পান্তা বুড়ির আন্তা কথা

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২১/০৮/২০১১ - ৯:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার ছোটো মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতাকে একটানা এগার বার বছর গল্প বলছি। বলতে বলতে আমার স্টক শেষ। এখন যেটাই বলি--সেটা ও আগেই শুনে ফেলেছে। এত নতুন গল্প বলি কি করে?
কাল রাতে আবার বলতে হল আরেকটা পুরনো গল্পই।

পান্তা বুড়ির গপ্প
--------------
বুড়ি রোজ হাড়িতে পান্তা করে রাখে। পরদিন খায়। কিন্তু এক চোর এসে পান্তাগুলো চুরি করে নিয়ে যায়। গল্পটা এখান থেকে।

বুড়ি বলল, এখন কি করি?
কে যেন জবাব দিল, কি-ও করতি পারবা না?
আর কোনো উপায় না পেয়ে বুড়ি সোজা রাজার কাছে গেল। বলল, রাজা মশাই, আমার পান্তা চুরি ঠেকান। রাজা মশাই বুড়ির কানে কানে একটি বুদ্ধি বাৎলে দিল। আর গল্পটির সাসপেন্স শুরু হয়ে গেল।
বুড়ি রাতে পান্তার বদলে হাড়িতে শিং মাছ রেখে দিল। চুলার মধ্যে একটা কাঁচা বেল। উঠোনে গোবর। আর ঘাসের মধ্যে একটা চাকু। উপকরণগুলো দেখুন-কাঁটাওয়ালা শিং মাছ, কাঁচা বেল, চুলার আঁচ, গোবর, চাকু। মার মার কাট কাট। কান্ট্রি মেথড। থ্রিল এসে যাচ্ছে।

রাতে বুড়ি ঘুমিয়েছে। যথারীতি চোর এসে পান্তার হাঁড়িতে হাত দিয়েছে। শিংমাছটি খচ করে তার আঙ্গুলে কাঁটা ফুটিয়ে দিয়েছে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেছে। আর ব্যথা কমাতে চোর চুলার কাছে আঙ্গুল সেঁকতে গেছে। চুলার ভিতরে থাকা কাঁচা বেলটি ফুটে চোরের চোখে মুখে লেগেছে। চোরের চোখ গেছে। বাইরে উঠোনে নামতেই গোবের পা হড়কে গেছে। পায়ের গোবর মুছতে ঘাসে পা ঘষছে। ঘাসে লুকানো চাকুতে পা কেটে গেছে। চোরতো পলানোর সুযোগ পায় না। বুড়ি উঠে বলল, এখন, এখন কি করবি?
চোর বুড়ির পায়ে পড়ে বলল, এখন তোমার কাছে মাফ চাইয়া নিমু। ব্যাস। গল্প এইটুকু।

প্রজ্ঞা বলল, ও বাবা—এ গল্পটি তো তুমি হাজারবার বলেছো। লক্ষবার বলেছো। আর কতবার বলবা?
একটু কায়দা করে বললাম, ওকে, এর মধ্যে আরও গল্প লুকিয়ে আছে, সেটা বের কর।
মেয়ের আমার সামার ভেকেশন চলছে। সুতরাং ঘুম আসে না। ঘুম আনতে তার গল্প চাই। সে কারণে গল্পের ভিতরে বাপমেয়েতে দুজনে মিলে গল্প খুঁজতে লেগে গেলাম।

পান্তা বুড়ির আন্তা গল্প
----------------------
পান্তা বুড়ির দেশটা বাংলাদেশ। সেখানে বুড়িটা একা থাকে। তার ছেলে মেয়ে নাতি পুতি কেউ নেই। বুড়িটা খুব গরীবও। তাকে একা একা চলতে ফিরতে হয়। কোনো কাজের মেয়েও রাখতে পারে না। আর দেশে বৃদ্ধাশ্রমের সিস্টেমও নাই। বুড়িটা এত গরীব যে তার দুগ্গা চাল জোগাড় করতে হয় ভিক্ষা করে। আনাজ পাতিও জোটে না। আর লাকড়িসাকড়িও বেশি নাই। ফলে রান্না একবার। স্রেফ ভাত। কিছু খায়। আর কিছু পান্তা করে রেখে দেয়। পান্তা পরদিন খায়। এইভাবেই পান্তা বুড়ির দিন কাটে।

দেশের অবস্থাও খুব খারাপ। পান্তা জোগাড় করাও কঠিন। লোকজনের ঘরে টাকা পয়সা নাই। চোরদের পান্তাও চুরি করতে হচ্ছে। আর রাজা শুধু উপদেশ দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ করে না। রাজা রাজা হয়েই খুশি। প্রজাদের হাতে হেরিকেন।
প্রজারাও রাজার চেয়েও অধম। তারা রাজাকে কিছুই বলে না। চোর ছ্যাছোড় ঠেকাতেও পারছে না। তারা চুরি ছ্যাচড়ামিকে তাদের কপালের লিখন বলে মেনে নিয়েছে। তারা ধরে নিয়েছে—কিছু বললেও রাজা কিছু করবে না। ফলে প্রজারা নো মিছিল। নো মিটিং। নো হরতাল। নো বিপ্লব। করো বিপদেও প্রজারা একে অপরের এগিয়ে আসে না। কোনো মতে প্রাণধারণ করে নাক গুঁজে ঘুমায়। ফলে বুড়িকেই শেষে রাজার কাছে যেতে হল।

রাজার দরবারে ঢোকা সহজ নয়। কিন্তু বুড়ি ঢুকতে পারল। রাজা তাকে খুব সহজেই দরবারে ঢোকার চান্স দিল। রাজা সিকিউরিটি প্রধানরে জিজ্ঞেস করল, ওকে ঢুকতে দেবা?
হ্যা মহারাজ। বুড়ি মানুষের কাছ থেকে রাজার কোনো ভয় হওয়ার আশঙ্কা নাই। সে রাজার কি করবে? করলে রাজাকে তুমি রাজা থেকে গজা হও বলে আশীর্বাদই শুধু করতে পারবে।
আশ্বস্ত হয়ে রাজা খুশী মনে বুড়িকে দরবারে ঢোকার পারমিশন দিল।

রাজাকে গড় করে বুড়ি বলল, রাজামশাই, আমার পান্তা চুরি হইয়া যাইতাছে। আমিতো না খাইয়া মরতেছি।
পান্তা খাওনেরর দরকার কি? কেক খাও।
কেক কি জিনিস?
বুঝছি। কেক জিনিসটা তোমার বাপের জন্ম শোনোনি। শোনার দরকারও নাই। তুমি এখন কি কইতে চাও সেইটা কও বুড়ি।
আমার পান্তা চোর ঠেকান।

রাজা এই রকম অভিযোগ কখনো শোনেনি। তার মন্ত্রী যন্ত্রী শান্ত্রী সেপাইরা সব সময় বলছে, দেশে কোনো সমস্যা নাই। এরকম শান্তি দুনিয়ার কোথাও খুঁজে পাবো নাকো তুমি। তাইলে এই বুড়ি কি মিথ্যে কথা বলছে?
মন্ত্রী যন্ত্রী শান্ত্রী সেপাইরা সমস্বরে বলল, নিশ্চয়ই মহারাজ, বুড়ি মিথ্যে কথা বলছে। বুড়িকে শত্রুপক্ষ পাঠিয়েছে। অপপ্রচার করছে। এইজন্য বুড়িকে শাস্তি দেওয়া দরকার।
কি শাস্তি?
শুল। শুলে চড়ানো হোক বুড়িকে। আর চিরস্থায়ী শান্তি রচনার জন্য আর কোনো ডক্টরেট নয়— আপনাকে এবার জলজ্যান্ত নো-বেল দেওয়ার প্রস্তাব রাখছি।
তথাস্তু। বলে বুড়ির শুলে চড়ানো অনুমোদিত হল। আর রাজার জন্য নো-বেল।

সে দেশের রাজারও এক থুত্থুড়ে উপরি রাজা ছিলেন। তাকে বলা হত গজা। গজার কোনো বিশেষ কাজ নেই। মাত্র দুটো কাজ। এক. কবর জেয়ারত করা। দুই. শুলে চড়ানো মাফ করে দেওয়া। বুড়ি তখনো জীবিত আছে। সুতরাং তাকে গজামশাই আনন্দিত মনে মাফ করে দিলেন। একটা ভাল কাজ করতে পেরেছেন মনে করে দীর্ঘদিন পরে ভাল একটা ঘুম দিলেন। তারপর রাজাও ঘুমায়। গজাও ঘুমায়।

বুড়ি শুল চড়ানোওয়ালাকে বলল, ও বাবা শুলুমনি, তুমি আমারে মাইরা ফেললেই ভাল হইত। বাঁচাইয়া রাইখাতো বড়ো বেপদে ফেললা!
ক্যানগো বুড়ি মা? হগ্গলেই তো বাঁচতি চায়। বাঁচনের লাইগা আমাগো ট্যাকা পয়সা ভেট দেয়। তোমার সমস্যা কি?
তুমি বাঁচাইল্যা কেমনে? এখনতো না খাওয়াইয়া মারনের ধান্ধা করছোগো বাপ। চোরতো এখন আর কেবল রাত্তিরে নয়-- রোজ রোজ দিনেও আসতি থাকবে। আমার পান্তাভাত খাইয়া ফেলবে। আমি খামু কি?

শুলওয়ালা বেশ বুদ্ধিমান। বিচারপতি হওয়ার যোগ্য। খুক খুক করে হাসে। হাসতে হাসতে সেই বিচারপতি হওয়ারযোগ্য শুলুমনি বুড়িকে কানে কানে একটা বুদ্ধি দিয়ে দিল। বুড়ি সেই বুদ্ধি নিয়ে বাড়ি ফিরল। তার মনে সুখ। তাকে খালি হাতে ফিরতে হয় নাই। সে যেমনই হোক কিছু বুদ্ধি তো পেয়েছে। অন্যরা তো রাজার দরবার থেকে খালি হাতেই ফেরে। কিন্তু এর বিনিময়ে বুড়ির কি খসলো? বুড়ির মাথার চুল কেটে নেওয়া হল। এইটাই বিচারকের ভেট। ভেট ছাড়া বিচারপতিরা রা করে না। বিচারপতিরা রা করলে রাজারা হা করে না। এইখানেই অসুখ।

বুড়ি পথে ফিরতে ফিরতে কিছু খুদ কুড়ো ভিক্ষে করল। খুবই সামান্য খুদ কুঁড়ো। সেটা ফুটিয়ে খেয়ে নিল। সেদিন পান্তা করার বাড়তি ভাত নেই। আর দরকারও নেই।
সে সময়ে বুড়ির বাড়ির আশে পাশে কিছু পুকুর বা খালবিলও ছিল। সেখানে শিংমাছও পাওয়া যেত। সেগুলো ধরে লোকে খেত। অথবা বাজারে বিক্রি করত। তাদের বলা হত জেলে মানুষ। এই জেলেরা একটু দয়ালুও ছিল। বুড়ি তাদের কাছে গিয়ে বলল, বাবারা, আমি তো গেছি।
কোথায় গেছো বুড়ি মা?
মইরা গেছি।
কিন্তু তুমারেতো জ্যান্তই দেখতি পাইতেছি। তুমি কি তাইলে ভুত হইছো?
ভুত নাতো কি? তরাও ভুত। হগ্গলেই ভুত।
ঠিকই কইছওৱো বুড়ি মা। আমরা ভুত ছাড়া আর কি। অখন কও, কি কইবার আইছো?
আর দুদিন পরেই মরব। তার আগে মনে একটা বাসনা রইয়া গেছে। সেইটা পূর্ণ না হইলেতো বাপারা শান্তিতে মরতেও পারছি না।
কি বাসনা বুড়ি মা?
শিংমাছের ঝোল খাব। তাজা শিং মাছের ঝোল।
ওকে। এই নাও শিং মাছ।

জেলেদের কাছ থেকে বুড়ি শিং মাছটি এনে ভাতের হাঁড়িতে রেখে দিল। আরেক প্রতিবেশির কাছ থেকে বাসনা পুরনের কথা বলে একটা কাঁচা বেলও আনল। আরেক বাড়ি থেকে আনল গোবর। মেলা বলে কয়ে কারো কাছ থেকে আনল একটা চাকুও।
বোঝা যাচ্ছে বুড়ির আশে পাশে প্রতিবেশীদের কিছু কিছু ফলপাকুড়ের গাছও ছিল। আর দুধেল গরুও ছিল। তবে তারা বুড়িকে সে দুধ দিত না। সে দুধ তারা শহরে বেঁচে দিত। রাজাগজারা খেত। বুড়ির নিজের গরু থাকলে অবশ্য পান্তার বদলে বুড়ি দুধভাতই খেত। গল্পে এই ঘটনাটি বোঝা যায়।

রাতে নয়—বুড়ি ফিরেছে খবর পেয়ে সন্ধ্যার পর পরই চোর এসে সোজা পান্তা ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিল। শিং মাছে কাঁটা ফুটিয়ে দিল।

ভান্তা সপ্পো
------------
আমার মেয়ে বলল, বাবাগো, চোরটা কি একটু বোকা ছিল?
চোর বোকা হবে কেন?
হাঁড়িতে হাত ঢোকানোর আগে একটু পরীক্ষা করে দেখল না-- ওর মধ্যে ভাত আছে, না, শিং মাছ আছে?
ঠিক প্রশ্ন। কিন্তু চোর পরীক্ষা করবে কিভাবে। রাতের বেলায় বুড়ির ঘরেতো আলো জ্বালানোর কোনো কায়দাই নেই। কেরসিন পাবে কোথায়?
তাহলো চোর টর্চ লাইট নিয়ে আসতে পারত।
চোরতো খুবই গরীব। টর্চ লাইট পাবে কোথায়?
কেন, অন্য লোকের বাড়ি থেকে?
অন্য লোকের বাড়িতে টর্চ কেন, বাত্তি ফাত্তি কিছুই নেই। কেনার টাকা পয়সাও নেই। থাকলে কি চোর বুড়ির বাড়ির পান্তাভাত চুরি করতে আসত রোজ রোজ?
তাইলে আলো জ্বলে কোথায়?
রাজাগজামন্ত্রীযন্ত্রীশান্ত্রীসেপাইদের বাড়িতে।
মেয়ে শুনে বলল, হুম। দেশের মানুষেরও রাতে বাতি জ্বালানোর কেরোসিন নেই। কেরোসিন কেনার পয়সাও নেই। খুব ভয়াবহ দেশতো বাবা? কিন্তু বাবা, কাঁচা বেল ফুটে তো চোরের চোখ নষ্ট হয়ে গেল। সামান্য পান্তা চুরির অপরাধে তার চোখ নষ্ট করা কি ঠিক হল? এটা তো বর্বর কাণ্ড। বল, বর্বরতা নয়?

মেয়ের এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আমার কাছে। এই রকম কঠিন কঠিন প্রশ্ন বলা শুরু করেছে। গেছি। চোখ বুজে ঘুমানোর ভান করলাম। মেয়ে গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, বাবা তুমি যে আগে বলেছিলে বুদ্ধিটা বুড়িকে রাজা দিয়েছিল। এখনতো আমরা বের করলাম শুলমনি বুদ্ধিটা বুড়িকে দিয়েছে। তাইলে রাজা দিল কিভাবে?

আমি নাক ডাকার ভান করি। বকবকানি শুনে মেয়ের মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। হাই তুলে জবাব দেয়- দেশের সব কথাই রাজার নামেই চলে। রাজার লোকজন যে যা কিছু বলে-সব রাজার নামেই বলে। রাজার কথাই সবার কথা। অন্যের কোনো কথা থাকতে নাই।
সে কি করে হয়? সে কি হয়?
হয় মা। দেশে এইটাই হয়।
পচা দেশ। পচা দেশ। পচা দেশ। মেয়ে বিড় বড়ি করে ঘুমিয়ে পড়ে।


মন্তব্য

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ভালো লাগল ... তবে গজারা বোধহয় বুড়ির মত কাউকে মাফ টাফ করে না ... এইটুকু বাদে বেশ

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

চোর পালায়। বুদ্ধি বাড়ে না। এবং পচা দেশের মালিক জনগণ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ভাল্লাগছে।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

The Reader এর ছবি

হাততালি

সৈয়দ আফসার এর ছবি

ভাললাগা জানাই।
কুলদা, কেমন আছেন আপনি?

__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।