এমিল নভেম্বর ০৮-১

শিবলী এর ছবি
লিখেছেন শিবলী [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০৫/১২/২০০৮ - ৪:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অধ্যায়-০১
২৬-১০-০৮

অপরূপ সুন্দর রিমনিকু ভ্যিলচা শহরের আন্তঃ নগর বাস স্ট্যান্ডে বুখারেস্ট থেকে আগত নরমান্ডিয়া বাস থেকে নেমে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। বাস স্ট্যান্ডে আগত কয়েক শত নারী পুরুষ ঘুরে ফিরে আমাকে দেখছিল। তাদের দেশে এ কোন দক্ষিণ এশিয় দর্শন যুবক এলো! (যতই আমার সল্ট এন পেপার চুল হোক না কেন, আমি এখনও দারুণ মাত্রায় যুবক)। দুই হাতে দুই সু্টকেস হুইলের উপর ফেলে সবার সামনে দিয়ে এক পাশে এসে দাঁড়ালাম, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের পাশে। এই মাত্র এমিলের মা মারিনার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। ওরা যে কোন মুহূর্তে চলে আসবে আমাকে মিট করতে। বুকটা টিপ টিপ করছিল। প্রায় পাঁচ মাস পরে এমিলের সাথে দেখা হচ্ছে। এই মাসের (অক্টোবর) ৫ তারিখ যখন ওর মাকে জানিয়েছি এমিলের পঞ্চম জন্মদিনে (নভেম্বর ১) আসতে চাই, অক্টোবর এ পঁচিশ নাগাদ তখন থেকে নাকি সোনা মানিক আমার কাউন্টডাউন করছে, পঁচিশ দিন বাকি, চব্বিশ দিন বাকি, তেইশ দিন বাকি- এভাবে গত কাল থেকেই অস্থির, পঁচিশ দিন তো এসেই গেলো, বাবার প্লেন কি দুবাইতে আটকে গেল?

ছোট্ট এই শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষিনকায় ওল্ট নদীটার ওপারে এমিলদের বাড়ী। আর বাস স্ট্যান্ডটা এ পারে, মাঝখানে ছোট্ট ব্রীজ দিয়ে হেঁটে আসলে ১০ মিনিট, ট্যাক্সিতে আসলেও প্রায় ১০মিনিট, দুই তিনটা ট্রাফিক লাইটের বাঁধা পরলে। ঝক ঝকে ট্যাক্সিগুলো বাস স্ট্যান্ডের পাশে এসে থামছিল। আর আমি ভিতরে কোন পিচ্চিকে খুঁজছিলাম, ছোট্ট মাথা, ছোট্ট মুখ, সব সাদাদের দেশে এক পুরো মাত্রায় বাঙালী দর্শন বালক (যদিও মাত্র পাঁচ বছর এর কাছাকাছি শিশু বয়সী)। একটা দুইটা করে প্রায় পনর বিশটা ট্যাক্সি চলে গেল। পাঁচ মিনিটকে যখন প্রায় পাঁচ মাসের মত দীর্ঘতর অথচ সীমাহীন আনন্দের, উতসুক্যের মনে হচ্ছিল, তখন যেন আধো মেঘলা পরিবেশে হঠাত ঝলসে উঠলো মিষ্টি নরম রোদ, দূরে এক ট্যাক্সির দরজার আড়াল থেকে উকি দিল সাত রঙা সূর্যের হাসি, পাহাড়ী মিয়ের্লা পাখির শীষের মতো ভেসে এলো প্রিয় ডাক, বাবা!

যেন পঁয়ত্রিশ বছর আগের শৈশবে ফিরে গেলাম, আয়নায় রোজ দেখা প্রিয় সেই মুখটার হুবহু প্রতিচ্ছবি টা আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল, ধূসর রঙের জ্যাকেটে আবৃত ছোট্ট শরীরে, জিনসে ঢাকা ছোট ছোট পা দুটো নীল রঙা নরম স্প্যানিশ লেদারের জুতোয় ঢাকা এমিলকে মনে হচ্ছিল যেন কোন এক দিগি¦জয়ী রাজকুমার। হাতের ব্যাগগুলো ছেড়ে দিয়ে ঝকঝকে ফুটপাতে এক হাঁটু গেড়ে বসলাম। দু হাত বাড়িয়ে বুকে তুলে নিলাম ছুটন্ত এমিলকে। আহা! কি আনন্দ! কি শান্তি! বুকের সাথে শরীরটাকে মিশিয়ে দিয়ে আমার দু গালে দুই হাত রেখে তৃষ্ণার্ত ঠোটে মিষ্টি চুমু খেয়ে বললো “বাবা কেমন আসো?”

তার পর নাকের উপর, কপালে, চোখে, দুই গালে চুমুর বৃষ্টি ঝরতে লাগল। আমি প্রতিবারের মতো আস্তে আস্তে জানতে চাইলাম, এমিল কে আসছে?
বাবা আসছে।
কোত্থেকে আসছে?
দিন বাংলাদেশ (বাংলাদেশ থেকে)।
কার জন্য আসছে?
এমিল জন্য আসছে।

হা হা করে হেসে উঠলাম, রিচুয়াল টা শেষ করে আমরা দুজনে। এমিলের পিছনে তখন ওর মা এসে দাঁড়িয়েছে। এমিল আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল- বাবা কুউব বালোবাসি, আই লাভ ইউ ভেরী ভেরী মাচ। তে ইউ বেসক, ফোয়ার্তে মুলত। আমি পরমানন্দে আবার দুষ্ট হাসি মাখা এমিল এর মুখটা বুকে জড়িয়ে নিলাম। হাজার বছর একাকি বেঁচে থাকা যায় এমন একটি দিনের জন্য।

হাউ আর ইউ, শিবলী? এমিলকে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে মারিনা দুই হাত দুর থেকে হাসি মাখা মুখে জানতে চাইলো। পরখণেই হাত বাড়িয়ে বললো ওয়েলকাম টু রুমানিয়া। আমি পুরনো বন্ধুর মত বুকে জড়িয়ে ধরলাম। একদা প্রেমিকা কাম প্রিয় বধূয়া আজ যে সে নারী!

ট্যাক্সিটা সবুজ বাতি পেয়ে ছুটে চলছিল এমিলের নানা বাড়ীর দিকে। শহরের কেতাদুরস্ত এক নেইবারহুডে থাকেন আমার প্রাক্তন শ্বশুড়-শাশুড়ী, দশতলা এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর সবচেয়ে উঁচু- দশতলায়। বাড়ীর কাছে গাড়ী থামতেই এমিল ঝটপট গাড়ীর পেছনে এল, ড্রাইভার সাহেব স্যুটকেস দুটা নামাতেই এমিল ছোট টা নিজের হাতে নিয়ে চাকায় ফেলে টানতে লাগলো সামনের সিড়ির দিকে। আমি হা হা করে উঠলাম। এইটুকু ছেলে প্রায় ওর সমান স্যুটকেস টানবে কিভাবে? এমিল বাধা পেয়ে মা কে বললো, মা বাবাকে বলো-আমি বড় হয়ে গেছি, বাবার স্যুটকেস আমি এখন টানতে পারি।

আমি চোখে তখন ঝাপসা দেখছি, মনে মনে বলছি, এমিল তুমি যখন সত্যি সত্যি বড় হবে তদ্দিন আমি বেঁচে থাকবো তো বাপ?


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

ভালো লাগলো। গল্প আরো সামনে বাড়ুক।

আপনার Shiblee নামটাকে শিবলী (বা শিবলি) করে দিতে পারেন মডারেটররা, যদি আপনি সম্মত থাকেন।


হাঁটুপানির জলদস্যু

শিবলী এর ছবি

খুউব ভাল হয়।
শিবলী করে দিন দয়া করে।

ধুসর গোধূলি এর ছবি
স্নিগ্ধা এর ছবি

লেখা ভালো লাগলো, কিন্তু ছবির রেসোল্যুশন কি ভালো করা যায়? দেখাই যাচ্ছে না কিছু।

বাংলা ব্লগে মনে হয় নামটা বাংলায় দেখতেই বেশী ভালো লাগবে হাসি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

লেখাটা ভাল লেগেছে। দীর্ঘদিন বাদে বাবা-ছেলের দেখা... মন ছুঁয়ে গেল। তবে ছবিটা দেখে বোঝা গেল না কিছুই।

চলুক...


A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?

রানা মেহের এর ছবি

খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা
এমিলের জন্য ভালোবাসা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

MostafaSohel এর ছবি

Ekta manushke kivabe valobasle se r konodin sere jabe naothobaek jibone prio manushder ki bojano sombov je taderke koto valobhasi? Shiblee Bhai you are able to make us understand that how much you love your Emil!

Great Shiblee Bhai! I love you bro!

Sohel

রিতু এর ছবি

আসলেই হাজার বছর একাকী বেঁচে থাকা যায় এমন একেকটি মুহূর্তের জন্য।
মাঝে মাঝে মনে হয় কে কাকে বেশী ভালোবাসে? এমিল বাবাকে, নাকি বাবা এমিলকে?
শিবলী, এমিল যখন বড় হবে তখন ও তুমি এমন দুর্দান্ত এক যুবকই থাকবে:)।

Polly Parveen এর ছবি

I feel so sad that a father eager for his son can't see him more than 1/2 times a year.

Some fathers who can see their children every day do not appreciate what they have.

Praying for all fathers to become more appreciative of their children all over the world - for the sake of children - who just needs to be loved - unconditionally.

তিথীডোর এর ছবি

চমৎকার!
বাবা -ছেলের এই নিখাদ ভালবাসা অটুট থাকুক সবসময়....

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।