পথের গল্প ০৫ (খ)- পাসপোর্ট বিড়ম্বনা

রাসেল এর ছবি
লিখেছেন রাসেল (তারিখ: শুক্র, ২৩/০৫/২০০৮ - ৩:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফর্ম পুরণ করা শেষ, ঠান্ডায় কাঁপছি রীতিমতো। নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে ঢুকিয়ে নিতে পারলে বেশ হতো। তবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমি যতটা সম্ভব নিজের আয়তন সংকুচিত করে বসে আছি। আমার সামনের সোফা থেকে সেই দুইজন উঠে চলে গেছে। মেয়েটা পাসপোর্টের ফরম জমা দিয়ে চলে গেছে। ট্রাস্ট ব্যাংকরের মানুষেরা সম্ভবত এর বেশী কিছু করতে পারবে না। পাসপোর্ট অফিসে ব্যাক্তিগত যোগাযোগের গুরুত্ব হয়তো আছে। সেখানে ৩০ দিনের পাসপোর্ট ব্যক্তিগত যোগাযোগে ১৫ দিনে এমন কি ৩ দিনেও নিয়ে আসা সম্ভব। তবে ট্রাস্ট ব্যংকে এটা সম্ভব না। মেয়েটার ধারাভাষ্য শুনে এমনটাই বুঝলাম। তার নিজের পাসপোর্ট সে করতে পারবে এখান থেকে, তবে তার বাবার পাসপোর্ট এখান থেকে করা যাবে না। এখানের নিয়ম হলো শুধু মতিঝিল রমনা সবুজবাগ থানার মানুষজন পাসপোর্ট করতে পারবে।
মেয়েটার বাবার জন্য কষ্ট হয়। তার পাসপোর্ট করতে পাসপোর্ট অফিসে ধর্ণা দিতে হবে। মেয়েটা তাও করবে, তেল তেলে ছেলেটা বিগলিত হয়ে বললো তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো।
মানুষের বিনয়ের এইসব শব্দ শুনলে মাথায় আগুন জ্বলে। কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো কি ব্যাটা, ধন্যবাদের প্রতিশব্দ কয়টা আছে বাংলায়?
লোকটা বাইরে গেলো, আবার পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পিওন হাসি চেপে বললো ভাই সামনের গেট দিয়ে নীচে নামতে হয়।
আমি আরও কুঁকড়ে বসে আছি। আমার পাশে এক সরকারী কর্মকর্তা। আসবার পর থেকেই টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত। কি বলেন, ক্যান ৮১ দিয়ে ৫৬ গুন দিবো ক্যান।
নাহ এইটা হবে না, সব লিগালি হতে হবে, তুমি যদি ঠিক মতো কাগজ জমা না দাও তাইলে তোমাকে আমি লিগালী ধরবো।
আবার কিছুক্ষণ বিরতি, ও আশরাফ ভাই- কে কে বলছেন।
আরে আমাকে চিনলেন না, আমি চৌধুরী, চৌধুরী বলবার ভেতরে যে ক্ষমতার দম্ভ সেটা দেখে মুগ্ধ হলাম। মনে হলো বাংলা ছবি দেখছি কারো সৌজন্যে।
আমার সামনে আরও একজন বসলো এসে, তার বুকের সব কয়টা বোতাম খোলা, হাতে চামড়ার ব্যাগ।
এসেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। ও করিম ভাই, আইচ্ছা আপনার পরিচিত কেউ আছে- না না আমি ট্রাস্ট ব্যাংকে, পাসপোর্টের কাজ করাতে হবে।,
হ্যাঁ হ্যাঁ পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজটা আমি করে দিবো। আমি গেছিলাম তো ওসির কাছে। বলছে কোনো সমস্যা নাই। আপনি শুধু রশিদটা আনবেন পুলিশ ভেরিফিকেশন আমি দিবো।
শফিক ভাই জানে

আবারও ফোন হাঁকায়, ও মইনুল ভাই। নাহ , ও আচ্ছা আচ্ছা ও এই ব্রাঞ্চের না। নারে ভাই পাসপোর্ট করতে দিবো, গতকাল আসছিলাম বলে বার্থ সার্টিফিকেটের কপি আনতে হবে, সব কিছুই আনছিলাম ঠিক মতো ঐটা আনতে ভুলে গেছিলাম।

না না ঠিক আছে।
আমি প্রচন্ড শীতের কামড়ে কুঁকরে আছি, তার বুকের ৩টা বোতাম খোলা। সে সোফায় হেলান দিয়ে ফোনে কথা বলছে। মোটামুটি সবাইকে শুনিয়েই ফোনে কথা হচ্ছে। দাপট দেখানোর লোভ কেউ ছাড়ে না।
পরিচিত মানুষের সাহায্য নিয়ে একটু নিয়ম ভেঙে কাজটা আগে ভাগে করিয়ে নেওয়ার বাজে স্বভাবটাই সব কিছুর মূলে। যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও অহেতুক কিছুটা বাড়তি সুবিধা চাওয়ার প্রয়োজন কি? তবে বাঙালীর স্বভাবটাই এমন। একটু সুযোগ আর ক্ষমতা দেখানোর কোনো সুযোগই তারা হেলায় হারাতে চায় না। আমি মিটমিটিয়ে হাসি। আমার মুখোমুখি বসা মেয়েটাও বাবার সাথে হাসে।
আরও মানুষ আসে। সবার হাতেই একটা করে ছোটো চিরকুট।
আমি উঠে গেলাম অভ্যর্থনা। আমার সামনে পাসপোর্ট লেখা কিউবিকল। সেখানে যাবো, সামনের মহিলা বলে উঠলেন, কেবল ৫ নাম্বার সিরিয়াল চলে। আমারটা ৮।
আমি লজ্জিত হয়ে ফিরে আসলাম। চেয়ার গুনলাম, আরও ৭ জন এর পরে আমি, সে হিসাবে আমি ১৪ কিমবা ১৫।
আরও মানুষ আসলো। সবার হাতেই কাগজের চিরকুট। আমি কিছুটা বিভ্রান্ত।
সামনে এগিয়ে গেলাম। একটু আগেই মেয়েটার নাম জেনেছি মুঠোফোনের কল্যানে, নাজিয়া- তাকেই জিজ্ঞাসা করবো ভাবলাম এই চিরকুট পাওয়া যায় কোথায়- উঠলাম গেলাম, দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যার্থও হলাম। আড় চোখে দেখি মেয়ের বাবা কটমট করে তাকিয়ে আছে। আমি পাত্তা না দিয়ে পাশের জনকে বললাম ভাই এই কাগজের টুকরা কোথায় পাইছেন, লাম্বার লাগানোর কাগজটা কোথায় গেলে পাবো।
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো, এখনও আপনি সিরিয়াল নেন নি।
ঐ যে গেটের কাছে যে আছে, তার কাছে পাবেন।
আমি টুকটুক করে সুবোধ বালকের মতো গিয়ে সিরিয়াল নাম্বার নিলাম। মেয়েটার বাবা কটমট করে তাকিয়ে আছে। তাকা পাত্তা না দিয়ে তাকালাম সিরিয়াল নাম্বার ২৭। অন্তত ১ ঘন্টা বাইরে কাটানো যায়। এর বেশী সময় এখানে কাটালো নির্ঘ্যাৎ নিউমেনিয়া হবে। আমার ঠান্ডা সহ্য হয় না।

বাইরে যখন বের হলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় ১০টা ৪৫। এই সময়ে কোথাও ১ ঘন্টা কাটানোর উপায় নেই, অসহায় ভাবে মোবাইলের দিকে তাকালাম। বেচারা মোবাইলের কোনো ডিসপ্লে নেই আপাতত- তাই মোটামুটি কানা, আমার মোবাইল এখন ওয়্যারলেসের মতো, যারাই ফোন করে তাদের বলি ফোন রাখবার আগে একবার বলবি ওভার, নাইলে বুঝি না, কিছুক্ষণ কথা বললার পরে বুঝি অন্য পাশে কেউ নেই।

মতিঝিলের আশে পাশে কাজ করে এমন বন্ধুদের তালিকা খুঁজছি। তালিকায় যাদের নাম আসলো, তাদের কারোই মোবাইল নাম্বার জানা নেই- আর ডিসপ্লেবিহীন মোবাইলে সম্ভব না ফোনবুক খুঁজে ফোন করা। মনে আছে একজনের নাম্বার। তাকে ফোন দিলাম, মতিঝিলের সাবধানী ফোনওয়ালা, চেইন দিয়ে টেবিলের সাথে বেঁধে রেখেছে মোবাইল, চেইনটাও আকারে ছোটো। ঝুঁকে কথা বলছি, একটু বাঁকা হয়ে, না সে আছে। যাওয়া যাবে। ঠিকানা নিয়ে রওনা দিলাম তার ওখানে।
পৌঁছালাম ঠিকঠাক মতোই। পৌঁছে পড়লাম বিপদে, বড় বিল্ডিংয়ের কোন দিক দিয়ে ঢুকবার সিঁড়ি। দোতালায় যেতে হবে। লিফটের পাশে গিয়ে উপরে উঠে ফেরত আসলাম, দরজা বন্ধ। আবার নীচে নেমে উর্দো দেখে একজনকে থামিয়ে বললাম আপনাদের অফিসে যাবো কিভাবে?
এইতো পাশের গেট। আমি অন্ধের মতো হেঁটে গেলাম, নাহ বড় দরজা। ঢুকলাম, নীচে জিজ্ঞাসা করলাম উপরে উঠবার সিঁড়ি কোথায়। সেটায় চড়ে উপরে উঠলাম।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বিশেষত প্রাইভেট ব্যাংকগুলো আসবার পড়ে ব্যাংকরে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বদলেছে। তবে এই বদলটা কাস্টমার কেয়ারের জায়গাতে। অন্য সবখানে এখনও তেজারতি ব্যবসার মতোই, একাপাশে কাগজের স্তুপ , এখানে ময়লা, সেখানে ঝুল। বিষয়টা ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে বিছানার চাদরের নীচে ময়লা লুকিয়ে ফেলবার মতো।

বস্তুত মানসিকতা, কর্মচারীদের দোহন করবার প্রবণতা কোনোটাই বদলায় নি, বরং বাইরের পোশাকটা বদলে গেছে।
সেখান বসে কিছুক্ষন কাজ দেখলাম। পরে বাইরে এসে সকালের নাস্তা। তখন ঘড়িতে বাজে ১১টা ৩০। অন্তত আমার সিরিয়াল চলে এসেছে এতক্ষণে।
বন্ধু বললো সমস্যা হবে না তো দেখো, ঐ ব্যাংকের হিসাবকিতাব আমার ভালো লাগে না।
কিসের কি সিরিয়াল আছে যখন তখন সমস্যা নাই। খেয়ে যখন ব্যাংকের দিকে রওনা দিলাম তখন ঘড়িতে ১২টা।
পৌঁছে দেখি গাদাখানেক লোক একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। সবারই নানাবিধ প্রশ্ন। পাশের ছেলেকে বললাম এখন কত নাম্বার সিরিয়াল চলে।
আমি ভাই ৩৭। আপনি কত?
আমি ২৭।
এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
কথা না বাড়িয়ে সামনে তাকাই, অবশেষে অশেষ ধৈর্য্যের পরে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সামনে দাঁড়াতে পারলাম। আমার পাশে ২ জন, সামনে দুই জন, সবারই তাড়া আছে। একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, একজন বিমান প্রশিক্ষক, একজন সাধারণ মানুষ আর একজন বরিশালের মানুষ।
বরিশালের মানুষ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ কর্মকর্তার বাড়ীও বরিশাল। তাই সেখানেও একটা বাড়তি সুযোগ খুঁজবার চেষ্টা। দেশের মানুষদের যদি একটু বাড়তি সুবিধা দিতেন তাহলে ভালো হতো।
দেশের মানুষকে বাড়তি সুবিধা দিবো কেনো, একটু কষ্ট দিবো। যান নীচে গিয়ে টাকা জমা দেন।
কবে পাবো পাসপোর্ট? লেখা আছে ফর্মে।
ঠিক সময়মতো পাওয়া যাবে তো।অবশেষে আমার দিকে ভগবান মুখ তুলে চাইলেন প্রায় ৩ ঘন্টা অপেক্ষার পরে আমি অবশেষে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলাম।
নাহ আপনার তো লেখা ছে সুত্রাপুর থানা। এইখানে হবে না।
বিনীত হয়েই বললাম ভাই এখনতো আমি রমনা থানার আন্ডারে আছি।
তাহলে তো হবে না। আপনার কি কমিশনারের কাছের কোনো চিঠি আছে?
না নেই।
ভোটার আইডি?
নাহ নেই।
তাহলে তো এখানে হবে না। আপনারটা সুত্রাপুর থানার আন্ডারে।
সুত্রাপুর থানার কাজ হয় কোথায়। ডিসি অফিসে।
ডিসি অফিস কোথায়। পুরান ঢাকায়।
এই জবাবে আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাই। পুরান ঢাকায় ডিসি অফিস খুঁজতে হবে। এইসব প্রশাসনিক জটিলতা কখনই পোহাতে হয় নি। কোথায় কোন সরকারী দপ্তর তা জানা নেই।

আমি ব্যর্থ দিনটাকে মনে করে সামনে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ মনে হলো সরকারী ঘোষণায় বলা ছিলো পোস্ট অফিসেও পাসপোর্টের কিউ খোলা হবে। উৎসাহ নিয়ে যাই জিপিওতে।
সেখানেও ব্যর্থ হলাম। আমার সামনে যে মানুষটা দাড়ানো রাস্তায়, তার পড়নে শাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতা, দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দা, উচ্চারণ শুনে এমনটাই মনে হলো।
হ্যাঁ ভাই একটু কষ্ট দিলাম। মনে কিছু করবেন না।
না মানে একজনকে জামিন দিতে হইতো। ওরাতো পলাতক ছিলো, আজকেই স্যারেন্ডার করবে।
নাহ না আপনার বিবেচনা, যা মনে করবেন।
দেশের জায়গাজমিতো সব আপনাদের জিম্মায় রেখে আসছি। এখন কি যাওয়ার সুযোগ হয়।

নাহ নাহ কি যে বলেন, লজ্জা দিচ্ছেন। আপনি ঢাকায় আসেন না কেনো, ঢাকায় চলে আসেন, কথা দিলাম এক বছরের মাথায় বাসা বানিয়ে দিবো।
আচ্ছা রাখি স্লামালাইকুম।

আমি সামনে গিয়ে সিগারের ধরালাম। এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই, বাং মারা সারাদিন বিফলে গেলো, এখন বাজে ১টা। যদি পাসপোর্ট অফিসেও যাই তাহলেও সময় লাগবে ১ ঘন্টা, পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সেটাও একটা বিবেচনার বিষয়।


মন্তব্য

আলমগীর এর ছবি

ডিসি অফিস না চিনলে পাসপোর্ট কেমনে পাবেন? আপনার ধৈর্যের প্রশসংসা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমার সামনে আরও একজন বসলো এসে, তার বুকের সব কয়টা বোতাম খোলা, হাতে চামড়ার ব্যাগ।
এই জাতিয় বাক্য লেখার আগে খোলাসা কইরা লেখবেন তিনি কোন গোত্রের। উফ... আমি তো এখনি ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের দিকে রওনা দিছিলাম। যাউক্গা... আপনের জন্য খারাপই লাগতেছে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।