অপতৎপরতা

মনামী এর ছবি
লিখেছেন মনামী (তারিখ: সোম, ২২/০২/২০১০ - ৬:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ বাসায় উৎসবের রোদ। কিন্তু তুলির মুখে একরাশ কালো মেঘের ছায়া। তার বাড়ির ধারাই হচ্ছে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যপক হইচই করা।

আরে হানিফ ভাই অফিস থেকে ফিরলেন নাকি?

হুম, কি অবস্থা?

আরে বাসায় ঢুকেন, দ্যাখেন কি করসি।

আরে বাহ! লাগায় ফালাইসেন! রংটা একটু হালকা হয়া গ্যাসে।

আমার এই রংটাই পছন্দ।

আব্বুর আদিখ্যেতার বিরক্তিকে ফাঁকি দিয়ে তুলি অনেক ভাবনার ভীড়ে গা ঢাকা দেয়। উঁকি দেয় সময়ের সেই সব গলিঘুপচিতে যখন জানা ছিলনা মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা - কেবল কষ্ট পেত অনিদের বাড়িতে রঙিন টিভি আছে কিন্তু ওদের বাড়িতে নেই বলে। প্রজাপতির মত উড়ে যায় দীর্ঘশ্বাস।

শহরের পাথুরে মাটিতে স্বচ্ছলতার ভিত গড়া চাট্টিখানি কথা নয়। আর এ জন্য সবচেয়ে কার্যকর পথটাই বেছে নিয়েছিলেন আব্বু। আর তা হলো রঙিন আকাঙ্খাগুলোর পাখা কেটে দিয়ে মুখ বুঁজে আপোষ করে যাওয়া।

ঝুঁকিকে সারাজীবনই বড় ভয় পেয়েছেন।

তাই অনেক স্বপ্নের খোরাক যোগানোর পর যখন কোনো কিছু বাস্তবে অস্তিত্বশীল হোত তখন বাসায় ঈদ ঈদ গন্ধ। কারণ এক একটা আসবাব ছিল সম্মানজনক সামাজিক অবস্থানের বেদীতে ওঠার এক একটা ধাপ।

তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারটাও ছিল অনেকটা সেরকমই। নাট্যকলায় পড়ার ইচ্ছা থাকলেও আব্বুর ইচ্ছাতেই ইংরেজিতে ভর্তি হতে হয়েছিল।

মেয়ে নাট্যকলায় পড়ে, এটা বলা যায় কাউকে? এটা কোনো বিষয় হলো?

কেন? এর মধ্যে খারাপের কী আছে?

খারাপ মানে? নাটক শিখে কী করবা? চাকরি-বাকরি কিছু পাবা? আমার মেয়ে একটা কোম্পানির ম্যানেজার এটা বলতে পারবো?

অকাট্য যুক্তি ! মেনে না নিয়ে কোনো উপায় নেই।

মেনে নেয়ার কঠোর অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই আয়ত্ব করেছে সে । হঠাৎ আব্বুর ডাকে ভাবনার সুতো ছিড়ে যায়। বাথরুমে কমোড বসানোর আনন্দের জায়গায় আব্বুর গলায় ঝরে পড়ে অনাকাঙ্খিত রাগ।

তুলি, তুলি এদিকে আসো। এইসব কী?

কী হইসে?

তোমার ইউনিভার্সিটি থেকে চিঠি আসছে কেন আমার নামে?

ওদের কি ভয় করেনা? পরীক্ষার ফল আটকে যেতে পারে, স্কলারশিপ কিংবা চাকরির জন্য রেকমেন্ডেশন মিলবেনা, সুপারিশ তো দূরের কথা। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কোত্থেকে পায় অজ পাড়া গাঁ থেকে আসা এই ছেলে মেয়েগুলো। সারা জীবন যে কোনো ঘটনা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শেখা তুলির নিজেকে কেঁচো বলে মনে হয়েছিল। বিভাগকে বিপণী বিতানে পরিণত করা রুখতে সবাই যখন স্বাক্ষর করলো তখন তুলির মনে হয়েছিল একেই বলে মাথা উঁচু করে বাঁচা।

এই জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চাইনি। যতসব নোংরা রাজনীতি। পরের বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া উচিৎ ছিল।

ক্যান কী হইসে?

কী হইসে তুমি জানোনা? পড়াশোনা করতে যাও না রংবাজি করতে?

রংবাজির কী আসে? ইভনিং এম এ চালু হলে আমাদেরই ক্ষতি। আর তাছাড়া সবাই সাইন করসে।

সবাই করসে, তাইলে তোমার নামে চিঠি আসছে ক্যান? তুমি কালকে যেয়ে তোমার টিচারের সঙ্গে দেখা করবা, এইসব বন্ধ না করলে তোমার ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ। ফাইজলামি! খালি পড়াশোনা না করার তাল।

নোটিশ

মেধাতালিকায় শীর্ষে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের ইভনিং এম এ চালু হওয়ার বিষয়ে অনাপত্তি এবং অরাজকতা দূর করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আবেদনের ভিত্তিতে জানানো যাইতেছে যে এই বিষয়ে আর কোন আপত্তিপত্র গৃহীত হইবেনা এবং যে কোনো অপতৎপরতার কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে।

ঝুঁকিকে বড় ভয়।


মন্তব্য

Shizumu Wabishii Tawakemono [অতিথি] এর ছবি

গল্পটা আমার কাছে খুব......আপন আর চেনা মনে হয়েছে কারণ নতুন কিছু করার জন্য আমার জেদ করা আর বাবা মার অনাবশ্যক ভীতি আর শাসন করার চেষ্টা - এ রকম প্রায়শই ঘটে । মধ্যবিত্ত আবহে বড় হওয়া সবারই এরকম অনুভূতি হবে গল্পটা পড়ে । ধন্যবাদ সুন্দর একটি গল্প লেখার জন্য । হাসি

মনামী এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ :)।

বইখাতা এর ছবি

আমি নিজেও...মানে আমরা কেউই, যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, ইভনিং এম এ চালু করার সিদ্ধান্ত মানতে পারিনি।
সুন্দর লিখেছেন গল্পটা।

মনামী এর ছবি

মধ্যবিত্তের নিরাপত্তা বলয় থেকে বেরিয়ে অসঙ্গতির বিরুদ্ধে দাড়ানোর উদাহারণ আজকাল দুর্লভ হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই "তুলি"র মত কিছু শিক্ষার্থীরা পাল্টা আবেদনপত্র দাখিল করে সব প্রচেষ্টা ভন্ডুল করে দেয়। আমাদের বিভাগে তা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে বটে কিন্তু আন্দোলনকারীদের কালোতালিকাভূক্ত করে নানাভাবে উত্তক্ত করা হচ্ছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।