কাঠালীচাঁপার ঘ্রাণ--১

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৫/০৯/২০১২ - ৯:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আমার বন্ধু শাহনুর কখনও কবিতা লেখে নাই। তখন আমাদের কবিতা ছিল ছোট নদীর বাঁকে। মাঝে মাঝে হাঁটু জলে রবি ঠাকুর নেমে পড়তেন বৈশাখ মাসে। কিছু কবিতা তুলে আনতেন। সেগুলো পড়তাম বইয়ের পাতা থাকে।

আমাদের প্রথম ক্লাশে রশিক স্যার ব্লাকবোর্ডে গাছের একটি ডাল এঁকেছিলেন। আমাদের অবাক করে দিয়ে তখন স্যারের সাদা চক খড়ির থেকে একটি বানর বেরিয়ে এসেছে। বসেছে লেজ ঝুলিয়ে ডালের উপর। তার চোখ পিট পিট করছে। তিনি লিখলেন—
হাতুম হুতুম করমচা
ওরে বান্দর চলে যা।।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওহে বালকগণ, দ্যাখো, বান্দরটি কী করছে?

আমরা সেকালে বানর দেখেছি রাস্তায় ডুগডুগি বাজানো বাজীকরের কাঁধে। সেই বানরটিই লাফ দিয়ে স্যারের ব্লাকবোর্ডে এসেছে। স্যার চকখড়ির দাগ কষে দিলেন—আর বানরটি ডালে বসে থাকল না। লাফ দিল ডাল থাকে।

আমার পেছনের বেঞ্চিতে একটু লম্বা করে ঢ্যাঙ্গা ছেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজনায় তার চোখ মুখ কাঁপছে। বলছে, স্যার বান্দরটা তো পড়ে যাচ্ছে। ব্যথা পাবে। শুনে রশিক স্যার থুতনিতে আঙ্গুল ছোঁয়ালেন। সেখানে চকের গুড়ো লেগে গেলো। বললেন, ওহে বালক, তোমার নাম কি?
বালকটি তার নাম বলল না। বলার কথা তার মনের মধ্যে নেই। আবার বলল, ওরে ফেলে দিয়েন না স্যার।
স্যার বললেন, আমার বান্দর আমি ফেলে দিলে তোমার কী?
ও মুখটা ফ্যাকাসে করে বলল, আমার কষ্ট হবে।
স্যার এবার তার কাছে এসে শুধালেন, তোমার নাম কী বাবা?

বালকটির পাশে ওর মতই আরেকটি বালক বসেছিল। বলল, ওর নাম শাহনুর। তার নিজের নাম শাহবুর। তারা দুই ভাই। বাসা মিয়া পাড়া। সোনালী ব্যাংকের পিছনে। শাহবুর শাহনুরের তার হাত ধরে বসাতে চেষ্টা করল। কিন্তু শাহনুর কিছুতেই বসবে না। বানরটি পড়ে যাওয়াকে সে সহ্য করবে না। তার চোখ ফেটে জল বের হতে চাইছে।

রশিক স্যার শান্তি নিকেতনের ব্রহ্ম বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। সেখানে রবি ঠাকুর ছাতিম গাছের তলায় বসে গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ছবি আঁকা শিখেছিলেন বিনোদ বিহারীর কাছ থেকে। বিনোদবিহিরী তখনো অন্ধ হয়ে যাননি। রশিক স্যার শাহনুরকে বললেন, ভয় পেয়ো না বৎস। তোমার বান্দর পড়বে না। বলে তিনি ডালের নিচে একটি লোকের ছবি আঁকলেন। তার মাথায় পাগড়ি। মাটিতে নয়-- তার কাঁধেই লাফ দিয়ে বানরটি বসেছে। দেখে শাহনুরের বুক থেকে পাথর নেমে গেল। সে হাসল। বসে পড়ল। তার এখন ভালো লাগছে।

সে সময়ে আমাদের বাড়িই ছিল আমাদের জগত। স্কুল ছাড়া বাইরে যাওয়া হত না। ঠাকুরদা পেয়ারা গাছের নিচে বসতেন মাদুর বিছিয়ে। বিকেলের শান্ত আলোতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরতেন—মুক্তির মন্দিরে সোপানো তলে/
কত প্রাণ হল বলিদান।
এটা কানা কেষ্টর গান। বাড়ির মেয়েরা তার সঙ্গে গলা মেলাত। আর মাথার উপর দিয়ে বাদুড়ের ঝাঁক উড়ে যেত। বাদুড় বাদুড় ছায়া আমারে একটা গয়া—বলতে বলতে দৌড়ে যেতাম পুকুর ঘাট অব্দি। দেখতে পেতাম, পশ্চিম থেকে তারা উড়ে যাচ্ছে পুবে। তারা আমাকে হেলা করছে। তখন পুকুর ঘাটে সন্ধ্যা নেমে আসত। মনে হত এভাবে সবাই উড়ে যাবে আমাকে একা ফেলে। কোথাও কারো ছায়াটিও পড়ে থাকবে না। আমার কান্না পেত।

এর মধ্যেই কামার পট্টি থেকে জয়দেব এসে যেত ভোরবেলা। হাফ প্যান্ট পরা। খালি পা। দুজনে মিলে উদয়ন পাড়া পেরিয়ে, সাহা বাড়ির কুসুম কুটিরের পাশ দিয়ে, ডালু পিসিদের দোচলা ঘরটি পিছনে রেখে পৌঁছে যেতাম মডেল স্কুলে। জয়দেব গল্প করত ফুলের। মডেল স্কুলের ঘাট পুকুরে অনেকগুলো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই এলে বুঝতে পারতাম বর্ষাকাল এসে পড়েছে। পাতাগুলো সবুজ। ফুল ফোটার অনেক দেরী। জলের মধ্যে ছায়া নড়ছে। জয়দেব তখন হাওয়া থেকে প্রজাপতিসম কৃষ্ণচূড়া ফুল তুলে আনত হাতের মুঠোয়। জলের মধ্যে ভাসিয়ে দিত। চলত দুলে দুলে। এটা ছিল জয়দেবের খেলা।

এ রকমই একদিন শাহনুর বলল, কাঁঠালীচাঁপা ফুল চিনিস?
জয়দেব হেসে বলল, চিনব না কেনো। এই দ্যাখ। বলেই হাওয়ার মধ্যে তার হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে একটি ফুল তোলার ভঙ্গী করল। তারপর মুঠো খুলে দেখাল। সবুজ একটা তাজা ফুল—এই ফুলটিতে কাঁটালের ঘ্রাণ। শ্বাস নিলে প্রাণ ভরে আসে। শাহনুর বলল, আহ। তখনই দেখতে পেলাম—শাহনুরের মুখে ভোরের আলো। খুব উজ্জ্বল। ফুলটি সে জলে ভাসিয়ে দিল না। সারাক্ষণ মুঠোর মধ্যে নিয়ে ক্লাশে বসে থাকল। মাঝে মাঝে সুঘ্রাণ নিল। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে গেল। সেদিন আকাশ ছিল নীল।

তারপর দিন ভোর থেকেই আকাশটা মেঘলা। বৃষ্টি হতে পারে। জয়দেব এল না। হুজুর স্যার স্কুল শুরুর আগেই ক্লাশে বসে আছেন। বিড়বিড় করে দোয়া দরুদ পড়ছেন। তার চোখে জল। ক্লাশের ঘণ্টা পড়ার আগেই ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেল। তিনি হাহাকার করে বললেন, এ দুনিয়ায় ঘোর আজাব নেমে এসেছে রে বাবা সকল।

হুজুর স্যার ক্লাশ নিলেন না। আজ স্কুল ছুটি। হেড স্যার লাইন ধরে আমাদেরকে নিয়ে চললেন রাস্তা ধরে। মডেল স্কুল থেকে বটতলা। বটতলা থেকে গার্লস স্কুলের মোড় ঘুরে কালীবাড়ি। তারপর ডিসি রোড। এর পরেই মিয়া পাড়ার সোনালী ব্যাংকের ইট সুরকির লাল এক তলা বিল্ডিং। এখানে আসতেই লোকজনের জটলা দেখা গেলো। অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে একটি বাড়ির ভিতরে। বাড়িটির সামনে বুড়ো একটি বরই গাছ। তার পিছনে টিনের ঘর। এটা এ বাড়ির কাছারি ঘর।

তার আশেপাশেই কোথাও জয়দেব দাঁড়িয়েছিল। আমাদেরকে দেখে ছুটে এল। হাত ধরে মিনতি করে বলল, যাস নে।
যাব কি যাব না এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। হেড স্যার সবাইকে এগিয়ে দিচ্ছেন। কোমল স্বরে বলছেন, যাও বাবা, এগিয়ে যাও। দেরী করো না। নিজে দেখ--দেখে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দাও।

আমারা সেই ছোট ছোট বালকেরা, সেই মেঘে ঢাকা ভোরে, বৃষ্টি নামার আগে, বাড়িটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জয়দেব আমার হাত ধরে আছে। বলছে--যাবি না, তুই যাবি না। জয়দেবের এই কথার মধ্যে দিয়েই আমরা ঘরটির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি। ঘরের মধ্যে জানালা খোলা। বিছানার উপর আলো পড়েছে। সেখানে একটি বালক শুয়ে আছে। বালকটির পেটে একটি ছিদ্র। সেখান দিয়ে রক্তের রেখা বেরিয়ে এসেছে। কিছু পিঁপড়ে ঘোরাঘুরি করছে। তার হাতের মুঠোর মধ্যে একটি বাসি ফুল। চারিদিকে সেই ফুলের ঘ্রাণ ভাসছে। এই ঘ্রাণ কাঠালীচাঁপা ফুলের। তার মুখটি দেখার আগেই জয়দেব আমার চোখ চেপে ধরেছে। বলছে তুই দেখবি না। কিছুতেই দেখবি না।

বাইরে তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হবে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। জয়দেব মৃত বালকটির হাতের মুঠোর মধ্য থেকে সবার অগোচরে ফুলটি নিয়ে এসেছে। বলল, আয়, শাহনুরের এই কাঠালীচাঁপাটি জলে ভাসিয়ে দেই। সেদিন প্রথম বাড়ির বাইরে মাকে ছাড়া দুজনে নদীতে চলে গেলাম। ফুলটি ভাসিয়ে দিল জয়দেব নদীর জলে। বলল, ওই দ্যাখ, শাহনূর ভেসে যায়।

আর কখনো শাহনুরকে দেখা হয়নি। সে চলে গেছে। রাতের বেলা জানালার বাইরে থেকে কেউ ইঞ্জেকশন দিয়ে তার পেটে বিষ ঢুকিয়ে দেয়ে মেরে ফেলেছে। কেনো—সেটা কেউ জানে না। জয়দেবও না। হেড স্যারও না।

কিন্তু প্রতি রাতেই সে সময়ে আমার ঘুমের মধ্যে শাহনুর আসত। আমার সঙ্গে ঘুরত। বলত, জয়দেবকে খবর দে।
জয়দেবকে কোথায় পাব? তারা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে—সে আর হাওয়া থেকে ফুল আনতে পারে না।

একদিন মা আমাকে গোলারগাতি নিয়ে গেল। রবি ঠাকুরের মত দাড়ি আছে বাবুরাম পাগলের। তিনি আমার হাতে একটি সুতোর ডোঁর বেঁধে দিলেন। বললেন, বাঁশের বনে জোনাক জ্বলে।
কাশের বনে গোবাক টলে।।

বাবুরাম পাগল বললেন,আর শাহনুর আসবে না তোর ঘুমের মধ্যে। শাহনূর তোকে ছেড়ে চলে গেছে।
শাহনূর সত্যি সত্যি আর আসেনি। কিন্তু তার ছায়াটি আসত। ফিসফিসিয়ে বলত, জয়দেবকে ডেকে আন। আমার ফুলটি দিতে বল।
--কী ফুল?
--কাঠালীচাঁপা। বর্ষার ফুল।

একদিন বাবা কুসুমদিয়া নিয়ে গেল। শের আলী ফকির তার পাগড়ি দিয়ে আমার চোখ মুছে দিলেন। বললেন, ছায়া চলে গেছে। বললেন, যে যায়—সে আর ফিরে আসে না।

সেদিন থেকে ছায়াটি চলে গেল। আর দেখতে পাইনি। পরে বুঝতে পেরেছি, আমাদের শহরে শাহনূর নামে একটি বালক ছিল—সে কথাটি সবাই ভুলে গেছে।
শুধু বর্ষা এলে এখনো আমি কাঠালীচাঁপার ঘ্রাণ পাই।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের পিছু বোধ হয় ছাড়বে না।কী বাজে একটা বিষয়।
আপনার লেখাটা ভালো লেগেছে।দারুণ ! তবে বিষয়টা খুব যন্ত্রণার।

মোহছেনা ঝর্ণা

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

স্মৃতিচারণগুলোকে সুতো দিয়ে বুনে অথবা না বুনেই একসাথে নিয়ে আসুন। অনেক বিষয়ের লিখিত ইতিহাস নেই। সেখান থেকে কিছু কিছু বিষয় কাভার হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

চলুক

সৌরভ  এর ছবি

লাইনগুলোর ভেতর ঢুকে গেছিলাম। যখন বেরিয়ে এলাম, নাকে তখন কাঁঠালীচাঁপার ঘ্রাণ।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ফেইসবুকের সার্ভার খুব ধীর গতির। ফেইসবুকের ছবি ব্যবহার করলে অনুগ্রহ করে পোস্টের ভিতরে দিন অথবা ফ্লিকার, সচলায়তন বা অন্য কোনো ছবি শেয়ারের সাইট থেকে লিংক করে দিন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।