এমিল নভেম্বর ০৮-২

শিবলী এর ছবি
লিখেছেন শিবলী [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৪/০১/২০০৯ - ৪:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অধ্যায়-০২
দুপুরের পর বাইরে রিমনিকু ভ্যিলচা শহরে বেশ রোদ উঠেছে। খাবার খাওয়ার পর ওদের ড্রয়িং রুমে এলাম। এখানকার ঢাউস আকৃতির সোফাটাকে চিৎকরে শুইয়ে দিলে বড়সর একটা বিছানা হয়ে যায়। গত তিন বছর ধরে এনিয়ে ছয় বার রোমানিয়া তে এলাম এমিলকে দেখতে। প্রতিবার একটাই আমার শোবার জায়গা, এমিল তার নানা-নানুকে সাথে নিয়ে এল। তাদেরকে বললো তাড়াতাড়ি বাবার জন্য বিছানা ঠিক করে দিতে। আমি ৮০ ভাগ না বুঝলেও ২০ ভাগ দিয়েই মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছি এই দুরুহ ভাষা।
এমিলের নানা জনাব মারিন বিশালদেহী সহজ সরল মানুষ। তার মেয়ে মারিনা'র জন্য (এমিলের মা) তাঁর অগাধ ভালোবাসা। আমাদের ৬ বছরের হানিমুন পিরিয়ডে (১ বছরের কোর্টশীপ আর ৫ বছরের বিয়ে) প্রতি বছর বেড়াতে আসতাম। এখন সেই মধুর বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর (আমি বলি, ওয়াজ হ্যাপিলি মারেড, নাও স্যাডলি ডিভোর্সড) বছরে দু বার আসতে হয়। ভদ্রলোক একই রকম পিতৃস্নেহে ্আমাকে বারবার বরণ করেন। অপর দিকে তাঁর স্ত্রী, আমার প্রাক্তন শাশুড়ী, সর্বোপরী এমিলের নানী মিসেস ভ্যালেন্টিনা প্রবল ব্যক্তিত্ব সমপন্না ভদ্র মহিলা। এমিলের প্রতি তার স্বামীর মতই তীব্র ভালোবাসা। পবিবারের প্রথম ও একমাত্র নাতি। আর কেন যেন বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পরও আমাকে পুত্র স্নেহে ভালোবাসেন। আগের মত এখনও বেড়াতে গেলে ভদ্র মহিলা তার ব্যস্ত শেডিউল থেকে টাইম অফ নিয়ে বাড়িতে সময় কাটান। মাঝে মাঝে আমার রুমে এসে খুঁজে খুঁজে ব্যবহৃত জামা কাপড় বের করে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকান। ধোয়া কাপড় গুলোকে ইস্ত্রি করে সুন্দর করে ভাঁজ করে আমার স্যুটকেসের কাছে রেখে যান। বাজার থেকে খুঁজে খুঁজে গরুর মাংস, বাসমতি চাল এনে রান্না করেন সুস্বাদু মাংস, আমার প্রিয় অক্স টেইল স্যুপ। ফ্রাইড রাইস বেড়ে দেয়ার সময় লজ্জ্বা, অপরাধ মেশানো কন্ঠে বলেন, মনে হয় ভালো হয় নি।

আমি মাথা নীচু করে খুটিয়ে খুটিয়ে খাই। কোথায় রাখি এ্যাতো ভালোবাসা?

দুপুরের খাবারের পর এমিল চট করে মায়ের রুমে গিয়ে রেডি হয়ে আমার কাছে এসে বললো, বাবা বাইরে চল। আমিও তৈরি হয়ে ছিলাম। এমিল মাথায় উলের টুপী পড়েছে। ওদের ভাষায় বলে কাচুলা। বাবার কাচুলা কই? এমিল ব্যস্ত হয়ে গেল। মায়ের রুম থেকে আরেকটা নিয়ে এল আমার জন্য। যদিও চমতকার রোদ উঠেছে, তবুও এখনো বেশ ঠান্ডা।
দশতলার ব্যালকনি থেকে বাইরে তাকালাম, ছবির মত সুন্দর চারপাশ। কার্পেথিয়ান পাহাড়টা সামনে অর্থাত পশ্চিমে, দেণ ও উত্তরে শহরটাকে ঘিরে রেখেছে। উপর থেকে পাহাড়কে খুব কাছে মনে হয়। যেন হাত বাড়ালেই ধরা যায়। এ্যাতো উচু পাহাড়! সত্যি সত্যিই "আকাশে হ্যালান দিয়ে, পাহাড় ঘুমায় ঐ"!

নীচে ঝকঝকে সুন্দর রাস্তা ঘাট। রাস্তার চেয়ে ফুটপাথ যেন চওড়া বেশী। কাছেই একটা ছোট্ট পার্ক ছিল, প্রায় দুই একর এর মত জায়গা নিয়ে। বেশ কটি বেঞ্চে বসার ব্যবস্থা। গাছপালা ছিল না। এমিলকে নিয়ে রোদ পোহাতাম বরাবর। কাছেই যদিও শহরের মূল পার্ক 'লা জভই' । কিন্তু ওটা বিশাল বিশাল গাছে ঠাসা। রোদ সহজে মাটিতে পড়তে চায় না। কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা। শরতের ঠান্ডায় আমার পছন্দ ছিল এই ছোট্ট গাছ হীন রোদেলা পার্কটা। কিন্তু অতিসম্প্রতি শহরের পৌর পিতার কু'নজরে পড়ে পার্কটি এখন বিশাল এক সেমি বসুন্ধরা সিটি, আই মিন, বেশ বড় সর এক শপিং মল এ রূপান্তরিত হয়েছে। এমিলকে নিয়ে সেই মল এই গেলাম। বাপ বেটা হাত ধরে হাট ছিলাম মলের ভিতরে। গতবারে ( মে মাসে ) দেখা গ্রাউন্ড ফোলরের পিজ্জা রেষ্টুরেন্টটা উঠে গেছে। মনে হয় ব্যবসায় ধরা। এমিলের পছন্দ টপ ফোলর। একটা চিলড্রেন্স কর্ণারে খেলার ব্যবস্থা আছে। লাফালাফি, ঘোড়া, কুমীর এর পিঠে চড়া কয়েন ফেলে। আর পাশের ফুডকোর্টে মনের সুখে পিজ্জা, শর্মা, আর জুস। এমিল আর আমি ইচ্ছে মতন স্পয়েল্ট হতে থাকি......।

রাতে খুউব কালন্ত ছিলাম, সন্ধ্যা ৮ টায় দেশের রাত ১১ টার বডি সিগন্যাল। ডিনার শেষে এমিলকে বুকে নিয়ে এমিলের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম।

খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় এখানে। ঘড়িতে ছয়টা। আমি জেগে যাই, কারণ আমার শরীরে দেশের টাইম, নয়টা বেজে গেছে। রীতিমত লেইট। অত ভোরে বাড়ীর সবাই নিদ্রায় সমাহিত। ঘুম থেকে উঠেই বরাবরের মত খিদা জেগে ওঠে। এমিলকে ঘুম থেকে উঠাই চুমু দিয়ে দিয়ে। রান্না ঘরে এসে খাবার খুঁজি। এমিলকে করুন স্বরে বলি খিদা লাগছে। এ্যা? ও খিদা লাগছে? চে মংকারে? অর্ধেক কথায়, অর্ধেক ইশারায় এমিলকে বুঝাই।
রান্নাঘরে গিয়ে ঘাটাঘাটি করতে বাঁধে। যেন অনধিকার চর্চা। রুমে ফিরে আসি।
সকালে ইন্টারনেটে ডেইলি ষ্টার পড়ার প্রবল নেশায় কম্প্যুটার খুলে বসি। জরুরী মেইল ও থাকতে পারে। আপন মনে ইমেইলের জবাব লিখছিলাম। কুয়াকাটার আপডেট আছে ইমেইলে, গরু-ভেড়া, মাছের খবর। অন গোয়িং ট্রেনিং এর রিপোর্ট পড়ছিলাম। কিছুখণ পরে রুমের দরজায় ধাক্কা পড়ে। অবাক হয়ে দেখি এমিল এক হাতে এক গ্লাস দুধ আর এক হাতে ফ্রীজের ঠান্ডা ২পিস পাউরুটি নিয়ে ঘরে ঢুকছে। আমার পাশে টেবিলে রেখে বলে, বাবা কাও! মানেংকা! মুখে বিজয়ীর হাসি। পাঁচ বছরের ছেলে আমার রান্নাঘর থেকে খুঁজে খুঁজে সহজ লভ্য অথচ বাবার প্রিয় খাবার নিয়ে এসেছে নিজে নিজে।

এ্যাতো সুখ রাখি কই?

আমি আবার চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম!


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হুম... ভালো লাগলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রেজওয়ান এর ছবি

হৃদয় ছুয়ে যাচ্ছে লেখাটা। লিখতে থাকুন। ধন্যবাদ।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

তানিয়া এর ছবি

এত্তো ভালো লেখেন আপনি ........ অসাধারন ........ জীবনের কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে সন্তানের জন্য আপনার ভালোবাসা আর বাবার প্রতি ছোট্ট এমিলের আদর আসলেই মন ছুয়ে যায়। লেখা পড়ে অনেক কষ্ট হয় আপনাদের সবার জন্য । এমিল কেমন আছে? এমিল কে অনেক আদর

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মন ছুঁয়ে গেলো।
এতো সম্পর্ক নষ্ট হয় পৃথিবীতে, এই একটা সম্পর্ক...বাচ্চার সাথে সম্পর্কটা একেবারেই, হিসেবের বাইরের কিছু।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

ভীষন ভাল লাগল লেখাটা ।
মনে প্রাণে কামনা করি এমিলের সাথে আপনার সম্পর্ক যেন সব সময় অটুট থাকে।

রানা মেহের এর ছবি

খুব ভালো লাগছে আপনার এই সিরিজ
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

হিমু এর ছবি

আপনার ছেলের সুন্দর শৈশব কামনা করি। সে যেন পরিণত বয়সে এইসব মধুর স্মৃতির কথা তার সন্তানদের জানাতে পারে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দৃশা এর ছবি

ভাইরে যখনি আপনার লেখা পড়ি ভাবি অবশ্যই মন্তব্য করব, কিন্তু পরে কোন না কোন কারনে ঠিকই ফস্কে যায়। পিতা-পুত্রের এই সুন্দর সম্পর্ক সবসময় এতোটাই উজ্জ্বল থাকুক এই কামনা করি।
আপনার লেখা পড়ে খুবই আরাম পাই। ঝরঝরে লেখা।
---------------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

এনকিদু এর ছবি

লেখা খুব ভাল লেগেছে শিবলী ভাই । নিয়মিত লিখতে থাকুন ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

Mostafa Sohel এর ছবি

Shiblee Bhai apnar lekhata pore ami kintu vison khushi hoyesi. Eto Emotional, Touchy, Exciting je ek nimise pore fellam. Just keep up this spirit Bhai- Apni amader agamidiner Super star Lekhok!

Mostafa Sohel

Suvas.mondol এর ছবি

Personally I don't know you brother but through your write up I already know yourself. This story is absolutely from the purest side of Ur heart.

Really it's a new elegy in Bangla literature!

Suvas Da

রিতু এর ছবি

ভাল হয়েছে, এত ছোট লেখ কেন।
তাড়াতাড়ি ৩ য় পর্ব দাও।
একাকিত্ব যেমন অসহনীয়, তেমনি তোমাদের বাটবেটার এই ক্ষণিক মিলন অসহ্য সুন্দর।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।