম নির্যাতন থেকে কেউই রক্ষা পাননি। ঐ জানোয়াররা শিশু সন্ধ্যার ওপর এমন বীভৎস নির্যাতন চালিয়েছিল যে, কষ্ট, যন্ত্রণা আর বিরামহীন রক্তপাতে সে নির্জীব ও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। এর ক’দিন পরে সে মারা যায়।

একাত্তরে বরগুনা জেলখানায় পাকি সেনাদের নির্যাতনে পিষ্ট এক নারী পুতুল রাণী রায়। সেসময় তিনি সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন। তিনি জানান, বর্বর পাকিরা কারাগারের অভ্যন্তরে আটক সকল মহিলাকে পালাক্রমে বীভৎসভাবে ধর্ষণ করেছে। প্রতিরাতে আটক মহিলাদের মধ্য থেকে বেছে বেছে কয়েকজনকে বের করে তাদের প্রমোদ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলোতে নিয়ে যেত। সারারাত ধর্ষণ নির্যাতন শেষে পরদিন সকালে তাঁদেরকে জেলখানাতে ফিরিয়ে নিয়ে আসত। পুতুল রাণী যেদিন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন ঐদিনই মধ্যরাতে তারা তাঁকেসহ চারজন মহিলাকে পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলোতে নিয়ে যায়। সেখানে চারজন পাকি আর্মি তাঁদের চারজনের ওপর সারারাত পাশবিক নির্যাতন চালায়। তারা ধর্ষণের আগে তাঁদেরকে ভয় দেখিয়েছে, বুকের ওপর বন্দুক তাক করে ধরেছে। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার ছিল না। এই চারজনের একজন ছিলেন অন্তঃসত্ত¡া। নির্যাতনের তিন চারদিন পরে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। এ নির্যাতনের নেতৃত্ব দেয় মেজর নাদের পারভেজ।

যুদ্ধের ন’মাস পাকিস্তানি সেনারা যে কতভাবে আমাদের নারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তা ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ না করলে বোঝা যাবে না। শহর ও গ্রামের যুবতী নারীদেরকে এরা কখনও বন্দী করে নিয়ে গেছে নিজেদের ক্যাম্পে ও বাঙ্কারে। দিনের পর দিন সেখানে তাঁদেরকে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করেছে, ইচ্ছে মতো সম্ভোগ করেছে। তাদের ঘাঁটি ও ক্যাম্পের আশপাশের অনেককে বাধ্য করেছে দিনের পর দিন তাদের কাছে হাজিরা দিতে। কখনও স্বামীহারা মেয়েদেরকে তারা নির্দেশ দিয়েছে নিজ ঘরে থাকবার জন্য, পাহারার ব্যবস্থা করেছে যাতে তারা পালিয়ে যেতে না পারে অন্য কোথাও। এরপর এসব মেয়েদের কাউকে কাউকে পাকি সেনাদের সম্মিলিত সম্ভোগের জন্য যৌনকর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। এইসব নারীদেরকে অসংখ্য পাকি আর্মি সম্ভোগ করেছে, ইচ্ছে মতো তাঁদেরকে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে নিয়ে গেছে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরিয়েছে। ক্যাম্পের পরিবর্তন হলে তাঁদেরকে সাথে নিয়ে গেছে পরবর্তী গন্তব্যে।

ঘাতকের এই অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতায় সভ্য সমাজ বিস্মিত না হয়ে পারে না।

ঘাতকের মনোবিশ্লেষণ

কী মনোভাব নিয়ে গণহত্যার খলনায়কেরা মানুষকে মানুষ বিবেচনা না করে নিষ্ঠুর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে উন্মাদ হতে পারে তা মনোবিজ্ঞানীদের নিকট গবেষণার বিষয় এবং সাধারণের নিকট বিভ্রান্তির বিষয় হয়ে আছে বহুকাল ধরে। কীভাবে মানুষ মানুষকে কীট পতঙ্গের মতো নিষ্পেষিত করে, অতুলনীয় নিষ্ঠুরতায় খন্ড বিখন্ড করে এবং মানবদেহকে নিরেট এবং জীবনের মধ্যবর্তী স্থানে বিবেচনা করে বলাৎকার করে তা নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ষ্পষ্ট হয়েছে যে, মানুষকে মানুষ মনে না করার কারণে, তাঁকে সম্পূর্ণ মানব মর্যাদা শূণ্য করার কারণে এবং সামগ্রিকভাবে উবযঁসধহরুধঃরড়হ করার কারণেই ভয়ংকর, বীভৎস ও অকল্পনীয় নিষ্ঠুর কর্মটি সম্পাদন সম্ভব হয়। ঘাতক ঘটনার শুরুটিকে নিজস্ব ধারণা, দর্শন, ইচ্ছা ও গোপন এষণা অনুযায়ী সাজিয়ে নেয় এবং নষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার শেষ অধ্যায়কে মহার্ঘ হিসেবে বেছে নেয়। মানবতার মৃত্যুসংক্রান্ত মধ্যবর্তী ঘটনাগুলোকে নিতান্তই মামুলি ও অপরিহার্য পরিনতি বা নিয়তি বলে বিবেচনা করে। ঘাতকের মনে এই নষ্ট দর্শন ও বোধের উদ্ভব এবং সংঘাত সৃষ্টিকারী অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা প্রবাহ সামগ্রিক সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিরই চুড়ান্ত ব্যর্থতা। যুগ যুগ ধরে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয় ঘাতক ও নির্যাতিত উভয়কেই।

প্রতিটি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ শুধু ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর নয়, সামগ্রিক মানব সভ্যতার ব্যর্থতা।

বিচার ও সম্ভাবনা:

"The righteous is not innocent of the deeds of the wicked" - Kahlil Gibran

গণহত্যা যেখানে হোক, যেভাবে হোক, যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন তার বিচার হতে হবে। প্রতিশোধ নয়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে নয়, ন্যায়ের জন্য এবং মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই বিচার হতে হবে। এই বিচারে রাষ্ট্র হবে বাদী। অপরাধটি সমগ্র বিশ্ব ও মানবতার বিরুদ্ধে হওয়ার কারণে সমগ্র বিশ্ব সমাজের দায়বদ্ধতা রয়েছে এই বিচার সম্পাদনের ব্যাপারে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের রয়েছে বাধ্যবাধকতা। তবে গণহত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য প্রথম উদ্যোগটি নিতে হবে দেশের ভিতর থেকেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের সংবিধানে ঘোষিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯ এর অধীনে বিচারের সুযোগ রয়েছে। এ বিচারকার্যে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তাদেরকে অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত করার বিধান রয়েছে আন্তর্জাতিক আইনে।

১৯৭৩-এর সাধারণ ক্ষমা এবং ’৭২-এর সিমলা চুক্তি প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৩০ নভেম্বর ’৭৩-এ বঙ্গবন্ধু যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন তা কোন ভাবেই যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ব্যাপারে প্রযোজ্য ছিল না। এ কারণেই কলাবরেটরস অ্যাক্ট-এ গ্রেফতারকৃত ৩৭৪৭১ জন বন্দীর মধ্যে ছাব্বিশ হাজার মুক্তি লাভ করে সাধারণ ক্ষমায়। এদের কেউই যেমন সিমলা চুক্তির কারণে মুক্তি হয়নি, তেমনি ঐ চুক্তির কারণে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীও দেশে ফেরত যায়নি।

’৭১ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ ও সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে ২রা জুলাই ১৯৭২-এ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি হয় তা-ই ছিল সিমলা চুক্তি।

এই চুক্তি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ছিল। এর অনেক শর্তের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের লক্ষ্যে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি অন্তর্গত ছিল। অতএব এটি ৯৫ হাজার যুদ্ধবন্দীর ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়ে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ছিল। এটা কোনক্রমেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন চুক্তি ছিল না এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তমূলক অঙ্গীকার ছিল না। ১৯৭৪-এর ২৪ শে ফেব্র“য়ারীর পূর্বে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কেননা ঐ তারিখে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পূর্বে ৭২-এ আমাদের সংবিধান প্রণীত হওয়ায় এর আইনি ধারাগুলো বিশেষ করে ৪৭-এর ৩ অনুচ্ছেদ ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম অ্যাক্ট ১৯/৭৩, এই যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিষয়ে ম্যান্ডেট প্রদান করে। এছাড়া বাংলাদেশ ১৯৯৮-এ জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষর করায় ’৭১-এর অপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৭৩-এর ২৮ শে আগস্ট ভারতের পি.এন হাকসার ও পাকিস্তানের আজিজ আহমেদের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী ও বিহারিদের ফিরিয়ে নেবার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। এই সমঝোতায় বেনামে এটা উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বিশেষ শর্তে ছাড় দিতে পারে। ’৭৪-এর ৯ই এপ্রিল মস্কো থেকে ফিরবার পথে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবন্দীদের ফেরত এবং পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে একটি শর্তাধীন সমঝোতায় পৌঁছেন।

এই সমঝোতার যে অংশ সংবিধানকে অর্থাৎ ৪৭-এর ৩ অনুচ্ছেদকে অস্বীকার করে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে ক্ষমা করার অধিকার কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের নেই। বিচারহীনতার অচলায়তন ভাঙবার দায়িত্বটি কোন একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়, এটি প্রতিটি সভ্য মানুষেরই দায়। এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তা বা নিরপেক্ষতার কোন স্থান নেই। আমাদের দৃষ্টির সামনে অবস্থান নেয়া মুষ্টিটি সরিয়ে নিলেই সম্ভাবনা ও সভ্যতার আলো আমাদেরকে উদ্ভাসিত করতে পারে।


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

জালাল ভাই, ডাঃ এম এ হাসানের লেখাগুলোকে বই আকারে প্রকাশ করা জরুরি। অন-লাইনে যে দিচ্ছেন তা খুবই ভালো উদ্যোগ নিঃসন্দেহে। তবে প্রিণ্টের বিষয়টাও ভেবে দেখা যেতে পারে।

এই বিষয়গুলো বেশি বেশি করে সামনে আনা না গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গণসমর্থন বেগ পাবে না। এমনিতেই বেজন্মা অপরাধীরা দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে এখন। সাথে জুটেছে আরো কতগুলো ভণ্ড। আশ্চর্য, মানুষ এখনো তা সহ্য করছে কীভাবে ! এগুলো ভাবলে যে কোন সুস্থ মানুষই তো পাগল হয়ে যাওয়ার কথা !

খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

পুতুল এর ছবি

জালাল ভাই, নীচের লিংকটায় একবার ক্লিক করে দেখবেন?
আমি লেখকের অনুমতি নেই নি, বর্ণনা বিশ্বাস যোগ্য মনে হওয়ায় আপনাকে লিংকটা দিলাম।
এই লেখাটিও পছন্দের তালিকায় রাখলাম।
http://prothom-aloblog.com/users/base/ujjwalldhar1/23
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।