অতিমূল্যায়ন ০২- স্বপ্ন সম্ভাবনার মৃত্যু

রাসেল এর ছবি
লিখেছেন রাসেল (তারিখ: শনি, ১৫/০৩/২০০৮ - ১:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঈদের দিন বিকেলে বসে আছি, হঠাৎ রাফি ফোন দিলো, অবশ্য এটা নিয়মিত বিষয়- রাফি অনেক দিন ঢাকা শহরছাড়া- ঢাকা শহরে নিয়মিত বসবাসের ফলে ওর ভেতরে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ জন্মেছে সেটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কোনোভাবেই- তার নিরাপত্তাহীনতার গল্প অদ্ভুত এবং আশ্চর্য- শহরের মানুষের নির্মমতা আর নিস্পৃহতার মর্মান্তিকতার বিষয়ে নানাবিধ পাঠ পাওয়া যাবে সে গল্পে- মানুষের প্রতিষ্ঠার লড়াই, টিকে থাকবার কানুইবাজি আর মানুষের যোগাযোগ রক্ষার নামে আদর্শহীনতার চর্চা, প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার রাজনীতি, প্রতিষ্ঠানের প্রতিহিংসাপরায়নতা এবং বিরুদ্ধতাদমনের চেষ্টা-
চিলেকোঠার সেপাইয়ের আসলে চিলেকোঠা ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ হয় না- চিলতে ছাদের সীমিত পরিসরেই তাকে ভেবে নিতে হয় আকাশ অসীম- হয়তো তার ভেতরের আগুন নিভে গেছে কিংবা নতুন কিছু করবার সাহসও তার নেই- ভেঙে সব কিছু নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মতো মানসিক জোড়ও হয়তো তার নেই এখন- তাই সসম্মানের পশ্চাতসরণের রীতি মেনে নিয়েছে সে-

হঠাৎ তার কথাতেই মনে হলো আজ হুমায়ুন আহমেদের নিষাদ দেখাবে- ও নিষাদ দেখতে আসবে- নিষাদ পরিচালনা করেছে অনিমেষ আইচ- ওর প্রিয় ছোটো ভাই- অনিমেষ আইচ নামটা একটু ধাক্কা দিলো- কোথায় পড়লাম? প্রথম আলো মেরিল পুরুস্কার পেয়েছিলো কোনো এক নাটকে- সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল পরিচালক-
বিনোদনের জগতটাকে আমার আশ্চর্য রকম হাস্যকর লাগে- যারা এখানে মূল্যায়িত হয়, যাদের নিয়ে জোর আলোচনা চলে তাদের যোগ্যতা বিষয়ে বিশাল একটা প্রশ্নচিহ্ন আমার ভেতরে থাকেই-

এনটিভিতে নিষাদ দেখাবে- বেচারা অনিমেষ আইচ নিজেই মিসির আলি সেজেছিলো- তবে আমার কষ্ট লেগেছে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছি মিসির আলীর সাদামাটা নিম্নমানের চিত্রায়নে-

গতবার বৃহন্নলা এবং এবার নিষাদ দেখে যে বোধটা জাগলো তা হলো মিসির আলির চরিত্রটা উপলব্ধি করবার সাধারণ বোধটুকু নেই পরিচালকের।
কেনো এটা আমি বুঝি না। মেধাবি পরিচালক নেই বলে বালছালকে মেধাবি পরিচালক উপাধি দেওয়ার ঘোর বিরোধী আমি- সিনে সাংবাদিকেরা যখন এটা করে তখন অযোগ্য মানুষের অতিমূল্যায়ন ঘটে এটা একধরনের হলুদ সাংবাদিকতা।

মিসির আলি চরিত্র কল্পনার প্রথমেই আমার ভেতরে যে চাহারা ভাসে বুদ্ধিদ্বীপ্ত চোখ- আত্মমগ্ন উদাসীন একজন মানুষ, যাকে দেখলেই নির্ভরতা জাগে- প্রশান্তি জাগে-
এমন একজন যার মাথার চুল এলোমেলো থাকবে- কিছুটা পাতলা, তবে সেই সাথে ধ্যানী মগ্নতাও থাকবে তার শাররীক ভঙ্গিতে-
পোশাকে পরিপাটি হবে না, কিছুটা অগোছালো হলেও সৌমভাব জাগ্রত হবে তাকে দেখলে- তার উপস্থাপনায় কখনই কোনো অপরিচ্ছন্নতা থাকবে না- অপরিচ্ছন্নতার কোনো অনুভুতি জাগাবে না তার উপস্থিতি।
ধারাবাহিক শিক্ষা চর্চায় মানুষের চেহারায় আলাদা একটা পালিশ চলে আসে- আর মুখভঙ্গি এবং বাচনিক কৌশলে শিক্ষার প্রভাবটা স্পষ্ট ফুটে থাকে ।
আমাদের এই মেধাবি অনিমেষকে মিসির আলীর ভুমিকায় দেখে প্রথমেই যে অনুভুতি জাগে তা হলো এই লোকটা মাত্র ডাস্টবীন ঘেঁটে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছে- একটা গা ঘিনঘিনে নোংরা অনুভুতি তার পোশাক আর দেহভঙ্গিতে-
দ্বীতিয় দুর্বলতা মিসির আলীর ঘরে বই নেই তেমন- অন্যমনস্কতার ছাপ হিসেবে তার বিছানায়- বসার টেবিলে একটা দুটো বইয়ের উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়- অন্তত একটা বই শোবার ঘরের বিছানায়- সেখানে একটা পেজমার্ক দেওয়া কাগজ- সাথে একটা নোটপ্যাড কিংবা খাতা- তবে ডিটেইলসের এই বিষয়টাই অনুপস্থিত এখানে-

মিসির আলীর চেহারা আর পোশাকে যে ব্যক্তিত্ব আর শিক্ষার ছাপ আশা করা হয় সে তুলনায় মিসির আলী সাজে অনিমেষ আইচ নিতান্তই ব্যক্তিত্বরহিত এক আবর্জনাখাদক যে সদ্য আবর্জনা ঘেঁটে ক্যামেরার সামনে পেছনে কাজ করছে।

শিক্ষা মানুষের চোখে আলাদা একটা দ্বীপ্তি দেয়, মিসির আলী যার মূল আগ্রহ পঠনে এবং সমস্যা বিশ্লেষণে এবং যার কাছে এই শিক্ষিত অভিব্যক্তি পাঠকমাত্রই আশা করে অনিমেষ আইচ তেমন মিসির আলী চিত্রয়নে পুরোপুরি ব্যর্থ।

পরিচালনা বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো- ক্যামেরার কাজ সামান্য কিছু জায়গায় সুন্দর হলেও সর্বোপরি ফ্রেমিং সুন্দর না-অতিমূল্যায়িত হোগাভারী পরিচালকের যোগ্যতা অনুযায়ী যতটা খারাপ হওয়ার কথা ছিলো নিষাদ তেমন মানেরই একটা কাজ হয়েছে- এই পরিচালকের যোগ্যতা আর ক্ষমতার প্রকৃত পরিস্ফুটন এই নাটক-

আমার মনে হয় বিনোদনের জগতে যোগ্য মানুষের অভাবটা দিন দিন আরও প্রকট হবে এবং এই অবসরে আমাদের অসংখ্য অখাদ্য মানুষকে হজম করতে হবে- যেমন হজম করতে হচ্ছে অমিতাভ রেজাকে- আমি বলছি না অমিতাভ রেজা জঘন্য- তবে আমার মনে হয় সার্বিক যোগ্যতা বিবেচনা করলে অমিতাভ রেজা হয়তো ৫০এর ঘরে নম্বর পাবে- তবে যেহেতু আদা বনে শেয়ালই বাঘ তাই সবাই তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ৯০এর উপরে দিয়ে যাচ্ছে এবং এটা একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে- যখন যোগ্যতার প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না তখন আসলে জোয়ারে অনেক আবর্জনাই পাড়ে চলে আসে- সেখানে মুক্তোসহ ঝিনুক থাকে তবে বেশির ভাগই অন্তঃসারশূন্য সৃষ্টিশীল যাদের এক কানে ফুঁ দিলে অন্য কান দিয়ে বাতাস বের হয়ে যাবে।


মন্তব্য

রাবাব এর ছবি

ঘটনা সত্য। যদিও অনিমেষ আইচের ব্যাপারে বিস্তারিত আমি জানি না, তার খুব বেশি কাজও দেখার সুযোগ আমার হয়নি তবে বাকি সব বিষয়ে সহমত পোষণ করছি।

রাসেল এর ছবি

আমিও খুব বেশী কাজ দেখি নি, যারা দেখে তারা হয়তো আরও ভালো বলতে পারবে-

-------------------------------------------------------
বাংলায় হাগি, মুতি, বাঁচি

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

হিমু এর ছবি

আইচ বেচারা এই পোস্ট পড়লে এমন কান্না কাঁদবে যে শাবানার ভূমিকায় চালিয়ে দেয়া যাবে।

একটা কথাই শুধু বলতে চাই, তোমার দিল্কি দয়া হয়না?


হাঁটুপানির জলদস্যু

দ্রোহী এর ছবি

প্যাকেজ উন্নয়নের জোয়ারে দেশে আগাছার মত পরিচালক, নাট্যাভিনেতা জন্মাচ্ছে — ব্যাপার না। ভালো কেউ না থাকলে আগাছার ভেতর থেকেই "সেরা" আগাছাটিকে বেছে নেয়া হবে। এটাই স্বাভাবিক। মুল সমস্যাটা অন্য জায়গায় — জাতি হিসাবে আমরা সবাই শর্টকার্ট মারতে আগ্রহী, কোনরকম পড়াশোনা বা পরিশ্রম ব্যতীতই আমরা চুড়ায় উঠে যেতে চাই। বাংলাদেশে যারা নাটক/সিনেমা পরিচালনার লাইনে আসেন তাদের কতজন প্রস্তুতিপর্বের কাজটুকু শেষ করে আসেন তা বলাইবাহুল্য।

মিসির আলী হিসাবে 'আবুল হায়াৎ' কে দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। যতদুর মনে পড়ে অতীতে সেটা করা হয়েছিল, এবং আমার কাছে ভালোই লেগেছিল।


কি মাঝি? ডরাইলা?

অয়ন এর ছবি

কতবড় রুচিহীন হলে মিসির আলির এইরকম হাস্যকর চরিত্রায়ন সম্ভব।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আশির দশকের শেষে বিটিভিতে মিসির আলী সিরিজের গোটাদুই নাটক হয়েছিল মনে পড়ে। অন্যভূবন আর অন্যভূবনের ছেলেটা। এখনকার টিভি নাটকের বিচারে বেশ ভালো হয়েছিল বলতে হবে। সেখানে মিসির আলী হয়েছিলেন আবুল হায়াত। তাঁকে সেখানে পারফেক্টই মনে হয়েছিল।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

রাসেল এর ছবি

আমার পছন্দ হুমায়ুন ফরিদী- অনেক চেষ্টা করেও আসাদুজ্জামান নুরকে মিসির আলী হিসেবে মেনে নিতে চাইছে না মন- আর আবুল হায়াতের প্রধান সমস্যা তার টাক- আমার কল্পনায় কোনো টাকসর্বস্ব মিসির আলী নেই- এর বাইরে আসলে তেমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না যাকে চোখ বুঝে মিসির আলীর চরিত্রে ভাবতে পারি

-------------------------------------------------------
বাংলায় হাগি, মুতি, বাঁচি

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

হিমু এর ছবি

মিসির আলির ভূমিকায় আবুল হায়াতকে একবার দেখে ফেলেছি বলেই বোধহয় তাকে মানানসই মনে হয়। টাক তো পরচুলা দিয়ে হর হামেশাই ঢাকা হচ্ছে।

তবে আমি মনে করি মিসির আলির জন্যে একেবারে আনকোরা কাউকে ধরে নিয়ে আসা উচিত। পড়ুয়া চেহারার কোন মাঝবয়েসী লোক। পরিচালক বাকিটা তার কাছ থেকে বার করে নেবেন।

সচলের মুজিব মেহেদী যদি গোঁফ কামাতে রাজি হতেন, তাকে মিসির আলির ভূমিকায় বেশ মানিয়ে যেতো বলে আমার বিশ্বাস।


হাঁটুপানির জলদস্যু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।