মাতৃস্নেহ

রাসেল এর ছবি
লিখেছেন রাসেল (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/০৯/২০০৮ - ১২:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গল্পটা অনেক দিন মাথার ভেতরে ঘুরছে, খসরা না নামালে হতো না ,তাই নামিয়ে দিলাম।

১.

বসতির সবাই শিকারে গেছে ন্যুমিয়া ছাড়া, ৭ মাসের গর্ভবতী ন্যুমিয়া ছাউনির সামনে বসে দেখছে চারপাশ।আশে পাশে কয়েকটা তাঁবু আছে, সেগুলোও ধুলোঝড়ে ধুসর। ৩ চাঁদ গেলো বৃষ্টির দেখা নেই, ঝড় হানা দিচ্ছে প্রতি দিনই, উত্তরের হাওয়ার সাথে উড়ে আসছে ধুলি, নদীটাও চোখের সামনে মরে গেলো,এখন তেমন শিকার পাওয়া যায় না এখানে, নিশাচর প্রাণীরাও এদিকে আসা ছেড়েছে,ন্যুমিয়ারাও চলে যাবে হয়তো, তবে যাই যাই করেও ঠিক যাওয়া হলো না।

২.
ন্যুমিয়া তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে দুরের নদীর পাশের রাস্তা দেখছে সকাল থেকেই, গর্ভে অনাগত সন্তান ঘাঁই মারে,শরীর অবসন্ন হয়ে আসে,গত ২ দিনে অবশিষ্ট যা ছিলো সব খেয়ে শেষ, এখন বসতিতে আর কিছু নেই। সমর্থ পুরুষ নারী সবাই গিয়েছে শিকারে পেছনে ফেলে রেখে গিয়েছে অশক্ত বৃদ্ধ গুণীন আর শিশুদের।

১ দিনের অনাহার শিশুদের প্রাণোচ্ছলতা কমাতে পারে নি, তারা নিজস্ব নিয়মেই উচ্ছল হয়ে আছে, শুধু এই বসতিতে নিনি আর গুটিকয় শিশুরাই অপেক্ষায় আছে, গুনীনের অপেক্ষা নেই, উপরের আকাশ থেকে তার খাদ্য আসে।

তাবুতে ঢুকবার পড়েই কোণা থেকে হামলে পড়লো তিয়া, হামাগুড়ি দিয়ে হাতে নাক ঘষলো, চার পেয়ে পোষা প্রাণীর মতো আদুরে স্বভাবে গায়ে নাক ঘষে তিয়া।

খাওয়ার না পেয়ে হাতে আঁচড়ে দেয় তিয়া , ওকে ঝটকা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দরজায় দাঁড়ালো নিনি।


বাইরে সামান্য কোলাহল, ওরা ফিরেছে, সাথে কোনো খাওয়ার নেই, জ্যান্ত লাশের মিছিলে নিজের অস্বাভাবিক গর্ভ নিজেই লজ্জিত হয় ও।

ঘরের পুরুষ ধুঁকছে, শিকারের ধকলে বিধ্বস্ত, ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়েছে, কথা বলবারও ক্ষমতা নেই তার। মানুষগুলো ম্রিয়মান পরস্পর সারি বেধে আসছে, সামান্য শব্দেও খেঁকিয়ে উঠছে, তবে সহিংস নয় কেউই। তেমন লড়াকু নয় কেউই, লড়াই করবার শক্তিও নেই এমন অবসন্ন শিকারের ধকলে, শিকার পাওয়া যায় নি কোনো।


তাঁবুর সামনেই অবসন্ন মানুষেরা বসে থাকে, লম্বা হাড়কাট্টা মিশিকে চোখে পড়লো ওর, বসতির সবচেয়ে বলিষ্ঠ পুরুষ, ওর ভাই, বসতির অন্য মেয়েদের ছেড়ে যখন তার ঘরেই উঠলো মিশি একটু অহংকারের দোলায় টালমাটাল ছিলো ন্যমিয়া।


এরপরেই তিয়া হলো,তবে আশ্চর্য ছেলে ওর, বাইরে ফালি ফালি হয়ে যাচ্ছে আকাশ, জুহু আগুণের বর্শা ছুড়ে মারছে জুব্দালকে, সেই শব্দে বসতির সবাই হাহাকার করে উঠে, তিয়া নিশ্চিন্ত ঘুমায়।

সামনে বাঘ এসে হামলে পড়লো একদিন, তিয়া বসে থাকে, হামাগুড়ি দিয়ে অন্য দিকে চলে যায়, বাঘের গর্জনে তার কান্না আসে না। গুণীন বললো এই ছেলে বড় আশ্চর্য ছেলে, আগুনের সামনে নিয়ে গেলেও ভয়ে কাঁপে না, যত সময় গেলো ততই অদ্ভুত হলো তিয়ার আচরণ, বসতির সবাই বলছে এ নির্ঘাত অপদেবতার কাজ, অপদেবতা ভর করেছে ওর উপরে, ওকে মেরে ফেলাই ভালো।


এই বিরুপ পরিবেশেও ছেলেটাকে অনেক দিন ধরে বড় করছে ও, ওরা মেরেই ফেলতো ওকে, ওই বাঁচিয়েছে বলা যায়, নিজের খাওয়া থেকে কিছু অংশ বাঁচিয়ে ওকে খাইয়েছে। তাও ২ বছর হয়ে গেলো, অদ্ভুত জন্তুর মতো স্বভাব, হামাগুড়ি দিয়ে চলে, মাঝে মাঝে থেমে নাক উঁচিয়ে চারপাশে ঘুরে, তার পর শরীরের সাথে শরীর ঘষে।

ভেতরের সন্তান আরো জোড়ে ঘাঁই মারে, মিশির গাঁয়ের গন্ধে দুরে ছিটকে পালায় তিয়া, ও মিশিকে ভয় করে, এই মানুষটাকে বুঝতে পারে না ন্যুমিয়া, তিয়াকে দেখলেই মিশির চোখে হিংস্র জিঘাংসা খেলা করে। সবার চোখ থেকেই আড়ালে রাখে ও তিয়াকে। সন্ধ্যায় আগুণ জ্বেলে গোল হয়ে বসে গুনীনের কথা শুনছে বসতির সবাই।

হয়তো আগামি কালই ওরা বসতি ছেড়ে দিবে, সামনে ২ দিনের হাঁটা পথ পার হলে আরও একটা জ্যান্ত নদী আছে, সেখানে খাবার মিলবে বিস্তর,

মিশিরা মগ্ন হয়ে গুনীনের কথা শুনছে। ন্যুমিয়া চুপচাপ ঘরে ফিরে আসলো।


ঘরের কোনা থেকে ছুটে আসলো তিয়া, নাক উঁচিয়ে হাতে গা ঘষলো। জুহু আমার গর্ভের সন্তান যেনো মিশির মতো হয়, গর্ভের সন্তান না খেতে পারে কাঁদছে । বিকেলের অবসন্ন ঘুমের ভেতরেও খেতে না পাওয়া অনাগত সন্তানের কান্না শুনছে ও, মনে হচ্ছে ঐ কান্না মাথার ভেতরে ঢুকে বসে আছে।


মিশি ঘরে আসলো যখন কোনার কুকুর তারা মাঝ আকশে স্থির,

খেতে আসো।

শরীরে নতুন জোর টের পায় ন্যুমিয়া,

ঘরের কোনায় কোনো শব্দ নেই, আকাশের তারারা স্মিত চেয়ে থাকে পৃথিবীর দিকে, নীচে ক্ষুধার্ত পৃথিবীতে সবাই শিকার খুঁজে, প্রাণে বাঁচতে চায়। জুহু সবার জন্যই খাদ্য রেখেছেন।

অনাগত সন্তানের কান্না শুনছে না ন্যুমিয়া, শুধু অদ্ভুত একটা ঘরঘর আওয়াজ শুনতে পায় থেমে থেমে। হাতটা অবসন্ন,পিচ্ছল, ভারী মনে হয়।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আদিবাসিদের অস্তিতের সংগ্রাম আর সাথে মায়ের ভালোবাসা ............ হুম...... প্লটটা সুন্দর । এরকম আরও কিছু আইডিয়া থাকলে নামিয়ে দিন পড়ে সময়ের সদ্ব্যবহার করি ।
নিবিড়

হাসান মোরশেদ এর ছবি

অনেকদিন পর রাসেলের কোন মৌলিক লেখা পড়ার সুযোগ হলো( হোক না খসড়া) । আমাদের অনেক অনেক সময়- আরো অনেক অনেক কাজে চলে যাচ্ছে ।

এই লেখাটা পড়তে গিয়ে বহুদিন আগের পাঠ- অভিজিৎ সেনের 'রহু চণ্ডালের হাড়' মনে পড়ে গেলো । কতোটুকু প্রাসংগিক যদি ও আমি নিশ্চিত না ।
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

রাসেল এর ছবি

আমি নিজেও নিশ্চিত না কতটুকু প্রাসঙ্গিক।
অভিজিৎ সেনের গল্প পড়া থাকলে বলতে পারতাম বিষয়টা।
------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

শেখ জলিল এর ছবি

রাসেলের গদ্য বরাবরই চমৎকার। আদিবাসীদের সংগ্রাম নিয়ে মৌলিক এ গল্পেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গল্পের শেষে এসে ন্যুমিয়া ও তার সন্তানের পরিনতি বুঝতে পারছি। তবে নিনির পরিনতি বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। পাঠক হিসেবে হয়তো এ আমারই অক্ষমতা!
...সুন্দর এ গল্প উপহারের জন্য রাসেলকে অনেক ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

রাসেল এর ছবি

নিনি আসলে কোনো চরিত্র না, ন্যুমিয়া আর নিনি এই দুইটা নাম ছিলো, ন্যুমিয়া দিয়ে শুরু করছিলাম কিন্তু পরে নিনি চলে আসছে কখন খেয়াল করি নাই।

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

নজমুল আলবাব এর ছবি

পড়তে পড়তে শিউরাইছি আর মনে হইছে রাহুল সংকৃত্যায়ন পড়ছি।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দারুন!
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

সুমন সুপান্থ এর ছবি

এর আগে আপনার আর কোনও লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয় নি, রাসেল । এই গল্পটা পড়ে সেই আফসোস আরও বাড়লো বৈ কি !
দুর্দান্ত গদ্যের হাত আপনার । এমন গদ্যেই সোনা ফলে। অভিবাদন জানবেন ।

---------------------------------------------------------

আমার কোন ঘর নেই !
আছে শুধু ঘরের দিকে যাওয়া

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

নিরিবিলি এর ছবি

সুন্দর তুলে ধরেছেন। অনেক ভাল লাগলো। আরোও লিখুন হাসি

জিফরান খালেদ এর ছবি

এইটা একটা চমতকার দুর্দান্ত গল্প। আমি সুমন ভাইয়ের ভাষা প্রসঙ্গে একমত হইতে পারতেসি না। তবে, ঘটনা এই যে, এই গল্প যখন লিখা হবে, আদৌ না হইলেও আমার বহু বহুদিন এইটা মনে থাকবে।

আপনি সে অর্থে সফল।

ঝরাপাতা এর ছবি

অসাধারণ!! শুধু এইটুকুই।


যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . (আবু হাসান শাহরিয়ার)


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।