অন্যরা ও অন্যরা

মনামী এর ছবি
লিখেছেন মনামী (তারিখ: বুধ, ১০/০৮/২০১১ - ১১:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে, আমরা যে বাসায় থাকতাম তার একটা বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। আমরা থাকতাম একটা বেসরকারি কোম্পানির চাকুরেদের জন্য তৈরি একটি কোয়ার্টারে যেখানে মাত্র দুইটা বিল্ডিং ছিল। বিরাট এলাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরা, এক কোনায় দেয়াল ঘেষে সামনাসামনি দুইটা ৫ তলা বিল্ডিং। আমরা থাকতাম সামনেরটার নিচতলার ডানপাশে। বিরাট বারান্দার তিনদিকে ৩টা ঘর। প্রতিটা ঘরের বারান্দার দিকে একটা দরজা, আবার একটা করে দরজা দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। বড় বড় জানালা তো আছেই। মোট কথা উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখে নেয়া যায়। পিছনের দিকে বড় রান্নাঘর, লাগোয়া স্টোররুম। পাশেই গোসলের ঘর আলাদা। নিচতলায় যারা থাকতেন তারা বাসার সামনের জায়গায় বাগান করার অধিকার পেতেন। সেই বাগানের কারণে বড় শোবার ঘরের আব্রু কিছুটা রক্ষা পেত আর কি।

শহরে যখন হট্টগোল শুরু হলো তখন আমরা একবারও ভাবি নাই এর বিস্তার কতদূর পর্যন্ত ঘটতে পারে। কোনো হই-হল্লাই কখনো আমাদের বড় বড় মাঠের ওপারের মূল ফটক পার হয়ে আমাদের স্পর্শ করতে পারেনি। স্ট্রাইক হয়েছে, মিছিল হয়েছে, গুলি চলেছে রাজপথে। আমাদের বাসার এতগুলো দরজা আর জানালা দিয়েও তার হাওয়া এসে ঢুকতে পারেনি। ৪ তলার আন্টির বাগানের গোলাপ চোর, সামনের বিল্ডিং এর দোতলার জানলা থেকে পেছনের বিল্ডিং এর দোতলায় লুকোচুরি প্রেম প্রেম খেলা, মারিয়া আন্টির বাসায় ভিসিআর দেখা, কারেন্ট চলে গেলে সবাই সিড়ির উপর বসে ভূতের গল্প করা (পেছনের বিল্ডিং এর পেছনের দিকটাতে সত্যিই ভুত ছিল), দলবেঁধে উৎসবের নতুন জামা দেখতে চাওয়া এসব করে আমাদের দিন ভালই কেটে যাচ্ছিল। আর সবাই যখন স্বৈরশাসক খেদানোর জন্য লড়ছে আমরা তখন ব্যস্ত কিছু শিশুতোষ খেলায়।

তারপর ধীরে ধীরে দেয়াল পার হয়ে টুকরো-টাকরা বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ আমাদের পরিধিতেও উড়ে আসতে শুরু করলো। আমাদের পিতা মাতারা খুব চেষ্টা করেছিলেন যাতে এই পুরো বিষয়টা থেকে বিযুক্ত থাকা যায়। তারা ছা-পোষা চাকুরে, আমরা তাদের সন্তান। কে দেশ চালালো তাতে আমাদের কি যায় আসে! আমরা কারো সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এসব আন্দোলন-ফান্দোলন আমরা বুঝিনা বাবা! আমাদের চাই নির্বিঘ্ন জীবন। তাই যখন সরকার সব ‘কুচক্রী’দের উপড়ে ফেলতে সশস্ত্র অভিযান শুরু করলো তখন আমাদের পিতা ও পিতৃতুল্যরা খুশিই হয়েছিলেন বলা চলে।

কিন্তু যেদিন একটি সশস্ত্র দল আমাদের অনেকগুলো দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকে পড়লো সেদিন অস্ত্রের ডগাগুলো বুঝতেই চাইলোনা আমরা কোনো দল করি না। প্রথমে আমরা দরজা বন্ধ করে তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলাম। পড়ে আমরা সবাই মিলে রান্নাঘরের পাশের স্টোররুমে, যেখানে ইঁদুর আর তেলাপোকার ভয়ে কখনো ঢুকি নাই, সেখানে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওরা এক এক করে আমাদের টেনে বের করলো এবং এক এক করে হত্যা করলো।

পরদিন পত্রিকায় খবরও এসেছিল, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে , সংখ্যাটা কত ছিল ঠিক মনে নেই, ধরে নেই ৭ জন নিহত।

আমাদের বাসায় এখন অন্য মানুষেরা থাকে। তারাও কারো সাতে-পাঁচে থাকতে একদম পছন্দ করে না।


মন্তব্য

guest_writer এর ছবি

চিন্তিত

সাত্যকি. এর ছবি

বাহ। অনেকটুকু অভিব্যক্তি!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হ... আমরাও কারো সাতে পাঁচে থাকতে পছন্দ করি না হাসি

তীব্র লেখছেন...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তানিম এহসান এর ছবি

অদ্ভুত লাগলো! চলুক

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

হ। আমরা কারো সাথেও নেই পাছেও নেই। স্বর্গে বসে লেখা এই অণুগল্পটা ভালো হয়েছে...

test পাঠক এর ছবি

মলম লাগানো মন্তব্য।

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা!

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

বিষ... গুরু গুরু

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

পাঠক দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

খুব সাধারণ একটা বিষয় দিয়ে শুরু। শেষে এসে সেটাই দারুণ হয়ে গেল। খুব সুন্দর।

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

চলুক

নজমুল আলবাব এর ছবি

কে মরলো, কে বাচলো কারকি তাতে? আমি বেঁচে আছি, আর কি চাই?

সুমন_তুরহান এর ছবি

গল্পের শেষটা নাড়া দিলো। চলুক

আশালতা এর ছবি

দারুন। হাততালি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

guest_writer এর ছবি

আমার বয়স যখন ১৮-১৯ তখন আমরা ঢাকায় ইস্কাটন গার্ডেন রোডের অফিসা্র্স কোয়ার্টারে থাকতাম। পাশাপাশি দুটো চারতলা বিল্ডিং। হ্যাঁ আমরাও তখন লুকোচুরি প্রেম প্রেম খেলা খেলেছি। সম্ভবত এধনের পরিবেশে এই বয়সে সবাই কমবেশী লুকোচুরি প্রেম প্রেম খেলা খেলে। তবে সেটা খুব বেশীদিন স্থায়িত্ব পায়না। তাই নয় কি ?
মন্তব্য লিখেছি : প্রৌঢ়ভাবনা

অতিথি অন্যকেউ এর ছবি

মন্দ না। আরেকটু ডিটেইলড হৈলে আরও ভালো হৈত। ধাক্কাটা লাগছে ঠিকই, আরও দাবি ছিলো আরকি...

মৌনকুহর এর ছবি

চলুক

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

মনামী এর ছবি

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।