অমর চরিত ওরফে ধনপতির চরের কাছিম সদ্দার

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/০৮/২০১২ - ৯:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


পেদরুর সঙ্গে কদিন আছি। পেদরুর বাড়ি লিসবোঁয়া। সেখান একদিন জলে ভেসে এসেছিল। কেনো এসেছিল সেটা এক রহস্য। নানা বৃত্তান্ত তৈরি আছে সে রহস্যে।

পেদরু এসেছিল বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এক চরে। সে চরের নাম ধনপতির চর। মনে করা হয় হাজার হাজার বছরের একটি প্রাচীন কাছিম এই মোহনায় ঘুমিয়ে আছে। কাছিমের পিঠে পলি পড়ে চর সৃষ্টি হয়েছে। চরটি ছয় মাস জলের উপরে জেগে থাকে। ছয় মাস জলে ভাসে। আশ্বিনে জেলেরা ঘোড়াদল থেকে ছয় লিংক সাগর পাড়ি দিয়ে ধনপতির চরে মাছ ধরতে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে মেয়েদের। তারা তখন তাদের ছয় মাসে বউ।

তারা সারাদিন মাছ শুকায়। দুটি খেতে পরতে পায়। তাদের হাড় জিরজিরে শরীরে লাবণ্য ধরে। তারা রমনী হয়ে ওঠে। জেলেরা মাছ ধরতে গেলে তারা মলিন বস্ত্রে থাকে। চুলে তেল নেয় না। সাজুনি করে না। চরে থেকে প্রার্থনা করে তার জেলেরা যেনো ফিরে আসে। তারা ফিরে এলে ঘর-কন্না করে। তাদের জড়িয়ে থেকে। তারা তখন চুলে সাবান দেয়। ফিতা বাঁধে। হাতে চুরি পরে। কপালে সিঁদুর লাগায়। আবার যখন চৈত্র মাস আসে তখন সবাই চর ছেড়ে চলে যায়। জেলেরা ফিরে যায় তাদের সত্যিকারের বউ আর ছেলেমেয়েদের কাছে। তাদের মনেও থাকে না এই ছয় মাসে জেলেনী বউদের কথা। জেলেনিরা তখন পথে পথে ঘোরে। কেউ আধপেটা খেয়ে শুকিয়ে যায়। কেউ আবার জুটিয়ে নেয় বাকি ছয় মাসে জন্য নতুন পুরুষ সঙ্গী। কেউ কেউ দেহজীবি হয়। তখন সমুদ্র ফুসে উঠতে শুরু করে। বর্ষায় চরটি ডুবে যায়।

এই জেলে জেলেনিরা বিশ্বাস করে একদিন ভাদ্রের বন্যায় জলের নিচে ঘুমিয়ে থাকা কাছিমটি জেগে উঠবে। ভেসে চলে যাবে গভীর সমুদ্রে। তখন আর চরটি থাকবে না। কেউ আর মাছ ধরতে পারবে না। তাদের জীবিকা শেষ হয়ে যাবে। সে কারণে জেলেনিরা কার্তিক পুর্ণিমায় মাটি দিয়ে কাছিমের মূর্তি গড়ে। কাছিমের গলাটি পুরুষাঙ্গের আকার দেয়। আর পিঠটি নারীর স্তনের গড়ন। তারা এই কাছিম সর্দারের পূজো দেয় গাবতলায়। তারা গান গায়। প্রার্থনা করে কাছিম সর্দার যেনো ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে তারা চরটি জেগে থাকবে। তারা আসতে পারবে। মাছ ধরে-মাছ শুকিয়ে বেঁচে-বর্তে থাকতে পারবে।

এই ধনপতির চরের উপন্যাসটি লিখেছেন অমর মিত্র। এখানে ধনপতি নামে এক বুড়ো চর প্রধান প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে থাকেন। তিনিই প্রথম এই চরে এসেছিলেন। তিনিই পেদরু। তিনিই এই চরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তিনি জেলেদের কাছ থেকে নজরানা পান। মাঝে মাঝে পুলিশ মঙ্গল মিদ্দে আসে। চাঁদা তোলে। আসে সরকারি অফিসের কেরানী বুড়ো হয়ে আসা মালাকার। তারা চরে কদিন থাকে তাদের চাহিদা মত মেয়েদের সঙ্গ নেয়। তারাই গরমেন নামে পরিচিত। তারাই এই চরের ধনপতির উপরে আরেক ধনপতি। তারা গরমেনের নামে মেয়ে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকে।

আসে ব্যাপারী সিং। তার মনে ধরেছে চরের জেলেনি বাতাসিকে। তাকে কিনে নিতে চায়। তাকে কদিন ভোগ করে বেঁচে দেবে মধ্য প্রাচ্যে। পুলিশ মিদ্দের সঙ্গে ব্যাপারী টাকা দিয়ে রফা করে। বাতাসিকে বলে গরমেন তাকে বেঁচে দিয়েছে। তাকে ব্যাপারীর সঙ্গে যেতে হবে। বাতাসি তার জেলেকে ছেড়ে যেতে চায় না। পুলিশকে আর ব্যাপারীকে নিয়ে তার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দেয়। চেঁচিয়ে জেলেনিদের জড়ো করে। তারা ধরে এই দুজনকে ঘোড়া দলে পাঠিয়ে দেয়।

গরমেনের গায়ে হাত লাগানোর কারণে পুলিশ ক্ষেপে যায়, গরমেনের হয়ে ইনকোয়ারীতে আসে কেরানী মালাকার। সে এসে ব্যাপারীর সঙ্গে যাওয়ার জন্য ধনপতিকে রাজী করায়। তার আগে বাতাসিকে নিজের জন্য চায়। বাতাসি তার কাছে যায় না। তখন ধনপতির ছয় মাসের ভাড়া করা অল্প বয়েসি বউ কুন্তি বাতাসির বদলে তার কাছে আসে। কিন্তু কুন্তি তখন তাকে গল্প বলে সে কামরুপ কামাখ্যা থেকে তুকতাক জানা মেয়ে। ফলে বুড়ো হয়ে আসা মালাকার ভয় পায়। সে কুন্তিকে ভোগ করতে ব্যর্থ হয়। ধনপতি অন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই চরের মালিকানা দিয়ে যায় তার সঙ্গিনী কুন্তিকে। তার নাম হয় ধনেশ্বরী।

ধনেশ্বরীও বৃত্তান্ত তৈরি করে। চরের শাসন পদ্ধতি পালটে যায়। একদিন বড়ো অফিসার বিডিও অনিকেতকে কুন্তি শরীর খুলে দেয়। এই প্রথম সে সমর্থ পুরুষের অভিজ্ঞতা হয়। তার কাছে দাবী তোলে এই চরটি ধনেশ্বরির নামে সাফ কবলা করে দিক। সারা বছর তারা চরে স্বাধীনভাবে মাছ ধরতে পারবে। গরমেনের শাস-ত্রাসন থাকবে না। অনিকেত রাজীও হয়। কিন্তু গরমেনের উপরে আরো বড় গরমেন ওরফে ব্যাপারী সিং উপরে যোগাযোগ করে এই চরের পাট্টা নেয়। চরে তার কোম্পানী বন সৃজন করবে। রিসর্ট তৈরী করবে। ফলে অনিকেত ব্যর্থ হয়। এই প্রথম পুলিশ মিদ্দে আর মালাকার বুঝতে পারে চরের গরমেন তাদের হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তারা চরে এসে চর ছাড়া করার ঘোষণা দিতে ভয় পায়। লঞ্চে উঠে মাইকে ঘোষণাটি দেয়। জেলে জেলেনিরা প্রথমে মকসো মনে করলেও যখন বুঝতে পারে তখন তারা ঢিল ছোড়ে লঞ্চের দিকে। লঞ্চটি পালিয়ে যায়। এই ভাবে ধনপতির চরের আখ্যানটি পরাজিত নগ্ন জেলেনিদের হাহাকারে পরিণত হয়।

অমর মিত্র এই উপন্যাসটি লেখার জন্য আলাদা এক ভাষা নির্মাণ করেছেন। দিয়েছেন পয়ারের বুনোনি। আখ্যানের পরে আখ্যান বর্ণিত হয় বর্ণনায় আর সংলাপে। এই সংলাপ ধরে এক ধনপতির চরে কুন্তি, বাতাসি, যমুনা, আন্না, গণেশ, মিদ্দে, মালাকার, ব্যাপারী, ফরিদপুরের ছাতার কারিগর, অনিকেত, ধনপতি পেদরু আমাদের ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায় ভাসান গানের মত। আমরা কোনো না কোনো ভাবে অমর মিত্রের সম্মোহনে পড়ে যাই। বুঝতে পারি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের ঘোড়াদলে নিয়ে যান, সেখান থেকে ছয় লিঙ্ক জল পাড়ি দিয়ে পৌছে দেন ধনপতির চরে। সেখানে আমাদের ছয় মাসের আস্তানা হয়ে ওঠে। সেখানে আমাদের নিয়তির হয়ে ওঠে কোনো এক পেদরু, তার ধনপতি, তার ধনেশ্বরি, আর কাছিম সদ্দার। আমরাও বলি-- যমুনা বিন বিন করে, কাত্তিক পুন্নিমে নিশি জুছনায় ভাসে,
ধনেছছরির সাথে দ্যাখো ধনপতি জাগে।

আমরা বুঝতে পারি অমর মিত্রের ধনপতির চর উপন্যাসটি ধনপতি নামের কোনো হার্মাদ পুরুষের নয়--এটা ধনেশ্বরী নামের নারীদের আখ্যান।

এই উপন্যাসটি পাঠের পরে আমাদের বিশ্বাস জাগ্রত করে যে মানিক- শ্যামল-অতীনের পরে নতুন মহাভারত লেখার সামর্থ্য আছে অমর মিত্রের হাতে। তার কলমটি প্লাস্টিকের নয়—সোনার তৈরী। সে কলম থেকে যে বাক্য প্রকাশিত হয় তা অমৃতময়।

আজ অমর গল্পকার-উপন্যাসিক অমর মিত্রের জন্মদিন। এ দিনেই শেষ করেছি ধনপতির চর উপন্যাসটির পাঠ। উপন্যাসটি আমাকে এনে দিয়েছে নিউ ইয়র্কের কুইন্স লাইব্রারী। পাঠের পরে প্রশ্ন জাগে অমর মিত্র কী জন্মেছেন কোনোকালে---কোনো একটি মাত্র দিনে? মনে হয় না। লিসবোঁয়ার পেদরুর মত তিনি আছেন জলে ভেসে কালের জন্মলগ্ন থেকে। তার পিঠের উপরে আমরা আছি। তাঁর জন্মদিনে অনন্ত পরমায়ূ হোক এই প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু মনে আসে না। এক জন ঈশ্বরের জন্যে এটাই খুব স্বাভাবিক।

এক নজরে অমর মিত্র :
জন্ম ৩০ আগস্ট ১৯৫১।
জন্মস্থান। সাতক্ষীরার ধুলিহর গ্রাম। প্রকাশিত গ্রন্থ—
অশ্বচরিত (বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত)
ধ্রুবপুত্র (সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত)
অরুন্ধতি তারার রাত (অমৃতলোক পুরস্কারপ্রাপ্ত)
ধনপতির চর
প্রান্তরের রাত, নিস্তদ্ধ নগর, সোনাই ছিল নদীর নাম, সমাবেশ, চতুর্থী, হাঁসপাহাড়ি, পুর্বগামিনী, আগুনের গাড়ি, জনসমুদ্র, কৃষ্ণগহ্বর, নদীবসত, শ্রেষ্ঠ গল্প।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

উপন্যাসটির নাম কী? অমর মিত্রের বই কি ঢাকায় পাওয়া যায়?

আবু ইসহাকের 'পদ্মার পলিদ্বীপ', ইউসুফ হায়দারের 'দ্বীপ অনামিকা' আপাতত এই দুইটা বইয়ের নাম মনে পড়ছে। মানিক-শ্যামল-অতীনের মতো এদেরও মহাকাব্যিক উপন্যাস সামর্থ্য ছিলো বলে মনে হয়। অসীম রায়, মিহির সেনগুপ্ত বা কাজী আবদুল ওয়াদুদকেও মনে হয় হিসেব থেকে বাদ দেয়া যায় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কুলদা রায় এর ছবি

ধনপতির চর

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

ধন্যবাদ। অমর মিত্রের কোন লেখা পড়া হয়নি। আপনার লেখা পড়ে আগ্রহ তৈরি হলো।
বইটি সংগ্রহ করতে হবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।