খড়ম পরিবার অভ্যাস না থাকিলে এ লেখা পড়া নিসেদ : খড়মবাড়ি

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৬/২০১১ - ৩:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
আমার আজা মশাইয়ের একজোড়া পাদুকা মাত্র। কাঁঠালকাঠের। একে খড়ম বলে। এই খড়ম পড়লে জগৎ ভ্রমাণো যায়। তখন আকাশে বাতাসে ধ্বনি ওঠে—খট্টাস খট্টাস। লোকে ফট্টাস ফট্টাস করে বুঝতে পারে—মাস্টারবাবু চরাচর ভ্রমাইতে বাহির হইয়াছেন। সন্ধ্যাকালে ফিরিবেন। ফিরিয়া লাভ আছে। কহিবেন, এ জগতে সকলই সবার। ইহার তুল্য বাক্য নাই। এই বাক্য বলিয়া তিনি গাহিতেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ফিরিলে সোনার বাংলা পাওয়া যায়। ভালবাসা পাওয়া যায়।

আজামশাইয়ের বাড়ির নাম খড়মবাড়ি। গ্রামের গ্রাম নারিকেলবাড়ি। কিন্তু নারিকেলবাড়ি গ্রামে একটাও নারিকেল গাছ নাই। লোকে বলে নারিকেলগাছ লাগালেই ফোঁস করে জল বাড়ে। জল বাড়ে জংলা থেকে উঠোনে আসে—উঠোন থেকে ফাল দিয়ে ঘরের হাইতনা ভাসে। কলার ভেলায় চড়ে দেখা যায়—নারিকেলগাছ ডুবু ডুবু। তার কচি পাতায় হাসফাঁস—মাথি পচে গেছে। লোকে বলে, অ মাস্টারবাবু, আমগো নারিকেলবাড়িতি কি নারকেলগাছ হৈবে না?
আজামশাইয়ের খড়মের খট্টাস খট্টাস বাজে। তিনি হেসে বাক্য গড়েন, হৈবে। নিশ্চয়ই হৈবেরে বাপধন।
--কবে হৈবে?
--চিন্তা কৈরো না। হৈবে একদিন।

নারিকেলবাড়ির লোকের আর চিন্তা থাকে না। তাদের সেই একদিন আসিবে। মাস্টারবাবুর বাক্য বৃথা যায় না। তারা শোনে মাস্টারবাবুর খড়মটি দূরে রওনা করেছে। খট্টাস খট্টাস শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনো বাড়ি যাচ্ছে। অন্য কোনো লোকের কাছে যাচ্ছে। তাদের বাক্য প্রয়োজন।

লোকে এই এই হেতু আমার আজা মশাইকে গড় করে। তারা জানে, মাস্টারবাবু কথা বলেন না, বাক্য দেন। আদিতে বাক্য ছিল। বাক্য হইতে এই জগৎ সৃজন। এই বাক্যের নাম ভালবাসা। সৃজনের ধাম ভালবাসা।

২.
নারিকেলবাড়ির পরে বটবাড়ি। বটবাড়িতে কোনো বটগাছ নাই। আমবাড়ি গ্রামে আমগাছ নাই। তালতলায় তালগাছ নাই। তেতুলিয়ায় তেতুলগাছ নাই। পিঠাবাড়ির লোকজন কখনো পিঠাগাছই দেখে নাই। কালেভদ্রে তারা পিঠা গড়ে আমার আজামশাই মাস্টারবাবুকে ডেকে দেয়। তিনি নলেনগুড় দিয়ে সেই পিঠা খেতে খেতে বাক্য দেন, পিঠাগাছ হৈবে। ধৈয্য নিও। ধৈয্যে কাঁঠাল ফলে।
এই কাঁঠালবাড়ির লোকজন চিরকাল কাঁঠাল কিনেই খেয়েছে। এই হেতু তাদের মনে দুঃখ নাই। আশা আছে। একদিন তাদের কাঁঠালগাছে কাঁঠাল হাসিয়া উঠিবে। এইরূপ বাক্য কথিত আছে।

কাঁঠালবাড়ির আগে বিদ্যেধর। এই ছোটো গ্রামটিতে বিদ্যে নাই। লোকে মাছ ধরে আর ধান করে। ধান না হলে শালুক চরে। ঢ্যাপ ভাজুক করে। সে ভাজুকের নাম—ঢ্যাপের খই। স্বাদে মধুর—সামান্য তিতা। মুঠি ভরে খেতে গেলে শ্বাসের সঙ্গে নাকের মধ্যে খইগুলো ঢোকে বিনা বাঁধায় —আর বিনা ধাঁধায় নিঃশ্বাসে হাওয়ায় ওড়ে। তারা কড়জোড়ে বলে, হ্যাগো, মাস্টারবাবু—আমগো গাঁয়ে বিদ্যে ধরিবে তো?
আমার আজা মশাই ফিকফিক করে হাসেন। থিক থিক করে পলকা খই সাদা দাড়ির মধ্যে আসে আর ভাসে। তিনি তাদেরও বাক্য দেন, বিদ্যে না ধইরা যাইবে কুনহানে বাপা! কওতো, স্বরে অ। স্বরে আ।
বিদ্যা ধরের লোকজন জানে মাস্টাবাবু যখন বাক্য ধরিয়াছেন, তখন নিশ্চয়ই তাদের গাঁয়েও বিদ্যে ধরিবেই ধরিবে। হাসি হাসি মুখে তারা নিশ্চিন্তে জলজঙ্গলে যায়—আর ভুটি জাল ফেলে রাজপুঁটির সন্ধান করে। দেখে এ চরাচর জল থৈ থৈ। এ চরাচরে স্থল কৈ কৈ?
বিদ্যধরের আগে পদ্মবিলা। বিলে শাপলা আর সুন্দি নাইল আছে। তবে পদ্ম নাই। ‘পদ্ম পদ্ম’ বলে তারা ও গাঁয়ে এ গাঁয়ে যাচে।

মাঝে আন্ধারমানিক। সেখানে রাত্র গাঢ় অন্ধকার নামে। এই অন্ধকারে মানিক বেটা নাই। মানিক নাই বলে তার যুবতী লক্ষ্মী বউটি চিঁচিঁ করে কাঁদে। কেঁদে কেঁদে বলে, হ্যাগো, তুমি কবে আইবারে। আমগো ঘরের চাল দিয়া পানি পড়েরে।
আজা মশাইর খড়ম তার বাড়ি পড়ে। তিনি বাক্য করেন, আইবো মাগো জননী। না আইস্যা আমার বেটা যাইবে কই?

বউটি এখান ওখান থেকে ছন কাড়ে। চালে গাড়ে। মাচান থেকে কুমড়ো পাড়ে। বেপারী নৌকায় তুলে দিয়ে বলে, লগে ইকটু কেরেস ত্যালও দিয়েন বাপারী ভাই।
বেপারী মাঝি জিগায়, কেরেস ত্যাল দিয়া তুমার কাম কি?
--পিদিম জ্বালামু।
--তুমি সোমত্তো বিটি। আন্দারইতো তুমার জৈন্য খাসা।
-- উনি আইসবে গো। পিদিম জ্বালাইয়া চাইয়া থাহি।
--উনি কেডা?
--উনিডা মোর উনি।
--নাম নাই?
--উনির নাম—উনি। ফল্লার বাপে।
--অ বুঝছি। মাস্টাবাবু কইছেন-- মাইনক্যা অন্ধারমানিকের মাইনকা। দেহা হইলে হ্যারে কমুয়ানে। ডরাইও না ভইন। হ্যায় আইসা পড়বে।

খট্টাস খট্টাস করে জলের পরে খড়ম জাগে। স্থলের পরে খড়ম জাগে। ঘরের চালে কাগ ডেকে যায়। আর তক্ষুণি কলসী খুঁজে গুণে ঘুণে সাতটি চাল ফেলে দেয় কাগের মুখে। এই লক্ষ্মী বউটারে আজ আর কোথাও দেখি না। শুধু রাজহাঁস দেখি।

এইসব কথা বহুদিন আগের। আমার মায়ের মনে আছে। মায়ের মনেই বেঁচে আছে। মাকে বলি, মাগো, তুমার কি মঞ্চায়?
মা হাসে। বলে, কিছু চাইনা রে বাপা।
আজামশাইয়ের সাইজা মেয়ে আমার মা জননী হাসতে হাসতে থেমে যায়। খুক খুক করে একটু কাশে। কেশে গলাটা ঝালিয়ে নেয়। বলে, বাপারে, আর কি চামু। জেবন তো না চাইয়াই গেল রে। তয়—
--তয় কি মা?
--তয় মোর বাপারে দেকবার মঞ্চায়।
--আমার আজা মশাইরে?
--নারে বাপ। ভুল কইছি। বুইড়া হইছিরে বাপ। এই বুইড়াকালে মোর বাপারে পামু কই। শুদু হ্যার খড়মখানা দেখবার মঞ্চায়।

আমার মা ব্যাকুল চোখে চেয়ে থাকে। তার চোখে ছানি। কানে শক্তি কম। বসে বসে মা থরথর করে কাঁপে। মার মুখে বলিরেখায় আলো ঝিলিক দিয়েএ ওঠে একবার।

৩.
জগৎ ভ্রমিয়া বলি, অ খড়ম তুমি কই?
খড়ম বলে, আমি নারিকেলবাড়ি নাই।
--অ খড়ম, তুমি গেলা কই?
--আমি আমবাড়িও নাই।
--অ খড়ম, তুমি আছ কনে?
--আমি বটবাড়িও নাই।
--তাইলে, তুমি কইগো খড়ম?
--তালতলায় নাই। তেতুলিয়ায়ও নাই। গাববাড়িও নাই।
--অ খড়ম, তুমি পিঠাবাড়ি কি পিঠা খাইতে আছ?
--আমি পিঠাবাড়িও নাইগো নাতি। কাঁঠালবাড়িও নাই।
--বিদ্যেধরে?
--হেইখানেও নাই।
--আন্ধারমানিকে কি গেইছ খড়ম?
--আন্ধারমানিকে আন্ধার আছে—মানিকও নাই। আমি ক্যামনে সেথায় থাকিগো বাপা নাতি?
--তাইলে খড়মবাড়ি আছ?
--খড়ম না থাকলি খড়মবাড়ি থাকে ক্যামনে?
--তাইলে খড়ম, তুমি কুনহানে?
--আমি কোনহানেও নাই।
--তাইলে নাই থিকাই ফিইরা আইসো গো খড়ম। তুমারে দেখবার মঞ্চায়।

খড়ম নিশ্চুপ। নো খট্টাস—নো ফট্টাস। আজামশাইও থুপ থুপ। তার বাক্য নাই। সাক্ষ্য আছে। সাক্ষ্য বলে, ফিরিয়া লাভ কি? এ জগতে কে কাহার?


মন্তব্য

 ঢাকাইয়্যা যাদুকর () এর ছবি

গুরু গুরু

ঢাকাইয়্যা যাদুকর

The Reader এর ছবি

তুমারে দেখবার মঞ্চায় । । । হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, আপনার সংলাপ রচনায় একধরনের যাদু আছে!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কৌস্তুভ এর ছবি

হাততালি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।