অন্ধকার

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি
লিখেছেন জেবতিক রাজিব হক [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২৭/০৪/২০১৩ - ৪:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইংল্যান্ডের সাউথশিল্ড শহর থেকে আমার বন্ধুরা যখন কাজের সন্ধানে নিউক্যাসেলে চলে যায়, তখন আমি বেশ অসুবিধায় পড়ে যাই। সাউথশিল্ড ছোট শহর, চট করে ব্যাচেলারদের জন্য রুম ভাড়া পাওয়া যায় না। আমার আশ্রয় হয় এক বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টের উপরে একটি ঘুপচি রুমে। এক পাশে রেষ্টুরেন্টের মালপত্র,অন্যপাশে তোষক পেতে আমি ঘুমাই। সেই রুমে কোন জানালা ছিলো না। ডিম লাইটের কোন ব্যাবস্থা নাই। রাতের বেলা আলো নিভিয়ে দিলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে থেকে ষ্ট্রিট লাইট আসারও কোন উপায় নেই। সেই অন্ধকারে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি কিছুক্ষন পরপর মোবাইলের আলো জ্বালাই, বহুবার পড়ে ফেলা মেসেজগুলো আবার পড়ি, শুধুমাত্র সেই নিকষ অন্ধকার থেকে বাঁচার জন্য। সেবারই প্রথম বুঝতে পারি - আমি অন্ধকার ভয় পাই।

গতকাল রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। ফেসবুকে আপলোড করা কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ আমাকে ঘুমাতে দেয় নি। সেই ভিডিও তে ধ্বসে পড়া রানা প্লাজার কনক্রিটের নিচে আটকে পড়া শ্রমিকের আর্তনাদ। অন্ধকার গহ্ববর থেকে ভেসে আসে শুধু এক আকুতি - ভাই, আমারে বাঁচান। আমি জানি না, তিনি আটকে পড়া শত শত শ্রমিকের মাঝে উদ্ধার হওয়া প্রচন্ড সৌভাগ্যবান শ্রমিকদের একজন কী না, কিন্তু এটা নিশ্চিৎ জানি, এই ধ্বংশস্তুপের আরো গভীরে, প্রবল অন্ধকারে এরকম আরো অনেকে আটকে আছেন। আমি ভাবতে পারি না, সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে, থেৎলে যাওয়া অভুক্ত শরীর নিয়ে, অক্সিজেনের অভাবে ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিঃশ্বাসে একজন মানুষ ঠিক এই মূহুর্তে কী ভাবছে? সে কী আল্লাহ খোদার নাম নিচ্ছে? পাশেই পড়ে থাকা লাশের মাঝেও কী সে আশা করে কেউ না কেউ তাকে ঠিকই বাইরে বের করে আনবে?

বেশ কয়েকদিন আগে মটরওয়েতে গাড়ি নিয়ে আটকা পড়েছিলাম। দুই দিকে শত শত গাড়ি, মাঝখানে রাস্তা আটকে দিয়েছে পুলিশ। জানতে পারলাম রোড ডিভাইডারে কীভাবে যেন একটা বিড়াল আটকা পড়েছে। খবর পেয়ে আরএসপিসিএ চলে এসেছে। নিরাপদে যাতে বিড়ালটিকে উদ্ধার করা যায়, সেজন্য তারা বন্ধ করে দিয়েছে দুপাশের হাইওয়ে। আমরা গরীব দেশের গরীব মানুষ। কুকুর বিড়াল তো দুরের কথা, জীবন্ত মানুষ উদ্ধারের জন্য আমাদের কাছে যন্ত্রপাতি থাকে না। আমরা কোটি কোটি ডলার দিয়ে মিগ কিনি, সাবমেরিন কিনি - মানুষ মারার হাতিয়ারে আমাদের শোকেস ধীরে ধীরে ভরে উঠতে থাকে। একটা যুদ্ধবিমানের টাকায় কতজন মানুষের জীবন বাঁচানো যেতো, সে হিসাব আমি মেলাতে পারি না। অবশ্য গরীব বাঁচানোর যন্ত্রপাতি কিনে খামাকা টাকা নষ্ট করে কী লাভ?

আমরা বরং একটা থেৎলে যাওয়া শরীর থেকে আস্ত মাথাটা কেটে এনে ফুটবল খেলি। আমাদের ম্যারাডোনা মখা সাহেব প্রচন্ড লাথিতে সেই কাটা মাথা বিপক্ষ দলের সীমানায় ফেলেন। প্রতিপক্ষের হয়ে সেই বল রিসিভ করেন এম কে আনোয়ার। তিনি পাস করেন হেফাজতি রুহি মাওলানাকে। রুহি আবার লাথি হাকান সরকারের সীমানায়। কিন্তু এই গোলবার সামলে আছেন স্বয়ং ড হাসিনা। দুই দলের লাথালাথিতে মাথা থেকে রক্ত ঝরে। সেই রক্ত আলতা হয়ে পা রাঙ্গায় আমাদের মহান খেলোয়ারদের। আমরা দলে দলে সেই আলতা পায়ের নৃত্য দেখি আর মুগ্ধ হই। আমাদের উল্লাসে ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায় অন্ধকার গর্তের সেই করুন আকুতি - ভাই আমারে বাঁচান।

এই খেলায় ক্লান্ত হয়ে যখন আমার চোখ একটু বুজে আসে, ঠিক তখনই নূপুর পরা ধূলোময় এক পা আমার কপালে লাথি মেরে বলে - কী রে ব্যাটা, ঘুমাইলি?


মন্তব্য

শিশিরকণা এর ছবি

মন খারাপ দু'দিন ধরে কেবলই দুঃস্বপ্ন দেখছি। প্রার্থনাতে বিশ্বাস নেই, তবু মনে মনে ফিস ফিস করে প্রার্থনা করেই ফেলি, আটকা পড়া মানুষগুলোকে শক্তি দাও খোদা আর একটু যেন টিকে থাকতে পারে। আর একটু...

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

আমি এই প্রার্থনাতেও ভয় পাই। টিকে থাকলেই কী বের হতে পারবে? হে খোদা, একটু রহম কর।

Rasel Mhamud  এর ছবি

নূপুর

হয়তো তুমি
নূপুর খানি পায়ে পরেছিলে
প্রিয়তমর দৃষ্টি আকর্ষণ
করার অভিলাষ নিয়ে।

হয়তো তুমি
তার সামনে দিয়ে
হেঁটেও এসেছিলে।
দেখেও কি না দেখার ভান করেছিল ?

দেখিছি আমরা
তোমার সর্ণ কমল পা।
দেহ খানি ঢেকে আছে
অভিসপ্ত ইট পাথর আর কংক্রিটে ।

আর আমি ?
সারা রাত জেগে
দু-চোখের পানি জমিয়ে
মুছে দিয়েছি
ধুলো আর রক্ত।

মাফ কর তোমার
আসভ্য ভাই কে।
মাফ কর ।

অতিথি লেখক এর ছবি

"এই খেলায় ক্লান্ত হয়ে যখন আমার চোখ একটু বুজে আসে, ঠিক তখনই নূপুর পরা ধূলোময় এক পা আমার কপালে লাথি মেরে বলে - কী রে ব্যাটা, ঘুমাইলি?"
মন খারাপ

সুবোধ অবোধ

তিথীডোর এর ছবি

কালো ব্যাজ ছিল আজ সারাদিন আমাদের বুকপকেটে আটকানো। একটুকরো কাপড়ে শোকপ্রকাশ করা যায় হয়তো। শোক মুছে ফেলা যায় না একরত্তিও। যার যায়, সেইই বোঝে...

শতশত মানুষ খাবার নিয়ে, ওষুধ নিয়ে, রক্ত দিয়ে ছুটে যায় সাভারে আহতদের বাঁচাতে। ঐসব বোঝে না হেফাজতের শুওর পীর শাফী, বলে এটা নাস্তিক সরকারের ওপর গজব। আরেক শুওর মখা আলমগীর বলে পিলার ধরে নড়াচাড়াতেই নাকি ধ্বসে পড়ে গেছে নয়তলা দালান। ব্লগিং করলে চোর-বাটপাড়ের মতো সাতদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়, ভাঙা ভবনে লাঠি দেখিয়ে শ্রমিক ঢোকালেও সরকার, রাজউক চোখ বুজে থাকে।
৩৩৭জন জলজ্যান্ত মানুষ লাশ এখন, হাজার ছাপিয়ে যায় কী না কে জানে। এক হতভাগ্য বাবা আহাজারি করে বলেন-- পা কাইটা হলেও আমার মীমরে আইনা দাও।
ফিনিশিং, সুয়িং অপারেটর, কাটিং মেকার-- ফি মাসের স্যালারি শিটের বদলে অতি পরিচিত এই শব্দগুলো খবরের কাগজে পড়তে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে একসময়। কোনভাবেই কি অন্তত একটু কিছু করতে পারি না? বিকাশ আছে, আছে ডিবিবিএল। জানি অতি সীমিত সাধ্য, তাও...।
ফেসবুকের ছবি, শেয়ারড স্ট্যাটাসে তাকিয়ে অস্থিরতা বাড়ে আরো।

মানুষ হিসেবে অসংখ্য অক্ষমতা নিয়ে হাহুতাশ করে বেড়ানো আমি আগে আর কখনো এত অসহায়, এত অপরাধী বোধ করিনি।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

মন খারাপ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমরা নূপুর পরে অপেক্ষায় দিন গুনি, কবে আমরাও একদিন...
এটাই আমাদের নিয়তি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

আমার প্রায়ই নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়, এখনও বেঁচে আছি বলে।

তারেক অণু এর ছবি
জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

মন খারাপ

খেয়া'দি এর ছবি

রাষ্ট্র যন্ত্রের মানুষ খুন দেখলে মরে যেতে ইচ্ছা করে।

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

চিন্তা কইরেন না, রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকই আপনাকে একদিন মেরে ফেলবে।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

মন খারাপ আর যারা মারা গেলো তাদের পরিবারের বুড়ো বাবা-মা, ছোট ভাই-বোন বা ছেলে মেয়েদের যে এখন কি হবে

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

অথবা যারা একেবারে পঙ্গু হয়ে গেলো মন খারাপ

মর্ম এর ছবি

কিছুই বলার নাই আসলে মন খারাপ

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

সচল জাহিদ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

কিছুই বলার নাই।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

...

খেকশিয়াল এর ছবি

...

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

...


_____________________
Give Her Freedom!

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

নূপুর পরা ধূলোময় এক পা আমার কপালে লাথি মেরে বলে - কী রে ব্যাটা, ঘুমাইলি?

আমাদের ঘুম ভাঙুক!

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ

সিরাজুল লিটন

নবনী এর ছবি

কিছু কিছু লেখায় চোখের পানি আটকে রাখা অসাধ্য

jishu ahmed  এর ছবি

প্রার্থনাতে বিশ্বাস নেই, তবু মনে মনে করে ফেলি ....

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

দর্শকরাই দলগুলোকে খেলার প্রেরণা জোগায় মন খারাপ

রানা মেহের এর ছবি

রাজু, এই লেখাটা গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে যায়

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

স্যাম এর ছবি

লেখাটি প্রথম দিন পড়ে আর কোন মন্তব্য করতে পারিনি - ইমোও দিতে পারিনি ।
বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু এক বছর - একবিংশে তা যে এত কমে যাবে, ভাবিনি। ইস্যুর অভাব নেই, হবেনা এদেশে - আর আগেই জানা আছে গোল্ডফিশ মেমোরির জাতি আমরা। কিন্তু এই লেখা আর ব্যানারটির 'লাত্থি' অনেকদিন মনে থাকবে আমার - নিশ্চিত!

নীড় সন্ধানী এর ছবি

কংক্রিটের পিলার থেকে বের হয়ে আসা একটা পা, আধপরা একটা মোজা(হয়তো কাজে গিয়ে মোজাটা খুলে আরাম করে কাজ শুরু করতে যাচ্ছিল) আর এক পাটি জুতোর ছবি যেমন গেঁথে গেছে প্রথমদিন, তেমনি গেঁথে গেল নুপুর পরা আরেকটা পা। স্বার্থপর সুস্থ থাকার জন্য অগণিত দৃশ্য মুছে ফেলতে চাই মগজের ভেতর থেকে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

"আমরা কোটি কোটি ডলার দিয়ে মিগ কিনি, সাবমেরিন কিনি - মানুষ মারার হাতিয়ারে আমাদের শোকেস ধীরে ধীরে ভরে উঠতে থাকে। একটা যুদ্ধবিমানের টাকায় কতজন মানুষের জীবন বাঁচানো যেতো, সে হিসাব আমি মেলাতে পারি না। অবশ্য গরীব বাঁচানোর
যন্ত্রপাতি কিনে খামাকা টাকা নষ্ট
করে কী লাভ?"

মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

"আমরা কোটি কোটি ডলার দিয়ে মিগ কিনি, সাবমেরিন কিনি - মানুষ মারার হাতিয়ারে আমাদের শোকেস ধীরে ধীরে ভরে উঠতে থাকে। একটা যুদ্ধবিমানের টাকায় কতজন মানুষের জীবন বাঁচানো যেতো, সে হিসাব আমি মেলাতে পারি না। অবশ্য গরীব বাঁচানোর
যন্ত্রপাতি কিনে খামাকা টাকা নষ্ট
করে কী লাভ?"

মন খারাপ

তালেব মাষ্টার

অতিথি লেখক এর ছবি

চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না

monni এর ছবি

যতবার চিন্তা করি ততবার এ কেমন জানি নিশ্স্বাস বন্ধ হয়ে আসছে টের পাই।
চোখের জলেই চোখ পরিষ্কার করি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।