বীভৎসতায় কিসের আনন্দ?

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি
লিখেছেন সংসারে এক সন্ন্যাসী (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/১২/২০০৭ - ৭:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রায় বছর দুয়েক আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত মফস্বলের এক পাঠিকার চিঠি আমাকে এতোটাই আলোড়িত করেছিল যে, তখন আমি ওই চিঠির একটা স্ক্রিনশট নিয়ে রাখি। এর কিছুদিন পরে ইন্টারনেটে বীভৎস একটা ছবি দেখে আমার মনে হয়েছিল, ওই চিঠির বক্তব্য আর ছবিটি পরস্পরের পরিপূরক।

সেই পাঠিকার অনুমতি ছাড়াই লেখাটি প্রকাশ করতে হচ্ছে। সাথে জুড়ে দিচ্ছি ছবিটাও।

________

বীভৎসতায় কিসের আনন্দ?

স্কুলে যাচ্ছিলাম। মেছিরপাড় মোড়ে দেখলাম একট মরা বনবিড়াল টানটান করে ঝুলিয়ে দিয়ে নিচে লেখা 'কেমন মজা'। আশপাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আর কিছু বুড়োধাড়ির দল দাঁড়িয়ে আনন্দ করছে। একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ঘেন্না লাগছিল তাই। তা ছাড়া পিটিয়ে, থেঁতলে মরা কোনো কিছু দেখলে আমার কেমন যেন একটা অনূভুতি হয়। ভ্যানে বসা অন্য লোকগুলো খুব মজা পাচ্ছিল। বলাবলি করছিল, বিড়ালটা আশপাশের মুরগি-হাঁস সাবাড় করছিল বলে এই শাস্তি। ভাবছিলাম অনেক কিছুই। মেধার কী স্বাক্ষর। যেন অন্য বিড়াল সব শিক্ষিত জীব। তাই ওদের জানান দেওয়া হয়েছে, মুরগি চুরির শাস্তি এই। 'কেমন মজা'। হাসিও পাচ্ছিল। এরকম মাঝেমধ্যেই দেখি। শিয়াল মেরে ঝুলানো। কোথাও সাপ মেরে লটকানো। ছোট কচ্ছপ আহতাবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখা, যাতে কোনো যানবাহন সেটিকে থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে। কখনো দেখি মরা ইঁদুর ফেলে রাখা। ফেরার সময় দেখি সেটা থেঁতলে ছেড়াবেড়া হয়ে গেছে। সাপ, কুঁচে মাছ, ব্যাঙ এসবও ফেলে রাখা হয়। কাঁকড়া রাস্তার মাঝখানে ফেলে রেখে একদল ছেলেমেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো যান তার ওপর দিয়ে গেলে শব্দ হয় - পটাস। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে ছেলেমেয়েগুলো। গরু মরলো তো ফেলে রাখা হলো রাস্তা বা রেললাইনের ধারে। শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া হলো কীটনাশক। মরা গরু খেতে আসা কাক-শকুন ঝাঁকে ঝাঁকে মরে পড়ে থাকলো।

এসব দেখে আর সবাই হাসে। কী আনন্দ। আমার খালি ঘেন্না লাগে। সঙ্গে ভয়। এ কেমন আনন্দের উৎস? প্রথমে পিটিয়ে কিংবা কুপিয়ে মেরে উল্লাস। তারপর সেটিকে থেঁতলে রক্ত-মাংস ছেড়াবেড়া করে আরেকবার। পরিবেশ সচেতনতার কথা বাদই দিলাম। কিন্তু এই উল্লাসের ব্যাখ্যা? এ তো বিকৃতির প্রাথমিক শিক্ষা (!)। শিশুরা দেখে শেখে। বয়ঃপ্রাপ্ত যারা এটা করছেন তাদের ভেতর কি খুব স্যাডিজম কিংবা পার্ভারসন লুকিয়ে থাকে? নাকি আদিম উল্লাস?কিন্তু আদিম সমাজে শিকার তো অপরিহার্য ছিল। তারা তো মানসিক উল্লাসের চেয়ে উদরপূর্তির প্রয়োজনে তা করতো। তাহলে এর মানে কী? কবে শুরু হয়েছে এই বিকৃতি? কোন প্রজন্মে? সূক্ষ্ম মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। কিন্তু এটুকু বুঝি, এসব সরল উল্লাস নয়। বিকৃতি। মানসিক বিকৃতি। এ থেকে অনেক কিছু হতে পারে। কে বলবে, এরশাদ শিকদারের আবির্ভাবের কারণ এটি নয়? বাপ্পীকে যারা মেরে ফেলল তারা এ বিকৃতির উল্লাস লালন করে বড় হয়নি? মানুষ হয়ে মানুষকে কেটে-ফেড়ে, থেঁতলে, টুকরো করার বিকৃতি আসে কোত্থেকে? মরা প্রাণীর রক্ত, মাংস, হাড় দেখে সয়ে যাওয়া চোখ আর মন কি শেষ পর্যন্ত বিকৃত মরা মানুষ দেখায় স্বাভাবিক হয়ে যায়? আমার খারপ লাগলে, ঘেন্না লাগলে ওদের লাগে না কেন? এটা কি আমার চিন্তার বাড়াবাড়ি? আমি জানি না। শুধু আমার সহজ-সাদা চোখ এ সব সইতে পারে না, সরল মস্তিষ্কে এর ব্যাখ্যা আঁটে না। ভয় লাগে। ভয় লাগে শিশুদের জন্য। মানুষগুলোর জন্যও। এ বিকৃতির সূচনা আর উপসংহার কী? জনসচেতনতা তৈরি করে থামানো হোক এসব।

বেণু বেগম বিজলী
সালমা সোবহান ফেলো
লালমনির হাট

কোরবানি উৎসব। আমার প্রয়াত পিতা বলতেন - পশুবধযজ্ঞ।

পুরো ছবি দেখতে ছবির ওপরে ক্লিক করুন।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা হিংস্রতাকে বিনোদন হিসেবে দেখে
এবং ক্রিয়েটিভলি হিংস্রতা করে

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম, ঘটা করে এক দিনে লক্ষ লক্ষ জীবহত্যা করার উৎসব কোরবানির মাধ্যমে আমাদের হিংস্রতাচর্চা এক ধরনের ভিত্তি আর উৎসাহ পায়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

শামীম এর ছবি

রেসলিং অনুষ্ঠানটার জনপ্রিয়তা দেখে সবসময়ই শিউরে উঠি। এটা যে কেন বন্ধ করে না ... ...

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

রেসলিং ছাড়াও হিংস্রতাজাগানিয়া আরও বিষয় আছে টিভিতে। আমাদের দেশে অতি জনপ্রিয় হিন্দি ছবিগুলোতেও কি এই জাতীয় উপাদান নেই?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

সমস্ত উঠতি ছেলেমেয়েরা এই রেসলিং দেখার জন্য পাগল।
এদের মস্তিষ্কের গঠনটা ভবিষ্যতে কেমন হবে তাই ভাবি...
আসলে আমরা সবাই কি কম বেশি স্যাডিস্ট!!!সচেতনতার চর্চাটা মনে হয় আমাদের নিজের ঘর থেকেই শুরু করা উচিত।
(কালো জাদুকর)

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

শুধু উঠতি প্রজন্মই রেসলিং-পাগল, কথাটা, বোধ করি, ঠিক নয়। এর জনপ্রিয়তা দেশে বহুদিনের।

তবে আপনার সঙ্গে "সচেতনতার চর্চাটা মনে হয় আমাদের নিজের ঘর থেকেই শুরু করা উচিত" বিষয়ে একমত।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আমি বাচচাদেরকে পড়াই
তাদের মধ্যে i will kill u, i will stab him, জাতীয় বাক্য তৈরীর প্রবণতা ভয় ধরিয়ে দেয়
সামনে আমাদের জন্য কোন নতুন সমাজ wait করছে....................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

... তাদের মধ্যে i will kill u, i will stab him, জাতীয় বাক্য তৈরীর প্রবণতা...

কী ভয়ংকর কথা! আমেরিকার স্কুলগুলোয় গোলাগুলির খবর খুব একটা বিরল নয়। আমরাও কি ধীরে-সুস্থে সেদিকে এগোচ্ছি?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

দিগন্ত এর ছবি

গত-সপ্তাহে চন্ডীগড়ে (ভারতে) একটা স্কুলের ছেলে তার সহপাঠীকে গুলি করে মেরেছে। বুঝলাম দেশ এগোচ্ছে ...
--------------------------------
আমি ততদিন নাস্তিক ছিলাম যতদিন না আমি বুঝেছি যে আমি নিজেই ঈশ্বর।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

দেশ এগোচ্ছে পেছনে। বলা চলে falling upward.

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

বজলুর রহমান এর ছবি

আমার বালকবেলাতে দেখা একটা ঘটনা আমি কখনো ভুলব না। আমাদের বাসাটি ছিল পুরনো ঢাকার দুটি গলির মোড়ে। একদিন অনেক হৈ-চৈ শুনে বারান্দাতে গিয়ে সবাই দেখলাম একটা শুকনো (খেতে পায় না মনে হলো) লোককে বাচ্চা-যুবক-বুড়ো সবাই চরম নির্দয়তার সঙ্গে পিটাচ্ছে। এমন কি তাকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে দলতেও শুরু করল। আমার বোনেরা আমাকে বললঃ তুই কিছু একটা কর। আমার পন্ডিত বিখ্যাত বাবা প্রেসারের রোগী, বিছানা নিলেন। আমি পুলিশে ফোন করলাম। কিন্তু পুলিশ এলো পরদিন। এরই মধ্যে শুনেছি লোকটা মরে গেছে। তার অপরাধ ছিল কাছের মসজিদ থেকে জুতো চুরি করা। পাড়ার লোক আমাদেরকে প্রায় এক ঘরে করে রেখেছিল বহুদিন পুলিশ ডাকার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কিছুদিন শখের বশে হলে ছিলাম। সেখানেও একবার একজনের খাবারের মাছে একটু ময়লা দেখা যাওয়াতে, একটা মোটা কাঠ দিয়ে মেস-বয়কে বেশ কিছুক্ষন পেটাল, অতি কষ্টে সমবেত দর্শকদের বিরক্তি উৎপাদন করে তাকে থামালাম। এই পেটোয়া ছাত্রটি পরে অনেক বিখ্যাত হয়েছে কর্মজীবনে, দর্শকদেরও অনেকেই।
এখনকার ছেলেমেয়েরা ভিডিও গেম থেকে নাকি ভায়লেন্স শিখছে। শুনে আমি ইস্টার্ন প্লাজা থেকে এমন একটা জনপ্রিয় সিডি আনলাম। একবার খেলতে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এটা কি করে সম্ভব যে এমনও খেলা থাকতে পারে যেখানে অকাতরে মানুষ গুলি করে, তাদের ওপরে গাড়ি চালিয়ে পিষে মেরে জিততে হয়।

আমার আর কখনই সমাজের মূল ধারাতে মেশা হলো না।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

কিছুদিন আগে সুশান্ত একটা সচিত্র পোস্ট দিয়েছিল। রুটি চুরির দায়ে এক লোককে সারাটা দিন খুঁটিতে বেঁধে রাখার কাহিনী। ছবিতে দেখা যাচ্ছিলো সেই লোকের চারপাশ ঘিরে উৎসুক জনতা উপভোগ করছিল সেই দৃশ্য।

আমরা এমন কেন?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ধর্মগ্রন্থই তো ঘৃনা ছড়ায় ।
শৈশবের শুরুতেই মাথায় ঢুকিয়ে দেয়-আমি বেহেশতের গোলাপ আর ও নরকের কীট !
----------------------------------------
পাখীটা উড়ে যেতেই চাঁদ উঠে পড়লো-
আজো সেই রক্তমাখা মুন্ডুটাই উঠলো ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

ধর্মগ্রন্থই তো ঘৃনা ছড়ায়

স্কুলের ইসলামিয়াত বই থেকে (অথবা শিক্ষকের কাছ থেকে, ঠিক মনে পড়ছে না) যখন জানলাম, মুসলমান মারা গেলে বলতে হয় ইন্না লিল্লাহে ... , আর ভিন্নধর্মী কারোর মৃত্যুতে পড়তে হয় এক ধরনের অভিশাপবাণী (মনে নেই), আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গিয়েছিলাম ইসলামের 'শান্তিপ্রিয়তায়'!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

মানুষ নিজেদের যতই সভ্য, উন্নত দাবি করুক না কেন, এরাই কি অবলীলায় যে হিংস্রতার পরিচয় দিয়ে যায় অনবরত, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। দিন দিন আমরা নিজেরাই খুঁড়ছি নিজেদের কবর, আর আত্মতৃপ্তিতে ভুগে পা বাড়িয়ে চলেছি সেই পথে!

বেণু বেগম বিজলীকে ধন্যবাদ জানাই এমন দারুন একটা চিঠির জন্য। আপনাকেও, পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

.... যখন জানলাম, মুসলমান মারা গেলে বলতে হয় ইন্না লিল্লাহে ... , আর ভিন্নধর্মী কারোর মৃত্যুতে পড়তে হয় এক ধরনের অভিশাপবাণী (মনে নেই), ....

এমনটা আমারও মনে পড়ে না স্কুলে পড়েছিলাম কি না! কখনো কখনো নিজের গোল্ডফিশ মেমোরীটাকে বড়ই প্রিয় মনে হয়!
_______________
বোকা মানুষ মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।