রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : একাদশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৯/১২/২০১১ - ১১:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

একাদশ পর্ব
জমিদারীর সঙ্গে আসমানদারীর সূত্রপাত

রামমোহনের অনুরোধে দ্বারকানাথ ঠাকুর বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত পড়েছেন। হিন্দু কলেজে ১৮৩১ সালে ভর্তি হন। ৩/৪বছর পড়াশুনাও করেন। তাঁর ভর্তি হওয়ার পরে ২৫ এপ্রিল ১৮৩১ ডিরোজিও পদত্যাগ করে চলে গেছেন। তার ক্লাশ দেবেন্দ্রনাথের করা হয়নি। কিন্তু তাঁর শিষ্য ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সেখানে সর্বতত্ত্বদীপিকা নামে একটি সভা স্থাপিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ এর সম্পাদক হন। সভার নিয়ম করা হয়েছিল—বঙ্গভাষা ভিন্ন এ সভাতে কোনো কথোপকথন হইবেক না। সে-সময়ের হিন্দু কলেজের শিক্ষিত নব্য যুবকেরা ইংরেজি শিক্ষায় মেতে দেশি ভাষা-সাহিত্য-ধর্ম-সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা শুরু করেছিলেন। সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ সে ধারার বিরুদ্ধে বাংলা চর্চাকেই তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। রামমোহনের প্রভাবে এ সভায় ধর্মবিষয়ক আলোচনাও অন্যতম লক্ষ্য হয়েছিল। সেখানে একেশ্বরবাদ, হিন্দু, ইসলাম, খ্রীস্টান, বৌদ্ধসহ সকল ধর্ম নিয়েই আলোচনা হত। ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের সর্বশেষ বিষয়াদিও অন্তর্ভুক্ত থাকত।

১৮৩৪ সালে হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে এনে দ্বারকানাথ ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে ইউনিয়ন ব্যাংকে শিক্ষানবিশ কোষাধ্যক্ষ্ হিসাবে নিযুক্ত করেন। এ সময় দ্বারকানাথ সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য নানাবিধ নৃত্য-গীত-ভোজসভার আয়োজন করতেন। দেবেন্দ্রনাথ এই পরিবেশে বিলাস ব্যাসনের স্রোতে ভেসে যান।

১৮৩৮ সালে তাঁর ঠাকুরমা মারা যাওয়ার পরে তাঁর মনে বিচিত্রভাবের উদয় হয়। তিনি রাতারাতি পাল্টে যান। গভীর তত্ত্বজ্ঞান জানার বাসনা জাগে। তিনি মহাভারত, ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্র প্রচুর পড়েন। ঈশোপনিষদের একটি শ্লোক পড়ে তার উপনিষদে ভক্তি জন্মে। শ্লোকটি--

ঈশা বাস্যমিদং সর্ব্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম।।

অর্থ : পরিবর্তনশীল এই জগতে সবকিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। তথাপি সবকিছু পরমেশ্বরের দ্বারা আবৃত। ত্যাগ অনুশীলন কর এবং সর্বভূতের চৈতন্যস্বরূপ আত্মায় দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হও। অপরের ধনে লোভ করো না। তিনি যা দিয়েছেন তাকে ভোগ করতে হবে।।

বহুচেষ্টায় পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে তিনি এই শ্লোকটির অর্থ বুঝলেন। এই তত্ত্বজ্ঞানের সন্ধানই তিনি করে ফিরছিলেন। তিনি রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে নিয়মিত উপনিষদ অধ্যায়ন করলেন। সমধর্মি বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন তত্ত্ববোধিনী সভা। প্রথমে নিজের বাড়িতে—পরে সুকিয়া স্ট্রিটে একটি বাড়ি ভাড়া করে সভার কাজ করেন। তার পিতা গভীরভাবে ধর্মলোকের চেয়ে ব্যবসালোকে বিচরণ করাটাকেই পছন্দ করতেন। আগে ব্যবসা—তারপর ধর্ম। রামমোহনের কাজেকর্মে তিনি সহায়তা করতেন বটে—কিন্তু তার হিন্দুধর্মকে বিসর্জন দিয়ে নয়। তিনি প্রতিদিন শাস্ত্রমেনে চলতেন। পূজার্চনা করতেন। ইংলণ্ডে সকালে এই পূজায় ব্যস্ত থাকার সময়ে রানীর প্রতিনিধি এলেও তাকে বসিয়ে রাখতেন। পূজা শেষে শেষে তার সঙ্গে দেখা করতেন। এই পূজাটা ছিল তার ব্যবসার জন্য বৃদ্ধির জন্য আরাধনা।

কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠিক উল্টোপথ বেঁছে নিলেন। তিনি বেছে নিলেন জ্ঞানসাধনার ধর্মপথ। তিনি উপনিষদের লোকাচারকে প্রশ্ন করে বসলেন রামমোহনের মতো। মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু পিতাকে অসম্মান করতে চাইলেন না। পিতার প্রত্যক্ষ নজর এড়াতে তিনি রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে যন্ত্রালয়ে গিয়ে পড়েছেন। একারণেই তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে আলাদা বাড়িতে তত্ত্ববোধিনী সভা সরিয়ে নিয়েছেন। এখানে তিনি বিষয়বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন।

রামমোহন রায় ইংলন্ড চলে গেলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর তত্ত্ববোধিনী সভা নিয়ে লুপ্তপ্রায় আত্মীয়সভায় যোগ দিলেন ১৮৪২ সালে। সভাতে ধর্মালোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তখন। এছাড়া তত্ত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মধর্মের প্রচারের কাজটাও করা শুরু করে তাঁর নেতৃত্বে।

এ সময় দ্বারকানাথ বিলেত চলে গেলেন। তখন দ্বারকানাথের জমিদারী আর ব্যবসাবানিজ্য সব কিছুর দ্বায়িত্ব পড়েছে দেবেন্দ্রনাথের উপর। কিন্তু এসবে বদলে তার উৎসাহ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজে। ১৮৪৩ সালে বছর খানেক ইংলন্ডে কাটিয়ে দ্বারকানাথ কোলকাতায় ফিরে এলেন। এসে দেখলেন দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভা ও তার প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথ রীতিমত বিখ্যাত হয়ে গেছেন। এই বছর ২১ ডিসেম্বর ২০ জন সঙ্গীসহ আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দিক্ষা গ্রহণ করেন। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তারা দীক্ষাগ্রহণের পরপরই বিস্কুট ও সেরী এনে খান। এগুলো হিন্দুরা তখন খেত না। দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন—জাতিভেদ আমরা মানি না, উহা দেখাইবার জন্য ঐরূপ করা হয়। খানা খাওয়া ও মদ্যপান করা রীতির জের রামমোহনের সময় হইতে আমাদের সময় পর্যন্ত টানিয়াছিল।

দ্বারকানাথের জীবিতাকালে এইসব কাজকর্মের খরচাপাতি যোগাড় করার একটি কৌতুককর বর্ণনা দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর—

তখন পরগণা থেকে টাকা আসত কলসীতে করে। কলসীতে করে টাকা এলে পর সে টাকা তোড়া বাঁধা হত।... এখন এই যে আমার নিচের তলার সিঁড়ির কাছে যেখানে ঘড়িটা আছে, সেখানে মস্ত পাথরের টেবিলে সেই টাকা ভাগ করে তোঁড়া বাঁধা হত।...কর্তদাদামশায় তখন বাড়ির বড়ো ছেলে। মহা সৌখিন তিনি তখন।..এবাড়ি থেকে রোজ সকালে একবার করে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে পেন্নাম করতে আসতেন---তখনকার দস্তুরই ছিল এই।...

কর্তামশায়কে তো বাপকে পেন্নাম করে ফিরে আসছেন। সেই ঘরে, যেখানে দেওয়ানজি ও আর কর্মচারীরা মিলে টাকার তোড়া ভাগ করছিলেন, সেখানে এসে হরকরাকে হুকুম দিলেন—হরকরা তো দুহাতে দুটো তোড়া নিয়ে চলল বাবুর পিছুর পিছু। দেওযানজিরা কী বলবেন—বাড়ির বড়ো ছেলে, চুপ করে তাকিয়ে দেখলেন। এখন হিসেব মেলাতে হবে—দ্বারকানাথ নিজেই সব হিসবে নিতেন তোঅ দুটো তোড়া কম। কী হল।

আজ্ঞে বড়োবাবু—

ও, আচ্ছা—

কিন্তু দ্বারকানাথ ছেলের এই ধর্মকাজে বিরক্ত হয়েছিলেন। ধারণা করেছিলেন তত্ত্বানুসন্ধানী ছেলে সম্পদ রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে। ফলে তিনি একটি ট্রাস্টডীড করে পৈতিক ও স্বোপার্জিত কযেকটি জমিদারি তার অন্তর্ভুক্ত করে দেন। এটা এমন এক ব্যবস্থা করা হল—যাতে তার ব্যবসাবানিজ্যের পতন ঘটলেও এই সম্পত্তি রক্ষা পাবে। ট্রাস্টিবোর্ড তার রক্ষা করবে। এর ফলে দ্বারকানাথ অর্জিত বিত্তবৈভব শেষ হতে তাঁর মৃত্যুর পরে আরও তিন পুরুষ লেগেছিল।

দ্বিতীয়বার ইংলন্ডে যাওয়ার পর ১৮৪৬ সালের ২২ শে একটি পত্রে ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে ভৎর্সনা করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার বাল্যকথায় এই পত্রটির বাংলাঅনুবাদ করেছেন--

আমার সকল বিষয়াসম্পত্তি নষ্ট হইয়া যায় নাই ইহাই আমার আশ্চর্য্য বোধ হয়। তুমি পাদ্রিদের সঙ্গে বাদ প্রতিবাদ করিতে ও সংবাদপত্রে লিখিতেই ব্যস্ত, গুরুতর বিষয় রক্ষা ও পরিদর্শন কার্য্যে তুমি স্বয়ং যথোচিত মনোনিবেশ না করিয়া তাহা তোমার প্রিয়পাত্র আমলাদের হস্তে ফেলিয়া রাখ। ভারতবর্ষের উত্তাপ ও আবহাওয়া সহ্য করিবার আমার শক্তি নাই, যদি থাকিত আমি অবিলম্বে লন্ডন পরিত্যাগ করিয়া তাহা নিজে পর্য্যবেক্ষণ করিতে যাইতাম।...

এইপত্র পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ কিছুটা বিমর্ষ হয়েছিলেন। কিন্তু থামেননি। তিনি সে সময়ই দেবেন্দ্রনাথ সপরিবারে নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। এর ঠিক এক মাস পরে দ্বারকানাথ ইংলন্ডে মারা যান। বড় ছেলে হিসাবে শ্রাদ্ধ করার দ্বায়িত্ব দেবেন্দ্রনাথের। তিনি বাবার শ্রাদ্ধ হিন্দু ধর্মানুসারে করলেন না। আনন্দচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ দ্বারা নিজ বিশ্বাস মত কয়েকটিমাত্র বৈদিক মন্ত্র পাঠ করিয়া স্বরচিত ব্রাহ্ম অনুষ্ঠানপদ্ধতিক্রমে এক গৃহে শ্রাদ্ধ করিলেন। সে স্থলে গঙ্গাজল তুলসী কুশ বা নারায়ণশিলা ছিল না। এ কারণে দেবেন্দ্রনাথকে বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করলেন। এটা ছিল একটা বড়ো বিদ্রোহ।

দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে ব্যবসা ও ব্যাঙ্কের পতন হয়ে ঠাকুর পরিবার গরীব হয়ে যায়। চাকরের ভিড় কমাইয়া দিলাম, গাড়ী ঘোড়া সব নিলামে দিলাম, খাওয়া পরা খুব পরিমিত করিলাম; ঘরে থাকিয়া সন্যাসী হইলাম। লিখেছেন দেবেন্দ্রনাথ। দ্বারকানাথ তিনশো টাকার ডিনার খেতেন—আর দেবেন্দ্রনাথ তখন চারিআনা মূল্যের ডিনার খাওয়া শুরু করলেন। তখন তাদের এককোটি টাকার মত দেনা। বিভিন্ন লোকের কাছে তাদের পাওনা ৭০ লাখ টাকা। ভাইদের নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ছমাসের মধ্যে পরিস্থিতি সামলে ওঠেন।

এরপরেই আবার তিনি ভ্রমণে বের হলেন নৌকায় করে। বর্ধমান, আসাম, বর্মায় গেলেন। ১৮৪৮ সালেই তিনি উপনিষদ ও অন্যান্য শাস্ত্র থেকে ব্রাহ্মধর্ম গ্রন্থ সংকলন করেন। ব্রাহ্মসমা্জের বাড়িটির তেতলা তৈরি করেন। সে সময় ঠাকুর পরিবারের আর কোনো ব্যবসা বানিজ্য না থাকায় তারা পরিণত হন জমিদারি নির্ভর। ১৮৫০ সা্লে ঠাকুর বাড়ি থেকে জগধাত্রী পূজা উঠে যায়।

দেবেন্দ্রনাথ পূজা-পার্বণাদি বন্ধ করে ‌’মাঘ উতসব’, ‘নববর্ষ’, ‘দীক্ষা দিন’ ইত্যাদি উৎসব প্রবর্তন করেন। ১৮৬৭ সালে তিনি বীরভূমের ভুবনডাঙ্গা নামে একটি বিশাল ভূখণ্ড ক্রয় করে আশ্রম স্থাপন করেন। এই আশ্রমই আজকের বিখ্যাত শান্তিনিকেতন। ১৮৮৮ সালের ৮ মার্চ তারিখে দেবেন্দ্রনাথ একটি ট্রাস্ট ডীড তৈরি করে শান্তিনিকেতনকে সর্বসাধারণের জন্য উৎসর্গ করেন। এবং নিজের জমিদারির কয়েকটি পরগনার (আনুমানিক ১৮৪৫২ টাকা মূল্যের) সম্পত্তি শান্তিনিকেতন আশ্রমের ব্যয় নির্বাহ করবার জন্য দান করেন। ডীডে ছিল, ‘’উক্ত সম্পত্তি চিরকাল কেবল নিরাকার একব্রহ্মের উপসনার জন্য ব্যবহৃত হইবে। …কোনো সম্প্রদায়বিশেষের অভিষ্ট দেবতা বা পশুপাখি মনুষ্যের মূর্তির বা চিত্রের বা কোনো চিহ্ণের পূজা হোমযজ্ঞাদি ঐ শান্তিনিকেতনে হইবে না। কোনো ধর্ম বা মনুষ্যের উপাস্য দেবতার কোনো প্রকার নিন্দা বা অবমাননা ঐ স্থানে হইবে না।‘’ এছাড়াও তিনি হিন্দু চ্যারিট্যাবল ইনস্টিটিউশনের বেথুন সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ কিছুদিন রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৫১সালের ৩১ অক্টোবর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হলে তিনি তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি দরিদ্র গ্রামবাসীদের চৌকিদারি কর মওকুফের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং ভারতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বলিত একটি পত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন। দেবেন্দ্রনাথ বিধবাবিবাহ প্রচলনে উৎসাহী ছিলেন, তবে বাল্য ও বহু বিবাহের বিরোধী ছিলেন। তবে নিজের পরিবারে বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করেছেন। এটা ছিল তাঁর বৈপরীত্য। শিক্ষাবিস্তারেও তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব থেকে ভারতীয় যুবকদের রক্ষার জন্য ১৮৬৭ সালে রাধাকান্ত দেব তাঁকে ‘জাতীয় ধর্মের পরিরক্ষক’ ও ব্রাহ্ম সমাজ ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করে।

পিতৃঋণ শোধ করার তাগিদেই দেবেন্দ্রনাথ বিষয়সম্পত্তির দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেন। তিনি নিজেই জমিদারি দেখতে আরম্ভ করলেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে। পরে ছেলেদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন। এইক্ষেত্রে তিনি কোনো ছাড় দেননি। তাঁর ধর্মবোধ, ন্যায়পরায়ণাতা, অপৌত্তলিক ধর্মে ও একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বরে বিশ্বাস ও নানা জনহিতকর কর্মে উৎসাহ ইত্যাদি বিষয় বহুবিখ্যাত। কিন্তু মরার আগে পর্যন্ত সকল দার্শনিকতার পাশপাশি বিষয়সম্পদাদিতে তাঁর প্রভুত্ব বজায় রেখেছেন।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পরে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধির দিকে মনোযোগী প্রবলভাবে তিনি একেশ্বরবাদের প্রচারণায় প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। তার জ্ঞান, অর্থ ও প্রতিপত্তি একক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। সমাজে বঙ্গের রেনেসাঁসের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পাশাপাশি নিজের পরিবারেও এর সুফলগুলো পরিপূর্ণভাবে বিকশারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেন উদারভাবে। তাঁর উত্তরসূরীরা পূর্বসূরীদের মতন ব্যবসাবানিজ্যের পথ থেকে সরে আসেন। জমিদারী থেকে আসমানদারীতে ঝুঁকে পড়েন।

তার উদ্যোগে ঠাকুর বাড়ি থেকে পত্রিকা বের হয়েছে , নাট্যমঞ্চ হয়েছে, সাহিত্য রচিত হয়েছে, বিদ্বোৎসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে। ছেলেরা বিলেতে উচ্চ শিক্ষার জন্য যাচ্ছে।

দেবেন্দ্রনাথের সংস্কার কার্যক্রমের কারণে আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে পরিত্যাক্ত হয়েছেন। তারা তার সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসে ভোজন করতে অস্বীকার করেছেন। এই কারণেই দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পরিবারের জন্য সৃজনশীলতার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমের নতুন স্বজন সন্ধান করেন। যার সুফল শুধু তার পরিবারেই নয়—আপামর বাংলায়ও ফলেছে। আসমানদারীর নতুন জমানা এসে গেছে।

আগের পর্বগুলোর লিংক :


মন্তব্য

সাম্য এর ছবি

"ভাইদের নিয়ে দ্বারকানাথ ছমাসের মধ্যে পরিস্থিতি সামলে ওঠেন" - এখানে কি দেবেন্দ্রনাথ হবে?

- সাম্য

কুলদা রায় এর ছবি

আপনি যথার্থ ভুলটি ধরেছেন। ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

সাদরিল এর ছবি

তথ্যবহুল পোষ্ট

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।