একটি চিনাবাদাম প্রকল্পের খসড়া

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৬/০৫/২০১১ - ৫:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জামাতের গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধী হলে চিনাবাদাম উগ্র বাম রাজাকার কমরেড আব্দুল হক যুদ্ধাপরাধী নয় কেন? কেন তাকে—চিনাবাদামদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় আনা হবে না?

এ প্রশ্নটি করেছেন আমার কলম বন্ধু মানিক। মানিক আমাদের দেশের চিনাবাদম রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন—একাত্তর তার প্রিয় বিষয়। চিনাবাদামদের ভূমিকা নিয়ে একটি বইও লিখছেন।

পাকিস্তান আমলে এই চিনাবাদাম উগ্র বামরাজনীতিকদের ভূমিকা কী ছিল? বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের বিরোধিতা করা, সামরিক আইয়ূব খানকে নিঃশর্ত সমর্থন করা, ৬ দফাকে সিআইএর দলিল ঘোষণা, বাঙালি সংস্কৃতিকে ফ্যাসীবাদি বলা, রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করা, সত্তরের নির্বাচনকে বাতিল করার জন্য জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে গাটছড়া বাঁধা, মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলা, পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, আর চাঁদাবাজি-লুটপাট করা—এইতো চিনাবাদাম বিপ্লবীদের ইতিহাস। জামাতে ইসলামী আর মুসলিম লীগও একই কাণ্ডগুলো করছে ধর্মের নামে, আর চিনাবাদাম উগ্র বামরা করেছে মার্কসের নামে, লেনিনের নামে, মাও সে তুংএর নামে।

পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির চিনাবাদাম কমরেড আব্দুল হক বলেছিলেন--মুক্তিযুদ্ধের নামে হচ্ছে পূ্র্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসন । অতএব মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই । আমার এই বন্ধু মানিক বলেছেন-- মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে যার যে ভূমিকাই থাকুক না কেন , একাত্তরের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী রাজাকার ,আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটি , মালেকের মন্ত্রীসভার সদস্যরা, হক-আলাউদ্দিনের চীনাপন্থী কমিউনিষ্ঠদের ভূমিকা আমার কাছে ঘৃন্য ছিল , আছে।

জামাতে ইসলামী এখন বলছে, একাত্তরে হিন্দু আধিপত্যবাদী ভারতের চক্রান্ত রোধের জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। আর চিনাবাদামরা বলেছিল, চিনের শত্রু সম্প্রসারণবাদি ভারতকে রোখার জন্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। দুপক্ষই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধর বিরোধিতা করেছে ভারত বিরোধিতার কথা বলে। দুজনেরই উদ্দেশ্য এক—ভারত বিরোধিতার আড়ালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা করা। রাজাকারী করা। তাহলে চিনাবাদামরাও যুদ্ধাপরাধী।

একাত্তরে ৩০ লক্ষ বাঙালি পাক বাহিনীর গুলি খেয়ে মরেছে। আর তখন চিনাবাদাম আনোয়ার জাহিদ মুরগী সাপ্লাই দিচ্ছে পাকবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে। মশিউর রহমান যাদু মিয়া ভারত থেকে ভাসানীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়ে মদ সাপ্লাই দিচ্ছে পাকিদেরকে। বদরুদ্দিন উমর পাজামা পরে নিরাপদে ঢাকার আত্মীয়দের বাসায় থেকে ভাবছেন—এ যুদ্ধে মহান মার্কস সাহেবের শ্রমিক শ্রেণীর লাভ কি? আব্দুল হক, মোহাম্মদ তোয়হা, আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিনরা রাজাকারদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদিদের সমর্থকদের ওয়াও ওয়াও করে গুলি করছে।

বাঙালীরা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে—আর ওনারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের কথা বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নন—অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ফালাফালি করছেন। তাদের কাছে বাংলাদেশ শব্দটি পছন্দের নয়—পছন্দ পূর্ব পাকিস্তান। খুব বেশি হলে পূর্ব বাংলা—নো বাংলাদেশ।

যখন দেশের মানুষ তথাকথিত লৌহমানব পাকিস্বৈরসেনাশাসক আইয়ূব খানকে শিমুল তুলোর মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে ১৯৬৯এ গণঅভ্যুত্থানের হাওয়ায়—তখন এই চিনাবাদাম কমরেডদের সাইক্লোস্টাইল করা দলিল দস্তাবেজে শোনা যাচ্ছে , ওনারা এই সব বুর্জোয়া শ্রেণীর কর্মকাণ্ডে নেই—ওনারা গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে কাজ করছেন। কি কাজ করছেন? কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ? কি জন্য কৃষকদের সংগঠিত করবেন তারা? প্রশ্ন নেই—উত্তরে পাহাড়। তখন কি এই মার্কসবাদী মাওলানাদের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে কোনে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল? কোনো আন্দোলন সংগ্রাম? খুঁজে পাওয়া কঠিন। সাধারণ মানুষ কি কখনো তাদের সঙ্গে এসেছিল? এলে কি চিনাবাদরা ক্ষোভে বলতে পারতেন—শুয়োরের বাচ্চা জনগণ/ থাকলো তগো নির্বাচন/ চল যাই সুন্দরবন।

সে সময়ে বিপ্লবের নামে চিনাবাদামরা এক ফ্যান্টাসীর জগতে বাস করছেন। শিক্ষিত সরলপ্রাণ যুবকদের বিভ্রান্ত করে তাদের বলির পাঠা করেছেন। বিপ্লব বিপ্লব নামের খেলা করতে পছন্দ করেছেন। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব হলেই তাকে দালাল ঘোষণা করে ঠুস করা হয়েছে। গ্রামের অবস্থাপনাপন্ন বাড়িতে বসবাস করেছেন। ফ্রি খাওয়া দাওয়া করেছেন। নিয়মিত চাঁদাপাত্তি জোগাড় করেছেন। আর মাঝে মাঝে শ্রেণী শত্রু খতমের আওয়াজ দিয়েছেন। এই শ্রেণী শত্রু কারা? জামাতি? মুসলিম লীগ? ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিরা? নো। তারা নয়। এরা কোনোদিন এদের বিরোধিতাও করেন নি। কোনোকালে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এরা রুখে দাঁড়িয়েছেন বলেও কোনো ঘটনা নাই। কেউ কেউ আবার এই অবস্থাপন্নদের মেয়েদের প্রেমেও পড়েছেন। তাদের জামাই সেজেছেন। শ্বশুরজী জামাতি—আর জামাইজী চিনা বিপ্লবী। দুজনের উদ্দেশ্য এক-- মহান পেয়ারা পাকিস্তানকে হেফাজত করা। পাক সার জামিন সাদ বাদ। কদম কদম বাড়ায়ে যা। ওরে আয়, লুটে পুটে খা। এইতো ইতিহাস! বিপ্লব আসিতে আর বিলম্ব নাই রে, সোনা! আসো, পেয়ারাবাগানে ঘুমাই।

এরা বলেছিলেন, ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ূব। আইয়ুব খান খুব ভাল মানুষ। তিনি আমগো চেয়ারম্যান ম্যাও সাবের দোস্তি। সুতরাং আমগো তিনি খুইব দোস্তি বটে। ইয়াহিয়া খান লোক ভাল। ভাল মদ খায়। টিক্কা খান আরও ভাল। মিস্টার ভুট্টোর তুলনাই নাই। তিনি লারকানার ভূস্বামী বটে--কিন্তু সর্বহারা বলা যাইতে পারে--সমাজতন্ত্রীও। টিক্কা খানের সঙ্গে জামাতের গোলাম আযম মিটিং করেছে। সে ছবি পত্রিকায় এসেছে। আর চিনাবাদামদের এরকম কোনো ছবি পাওয়া যায় না টিক্কা খানের সঙ্গে, ভুট্টোর সঙ্গে। কিন্তু একটা চিঠি পাওয়া যায়। লিখেছেন কমরেড আব্দুল হক। প্রাপক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো। সময়কালটা উনিশ তেয়াত্তুর। বাংলাদেশ তখন স্বাধীন। তিনি লিখেছেন কমরেড ভুট্টোর কাছে—ভাইলোগ, কিছু টেকা পয়সা আর অস্ত্রপাতি পাঠায়া দ্যান। আমরা পেয়ারা পাকিস্তানরে পুনরুদ্ধার কইরা ফালাই। বোঝেন। এই চিনাবাদম কমরেড আব্দুল হক মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন, প্রচুর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন এবং তিনি জীবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করেননি । হক মুক্তিযুদ্ধকে বলেছেন-- মুক্তিযুদ্ধের নামে পূ্র্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসন । অতএব বিপ্লবীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হল মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা । তখনকার সময়ে, একাত্তরের জুনে পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে নকশালী চারু মজুমদার স্পষ্টই সমর্থন দিয়েছেন হক-তোয়াহাদের।

আর শোনা যায়, বরিশালের পেয়ারা বাগানে সিরাজ সিকদার মরণপণ যুদ্ধ করছেন। ও যুদ্ধের বিস্তৃতি কি ছিল? সিকদার থাকতে পাক বাহিনী শর্ষিণার রাজাকারদের দিয়ে কী করে পেয়ারা বাগান কেটে ফেলল? কি করে পেয়ারা বাগানের নাকের ডগায় শর্ষিণার পীর নেছারউদ্দিনের বাড়িতে জল্লাদখানা খোলা হয়েছিল? সিরাজ সিকদার কি তখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাও সে তুংএর নামছাপা করা লাল মলাটের বই মাথায় রেখে পাক বাহিনীর সঙ্গে মনে মনে যুদ্ধ করছিলেন? আর কবিতা লিখেছিলেন? তার সাঙ্গাৎ মগবাজার মোকাবেলা বহিতে পরে লিখছেন-- ‘ধর্ম, রাজনৈতিকতা ও কবিতার সম্পর্ক বিচারই যে একালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পূণর্গগঠনের পূর্বশর্ত’। মাও সাবেও কবিতা লিখতেন। কবিতা লেখা ছাড়া বিপ্লব আর প্রেম হতে পারে না। কবিতা না থাকলে বিপ্লব আর প্রেম দূর দিয়ে চলে যায়—আঙিনায় আসে না।

সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি অনেক বড় গপ্প। গপ্পের গরু গাছেও ওঠে। এত্তো বড় গপ্প—উনি এত বড় মুক্তিযোদ্ধা যে, দেশ স্বাধীন আগে -- ৭ জুন ১৯৭১ তার সর্বহারা পার্টির প্রচারপত্র উল্লেখ করা হয় "পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন (সর্বহারা পার্টির অঙ্গ শ্রমিক সংগঠন) প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীসহ সকল দেশপ্রেমিক পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক পথে সংগ্রাম পরিচালনা করতে আহবান জানায়। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু ভারতীয় দালাল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই । সুতরাং এই সিরাজ সিকদার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বলে ফেললেন, নো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অস্তিত্ব মানি না। আমার পার্টির নাম তাই বাংলাদেশ করব না—রাখব পূর্ব বাংলার সর্বহারার পার্টি। তিনি বরাবর ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে হরতাল ডাকতেন। দেখুন—তার ধারার হক-তোয়হার পার্টির নাম—পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। অদ্যাবদী তাদের গলাকাটা পার্টি এবং চাঁদাবাজি পার্টি হিসাবে অস্তিত্ব কোথাও থেকে থাকলেও বাংলাদেশ নামটিকে এখনো নেয়নি তারা। এখনো সেই পূর্ব বাংলা। নো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে অবস্থিত এই পূর্ব বাংলাটি কোথায় রে ভাইসগোল?

একাত্তরে ১৬ই ডিসেম্বরে পাকবাহিনী পরাজিত হলে পাকিদোসর মুসলিম লীগ, জামাতের চাঁইবাজ নেতাদের কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে কেউ পাকিস্তানে, কেউ সৌদিতে, কেউ লন্ডনে। আর বাকীরা বাংলাদেশের মধ্যেই গা ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ দালাল আইনে ধরাও খেল। অনেকে সাধারণ আইনে ছাড়া পেয়ে গেল। আর কমরেড সেনাশাসক জিয়া এসে খোদ দালাল আইনটিকেই বিদায় করে দিলেন। বললের, যাও বাপু, বিদেশ থেকে গোলাম আযমকে ডেকে আন, সাকা চৌধুরীকে ফিরিয়ে আন। উহাদের কষ্ট আর সহিতে নারি। এই জিয়া ঘোষণা করতে ভালবাসতেন। তিনি শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত নন। ঘোষণা কায়েমও করেন। তিনি কায়েমী স্বার্থবাদি অশুভ শক্তি। তার কথা পরে হোক।

কিন্তু ৩০ লক্ষ বাঙালীর রক্ত আর ৩ লক্ষ ধর্ষিতার আর্তনাদের অন্যতম কারিগর সেই চিনাবাদাম উগ্র বাম বিপ্লবীগণ কিন্তু বিদেশে পালালেন না। জেলেও তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না। দালাল আইনে কি তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হলেন? উত্তর—একেবারে নো। তাইলে তাদের কী হল? দেখতে পাচ্ছি—সদ্য স্বাধীন দেশের নবজাত সরকারের বিরুদ্ধে তারা রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বাংলাদেশ যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক দেশ। এক কোটি শরণার্থীর সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফেরা, ৩০ লক্ষ স্বজন হারানো মর্মবেদনা আর দেশী-বিদেশী চক্রান্তের ফোস ফোসানী নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ গ্রুপ ডিপ্রেশনের শিকার। এর মধ্য বন্যা, মারী ও মড়কের মধ্যে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা বিদেশে থেকে চাঁদা তুলছে আর থুবড়ে পড়া পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন করে বেড়াচ্ছে। এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়েছিল। কিন্তু রাজাকাররা জমা দেয়নি। তারা গোপনে গোপনে অর্থ, অস্ত্র আর তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল দিয়ে সরকারকে অস্থির করে তুলছে। এই লোকবলের মধ্যে আছে—পাকিবাহিনীর হাতে গড়া সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন যারা মুক্তিযুদ্ধ অংশ নেয়নি— যারা পাকিদের সহায়তা করেছে। এরা সবাই মিলে সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। সরকারের মধ্যেকার সুবিধাবাদি গ্রুপকে কিনে ফেলেছে। তখন এই চিনাবাদাম বিপ্লবীরা বসে নেই—তারাও নবোদ্যমে নেমে পড়েছে। নতুন দেশে বোমাবাজি, লুটপাট, শ্রেণীশত্রু হত্যার নামে গলাকাটা অভিযান পরিচালনা, ডাকাতি, রাহাজানি, ব্যাংক-থানা লুট, জ্বালাও পোড়াও কর্মকাণ্ড, বিজয় দিবসের দিয়ে হরতাল ডাকা—এইতো তাদের কর্মসূচি। চিনাবাদামদের এইসব কর্মসূচি কাদের পক্ষে গেল? একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগিদের পক্ষে—একদা তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মেরেছে, একাত্তরের পরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর কাজটিই আবার কাঁধে কাধ মিলিয়ে করেছে। নেতা কে? আব্দুল হক, আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন— আর সিরাজ সিকদার।

‘এই বীর সিরাজ সিকদারকে কেন মারা হল’—তার জন্য মৃত বঙ্গবন্ধুকে এখনও জবাবদিহি করতে হচ্ছে। মনে কি পড়ে—বিএনপি-জামাতসৃষ্ট র‍্যাববাহিনী ঢাকার গোপন আস্তানা থেকে ধরে গুলি করে হত্যা করেছিল বিএনপি-জামাতের নির্দেশে উগ্রবাম নেতা মোফাখখারুল ইসলাম চৌধুরীকে? যেহেতু এই খুনটি করা হয়েছিল বিএনপি-জামাতে নির্দেশে—সেকারণে সিরাজ সিকদারের হত্যাকাণ্ডের মত কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর সঙ্গে এই মৃত্যুটির তফাৎ কি?

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হল—পাকিস্তানপন্থীরা যখন আবার ক্ষমতা নিল, তখন কিন্তু বিপ্লবীরা থেমে গেলেন। বিপ্লব সব শেষ। তারা সুড় সুড় করে কমরেড পাকিপন্থী সেনানায়ক জিয়ার সঙ্গে ভিড়তে শুরু করলেন। দেখা গেল চিনাবাদাম নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়া জিয়ার মন্ত্রী সভার সিনিয়র মন্ত্রী। সাংবাদিক এনায়েততুল্লাহ খান বিশাল মন্ত্রী। এদের সঙ্গে মন্ত্রী হিসাবে যোগ দিয়েছে একাত্তরের দালাল কুখ্যাত শাহ আজিজ এন্ড গং। শাহ আজিজ একাত্তরে জাতি সঙ্গে গিয়ে বলেছিল—পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক। একহাতে তার লালপতাকা অন্যহাতে পানপাত্র। দেখা গেল খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এসে গেছেন এদের সঙ্গে। পরে আমরা দেখব—তিনি জিয়াবিবি খালেদার বিএনপির জেনারেল সেক্রেটারি। চিনাবাদামদের কাউকে কাউকে দেখা গেল স্বৈরশাসক এরশাদের সঙ্গে।

স্বৈরশাসক এরশাদের মন্ত্রীসভায় ঝাড়ু দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন চিনাবাদামকামপন্থী আনোয়ার জাহিদ, সিরাজুল হোসেন খান প্রমুখ। সঙ্গে পাকিস্তানী খুনী আব্দুল আলিম, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা। বামে আর পাকিতে কী অদ্ভুদ মিল—করে ঝিলমিল। আর যেসব মধ্যচিনাপন্থী—তারাও যোগ দিয়েছেন জিয়া, এরশাদ, খালেদার দলে। দেখুন চিনাবাদাম মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া বিএনপির সেক্রেটারি, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বিএনপির সেক্রেটারি। কাজি জাফর আহমেদ এরশাদের প্রধানমন্ত্রী—এখনো এই চিনিচোর বিপ্লবী তার সঙ্গে।

এই চিনাপন্থীদের কাউকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলে ভিড়তে দেখা যায়নি। এরা ভিড়েছে সামরিক শাসকদের সঙ্গে—পাকিস্থানপন্থী প্রতিক্রয়াশীল এরশাদ, জিয়া, খালেদার সঙ্গে। জামাতের সঙ্গে সরাসরি কাউকে দেখা না গেলেও এই চিনাবাদামদের কেউ কেউ জামাতের পত্রপত্রিকায় লেখেন, টেলিভিশনে টকশোতে কহেন—জামাতের রাজনীতির পক্ষে সওয়াল করেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে এরা একটি ক্যালোরী ক্ষয় করে না। পাঁকে পাকিদের গমন ছাড়া কথা কথা নাই। এদের হাতকেই এরা শক্তিশালী করছে। আর হালুয়ারুটি কামাচ্ছে। মস্কোপন্থী বামদের সর্বত্যাগী একটা ভূমিকা ছিল—আর চিনাবাদামদের চরিত্র সর্বগ্রাসী । কী বৈপরীত্য! দেখা যায়—এরা দেশের কোনো এলাকায় গলাকাটা করছে, চাঁদাবাজি করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। আর নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামাতের হয়ে ভাড়া খাটছে।

এটা একটা চিনাবাদাম প্রকল্প। এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল হক-তোয়হা-মতিন-আলাউদ্দিন-সিরাজ সিকদারদের দিয়ে। এখন বরবাদ মজহারে এসে তাইরে নাইরে করছে। এদের সঙ্গে জামাতে ইসলামীর কোনো মৌলপার্থক্য নেই। এরা এখন বলছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ছিল ফ্যাসিবাদী কর্ম। মুক্তিযোদ্ধারা ছিল সন্ত্রাসী। জঙ্গীবাদি মৌলবাদিরা সহি বিপ্লবী। এনারা জঙ্গীদের বোমাবাজি-মানুষ হত্যার সমর্থনে কলাম লিখছেন। জঙ্গী হিজবুত তাহরীর উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছেন। বলছেন, সেক্যুলাররা ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে উৎখাতের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে নেমেছে। জামাত ধর্মের নামে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে মানুষ খুন করেছে—এখনো পাকিস্তানকে ফেরত আনার ধান্ধা করছে। আর চিনাদামরা মার্কস-মাওসেতুংএর নামে জামাতি পাকিদের সঙ্গেই ছিল—এখনও আছে।

সম্প্রতি মার্কস-মাওয়ের সঙ্গে এরা নাম নিচ্ছে ফুকো, দেরিদার। মিশেল দিচ্ছে মৌলবাদ আর উত্তরাধুনিকতার।। আর সেই হিন্দুবিদ্বেষ, সেই সাম্প্রদায়িকতা, সেই বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতা, ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রের বিরোধিতা, ভারতবিরোধিতার নামে প্রগতিশীলতার মুণ্ডপাত—এই হচ্ছে এদের কাণ্ডকারখানা। এরা মিডিয়া কিনেছে—তরুণদের কিনছে, বুড়ো অবসরপ্রাপ্ত প্রগতিশীলদের কাউকে কাউকে ভাড়া করছে, বানাচ্ছে পাকিপ্রোপাগাণ্ডামূলক ছিঃনেমা ‘মেহেরজান’।
এইসব করছে জামাতের পয়সায়। টাকা পয়সা কামানোটাই এদের আসল কর্ম। এদের কাছে সর্বহারার বিপ্লবটা নকল।


মন্তব্য

মৌরী এর ছবি

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন...

guest_writer এর ছবি

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন ক্যানো জানতে পারি?
-মেফিস্টো

রবিন হুড এর ছবি

কুলদা রায়, আপনি নিজেও বোধহয় বামপন্থী ছিলেন একসময়, নাকি? চিন্তিত

সেতু এর ছবি

উনি বামপন্থী নন, আমপন্থী ছিলেন এবং এখনো আছেন।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ন্যাশনালিস্ট পলিটিক্স এবং ক্লাস পলিটিক্স দুইটা দুই ধারায় চলতে পারে (সবর্ত্র চলছে কিনা সেইটা ভিন্ন প্রশ্ন) -- কিন্তু উপনিবেশবাদবিরোদী জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে যথাসময়ে চিহ্নিত করতে না পারার ব্যর্থতাকে কোনো তত্ত্ব দিয়া ডিফেন্ড করা যায় না।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নিধুবাবু এর ছবি

ভারত উপমহাদেশের বামপন্থিরা, যাদের 'ক্লাস পলিটিক্স' এর ধারক বলছেন বাই ডেফিনিশন জাতীয়তাবাদি রাজনীতি প্রভাবিত। এটা তাদের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু এখানে সেটা মূল বিষয় নয়। মূলবিষয় 'উপনিবেশিকতা'। 'স্বায়ত্তশাসন', 'স্বশাসন' ইত্যাদির সংগ্রাম আর 'উপনিবেশিকতা' বিরোধী সংগ্রাম ঠিক এক কথা কি? উদাহরণ হিসেবে ভারতের কাশ্মির কিংবা মিজোরাম-নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতার আন্দোলনকে কি আমরা (ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট সহ) 'উপনিবেশবাদবিরোদী আন্দোলন বলে গণ্য করব? ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের কাছে তো এ 'বিচ্ছিন্নতানবাদী' আন্দোলন। বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতার বা তাদের পূর্বসূরীরা সবাই কিন্তু ১৯৪৭ এ নিজ পছন্দেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন, সমর্থ এবং এর পরিচয়ের সঙ্গে নিজেদের সনাক্ত করেছিলেন। পরবর্তিতে তাদের বনিবনা হয়নি বা 'ভুল' উপলব্ধি করে তাদের আলাদা হতে রক্তক্ষয়ি সংঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
আবার এখন আপনার 'ক্লাস পলিটিক্স' বেসিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে কি দাঁড়ায়? শাসক একটি শ্রেণী। তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও কর্তৃত্ব বলে সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন শোষণ পাকিস্তান, ভারত বা বাংলাদেশ সর্বত্রই শাসক শ্রেণীর চরিত্র মুটামুটি এক। করে। 'ক্লাস পলিটিক্স' ওয়ালারা বিশ্বের সব শোষিত ও শাসক-শোষক স্ব স্ব শ্রেণীর সংহতির বিশ্বাসী। এখন প্রশ্ন (পশ্চিম) পাকিস্তানের সমস্ত লোকই শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিল, বা এখনও আছে? তাহলে ১৯৪৭ এ ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদী’ ও পরে রাতারাতি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ হওয়াদের কথা বাদই দিলাম, 'ক্লাস পলিটিক্স' ওয়ালারা যারা পাকিস্তান মেনে নিয়েছিলেন, তাদের পাকিস্তানের সিন্ধ, বালুচ, পাঠান এমন কি পাঞ্জাবী শোষিতদের সঙ্গে সংহতি কোথায় ছিল?

ফরিদ এর ছবি

প্রচুর অজানা তথ্য সামনে আসলো।

তবে শুধু একজনের লেখা পড়ে কোন বিষয়ে চুড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গী নেয়া মুশকিল। লেখক ও পাঠকদের প্রাণবন্ত আলোচনা আশা করছি লেখার তথ্য, বিষয়বস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরে।

ফরিদ এর ছবি

প্রচুর অজানা তথ্য সামনে আসলো।

তবে শুধু একজনের লেখা পড়ে কোন বিষয়ে চুড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গী নেয়া মুশকিল। লেখক ও পাঠকদের প্রাণবন্ত আলোচনা আশা করছি লেখার তথ্য, বিষয়বস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরে।

সন্দেশ এর ছবি

সচলায়তনের নীতিমালা অনুযায়ী একটি পোষ্ট ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত অন্যত্র প্রকাশিত হতে পারবে না। নিয়মটি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

http://porimanob.amarblog.com/posts/131481

মান কচু এর ছবি

ভাল লাগলো,সিরাজ সিকদারের ব্যপারটি জানার ইচ্ছা ছিল সেটা কিছুটা জানতে পারলাম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।