বিস্ফোরণ ২

রাসেল এর ছবি
লিখেছেন রাসেল (তারিখ: শুক্র, ২১/০৩/২০০৮ - ১:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জহির ওসমান অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে একাকি- ঘরে কেউ নেই- এসির বাতাসে ঠান্ডা লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই- প্লেনে উঠবার পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করছে বসে বসে। এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা- পারলে ন্যাংটা করে প্লেনে উঠায় যাত্রীকে, এর ভেতরেও মাঝ আকাশে কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটে।
সৌভাগ্য তার এবং আরও ২০ জন যাত্রীর, প্লেনটা বিস্ফোরিত হয়েছিলো সিয়াটল লেকের কাছাকাছি- সেখান থেকে সোজা জলাভূমিতে পড়েছে- অন্য সবার হাত- পা ভেঙেছে, কেটেছে- এমনই দুর্ভাগ্য তার- তার শরীরে আঁচরও লাগে নি- আর এ জন্যই বোধ হয়- সিয়াটল সিটি হলের অস্থায়ী জয়েন্ট সেলে বসে আছে সে একাকি।

সিয়াটল শহরের একটু দূরে লেকের উপরের আকাশের বিস্ফোরিত বিমানের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে- সেখানে উপস্থিত স্থানীয় শহরের শেরিফ জ্যাসন বাউ, এফ বিআইয়ের স্থানীয় কর্মকর্তা রবার্ট ডাউনিং জুনিয়র, সিআইএ চীফ কেনেথ পলম্যান- বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞদের একটা দল বসে আছে সিটি হলে স্থাপিত অস্থায়ী হেড কোয়ার্টারে- বিস্ফোরণের ধরণটা আঁচ করবার চেষ্টা করছে তারা।

আন্তর্জাতিক প্রতিটা ফ্লাইটে দুজন অফিসার থাকে- স্থানীয় ফ্লাইটে কেনো এমন নিরাপত্তা আওফিসার থাকে না- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে রিপাবলিক্যান সরকার উদাসীন- বোস্টন টাইমসের কড়া সম্পাদকীয় পড়ে মুখ তিতা হয়ে আছে জ্যাসনের- অন্য কোনো জায়গা পেলো না এখানেই বিস্ফোরিত হতে হবে প্লেনটাকে? এখন দিন রাত সব এককরে খুঁজতে হবে প্লেনের ধ্বংসাবশেষ।

সিয়াটল লেকের সম্পূর্ণ এলাকা খোঁজা সম্ভব না- রবার্ট ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে এটুকুই- যেনো লেকের ভেতরের দিকে প্লেনের টুকরোগুলো না পড়ে- অন্তত যেনো খুঁজে পাওয়া যায়-

ডুবুরির দলের বিরাম নেই- অনবরত পানিতে ডুব দিয়ে যাচ্ছে তারা- প্রতিবারই কিছু না কিছু অংশ উপরে উঠে আসছে। টুকরোগুলো জমা করে নিয়ে যাওয়া হবে ওয়াশিংটনে- আপাতত তাদের কাজ প্লেনের সবকটা মানে যতটুকু উদ্ধার করা যায় ততটুকুই উদ্ধার করে নিয়ে আসা। বিমানটা মাটি থেকে ১৬০০ ফুট উপরে যখন নীচে নামবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন বিস্ফোরিত হওয়ায় প্রাণহানী তেমন হয় নি। এমনিতেই দুপুরের ফ্লাইটে তেমন লোক থাকে না- ফিলাডেলফিয়া থেকে সিয়াটলে আসবার পথে প্লেনে সব মিলিয়ে যাত্রী ছিলো ৫০ জনের মতো- আহত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৩০ জনকে- মারা গেছে ১০ জনের মতো- আর বাকি ১০ জন এখনও নিখোঁজ- আশা করা হচ্ছে তাদের ভেতরেও কেউ কেউ বেঁচে যাবে- অবশ্য যদি তারা লেকের অগভীর অংশে পড়ে তবে- ১৬০০ ফুট উপর থেকে সোজা পানিতে পড়লে আসলে বাঁচবার সম্ভবনা কম-আর বিস্ফোরণ আর পতনের পরের হতকচিত অবস্থা থেকে সম্বিত ফিরে পেতে পেতেই চলে যায় মূল্যবান কয়েকটা সেকেন্ড- এখানে প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান-

মানুষের প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত- এর ভেতরেও শূন্যেই কেউ কেউ শরীরটাকে গুটিয়ে নিতে পেরেছিলো- কেউ পড়েছিলো লেকের ধারের ঝোঁপের উপরে- তাদের কারো আঘাতই তেমন মারাত্বক নয়- সেরে যাবে- তবে ভোগাবে অনেক- শহর থেকে এম্বুলেন্সের মিছিল এসেছিলো এখানে-
ফিলাডেলফিয়া থেকে যাত্রীর তালিকা হাতে পেয়েই রবার্ট খুঁজে খুঁজে দেখছিলো এর ভেতরে সাম্ভাব্য অপরাধী কে হতে পারে- একটা নামে আঙ্গুল স্থির করলো সে জহির ওসমান- লংউড কলেজের কেমিস্ট্রির এসোসিয়েট প্রফেসর-

জহিরের সীট নাম্বার ছিলো ১৩-সি। ১৩ সংখ্যা অলুক্ষুণে এ কথা বিশ্বাস করে না সে- তবে এখন মনে হচ্ছে সংখ্যাতত্ত্বে আসলেই কিছু আছে। নইলে এত বড় বিপর্যয়ের পরেও কেনো সে সাম্ভাব্য বোমাবাজ চিহ্নিত হবে-
রবার্ট জহিরকে বসিয়ে রেখে উর্ধতন কর্মকর্তাদের জন্য অপেক্ষা করছে- তারা আসলে মূল ইন্টারোগেশন শুরু হবে- জহিরে চেহারার ভেতরে তেমন বিশেষত্ব নেই- বয়েস হবে ৩৫এর কাছাকাছি- খোঁজখোব নিয়ে যতটুকু জেনেছে- সেন্ট লুইস থেকে কেমিস্ট্রিতে গবেষণা শেষ করে সে লংউড কাউন্টি কলেজে নিয়োগ পেয়েছে ২ বছর আগে- কারো সাথেই বিদ্বেষের সম্পর্ক কেউ- কেউ তাকে কখনও উঁচু গলায় কথা বলতে শুনে নি- সবার সাথেই সদ্ভাব বজায় রেখে চলে- শুধুমাত্র তার কম্পিউটারে কিছু ধর্মীয় পুস্তক পাওয়া গেছে-
এটার ভিত্তিতে কাউকে বোমাবাজ বিবেচনা করা নেহায়েত অন্যায় হয়ে গেলেও তার উপরে নির্দেশ আছে জহিরকে কঠোর তত্ত্বাবধানে রাখবার- অনিচ্ছা স্বত্তেও সে এই কাজ করছে-
জহির তার সীটে বসেছিলো- পাশের কালো যিবকের গায়ের বিটকেল গন্ধটা নাকে সয়েও গিয়েছিলো- ২ ঘন্টা পরে আসলে তেমন মাথাও ঘামাচ্ছিলো না এটা নিয়ে- প্লেনের কর্কশ শব্দটাও মিলিয়ে গিয়েছিলো- সিয়াটলের কনফারেন্সে দিতে যাওয়া বক্তৃতার বিষয়বস্তু আর উপস্থাপনা নিয়ে ভাবছিলো মনে মনে-
৬ নাম্বার সীটের পাশে ধোঁয়া উঠতে দেখেছিলো সামান্য- এখন যেকোনো প্লেনেই ধুমপান নিষেধ- স্টুয়ার্ডেসকে কিছু বলবার আগেই ধাক্কাটা টের পেলো সে- প্লেনের একপাশ হা হয়ে গেছে- সেখান দিয়ে বাতাস ঢুকছে তীব্র বেগে- ফিউজলেজ দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে- একটা সীট উড়ে গেলো- ডানার পাশে আগুন জ্বলছে- প্লেনের মাথা নড়ছে- পাইলটের মে ডে ডাকটা শোনবার আগেই প্লেনটা মাঝ বরাবর দুইভাগ হয়ে গেলো- ছিটকে পড়লো সে শূন্যে- নীচে হালকা সবুজ পানি- সিয়াটল লেকে- লেকের চারপাশের গাছগুলোর মাথা এখন লালচে হলুদ- অদ্ভুত সুন্দর লাগছে- উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেনো রংতুলিতে একেছে এই দৃশ্য- আস্তে আস্তে রংয়ের ভেতর থেকে ধুসর ডালগুলো দেখা গেলো- শুন্যে সাঁতার কাটবার মতো ভেসে যাচ্ছে সে- প্রায় ১৫০ মাইল গতিতে নীচে পড়ছে- বাতাসের তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট হবে- টি শার্টের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে- রক্ত জমাট বেঁধে যাবে এমন অনুভুতি হচ্ছে তার।
মাত্র ১৫টা সেকেন্ড শূন্যে ছিলো সে- মনে হলো যেনো অনন্ত কাল- পানির কাছে পৌঁছাতেই শরীরটা গুটিয়ে নিয়ে যতটা সম্ভব ধাক্কা এড়াতে চাইলো সে-

ভাগ্যটা ভালো এমন বলতে পারছে না এখন- ধোঁয়ার গন্ধে পরিচিত কিছু একটা ছিলো- অথচ মনে পড়ছে না এখন- পানি তার পতনের ধাক্কাটা সম্পূর্ন সহ্য করে না নিলেও বোধ হয় বড় কোনো আঘাত সে পায় নি- সাঁতরে তীরেও পৌঁছেছিলো-
জলন্ত প্লেনের টুকরা যে মাঝপথে তাকে বিদ্ধ করে নি এটা ভেবেই আশ্চর্য হয়েছিলো সে- এম্বুলেন্সের সাইরেন শুনে কোনো আশ্বস্ত হয়েছিলো- পরে হেলিক্পাটার থেকে একজন তাকে দেখে- তুলে নিয়ে আসে হাসপাতালে-

রবার্ট হাসপাতালে গিয়ে তার সাথে কথা বলে- এরপর তাকে নিয়ে আসে সিটি হলে- এরপর থেকে সেখানেই বসে আছে জহির-

ওয়াশিংটন পোস্টের বিকেলের সম্পাদকীয় বারুদের মতো বিস্ফোরক ছিলো- আমরা দেশের বাইরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি- এখানে ওখানে কল্পিত সন্ত্রাসীদের হত্যার মিশন পাঠাচ্ছি- আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে আমরা সবার উপরে গোপনে খবরদারি করছি-
আমরা সবার ফোন লাইন আর ইন্টারনেটের উপর নজরদারি করছি- আমরা দেশের অধিবাসী এক বিশেষ ধর্মাবলম্বিদের উপরে অহেতউক সন্দেহ পোষণ করছি-
আমরা বাইরে সন্ত্রাসী নিধনের লোভে কি আমাদের নিজেদের দেশেই সন্ত্রাসীদের লালন পালন করছি?

জহিরের মনের অবস্থাও অনেকটা এরকমই- তার বন্ধুদের ভেতরে সাদা যেমন আছে তেমন আছে ভারতীয়- মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ- কাউকেই তার তেমন খারাপ লাগে নি- সবাই খেটে খাওয়া মানুষ- আইন মেনে চলে- কাউকেই হঠাৎ করেই মানুষ খুন করে বসবার মতো ম্যানিয়াক মনে হয় নি তার-

তবে ইদানিং তার বেশ ভয় হয়- বিশেষত স্কুলে আর কলেজের ক্যামপাসে যেভাবে বিষন্ন মানুষেরা পাখির মতো মানুষ মারছে তাতে নিজের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই- আসবার আগেও ভাবছিলো একটা রিভলবার কিনবে সে- এখন এই ছোট কক্ষে বসে তার মনে হচ্ছে খুবই ভালো হয়েছে যে সে রিভলবারটা কিনে নি এখনও-

রবার্ট তার নাম জানবার পড়ে যেভাবে তাকিয়েছিলো এই তাকানোতেই স্পষ্ট হয়েছে জুজুর ভয়ে ভীত সাধারণ মানুষেরা-
হাতের কানুই ব্যথা করছে তার- ঘুমও আসছে -
টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো জহির।

লেকের নীচ থেকে যতটুকু সম্ভব প্লেনের টুকরোগুলো তোলা হয়েছে- সেগুলোকে ট্রাকে তোলা হচ্ছে- অবশ্য এখানেই শেষ না- আরও ৩ দিন খোঁজ অব্যহত থাকবে- নিখোঁজ ১০ জন আর যদি অন্য কোনো আলামত পাওয়া যায়-
গুরুতর আহত যারা তাদের বাদ দিলে সবার সাথে কথা বলে শেরিফ নিশ্চিত হয়েছে আদতে ৬ নাম্বার সীটের আশে পাশে কোথাও কোনো গলদ ছিলো- তবে গলদটা ইঞ্জিনের না- ইঞ্জিনের গলদ হলে সেটা পাইলটের বুঝতে পারার কথা- পাইলট এখানে কিছুই বুঝে নি- অন্তত বিস্ফোরণের আগে পর্যন্ত-

যতটুকু বুঝতে পারছে ধোঁয়া দেখা যাওয়ার ৫ সেকেন্ডের ভেতরেই বিস্ফোরিত হয় জায়গাটা- তবে প্লেনে উঠবার সময় কারো কাছেই কোনো তরল ছিলো না- এমন কি দেশলাই কিংবা লাইটারও ছিলো না কারো কাছে- এমনিতেই প্লেনে এসব নিয়ে উঠা নিষেধ- ছোটো বেলায় আতশী কাঁচে আগুন জ্বালিয়েছে অনেকেই কিন্তু চলন্ত প্লেনে কেউ আতশী কাঁচ দিয়ে কিংবা চশমার লেন্স দিয়ে আগুন জ্বালাতে পারে এমনটা বিশ্বাসযোগ্য না- অনেকগুলো সম্ভবনা এক হলে হয়তো সে পরিমানে আলো পাওয়া সম্ভব-
আপাতত সে চিন্তা বাদ- আর কেউ যদি এমনটা করতেও চায়- সব যাত্রীর চোখ এড়িয়ে এমনটা করাও সম্ভব না-
অন্য কোথাও এমন ঘটনা ঘটেছে কি না? রহস্যময় কারণে মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়েছে কোনো বিমান? কেনিয়াতে রহস্যজনক বিস্ফোরণ ঘটেছিলো প্রেসিডেন্টকে বহন করা বিমানে -তবে পরে জানা গেছে কেনিয়ার সেনাবাহিনী এটাতে যুক্ত ছিলো- এবং ক্যুয়ের পরে সেনা প্রধান এখন কেনিয়ার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রশাসক-
আর অন্য একটা ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে-

এছাড়া ব্যাখ্যাহীন বিস্ফোরণ ঘটেছে আঙকারায়-


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম্‌ম্ চালিয়ে যান, পড়ে যাচ্ছি।

----------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

অমিত এর ছবি

ডেইলি কি ১টার বেশি দেয়ার নিয়ম নাই নাকি ? এভাবে ঝুলায় রাখলে তো ইচ্ছা করে .....

ফারুক হাসান এর ছবি

এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা- পারলে ন্যাংটা করে প্লেনে উঠায় যাত্রীকে
হাহাহা, একদম ঠিক।
অমিতের সাথে সহমত। ঝুলাঝুলি ভাল্লাগে না।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- খালি ত্যান প্যাচান মিয়া, বাকী কথা কন না ক্যা?

চট্টগ্রামের বর্ণনা দিলেন এক প্যারায় নামায়া, আর সিয়াটলের দিলেন পুরা এক পাতা। অখন এইটা নিয়া কিছু কইলেই কইবেন যে বুইলচে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

তারপরে?

রাসেল এর ছবি

এখনও উনুনে আগুন জ্বলছে- শুরু করবার আগে বুঝি নাই এইটা এত কঠিন।
যাউকগা- নিয়মিত চেষ্টা করবো এক পাতা দুই পাতা নামানোর। বাকিটা এলাহী ভরসা।
-------------------------------------------------------
বাংলায় হাগি, মুতি, বাঁচি

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।