অপেক্ষা

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: মঙ্গল, ২৭/০৫/২০০৮ - ৩:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লোকটা যেন মাঠের ঘাস ফুঁড়ে বেরিয়ে এল।
মিশু একটু আগেও তাকে খেয়াল করে নি। তাদের বাড়ির সামনেই বেশ খানিকটা মাঠ, ঘন সবুজ ঘাসে ভরা। বিকেলে এক পাল ছেলেমেয়ে এসে এই মাঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাধারণত ফুটবল খেলাই হয়, ফুটবলের অভাব হলে দাড়িয়াবান্ধা কিংবা হাডুডু। কোনো কোনোদিন আবার মেয়েদের সংখ্যা বেশি থাকলে অনায়াসেই বৌচি খেলা শুরু হয়ে যায়। সংখ্যালঘু ছেলেরা মুখ গোঁজ করে সেই খেলায় যোগদান করে।
মিশুরা এই এলাকায় এসেছে প্রায় এক সপ্তা, এখনো সে এখানে কারো সাথে পরিচিত হতে পারে নি। কিন্তু তাদের বাড়ির সামনেই মাঠ, সেখানে একদল ছেলেমেয়ে রোজ আসে, মিশু চাইলেই ওদের সাথে পরিচিত হয়ে খেলায় নেমে পড়তে পারে, কিন্তু তার লজ্জা করে। কত কত ছেলে আছে, নতুন জায়গায় যাওয়ামাত্রই "অ্যাই, তোর নাম কী রে" অথবা "আমার কাছে টেনিসবল আছে, আয় বোমবাস্টিং খেলি"--এসব কথা বলে দিব্যি খাতির পাতিয়ে ফেলে, কিন্তু মিশুর পক্ষে সেটা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
অথচ একেবারে খাঁ খাঁ দুপুরবেলা, যখন মাঠে কেউ থাকে না, তখন ভাত খাওয়ার পর মুখে একটা এলাচদানা দিয়ে চুষতে চুষতে সে এখানে চলে আসে। তারপর মাঠের পাশের পেয়ারা গাছটার নিচে ছায়ায় বসে থাকে। এভাবে যদি একমাসও কেটে যায়, তারপরও বোধহয় সে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারবে না।
আজকেও সেরকমই মাঠের পাশে বসে ছিল সে। বেশ বাতাস দিচ্ছে, দুপুরের রোদের তেজ যেন ঠিক নেই। এরকম সময়েই লোকটা যেন মাঠের ভেতর থেকে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল।
লোকটাকে একদমই খেয়ালই করে নি মিশু। সে এখানে প্রায় মিনিট পনেরো ধরে বসে আছে, এরকম কাউকে তো আসতে দেখে নি। নাকি লোকটা আগে থেকেই ছিল ? এই রোদের ভেতর মাঠের মধ্যে কী করছিল ?
লোকটার দাঁত ফোকলা। সে হেসে কথা বলতেই সেটা চোখে পড়ল। লোকটা আকর্ণ হেসে মিশুকে জিজ্ঞেস করল, আইচ্ছা আমারে বল তো, আইজকা কী বার ?
এই খাঁ খাঁ দুপুরবেলায় জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষ যদি মাঠের ভিতর থেকে উঠে এসে এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করে, তাহলে একটু ভয় তো করারই কথা। কিন্তু মিশুর সেরকম কিছুই হল না, বরং সে খানিকটা ফ্যাচফ্যাচ করে হেসে ফেলল। তার কারণ, লোকটার চেহারা। লোকটা ফোকলা তো বটেই, দুই কান পর্যন্ত ছড়ানো একটা মিঠেমার্কা হাসি, ছোট করে ছাঁটা খাড়া খাড়া চুল, কান দুটো খরগোসের মতো লম্বা। গোল গোল রসগোল্লার মতো দুটো চোখ মিলিয়ে পুরো চেহারায় একেবারে সাক্ষাত্ মিকিমাউস !
মিশু হাসতে হাসতেই বলল, কেন, বার দিয়ে আপনার কী দরকার ?
লোকটা বেজার হয়ে বলল, এই দেহ, তোমারে একটা কাজের কথা জিগাইলাম, আর তুমি দেহি প্যাচোর প্যাচোর কইরা হাসি শুরু কইরা দিছ !
মিশু হাসি থামিয়ে বলল, আজকে সোমবার। এবার বলুন বার দিয়ে কী করবেন ?
লোকটা আবার একরাশ বিচ্ছিরি আঁকাবাঁকা দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিল, আইজকা আমার কী কাজ করনের কথা, সেইটা মনে করবার জইন্যই বারটা জানা দরকার ছিল !
মিশু মুচকি হেসে বলল, কীরকম শুনি আপনার কাজ ?
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, হু হু, কাজ মানে কাজ। বার বুইঝা ভাগ ভাগ কইরা কাজ করতে পারলেই জীবনে শান্তি থাকে, নইলে না। ধর, শুক্রবারের কথা। শুক্রবার হইল জুম্মাবার, সেইদিন আল্লারে ডাকাডাকি করতে হইব। সারা সপ্তায় তো ডাকছই, এইবার সারাদিন ধইরা একটু মনপ্রাণ দিয়া ডাক ! তারপর ধর গিয়া তোমার শুক্রবারের পরে মঙ্গলবার--
মিশু চোখ কুঁচকে বলল, শুক্রবারের পর বুঝি মঙ্গলবার ?
লোকটা একগাল হেসে বলল, ওই যাঃ, এক্কেরে খেয়াল থাকে না। এই ধর গিয়া, শুক্রবারের পর বুধবারে হইল কামকাজ। সারা সপ্তায় তো কাজকাম করতে গিয়ে ম্যালা ফাঁকি দিছ। এহন এই দিনডা একটু মন দিয়া কাজকাম করবা। তারপরে ধর গিয়া তোমার সোমবার, হেইদিন একটু ভালো কইরা খানাখাদ্য খাওন লাগব। নইলে সারা সপ্তা কাজকাম করবা ক্যামনে--
মিশু একেবারে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আচ্ছা, আপনি কি পাগল ?
লোকটা এবার আর রাগল না। বরং কেমন একটা লাজুক হেসে বলল, ক্যান, আমারে কি তাই মনে হয় ? অবইশ্য অনেকে বলে, আমার মাথায় টুকচা দোষ আছে। কিন্তু হের লাইগা কি আমারে পাগল কওন যায় ?
মিশু বলল, না না, আপনি পাগল হতে যাবেন কেন ? আমি এমনিই মজা করে বললাম। আপনি যদি পাগল হতেন, তাহলে কি আর আপনার সঙ্গে কথা বলা যেত ?
লোকটা একটু অবাক হল, ক্যান, কথা কওন যাইত না ক্যান ? ভয় পাইতা ?
ভয় বলে ভয়--মিশু বলল, আপনি নিশ্চয় এ এলাকার লোক, তাহলে তো এখানে একজনের কথা জানার কথা। ঐ যে সতেরো নাম্বার বাড়ি, ঐ বাসায় তো একটা পাগল আছে, তাকে সবসময় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। আমি যখন স্কুলে যাই, যাবার রাস্তার পাশে ঐ বাসাটা পড়ে। লোকটা প্রায় সময়ই ষাঁড়ের মতো চেঁচায়, আমিও একদিন স্কুলে যাবার পথে শুনেছি। একবার নাকি লোকটা বাঁধন খুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল, তারপর তো ভয়াবহ অবস্থা, যাকে সামনে পায় তাকেই কামড়ায় ! কী ডেঞ্জারাস ! অথচ লোকটা নাকি একসময় একেবারে ভদ্র একটা মানুষ ছিল, কেমন করে এরকম হল কে জানে ?
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, মিছা কথা, এক্কেরে মিছা কথা ! পাগলাটা কাউরেই কিছু কয় নাই, কেউ যদি একটা পাগল সামনে পাইয়া কোনো কথাবার্তা না কইয়া বাঁশ দিয়া পিটান শুরু করে, তাইলে পাগল তো পাগল, ভালো মাথার মানুষও চেইতা গিয়া কামড় দিবো ! পাগলের আর দোষ কী !
মিশু অবাক হয়ে বলল, ঘটনাটা ঘটার সময় আপনি কি সামনে ছিলেন নাকি ?
লোকটা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছে, কোনো জবাব দিল না। একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি বরং বাসায় যাও গা। মাইনষে দেখলে চিল্লাইবো ! কোন ঝামেলায় পড়বা !
লোকটার বরা ভঙ্গিতে কী যেন ছিল, মিশুর গা ছমছম করে উঠল! তারপরও সে একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, ঝামেলা ? কিসের ঝামেলা ?
লোকটা ভীষণ গম্ভীর হয়ে আছে, নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, আমিই সতেরো নাম্বারের বাসায় থাকি, স্কুলে যাওনের সময় তুমি আমারই গলা হুনছ !
মিশুর দিকে চোখ তুলে বলল, আইজকাও আমি শিকল খুইলা বাইর হইয়া আইছি ! আমার কাছে একটা লুকাইন্যা চাবি আছে। ঘরে বইয়া বইয়া মনডা ভীষণ আনচান করে, আলোবাতাস লাগাইতে মন চায়। দেহ না, রইদের মইধ্যে পিঠ পাইতা দিয়া শুইয়া আছিলাম !
মিশুর সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। সব্বোনাশ, এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে বসে আছে সে !
লোকটা বলল, তুমি যাও গা, পাগল ছাগলের লগে থাকলে তোমারও ডর করব, মাইনষেও খামাখা চিল্লাপাল্লা করব !
মিশু একটা কথাও না বলে উঠে সোজা বাসার দিকে পা বাড়াল। সে সবে দুই পা ফেলেছে, এমন সময় লোকটা পেছন থেকে ডাকল, হুনো !
মিশুর সারা শরীর হিম হয়ে গেল। অনেক কষ্টে পিছন ঘুরে তাকাল।
লোকটা তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, আমি কি তোমারে কামড়াইছি, কও ! মাইনষে আমারে হুদাই ডরায়, আমি তো কাউরেই কিছু কই না, খালি যখন অমাবইশ্যা ছাইড়া পুন্নিমাটা আহে, তহন মাথাডা ক্যামন য্যান গড়বড় লাইগা যায়। বুক ফাইটা কান্দা আহে আমার, আমি সারাদিন কান্দি, আর মাইনষে ভাবে, আমি হেগোরে কামড়ানির লাইগা চিল্লাইতাছি !
মিশু বলবে না বলবে না করেও ফস করে কীভাবে যেন তার মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল, কাঁদেন কেন ?
লোকটা তার করুণ চেহারাটা সামনে মেলে ধরে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল। তার চেহারা এখন আর মিকিমাউসের মতো মনে হচ্ছিল না। সে ভাঙ্গা গলায় বলল, আমার একটা পুলা আছিল যে, এই ধর, তুমার চাইতেও ছোট। অসুক কইরা মইরা গেল, হের দুঃখে পুলার মাও মইরা গেল। খালি আমি আছি, আল্লায় পোড়া দুইডা চোখে আমারে দেহেও না, মনে দুঃখ নিয়া পশুর মতো বাঁইচা আছি। হেগোর কথা খালি ভাবি, আর কান্দি !
লোকটা চোখ মুছে বলল, যাও গা, বাড়ি যাও !
মিশু চুপচাপ এগোতে এগোতে দেখল, বেশ খানিকটা দূরে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে, যারা রোজ এই মাঠে খেলতে আসে। তাকে দেখিয়ে কী যেন ফিসফিস করে বলছে। সে কাছে যেতেই তারা তাকে একেবারে ঘিরে ফেলে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করে দিল--সব্বোনাশ, পাগলটা তোমারে কামড় দেয় নাই ? তুমি ভয় পাও নাই ?
এর দু-তিনদিন পরেই দেখা গেল এ এলাকায় মিশুর অনেক বন্ধু হয়ে গেছে। ফুটবল খেলার সময় সে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে অনেকের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে, যে নামগুলো দুদিন আগেও সে জানত না। মিশুর বন্ধু সমস্যা আপাতত মিটে গেছে। এখন রোজ বিকেলেই খেলার মাঠে সে নিয়মিত প্লেয়ার।
তারপরও একেবারে কটকটে দুপুরবেলায়, যখনও কেউ মাঠে আসে না, তখন সে গিয়ে পেয়ারাগাছটার ছায়ার নিচে চুপচাপ বসে থাকে। কেন... সেটা সেই জানে !


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

দারুন একটা গল্প মৃদুলদা ! দারুন লাগলো !

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

শাহীন হাসান এর ছবি

পড়লাম আপনার গল্পটি। ভাল-লাগলো ...।

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

আকতার আহমেদ এর ছবি

চমতকার গল্প ! বুকের ভেতরটায় কেমন জানি একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো !
দুর্ধর্ষ এই গল্পের জন্য (বিপ্লব)

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আরে বস... থ্যাঙ্কিউ! আপনার কন্ধকাটার গল্প কবে আসবে? কয়াইদান-এর আরেকটা দান মারেন না শিগগির!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

ধন্যবাদ, শাহীন ভাই, আরে আকতার ভাই, এই চিনচিনে ব্যথাটা সামলাবার আর ভাগাভাগি করার জন্যই তো লিখি!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

মুশফিকা মুমু এর ছবি

দারুন লিখেছেন, খুবই হৃদয় স্পর্স করা গল্প হাসি পাগল লোকটার জন্য খুব মায়া লাগছে মন খারাপ
-------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

স্নিগ্ধা এর ছবি

মৃদুল - আপনাকে একটা গল্পের বরাত দিই? 'ছোট'দের গল্প লেখা 'বড়'দের জন্য লেখার চাইতে কঠিন, আপনি সেটা ভালোভাবে পেরেছেন বলেই ইচ্ছেটা হলো।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আমি এখন আমার টেবিলে নেই। খাঁ খাঁ দুপুরের কটকটে রোদে পেয়ারা গাছটার নিচে বসে আছি। আর সামনে দেখতে পাচ্ছি অনন্ত নির্জনতা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভাবতেছি এইটারে ছড়ায় ছড়ায় বর্ণনা করলে কেরম হইতো... ভাইবা দেখলাম... তাহার জন্য আমি যথেস্ট না... মৃদুল আহমেদরেই লাগবে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে। অনেক অনেক...
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

অতিথি লেখক এর ছবি

লাজওয়াব গল্প হয়েছে। চালিয়ে জান মৃদুল ভাই। আরো চমকপ্রদ, ঝাঁঝালো গল্প চাই আপনার কাছে।

কির্তীনাশা

তূলি এর ছবি

দারুণ গল্প... ভালো লাগলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।